মুহাররম ১৪৪০   ||   অক্টোবর ২০১৮

সুপারিশ : সেবার এক উন্মুক্ত দুয়ার

মাওলানা শিব্বীর আহমদ

কত রকম বৈচিত্র্যের ছড়াছড়ি এ জগতে! এখানে ভালো মানুষ আছে, মন্দ মানুষও আছে। গরীব ও অসহায় মানুষ আছে, আছে ধনী ও বিত্তবান মানুষ। মালিক আছে, শ্রমিক আছে, আছে কর্তৃপক্ষ-কর্মচারী। কেউ শিক্ষিত, কেউ অশিক্ষিত। কেউ নরম, কেউ গরম। এভাবে নানা রকমের নানা পেশার নানা শ্রেণির মানুষের সাক্ষাৎ আমরা প্রতিনিয়তই পাই। সমাজবদ্ধ এ জীবনে মানুষের শ্রেণি-পেশা ও অবস্থার বৈচিত্র্য অপরিহার্য। জগতের এক স্বাভাবিক নিয়ম হিসেবেই কর্মচারী ও শ্রমিক বারবার মালিকের দুয়ারে ফিরে যায়। তাদের জীবনের অবলম্বন খুঁজে বেড়ায়। জীবনের কোনো এক অনাকাক্সিক্ষত ঝাপটায় নিরুপায় হয়ে অসহায় মানুষ গিয়ে হাত পাতে ধনীর দুয়ারে। চাকরির সন্ধানে বেকার যুবককে ঘুরতে হয় কর্তৃপক্ষের দ্বারে দ্বারে। ব্যক্তিগত কিংবা সামাজিক বিভিন্ন প্রয়োজনে ছুটোছুটি করতে হয় নানান অফিসে। এই যে একে অন্যের কাছে ঘুরে বেড়ানো, এটা যেমন একটা স্বাভাবিক বাস্তবতা, তেমনি একজন আরেকজনের কাছে গিয়ে কখনো আইনি কারণে, কখনোবা অনৈতিক কোনো কারণে, আবার কখনো আস্থা ও বিশ্বাসের কিছুটা সংকটের কারণে মানুষ আটকে যায়, এটাও এক অনস্বীকার্য বিষয়। তখনই প্রয়োজন হয় সুপারিশ। জাগতিক প্রয়োজনে এ সুপারিশ আমাদের জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ।

সুপারিশ যেমনই হোক, যার জন্যে সুপারিশ করা হয় সে তো প্রয়োজনের তাগিদে কিংবা অসহায়ত্বের মুখে পড়েই অন্যের দ্বারস্থ হয়ে থাকে। প্রয়োজনের মুহূর্তে তাই একটু সুপারিশ অনেক বড় এক সেবা। মানুষের এই সমাজে একজনের প্রয়োজনে আরেকজন সঙ্গে থাকবে, একজনের অসহায়ত্বের সময় আরেকজন পাশে এসে দাঁড়াবে-এটা যেমন মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের পরিচায়ক, এর পাশাপাশি হাদীস শরীফে ঘোষিত হয়েছে এর এক মহা প্রতিদানের কথা। হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ لاَ يَظْلِمُهُ، وَلاَ يُسْلِمُهُ، وَمَنْ كَانَ فِي حَاجَةِ أَخِيهِ كَانَ اللهُ فِي حَاجَتِهِ، وَمَنْ فَرّجَ عَنْ مُسْلِمٍ كُرْبَةً فَرّجَ اللهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرُبَاتِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ.

