সফর ১৪৪০   ||   নভেম্বর ২০১৮

তালিবুল ইলমদের প্রতি  শায়েখ মুহাম্মাদ আওয়ামার নসীহত

মাওলানা মুহিউদ্দিন ফারুকী

[শায়েখ মুহাম্মাদ আওয়ামার -হাফিযাহুল্লাহু তাআলা ওয়া রাআহু- খাছ মজলিসের এই নসীহতগুলো দুই-তিন বছর আগেই ভাই মাওলানা মুহিউদ্দিন ফারুকী -হাফিযাহুল মাওলাল কারীম- প্রস্তুত করে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু আমার বেখিয়ালির কারণে তা এখনো ছাপা হয়নি। এখন তিনি আবার তা আমার সামনে পেশ করলেন। শায়েখের নসীহতগুলো অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু শায়েখ হয়ত শোনেননি যে, এখন উলূমুল হাদীস বিভাগ এ দেশের অনেক মাদারাসায়ই আছে।

সমস্যাটা কিন্তু বিভাগ থাকলেই হল্ হবে না। আসল তো রিজালসাযি-এর ওসায়েল মওজুদ থাকা এবং মজবুত ইশরাফ ও বাস্তব রাহবারির ইতমিনানবখ্শ ব্যবস্থা থাকা। অপরদিকে মুতাদাররিবীন যী-ইসতি‘দাদ, মেহনতী এবং মোটামুটি ফিতরী যওক রাখে- এমন হওয়া। وأين هذه الشروط الآن؟

আরবী কিতাব আরবী ভাষায় পাঠদানের যে কথা শায়েখ বলেছেন, সেটা উস্তাযে মুহতারাম হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ তাকী উসমানী হাফিযাহুল্লাহ-এর ওখানে দেখেছি। মেখলের হযরত মুফতী ছাহেব রাহ.-এর ব্যাপারেও শুনেছি, হযরত রাহ. যে কিতাব যে ভাষার সেই ভাষায় তার দরস দিতেন। আমাদের দেশে মাদরাসাতুল মদীনাতেও আরবী তাদরীসের নেযাম আছে। আল্লাহ তাআলা এ সিলসিলাকে মুফীদ এবং নাফে বানান। শায়েখের হেদায়েতের উপর আমলের পূর্বে মূলত তার মাহাওল প্রস্তুত করা জরুরি।

এটা আসলে দুঃখজনক যে, এখন কিতাব-ফাহমীর বিষয়টি খুবই অবহেলিত। বড় কারণ, আরাবিয়্যাতের দুর্বলতা। আরেক কারণ, আকলে সালীম ও ফিতরী যওক-এর অভাব। আরেক কারণ, ফন এবং কিতাবের উসলূবের সাথে মুনাসাবাত ও উনসের অভাব। আল্লাহ তাআলা আমাদের এইসবের তাদারুক করার তাওফীক দান করুন। শায়েখের এই মূল্যবান নসীহতগুলোর কদর করার তাওফীক দিন। -আবদুল মালেক]

শায়েখ মুহাম্মাদ আওয়ামা হাফিযাহুল্লাহ। বাংলাদেশের উলামা-তলাবা সকলের নিকটই একটি প্রিয় নাম, প্রিয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর ইলমী ও তাহকীকি বৈশিষ্ট্য তাঁকে সকলের হৃদয়ে স্থান করে দিয়েছে। বিশেষত হাদীসশাস্ত্রীয় কোনো বিষয়ে আলোচনা হলে তাঁর নাম বিশেষভাবে উচ্চারিত হয়। এছাড়া তিনি তাহকীকের মাজালে বিরাট ভূমিকা রেখেছেন। তাঁর প্রতিটি কিতাবের ভূমিকা বা পর্যালোচনা থেকে আলিম-তালিবুল ইলম বিশেষ রাহনুমায়ী লাভ করে।

