যিলকদ ১৪৩৯   ||   আগস্ট ২০১৮

হালাল উপার্জন

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ

[১৪৩৮ হিজরির রমযানে মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা-এর হযরতপুর প্রাঙ্গণের মসজিদে ইতিকাফকারীদের উদ্দেশে হালাল উপার্জন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা রাখেন মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা-এর  সম্মানিত মুদীর  হযরত মাওলানা মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম। তিনি উপস্থিত শ্রোতাদের বিভিন্ন প্রশ্নেরও জবাব দেন। তাঁর মূল্যবান  বয়ান ও প্রশ্নোত্তর এখানে আলকাউসারের পাঠকবৃন্দের জন্য উপস্থাপিত হল।]

نحمده ونصلي على رسوله الكريم وعلى آله وصحبه أجمعين.  أما بعد..

হালাল-হারাম বিষয়ে বলার জন্য কেউ কেউ অনুরোধ করেছেন। বিষয়টা তো বিস্তৃত, লম্বা। এজন্য আমি অল্প সময় হাতে নিয়ে শুরু করতে চাচ্ছিলাম না। আবার রমযান; আপনাদেরও কষ্ট হবে। মনে করেছিলাম কিছু বলব না। তারপরও দু-একটা কথা বলছি।

ভূমিকাস্বরূপ কিছু কথা বলি, এরপর আপনাদের কেউ কেউ কিছু প্রশ্ন করতে চেয়েছিলেন সেগুলোর জবাব দেওয়ারও চেষ্টা করা হবে ইনশাআল্লাহ।

একজন মুমিন বান্দাকে বিশ্বাসের ক্ষেত্রে, ইবাদতের ক্ষেত্রে যেমন কিছু বিধি-বিধান এবং নিয়ম মেনে চলতে হয়, কিছু বিশ্বাস তাকে স্থাপন করতে হয়, কিছু ইবাদাত তাকে করে যেতে হয়, ঠিক এমনিভাবে তার জীবন চলার যত উপকরণ সেগুলোর ক্ষেত্রেও নির্ধারিত বিধি-বিধানের মধ্যে তাকে চলতে হয়। এর ভেতরে তার খাবার-দাবার, তার থাকা, পোশাক-পরিচ্ছদ এজাতীয় যা কিছু আছে, যাকে এককথায় আমরা রিযিক বলি- সবই অন্তর্ভুক্ত।

রিযিক শব্দটা অনেক ব্যাপক। অনেকে রিযিক বলতে শুধু খাবার বোঝে। রিযিক শুধু খাবার না। এই যা কিছু বললাম, সব কিছু এর ভেতরে আছে। যত রকমের ব্যবহার, যত রকমের উপভোগ, জীবন চলার জন্য মানুষের যা কিছু প্রয়োজন সবই রিযিকের অন্তর্ভুক্ত। এজন্য রিযিকের সাথে হালাল এবং হারামের কথা বলা হয়।

মালয়েশিয়ার এক মন্ত্রী মজার কথা বলেছিলেন। কথাটা সঠিক। কয়েক মাস আগে কোনো কনফারেন্সে তিনি বলেছিলেন, আমরা খাবার খাওয়ার সময় হালাল খোঁজ করি- শুকর না গরু, তা যাচাই করি। শুকর হলে খাই না, গরু হলে, মুরগি হলে খাই। কিন্তু এ গরু আর মুরগি কীভাবে অর্জিত হয়েছে- বৈধ পন্থায় না অবৈধ পন্থায়- ওই পর্যন্ত আমরা হালাল-হারাম খোঁজ করতে যাই না। হালাল-হারামের শেষ স্তরটা দেখি। মুরগি কিনতে পারছি, এটা ঠিক আছে। মুরগিটার জবাই ঠিক মত হয়েছে কি না- এটা কেউ কেউ খোঁজ করি, কিন্তু মুরগি যে পয়সা দিয়ে কিনল সে পয়সাটা হালাল, না হারাম ওটা আমরা দেখি না। হালাল এবং হারাম একেবারে উৎস থেকে শুরু হয় এবং শেষ পর্যন্ত ধাপে ধাপে চলে।