মুসলমান মুসলমানের ভাই। সে তার ওপর জুলুম করতে পারে না, তাকে অপমানিত করতে এবং শত্রæর হাতে তুলে দিতে পারে না। আর যে তার ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করে, আল্লাহ তার প্রয়োজন পূরণ করে দেন। যে (দুনিয়াতে) কোনো মুসলমানের একটি বিপদ ও দুশ্চিন্তা দূর করে দেয় আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার বিপদ ও দুশ্চিন্তা দূর করে দেবেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৪৪২; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৮০

হাদীসে উল্লেখিত এই যে এক ভাই আরেক ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করে দেয়া, এক মুসলমান আরেক মুসলমানের দুশ্চিন্তা দূর করে দেয়া, এগুলো যেমন কেউ নিজেও করতে পারে, আবার নিজে না পারলে অন্যকে সুপারিশ করে করিয়েও দিতে পারে। এ দুটি কাজের যে প্রতিদানের কথা এখানে ঘোষিত হয়েছে, তা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। আল্লাহ যদি কারও প্রয়োজন পূরণ করে দেয়ার ওয়াদা করেন, তাহলে তার আর চিন্তা কীসের! দুনিয়ার জীবনের নানামুখী সংকট মোকাবেলায় এর চেয়ে প্রশান্তিদায়ক অঙ্গীকার আর কোথায় কার কাছে পাওয়া যাবে?

দ্বিতীয়ত, দুনিয়াতে কেউ কারও একটি দুশ্চিন্তা দূর করে দিলে বা বিপদ থেকে উদ্ধার করলে পরকালে আল্লাহ তার একটি দুশ্চিন্তা ও বিপদ দূর করে দেবেন। পরকালের যে কঠিন ও সংকটময় পরিস্থিতির কথা আমরা পড়ি ও শুনি, সেসময় আল্লাহ যদি কোনো দুশ্চিন্তা সরিয়ে দেয়ার কথা দেন, এর চেয়ে বড় প্রতিদান আর কী হতে পারে?

নিজে সরাসরি সহযোগিতা করে যেমন এ পুণ্য হাসিল করা যেতে পারে, তেমনি নিজের সামর্থ্য না থাকলেও অন্য কারও কাছে একটু সুপারিশ করে সহযোগিতা করার সুযোগ যার আছে, সেও তার আমলনামাকে সমৃদ্ধ করতে পারে এর মধ্য দিয়ে। এ সুপারিশ সহযোগিতা, পারস্পরিক কল্যাণকামনা আর একে অন্যের বিপদে পাশে দাঁড়ানোর এক মাধ্যম। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও সুপারিশ তাই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

সুপারিশের কথা বর্ণিত হয়েছে পবিত্র কুরআনেও। পড়–ন-

مَنْ یَّشْفَعْ شَفَاعَةً حَسَنَةً یَّكُنْ لَّهٗ نَصِیْبٌ مِّنْهَا،  وَ مَنْ یَّشْفَعْ شَفَاعَةً سَیِّئَةً یَّكُنْ لَّهٗ كِفْلٌ مِّنْهَا،  وَ كَانَ اللهُ عَلٰی كُلِّ شَیْءٍ مُّقِیْتًا.

যদি কেউ কোনো ভালো (কাজের) সুপারিশ করে তাহলে তাতে তার অংশ থাকবে, আর কেউ কোনো মন্দ (কাজের) সুপারিশ করলে তাতে তার অংশ থাকবে; আর আল্লাহ সর্ব বিষয়ে নযর রাখেন। -সূরা নিসা (৪) : ৮৫

আয়াতের মর্ম স্পষ্ট-কেউ যদি কাউকে সুপারিশ করে কোনো একটি কাজ করিয়ে দেয়, তাহলে এর প্রতিদান সে পাবেই। সুপারিশকৃত কাজটি যদি ভালো হয় প্রতিদানও ভালো হবে। কাজটি মন্দ হলে প্রতিদানও হবে মন্দ। অসহায় গরীব কাউকে দান করলে দানকারী যেমন সওয়াব পায়, সে যদি কারও সুপারিশে দান করে থাকে তাহলে সুপারিশকারীও এ দানের কারণে সওয়াবের অংশীদার হবে। হাদীসের ভাষ্য-

إِنّ الدّالّ عَلَى الخَيْرِ كَفَاعِلِه.