দেশের উলামা-তলাবা সবাই তাঁকে একটু দেখার জন্য ব্যাকুল থাকেন। তিনি যেহেতু মদীনা মুনাওয়ারায় ছিলেন তাই যিয়ারতে মদীনার সৌভাগ্য যাদের হত, তারা তাঁর সাথে মুলাকাত করতে উদগ্রীব হয়ে থাকতেন। তাঁর ছোহবত পেয়ে ধন্য হতে চাইতেন।

১৪২৮ হিজরী হজে¦র মৌসুমে উস্তাযে মুহতারাম মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক হাফিযাহুল্লাহ আমাকে শায়েখ মুহাম্মাদ আওয়ামা হাফিযাহুল্লাহর খেদমতে নিয়ে যান। তাঁর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। তাঁর সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে বলেন এবং তাঁর কাছ থেকে ইলমী ইস্তেফাদা করতে বলেন। সেদিন থেকে প্রায় নয় বছর বিভিন্ন সময়ে শায়েখের বাসায় যাচ্ছি। সুযোগমত খেদমত করার চেষ্টা করছি। উলূমুল হাদীস ও আকীদাসহ বিভিন্ন বিষয়ের কয়েকটি কিতাব শায়েখের কাছে নিয়মিত পড়েছি। শায়েখের যেহেতু নির্দিষ্ট কোনো দরস ছিল না তাই তাঁর সাথে বিশেষ সাক্ষাতের জন্য অধীর আগ্রহী হয়ে থাকতাম। কোনো সুযোগ পেলেই সে মজলিস থেকে ফাওয়ায়েদ ও আদাব নোট করতাম।

এসমস্ত মজলিসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, হজ¦ ও উমরাহ করতে আসা আলেমগণকে শায়েখের সাথে মুলাকাত করতে নিয়ে যাওয়া এবং বিভিন্ন বিষয়ে কিছু নসীহত ও আলোচনা শোনা। তবে কাউকে শায়েখের বাসায় নিয়ে যাওয়া উসতাযে মুহতারামের অনুমতি এবং দিকনির্দেশনা মোতাবেকই হত এবং দিকনির্দেশনা অনুযায়ী নিয়ে যাওয়াকে আমি আদব এবং কৃতজ্ঞতা আদায়ের অংশ মনে করতাম।

১৭-০৪-১৪৩৬ হিজরী রোজ সোমবার উসতাযে মুহতারামের নির্দেশে দেশের প্রসিদ্ধ একজন আলেমকে নিয়ে শায়েখের খেদমতে হাজির হই। শায়েখ তাঁর সাথে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করেন। আমি প্রতিটি মজলিসেই শুরু থেকে চেষ্টা করি শায়েখের প্রতিটি কথা এবং আলোচনা লিখে রাখতে। তাসজিল বা রেকর্ড আমি কখনোই করি না এবং শায়েখ নিজেও তা পছন্দ করেন না। এক্ষেত্রে একটি বিষয় বলে রাখা ভালো যে, আমরা তালিবুল ইলমরা যখন কোনো শায়েখের সাথে লেকা’ বা সাক্ষাতে যাই তখন অবশ্যই নসীহত বা বাণীগুলো নোট করার চেষ্টা করব। তাঁর অনুমতি ব্যতীত কোনো কথা তাসজিল বা রেকর্ড করব না। তবে আম মজলিস হলে ভিন্ন কথা।

যাহোক, সেদিন অনেক বিষয়ে শায়েখ আলোচনা করেছেন। একপর্যায়ে শায়েখ তিনটি বিষয় খুব গুরুত্বের সাথে বললেন। আমাকে ডেকে বললেন, ‘মুহিউদ্দীন! আমার এই আহ্বানগুলো, এই আবেদনগুলো লিখে রাখো এবং তা তোমার দেশের উলামা-তলাবাদের নিকট পৌঁছে দিও।’

শায়েখ সেদিন যে নসীহতগুলো করেছিলেন তা হল :

 

এক.