হালাল-হারামের বিষয়ে হাদীসে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তাআলা রাসূলদের যে নির্দেশ দিয়েছেন, মুমিনদেরকেও সে নির্দেশ দিয়েছেন।

রাসূলদেরকে কী নিদের্শ দিয়েছেন-

یٰۤاَیُّهَا الرُّسُلُ كُلُوْا مِنَ الطَّیِّبٰتِ وَ اعْمَلُوْا صَالِحًا.

রাসূলদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন كُلُوْا مِنَ الطَّیِّبٰتِ  অর্থাৎ পূতপবিত্র খাও! এবং এটা আগে বলেছেন। পরে বলেছেন- وَاعْمَلُوْا صَالِحًا

ভোগ শব্দটা এখন খুব ব্যবহার হচ্ছে! আমার হাসিও আসে, দুঃখও লাগে। বাজেট পেশ করার সময় বলতে শোনা যায়, দেশ উন্নত হয়ে যাচ্ছে! উন্নত হয়ে যাচ্ছে!!

এবারের বাজেটের শ্লোগান ছিল ‘উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ, সময় এখন আমাদের’। আমাদের অর্থমন্ত্রী সাহেব আলোচনার মাঝে দেশের জিডিপি বেড়ে গেছে, এই বেড়ে গেছে, সেই বেড়ে গেছে, এগুলো খুব লম্বা করে বলেন। কয়েক বছর থেকে বলছেন যে, ভোগ বাড়ছে! ভোগ বাড়ছে!! যেন ভোগ বাড়লেই উন্নতি হয়ে যায়। যেন মানুষ দুনিয়াতে শুধু ভোগের জন্য এসেছে।

ভোগ বাড়লে মানুষের উন্নতি হয়ে যায় কীভাবে? হয়ত ভোগ বাড়ছে বলে বোঝাতে চাচ্ছেন যে, মানুষ বেশি কামাচ্ছে, আয় বেশি হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, ভোগটা বৈধ হচ্ছে কি না? খুব বেশি যারা ভোগ করছেন, তারা ক’জন শুদ্ধভাবে কামাই করে ভোগ করতে পারছেন? ক’জন অবৈধভাবে কামাই করে ভোগ করছেন? এ বিষয়গুলো ফরক করার দরকার আছে। একজন মুসলিমের জন্য, একজন মুমিনের জন্য, একজন মানুষের জন্য এ জিনিসগুলো পার্থক্য করার দরকার আছে।

ইসলামে কামাই করে খেতে মানুষকে বার বার উৎসাহিত করা হয়েছে। সাহাবায়ে কেরামের জিজ্ঞাসায় এসেছে, কোন্ খাবারটা ভালো, কোন্ কামাইটা ভালো। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন ভাষায় বলেছেন-

عمل الرجل بيده، كسب الرجل بيده.

অর্থাৎ নিজের উপার্জিত আয় ‘আতয়াব’, মানে অতি উত্তম, বেশি ভালো। অর্থাৎ ইসলাম মানুষকে অলস বসে থাকার, অন্যের ধন-সম্পদে নজর দেওয়ার, বেকার-ভাতা গ্রহণ করার জন্য বসে থাকার এবং দান-সদকা নির্ভর থাকার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেনি। এর বিপরীতটার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছে। মানুষ কামাই করবে, খরচ করবে। এটার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছে। শুধু উদ্বুদ্ধই করেনি, বাস্তবে দেখিয়ে দিয়েছে।