নিশ্চয়ই কল্যাণ ও পুণ্যের পথ যে দেখিয়ে দেয় সেও পুণ্যকারীর মতোই সওয়াব পাবে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৬৭০

আর সুপারিশের মধ্য দিয়ে একে অন্যকে এ কল্যাণের পথই দেখিয়ে থাকে। মন্দ কাজের বিষয়টিও অনুরূপ। সেখানে যে কোনোরূপ সহযোগিতা যেমন গোনাহের কাজ, তেমনি সহযোগিতা যদি কারও সুপারিশের কারণে হয় তাহলে এ সুপারিশও গোনাহের কাজ। আয়াতের এ মর্ম আমাদেরকে সুপারিশের ক্ষেত্র অনেকটাই স্পষ্ট করে দেয়। অর্থাৎ সুপারিশ করতে হবে কেবলই ভালো কাজে, কল্যাণকর কাজে। মন্দ ও গোনাহের কোনো কাজে কারও পক্ষে সুপারিশ করা যাবে না।

সূরা নিসার উপরোক্ত আয়াত থেকে এ কথাও জানা যায়, সুপারিশ যেমনই হোক, ভালো-মন্দ যাই হোক, সুপারিশকারী এর প্রতিদান পাবেই। এক্ষেত্রে সুপারিশ গৃহীত হল কিনা-তা বিবেচ্য বিষয় নয়। কেউ যদি ভালো কোনো কাজের সুপারিশ করে তাহলে সুপারিশ গৃহীত না হলেও সে সওয়াব থেকে বঞ্চিত হবে না। আবার কেউ যদি কোনো পাপ কাজের জন্যে সুপারিশ করে আর তার সুপারিশ গৃহীত না হয়, তবুও তাকে বইতে হবে গোনাহের ভার।

সহীহ বুখারীর একটি হাদীস, হযরত আবু মূসা রা. বর্ণনা করেন-

كَانَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم إِذَا جَاءَهُ السّائِلُ، أَوْ طُلِبَتْ إِلَيْهِ حَاجَةٌ قَالَ اشْفَعُوا تُؤْجَرُوا وَيَقْضِي اللهُ عَلَى لِسَانِ نَبِيِّهِ صلى الله عليه وسلم مَا شَاءَ.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে যখন কোনো সাহায্যপ্রার্থী আসত, কিংবা তাঁর কাছে কোনো প্রয়োজনের কথা বলা হতো, তিনি তখন (উপস্থিত সাহাবীদের) বলতেন, তোমরা (তার পক্ষে) সুপারিশ কর, তাহলে তোমরা পুরস্কৃত হবে। আর আল্লাহ যা চান, তাঁর নবীর জবানে সেই ফয়সালাই করাবেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৪৩২

এ হাদীসটিতে উপরোক্ত বিষয়টি আরও সুস্পষ্টরূপে দৃশ্যমান। রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এখানে বলছেন, অভাবী অসহায় কেউ যখন আসে তোমরা তার পক্ষে সুপারিশ করো। সুপারিশ করলেই যে সেটা গৃহীত হবে এমন নয়। কিন্তু তোমাদের সুপারিশ গৃহীত হোক আর নাই হোক, তোমরা কোনো অবস্থাতেই এর সওয়াব ও প্রতিদান থেকে বঞ্চিত হবে না।