দ্বীনী মাদারেসের সকল আসাতেযা ও তালিবুল ইলমের আরবী ভাষার ব্যাপারে গুরুত্বশীল হতে হবে। গুরুত্বের সাথে আরবী ভাষা শিখতে হবে। আরবী বিষয়গুলো আরবীতেই পাঠদান করতে হবে। শায়েখ কিছু কিতাব ও উচ্চ মারহালার ছাত্রদের পাঠদানের পদ্ধতি জানতে চাইলেন। যখন বলা হল যে, তা বাংলায় পড়ানো হয়। তখন শায়েখ হাফিযাহুল্লাহ বললেন, كيف يصح هذا؟ ‘এটা হয় কীভাবে?’ এরপর তিনি বললেন, ‘আমি সবসময় হিন্দুস্তান এবং বাংলাদেশের আলেমদের বলি, যেন উচ্চ মারহালার আরবী বিষয়গুলো আরবীতেই পড়ানো হয়। তাদরীস যেন আরবীতে হয়। খুব বেশি করে যেন আরবী পরিভাষা ব্যবহার করা হয়। কেননা মূল ইলম হচ্ছে আরবী; কুরআন আরবী, হাদীস আরবী; ইংরেজি, বাংলা বা উর্দূতে নয়। আমি এই ভাষাগুলোকে ছোট করে দেখছি না। নিজ নিজ ভাষায় আলেমদের অবশ্যই যোগ্যতা অর্জন করতে হবে, দক্ষ হতে হবে। তবে কুরআন-হাদীসের ভাষা, মাছাদের মারাজে‘ বা মূল তথ্যসূত্রের ভাষা যেহেতু আরবী, তাই আরবী ভাষাটা ভালোভাবে শিখতে হবে। এই ভাষায় যেন ভাবটা প্রকাশ করা যায়, আরবী কেউ বললে তা সহজে বুঝা যায় এবং দরস প্রদানের ক্ষেত্রে বিষয়বস্তুটি আরবীতে প্রকাশ করা যায়- কমসেকম এতটুকু যোগ্যতা অর্জন করতে হবে।

তিনি উচ্চস্তরে কী কী কিতাব রয়েছে তা শুনতে চান। এরপর যখন জানতে পারেন- এগুলোর বাংলা অনুবাদ রয়েছে, তখন তিনি বলেন, هذا خطأ كبير এটা বিরাট ভুল। এর মাধ্যমে এসকল কিতাব পড়ানো বা মানহাজে রাখার মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়। এর মাধ্যমে এসকল কিতাবের বাহজাত ও রওনক চলে যায়। এর আবেদন হারিয়ে যায়। তাই এজাতীয় কিতাবের অনুবাদ না হওয়াই উত্তম।

শায়েখ বলেন-

خدمات علماء الهند وبنغلاديش على الرأس والعين، وخدماتهم كثيرة، ولكن نحن محرومون عن الاستفادة.

বাংলাদেশ ও ভারতের উলামায়ে কেরামের ইলমী খেদমতের কথা স্বীকার করি এবং তাদের খেদমতও অনেক, কিন্তু আমরা তা থেকে উপকৃত হতে পারছি না; আমরা মাহরূম হচ্ছি। এর একটি কারণ, আরবী ভাষায় দুর্বলতা এবং আরবীতে তাসনীফ-তালীফের অপ্রতুলতা। তাই আমি উলামা-তলাবা সকলকে এ ভাষা ভালোভাবে শিখতে অনুরোধ করছি। আরবী কিতাবগুলো যথাসম্ভব আরবীতেই পাঠদানের আহ্বান জানাচ্ছি। আরবী ভাষায় বলা ও লেখায় পারদর্শী কিছু আলেম তৈরি হোক- সেই প্রত্যাশা করছি।

 

দুই.