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুওতপ্রাপ্তির পূর্বেই মৌলিক দুটো কাজ, মানুষের কামাইয়ের মৌলিক দু’টো মাধ্যম অতিক্রম করে এসেছেন। মৌলিক দু’টো মাধ্যমের একটা হল, শ্রমের মাধ্যমে অর্থ যোগাড় করা। আরেকটা ব্যবসার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করা। এ দু’টো স্তরই রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আগে অতিক্রম করে এসেছেন। এবং বিশ্বস্ততার সাথে, সুনাম-সুখ্যাতির সাথে অতিক্রম করে এসেছেন। হাদীসে আছে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যত নবীগণ আগে গেছেন, সবাই বকরি চরিয়েছেন। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করেছেন, আপনিও? বললেন, হাঁ! আমিও এক কবিলার ছাগল চরিয়েছি।

আরেকটা কথা বলে নিই, শ্রেণিবৈষম্যগুলো পরের তৈরি জিনিস। আমাকে দিয়ে শুরু করি। আমরা হুযূর। এখন আমাকে যদি ক্ষেতের কাজে লাগিয়ে দেওয়া হয়, তো কেমন কেমন জানি লাগবে। আমি যদি বাদাম বেচতে নেমে যাই, আপনি বলবেন যে, কেমন কথা। একজন হুযূর হেঁটে হেঁটে ‘গরম বাদাম’, ‘গরম বাদাম’ বলে। এটা এমন পরিবেশ তৈরি হয়ে গেছে বিধায় এমনটি লাগছে। কিন্তু এ রকম আগে ছিল না। ইতিহাসে তো স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে, খলিফা আবু বকর সিদ্দীক রাযিআল্লাহু আনহু মাথায় কাপড়ের পুঁটলি নিয়ে বাজারে যাচ্ছিলেন। এখন তো এগুলো কমে গেছে। গ্রামে আমরা এ জিনিসটা দেখতাম। গ্রামে হাট বসত সপ্তাহে এক দিন, দু’দিন। বেশির ভাগই দোকান ঘর-ছিল না। বরং মাচানের মত থাকত। আর বাহির থেকে পুঁটলি নিয়ে নিয়ে দোকানদাররা ওই জায়গাগুলোতে গিয়ে বসত। সেখানে তারা বিক্রি করে আবার রাতে চলে আসত। এই তরিকা ছিল। আমার ধারণা, আবু বকর সিদ্দীক রাযিআল্লাহু আনহু এভাবেই মাথায় পুঁটলি নিয়ে যাচ্ছিলেন বাজারে। তো একদিন তিনি যাচ্ছেন, ওমর রাযিআল্লাহু আনহু রাস্তায় তাকে আটকিয়ে দিয়েছেন। আপনি পুঁটলি নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন? আপনি পুঁটলি নিয়ে বাজারে গেলে রাষ্ট্র চালাবে কে?

যাই হোক, এই যে খলিফা মাথায় পুঁটলি নিয়ে যাচ্ছেন, এটা দোষের ব্যাপার ছিল না। ওমর রা.-ও দোষের মনে করেননি। বলেননি, হায় হায় দেখতে কেমন লাগে। আপনি খলিফাতুল মুসলিমীন। আপনি মাথায় পুঁটলি নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন, আপনি ব্যবসায় লেগে গেলে রাষ্ট্র পরিচালনার সময় পাবেন কোথায়? খলিফা! কোথায় যাচ্ছেন? তাহলে রাষ্ট্র চালাবে কে? হযরত ওমর রাযিআল্লাহু আনহু বলেননি যে, এটা তো মানায় না আপনার জন্য। আসলে মানায় কি মানায় না এ প্রশ্ন নেই। শরীয়ত বলে যে, তুমি হালাল কামাই কর।