এ হাদীসের আরেকটি শিক্ষা-সুপারিশ করলেই যে তা গ্রহণ করতে হবে এমন নয়। সুপারিশ তো একটি পরামর্শ মাত্র, একটি অনুরোধ। সুপারিশকারী ভালো মনে করলে সুপারিশ করবেন, আর যার কাছে সুপারিশ করা হল তিনি ভালো মনে করলে সে সুপারিশ গ্রহণ করবেন। কথা এতটুকুই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের সুপারিশ তোমরা কর, আর আল্লাহ তাআলা যেটা চান, তিনি তাঁর নবীকে দিয়ে সেটাই ফয়সালা করাবেন। অনিচ্ছা সত্তে¡ও সুপারিশ যদি গ্রহণ করতেই হয়, সেটা সুপারিশকারীর ভয়েই হোক কিংবা তার ক্ষমতা ও দাপটের কারণেই হোক, তখন তা আর সুপারিশ থাকে না। এটাকে হয়তো ‘আদেশ’ বলতে হবে, কিংবা বলতে হবে ‘অন্যায় হস্তক্ষেপ’। এটা সুপারিশ নয়। সুপারিশকারীকে এমন উদার মানসিকতা নিয়েই সুপারিশ করতে হবে-আমার কথা তিনি রাখতেও পারেন, নাও রাখতে পারেন। সুপারিশ যদি গৃহীত না হয় তাহলে এ নিয়ে তার রুষ্ট হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র জীবনে ঘটে যাওয়া একটি সুপারিশের ঘটনা লক্ষ করুন-তিনি কতটা উদার মনে সুপারিশ করতেন।

দুই সাহাবী-হযরত মুগীছ রা. এবং হযরত বারীরা রা.। সম্পর্কে স্বামী-স্ত্রী ছিলেন। বিয়ের সময় হযরত বারীরা ছিলেন আরেকজনের দাসী। হযরত বারীরা রা.-এর মনিব হয়তো তার অমতেই তাকে বিয়ে দিয়েছিলেন হযরত মুগীছ রা.-এর কাছে। বারীরা ছিলেন অত্যন্ত রূপসী। কিন্তু তার স্বামী মুগীছ রা.-এর গঠন-আকৃতি সুন্দর ছিল না। এরপরের কথা। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রা. এই দাসীকে কিনে আজাদ করে দিলেন। হযরত বারীরা যখন স্বাধীন হয়ে গেলেন, তখন ইসলামী শরীয়তের বিধানানুসারে তার বিয়েটি টিকিয়ে রাখার কিংবা ভেঙ্গে দেয়ার এখতিয়ার লাভ করলেন। এই এখতিয়ারের ভিত্তিতে তিনি তাদের বৈবাহিক সম্পর্ক ভেঙ্গে দেন। হযরত মুগীছ রা. অনেক অনুনয়-কান্নাকাটি করেও বারীরার মন গলাতে পারেননি। অবশেষে হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন : আপনি আমার জন্যে সুপারিশ করুন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত বারীরা রা-কে তার সিদ্ধান্তটি প্রত্যাহার করতে সুপারিশ করলেন-

لو راجعتيه فإنه أبو ولدك

তুমি যদি তাকে আবার গ্রহণ করে নিতে! সে যে তোমার সন্তানের বাবা!

সদ্য মুক্তি পাওয়া এই নারী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রত্যুত্তরে যা বলেছিলেন তাতেই তিনি ইতিহাস হয়ে থাকতে পারেন। তিনি বলেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি আমাকে এর আদেশ করছেন? (আপনার আদেশ যদি হয় তাহলে আমার জন্যে তা শিরোধার্য। আমার মতের সঙ্গে তা মিলুক আর নাই মিলুক, আমি আপনার আদেশই মেনে নেব। কিন্তু যদি আদেশ না হয় তাহলে ভিন্ন কথা।) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,  إنما أنا شفيع

আমি কেবলই একজন সুপারিশকারী। (অর্থাৎ এটা তোমার প্রতি আমার আদেশ নয়, পরামর্শ ও অনুরোধ)

তখন হযরত বারীরা রা. বললেন, তাই যদি হয়, তাহলে তার কাছে আমার কোনো প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ তাকে আবার গ্রহণ করে নেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২২৩৩; সুনানে নাসাঈ, হাদীস ৫৪১৭

হযরত বারীরা রা. এখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুপারিশ গ্রহণ করলেন না। এটা ছিল তার অধিকার ও স্বাধীনতা। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাই তার ওপর বিষয়টি চাপিয়ে দেননি। তবে এ সুপারিশ প্রত্যাখ্যাত হওয়ার কারণে তিনি কি অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন? রুষ্ট হয়েছিলেন? ইতিহাস আমাদের ভিন্ন কথা বলে।