আমি যতুটুকু জেনেছি, বাংলাদেশে মাদারেসে দ্বীনিয়াতে অনেক হাদীসের কিতাব পড়ানো হয়। তাই নয় কি? আমরা উত্তরে বললাম, জ্বী, অবশ্যই। তিনি সাথে সাথেই প্রশ্ন করলেন-

كم حديثا يحفظ الطلاب من هذه الكتب؟

তালিবুল ইলমরা এসব কিতাব থেকে কয়টি হাদীস মুখস্থ করে? এটা ঠিক নয়। তালিবুল ইলম এসব হাদীসের কিতাব পড়বে অথচ একটি হাদীসও হিফয করবে না- এটা বড় দুঃখজনক। তিনি বলেন, হিফযুল হাদীস ওয়ালআছার খুবই জরুরি। উলামায়ে কেরামের উচিত প্রাথমিক পর্যায়ে ছাত্রদেরالأربعون النووية কিতাবটি হিফয করানো। এরপর রিয়াদুস সালেহীন মুখস্থ করাবে। তিনি বলেন, একজন তালিবুল ইলমকে অন্ততপক্ষে রিয়াদুস সালেহীন মুখস্থ করা উচিত। এরপর যারা বেশি মেধার অধিকারী তাদেরকে সহীহ বুখারী,  সহীহ মুসলিম এবং কুতুবুস সিহাহ হিফয করতে দেয়া উচিত। উলামায়ে কেরাম যেন এ ব্যাপারে উদ্যোগী হন। প্রত্যেক মাদরাসায় যেন কয়েকজন উস্তায দায়িত্ব নিয়ে এ খেদমতের তদারকি করেন এবং তালিবুল ইলমদেরকে হিফযুল হাদীসের জন্য উৎসাহ প্রদান করেন। গুরুত্বের সাথে হিফযুল হাদীসের বিষয়টি বাস্তবায়নের জন্য আমি উলামা-তলাবাদের আহ্বান জানাচ্ছি।

 

তিন.

বাংলাদেশে আমি যতুটুকু জেনেছি যে প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে এবং প্রত্যেক মাদরাসায় কিসমুল ফিকহ বা কিসমুল ফাতাওয়া খোলা হয়। মুফতী হওয়া নয়, বরং ফিকহের সাথে প্রাথমিক একটা সম্পর্ক তৈরি হওয়ার জন্য এ ধরনের মেহনত ভালো। তবে মুফতী হতে হলে দীর্ঘ মুমারাসা এবং ছোহবতের প্রয়োজন। দীর্ঘ অভিজ্ঞতার প্রয়োজন। যাহোক, আমি সেটা বলতে চাচ্ছি না; আমি বলতে চাচ্ছি যে, ফিকহ পড়ার জন্যও হাদীসের বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান থাকা আবশ্যক। উলূমুল হাদীসের বিষয়গুলোর ব্যাপারে ধারণা থাকা অপরিহার্য।

দাওরায়ে হাদীসের সমস্ত কিতাবগুলো পড়ানো হয় ফিকহী তরযে।

শায়েখ বলেন, ফিকহ পড়ার জন্য প্রায় সব প্রতিষ্ঠানেই ‘কিসমুল ফিকহ’ রয়েছে। তাই এখন কিসমুল ফিকহ আর না খুলে বরং ‘কিসমু উলূমিল হাদীস’ বা قسم التخصص بعلم السنة رواية খোলা প্রয়োজন। বর্তমান সময়ে যে অবস্থা চলছে, সহীহ-যঈফ বলে বলে মানুষকে যেভাবে বিভক্ত করা হচ্ছে, এমতাবস্থায় উলূমুল হাদীস বিষয়ে জ্ঞান থাকা প্রতিটি তালিবুল ইলমের জন্য অত্যন্ত অপরিহার্য বিষয়। রাবির অবস্থা, বিবরণ, হাদীসের মান, হাদীসের কিতাব বিষয়ে সার্বিক ধারণা প্রত্যেকেরই থাকতে হবে।

সবশেষে আমি আবার বলছি, উলামায়ে কেরামসহ সকল তালিবুল ইলমকে দ্বীনের গভীরতা অর্জনে আরবী ভাষা শিখতে হবে। এ ভাষায় পারদর্শী হতে হবে। হিফযুল হাদীসের ব্যাপারে যত্নবান হতে হবে। এবং কিসমু উলূমিল হাদীস বা ‘আততাখাসসুস ফী উলূমিল হাদীস’ বিভাগ খুলতে হবে। এসব বিষয়ে সকল উলামা-তলাবা সচেষ্ট হবে- আমি সেই প্রত্যাশাই করছি। 

 

 

advertisement