যিলকদ ১৪৩৯   ||   আগস্ট ২০১৮

মা    ন    ব    সে   বা : অনাথ-এতীমের প্রতিপালন

আব্দুল্লাহ আবু মুহাম্মাদ

বাংলায় একটি কথা আছে- আলোর নীচে অন্ধকার! বিষয়টিকে আরেকভাবেও বলা যায়- অন্ধকারের উপরে আলো। নির্ভর করছে আমরা কখন কীভাবে মূল্যায়ন করব তার উপর। আমাদের ভিতরে-বাহিরে, ব্যক্তি-জীবনে ও সমাজ-জীবনে আলো-আঁধার পাশাপাশি অবস্থান করছে। আঁধারের ঘটনাগুলো যেমন আমাদের ভারাক্রান্ত করে আলোর ঘটনাগুলো করে তোলে উজ্জীবিত ও আশাবাদী। সেই আশাবাদের কিছু কিছু দৃষ্টান্ত নিয়ে বন্ধুদের সাথে কিছু সুখ-আলোচনাও নানা  কারণে প্রয়োজন।

বর্তমান সমাজ বাস্তবতায় শ্রম ও শ্রমিক প্রসঙ্গটিকে সুখকর প্রসঙ্গ বলা কঠিন। তবে এর মধ্যেও কিছু ভালো দৃষ্টান্ত যে নেই তা নয়। সম্ভবত এই রকমের একটি দৃষ্টান্তের শিরোনাম ‘অরকা হোমস’।

‘অরকা’ ওল্ড রাজশাহী ক্যাডেটস অ্যাসোসিয়েশন-এর সংক্ষিপ্ত রূপ। রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের প্রাক্তন ছাত্রদের এই সংগঠনটি চট্রগ্রাম ও গাইবান্ধায় দুটি আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তুলেছে দুস্থ ও এতিম শিশুদের জন্য। দুটো আশ্রয়কেন্দ্রের নামই ‘অরকা হোমস’।

চট্টগ্রামের হোমসে রয়েছে ৩০ জন শিশু। এর মধ্যে রানা প্লাজা ধ্বসে হতাহত নারী পোষাককর্মীদের সন্তান ১০ জন। আর গাইবান্ধায় আশ্রয় পেয়েছে রানা-প্লাজায় হতাহত নারী শ্রমিকদের ২৩ ছেলে, ২১ মেয়ে।

রানা প্লাজা ট্রাজেডি ছিল মানুষের লোভ ও স্বার্থপরতার এক মর্মান্তিক স্মারক। অন্যদিকে ‘অরকা হোমস’ স্নেহ, ভালোবাসা ও পরোপকারের একটি দৃষ্টান্ত।

দৈনিক নয়া দিগন্তের (২৫ এপ্রিল ২০১৮) একটি রিপোর্টে যে তথ্যগুলো এসেছে তা হচ্ছে, এই দুটি আশ্রয়কেন্দ্রের ব্যয় নির্বাহ হয় দেশে-বিদেশে থাকা অরকার সদস্যদের আর্থিক সহায়তার ভিত্তিতে। রপ্তানিমুখী তৈরি পোষাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ চট্টগ্রামের অরকা হোমসের শিশুদের জন্য প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়। এখানের শিশু-কিশোরেরা সবাই পড়াশোনা করছে নৌবাহিনীর স্কুল এ্যান্ড কলেজ এবং পতেঙ্গা স্কুলে। এ কারণে নৌবাহিনীর কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং চট্টগ্রামের দানশীল ব্যক্তিরাও এখানে নিয়মিত সাহায্য করে থাকেন।

আশ্রয়কেন্দ্র দুটি সম্পর্কে ব্যতিক্রমী যে বিষয়টি জানা গেল তা হচ্ছে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও রুচিসম্মত পরিবেশ। সাধারণত আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর পরিবেশ মানসম্মত হয় না। এদিক থেকে এই প্রতিষ্ঠানটি ব্যতিক্রম। শিশু-কিশোরদের দেখভালের জন্য আছেন একজন তত্ত্বাবধায়ক। গৃহশিক্ষক ও ধর্ম শিক্ষকও রয়েছেন।

আমাদের দ্বীন-ইসলামে এতীম-অসহায় শিশুর তত্ত্বাবধান ও ভরণ-পোষণের কত তাকিদ ও ফযীলত এসেছে! সেই শিক্ষার কারণে ইসলামের স্বর্ণযুগে প্রায় প্রতিটি ঘরই ছিল এক বা একাধিক এতীমের নিবাস। পরিবারের একজন সদস্যের মতোই তারা হেসে খেলে বড় হয়ে উঠত। এতীমের প্রতিপালনের উপর হাদীস শরীফে জান্নাতের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে।

হযরত সাহল ইবনে সা‘দ রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

أَنَا وَكَافِلُ اليَتِيمِ فِي الجَنّةِ هَكَذَا وَقَالَ بِإِصْبَعَيْهِ السّبّابَةِ وَالوُسْطَى.