তিনি একবার গিয়েছিলেন হযরত বারীরা রা.-এর ঘরে। গিয়ে দেখলেন- ডেগচিতে মাংস রান্না করা হচ্ছে। এরপর হযরত বারীরা রা. নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রুটি এবং ঘরে থাকা অন্য একটি তরকারি দিয়ে আপ্যায়ন করলেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন : কী ব্যাপার! ডেগচিতে দেখলাম মাংস রান্না করা হচ্ছে! (অথচ তুমি আমাকে মাংস না দিয়ে এসব দিয়ে মেহমানদারি করছ!) তিনি জানালেন, এটা সদকার মাংস আর আপনি তো সদকার কোনো খাবার গ্রহণ করেন না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এটা তোমার জন্যে সদকা, কিন্তু (তুমি যখন আমাদেরকে খাওয়াবে তখন) আমাদের জন্যে তা হাদিয়া! -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫২৭৯

এমন উদার মন নিয়ে সুপারিশ করাই আমাদের জন্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা। উপযুক্ত স্থানে, সামর্থ্য থাকলে সুপারিশ করতে হবে। কিন্তু এমনটা ভাবা যাবে না-আমার সুপারিশ গ্রহণ না করা আমাকে অপমান করার নামান্তর।

অবশ্য সুপারিশ গ্রহণ করতে যদি কোনো সংকট না থাকে, তাহলে যথাসম্ভব সুপারিশকারীর কথা গ্রহণ করা উচিত। কারণ সুপারিশ সাধারণত কোনো সম্পর্কের ভিত্তিতেই করা হয়। এই সম্পর্কের কারণে সুপারিশকারী আশায় থাকে-আমার সুপারিশ হয়তো সে গ্রহণ করবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

أَنْزِلُوا النّاسَ مَنَازِلَهُمْ.

মানুষদেরকে তাদের উপযুক্ত মর্যাদা দাও। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৮৪৪

তাই একই বিষয়ের সুপারিশ যদি আগে-পরে দুই সময়ে দুইজন করে, আর প্রথম সুপারিশকারীর তুলনায় দ্বিতীয় সুপারিশকারীর সঙ্গে সম্পর্ক অধিক ঘনিষ্ঠ হয়, কিংবা দ্বিতীয়জন অধিক সম্মানিত-সম্ভ্রান্ত কেউ হন, তাহলে প্রথমজনের সুপারিশ অগ্রাহ্য করার পরও দ্বিতীয়জনের সুপারিশ গ্রহণ করা যেতে পারে। সবার সঙ্গে একই আচরণ করতে হবে, একজনের সুপারিশ অগ্রাহ্য করার কারণে সবারটাই অগ্রাহ্য করতে হবে-এটা জরুরি নয়।

সুপারিশ যখন করা হবে, তখন যার কাছে সুপারিশ করা হচ্ছে তার বিষয়টিও যতেœর সঙ্গে লক্ষ রাখতে হবে। সুপারিশ একটি পরামর্শ আর পরামর্শ প্রদান একটি আমানত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

الْمُسْتَشَارُ مُؤْتَمَنٌ.

যার কাছে পরামর্শ চাওয়া হয় সে তো আমানতদার। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৮২৩

আর আমানতদারির দাবি হচ্ছে, তার কাছে সুচিন্তিতভাবে যেটা ভালো মনে হবে সে সেভাবেই পরামর্শ দেবে। পরামর্শ দেয়ার সময় কল্যাণকামিতার বিষয়টি বিবেচনায় রাখা অপরিহার্য। কল্যাণকামী মানসিকতা ছাড়া সঠিক পরামর্শ দেয়া সম্ভব নয়। তাই কোনো অসহায় বা বিপদগ্রস্ত ব্যক্তির জন্যেও যদি কারও কাছে সুপারিশ করতে হয়, সেখানেও লক্ষ রাখতে হবে-এ সুপারিশ রক্ষা করতে গিয়ে সে আবার বিপদে পড়ে কি না; তার কোনো নিয়ম লঙ্ঘন করতে হয় কি না; তার নীতি ও নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে কি না; তাকে পরবর্তীতে প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে কি না; তার সম্মান-মর্যাদা ও চারিত্রিক শুদ্ধতা আক্রান্ত হয় কি না; আমার সুপারিশের মর্যাদা দিতে গিয়ে তাকে অনাকাক্সিক্ষত কোনো পরিস্থিতির শিকার হতে হয় কি না; তার ধনসম্পদ কিংবা দ্বীন-ধর্ম এতে আবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায় কি না। তাই চাকরি বা এজাতীয় কোনো সুপারিশের ক্ষেত্রে প্রথমেই ভেবে নিতে হবে-যার জন্যে সুপারিশ করা হচ্ছে সে এ পদের উপযুক্ত কি না; এ পদে সে নিযুক্ত হলে মালিকের কিংবা জনগণের জানমালের কোনো ক্ষতির আশঙ্কা আছে কি না। কারও জন্যে আর্থিক সহযোগিতার সুপারিশ করতে হলেও যথাসম্ভব জেনে নিতে হবে-বাস্তবেই সে অভাবগ্রস্ত কি না; এমন সহযোগিতা পাওয়ার সে উপযুক্ত কি না।

এসব দিক যদি রক্ষিত হয় তাহলে সুপারিশের মাধ্যমে উপকৃত হবে তিন পক্ষই-যার জন্যে সুপারিশ করা হয়েছে তার প্রয়োজন পূরণ হবে, সংকট কেটে যাবে; যার কাছে সুপারিশ করা হল একটি ভালো কাজে কিংবা কোনো অভাবগ্রস্তকে সহযোগিতা করার মধ্য দিয়ে তিনিও একটি পুণ্যের কাজ করার সুযোগ পেলেন, উপযুক্ত ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে পারলেন; আর যিনি সুপারিশ করেছেন তিনি পাবেন সুপারিশের বিনিময়ে পরকালের মহাপুরস্কার, এমনকি হাদীসের ভাষ্য মোতাবেক এর ফল তিনি দুনিয়াতেও ভোগ করবেন।

এর বিপরীতে যদি সুপারিশ করার সময় এসব বিষয়ের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করা না হয় তাহলেও এর ফল ভোগ করতে হবে তিন পক্ষকেই-যার পক্ষে সুপারিশ করা হয়েছে আর যার কাছে সুপারিশ করা হয়েছে হয়তো তাদের দুজনের একজন অন্যায়কারী আরেকজন অন্যায়ে সহযোগিতাকারী হবে কিংবা তাদের একজন হবে জালেম আরেকজন হবে মজলুম। আর সুপারিশকারী সর্বাবস্থায় হবেন অন্যায়ের পথ উন্মোচনকারী।

যোগ্য ব্যক্তির জন্যে সুপারিশ করার পরও যে সে অন্যায় করবে না, কারও কোনো ক্ষতি করবে না, ধোঁকা-প্রতারণার আশ্রয় নেবে না-এ নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। আর এটা ভবিষ্যতের বিষয়, যা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। তবে সুপারিশ করার সময় ব্যক্তির অতীত ও বর্তমানকে সামনে রেখেই করতে হবে। না হলে এর দায়ভার তো বহন করতে হবেই।

সুপারিশের মহান ফযিলত লাভ করতে হলে এসব মূলনীতি সামনে রেখেই সুপারিশ করতে হবে। অন্যথায় ধর্মীয় ও সামাজিক-উভয় দৃষ্টিকোণ থেকেই গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি আমাদের আপদ হয়ে দাঁড়াবে। এ বিষয়ে তাই সচেতনতা ও সতর্কতার বিকল্প নেই।

 

 

advertisement