আমি এবং এতীমের প্রতিপালনকারী জান্নাতে এইরূপ (একসাথে) থাকব। এরপর তিনি শাহাদাত ও মধ্যমা আঙ্গুল দ্বারা ইশারা করলেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬০০৫

আরেকটি হাদীসে আছে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

مَنْ ضَمّ يَتِيمًا بَيْنَ أَبَوَيْنِ مُسْلِمَيْنِ إِلَى طَعَامِهِ وَشَرَابِهِ حَتّى يَسْتَغْنِيَ عَنْهُ، وَجَبَتْ لَهُ الْجَنّةُ الْبَتّةَ.

যে ব্যক্তি কোনো মুসলিম পিতা-মাতার এতীম সন্তানকে তার স্বাবলম্বী হওয়া পর্যন্ত নিজের সাথে পানাহারে যুক্ত করে নেয় তার জন্য অবশ্যই জান্নাত অবধারিত হয়ে যায়। -মুসনাদে আহমাদ হাদীস ১৯০২৫

বিখ্যাত মনীষী তাবেয়ী হযরত হাসান বসরী রাহ.-এর একটি বাণীতে উঠে এসেছে যে, ইসলামের স্বর্ণযুগে এতিম-মিসকীনের প্রতি সহৃদয়তায়, আত্মীয়-প্রতিবেশীর হক আদায়ে মুসলিম জাতি কত সচেতন ও তৎপর ছিল। তিনি বলেন-

لَقَدْ عَهِدْتُ الْمُسْلِمِينَ، وَإِنّ الرّجُلَ مِنْهُمْ لَيُصْبِحُ فَيَقُولُ: يَا أَهْلِيَهْ، يَا أَهْلِيَهْ، يَتِيمَكُمْ يَتِيمَكُمْ، يَا أَهْلِيَهْ، يَا أَهْلِيَهْ، مِسْكِينَكُمْ مِسْكِينَكُمْ، يَا أَهْلِيَهْ، يَا أَهْلِيَهْ، جَارَكُمْ جَارَكُمْ، وَأُسْرِعَ بِخِيَارِكُمْ وَأَنْتُمْ كُلّ يَوْمٍ تَرْذُلُونَ.

আমি তো মুসলমানদের দেখেছি, তাদের পুরুষ সকালে পরিবারকে বলত, হে আমার পরিবার! তোমাদের এতীমকে দেখো, তোমাদের এতীমকে দেখো। হে আমার পরিবার! তোমাদের মিসকীনকে দেখো, তোমাদের মিসকীনকে দেখো। হে আমার পরিবার! তোমাদের প্রতিবেশীকে দেখো, তোমাদের প্রতিবেশীকে দেখো! (হায়!) তোমাদের শ্রেষ্ঠ লোকেরা বিদায় নিয়েছেন, আর তোমরা প্রতিদিন নীচের দিকে নামছ। -আল আদাবুল মুফরাদ ১/৭৪, বর্ণনা ১৩৯

এই নীচের দিকে নামতে নামতে এত নীচে আমরা নেমে এসেছি যে, উপরের দিকে তাকানোর কথাও ভুলে গিয়েছি।

আমাদের জীবন থেকে ধীরে ধীরে সবই বিদায় নিয়ে গেছে। এতীম-বিধবার ভরণ-পোষণ, গরীব-মিসকীনের প্রয়োজন পূরণ, আত্মীয়-স্বজনের সাথে সুসম্পর্ক, প্রতিবেশীর সাথে সদাচার একে একে সবই যেন বিলুপ্ত হতে চলেছে। এই সুযোগে অমুসলিমেরা কিছু কিছু সামাজিক কাজ-কর্মের মাধ্যমে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের চেষ্টায় নেমে পড়েছে। বিশ^মিডিয়ায় সেগুলোরই ফলাও প্রচার হচ্ছে। প্রচার-প্রচারণার ডমাডোলে কোণঠাসা মুসলিমজাতি আরো কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। এটা এক বিপদ, তবে এর চেয়েও বড় বিপদ হবে যদি আমরা মুক্তি ও কল্যাণের চাবিকাঠি আমাদের মহান আদর্শ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। কাজেই আমাদের আত্মনির্মাণের পথে এগুতে হবে। মুহাসাবামুখী জীবন অবলম্বন করতে হবে। আবারো আমাদের একটু একটু করে উপরে উঠতে হবে। একটি একটি করে সদগুণের চর্চা আবারো আমাদের ব্যক্তিজীবন ও সমাজ-জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাহলে ইনশাআল্লাহ আবারো আমরা প্রতিষ্ঠা ও গৌরবের, আল্লাহ্র রেযামন্দি ও সন্তুষ্টির উচ্চ মর্যাদায় উন্নীত হতে পারব।

আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দান করুন- আমীন। হ

 

 

advertisement