হাদীসের মধ্যে আমাদের যে বর্ণনাকারীগণ আছেন, আপনারা যে মশহুর কিতাবগুলোর নাম শোনেন- বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী। ওখানে বর্ণনাকারীদের নামের শেষে বিভিন্ন লকব লাগানো থাকে। ‘আলহাযযা’ও আছে সেখানে। ‘হাযযা’ মানে মুচি। আমি একটার নাম বললাম শুধু। এমন একটা বললাম যেটা শুনতে আপনার কাছে একেবারেই কেমন কেমন লাগবে। আলহাযযা-মুচি। আমাদের দেশে রীতি হয়ে গেছে এই কাজ বিশেষ শ্রেণির লোকেরা করে। এজন্য এটা কেমন কেমন লাগে। কিন্তু আমরা অন্যান্য দেশে দেখেছি, বাকায়দা নামাযী লোক, দাড়িওয়ালা লোক, তারা মুচিগিরীও করছে, আবার অন্য আরো কাজও করছে। এটাকে দোষ মনে করা হচ্ছে না।

আরো আছে, খায়্যাত-দর্জি। এ ধরনের পেশার লোকদের নাম হাদীসের কিতাবে আছে, যাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য ভিন্ন পেশা ছিল এবং তারা দ্বীনের কাজ করে গেছেন, ইসলামের খেদমত করে গেছেন। আমি আমাদেরকে দিয়ে শুরু করলাম। কারণ, শ্রেণিবৈষম্য আমাদের মধ্যেও শুরু হয়েছে। আমরা হুযূররা এখন শুধু মসজিদ-মাদরাসা নিয়ে আছি। অন্য কাজ করে খাব, সাথে মাদরাসা-মসজিদে কাজ করব, এটা এখন সাধারণত আমাদেরকে দিয়েও হয় না। না হওয়ার বিভিন্ন কারণ আছে ঠিক। আলেম-গায়রে আলেম সবাই মিলে যদি আমরা এ কাজগুলো করতাম তাহলে ভাগাভাগি করে করতে পারতাম। মানে সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত ভাইয়েরা কিছু দ্বীনের কাজ করবে, আমরাও কিছু দ্বীনের কাজ করব। তাহলে মিলেমিশে করতাম। ইঞ্জিনিয়ারিং, ডাক্তারি আমরা পারব না, কিন্তু অন্যান্য সাধারণ কাজগুলো আমরাও করতে পারতাম কিছু কিছু। তাহলে কাজ ভাগাভাগি হত। কিন্তু এখন ভাগ করে ফেলেছি। আপনারা বলছেন, আমরা শুধু মাখলুকের খেদমত করব, আপনারা শুধু দ্বীনের খেদমত করতে থাকেন। ভাগ হয়ে গেছে। এ ভাগের বিষয়টা আগে এত প্রকটভাবে ছিল না।

তো আমি শুরু করেছিলাম ছাগল চরানো দিয়ে। আম্বিয়ায়ে কেরামকে আল্লাহ তাআলা নবুওত দেয়ার আগে ছাগল চরানোর কাজ করিয়ে নিয়েছেন। এর বিভিন্ন ব্যাখ্যা মুহাদ্দিসীনে  কেরাম দিয়েছেন। সেদিকে এখন যাচ্ছি না। আমি শুধু এটা দেখাতে চাচ্ছি যে, এ বিষয়গুলো দূষণীয় ছিল না; বরং প্রশংসার সাথে দেখা হত যে, ইনি কাজ করে খাচ্ছেন। সেটা হোক কৃষকের কাজ, শ্রমিকের কাজ বা রাখালের কাজ। মুখ্য ছিল তিনি খেটে খাচ্ছেন কি না? কামাই সঠিকভাবে করছেন কি না? কাউকে ধোঁকা দিচ্ছেন না তো! এটা ছিল মুখ্য বিষয়। তাহলে শ্রমিক-কৃষকের কাজ এক ধরনের উপার্জনের মাধ্যম। উপার্জনের আরেক মাধ্যম হল ব্যবসা। এক হাদীসে ব্যবসার কথাও এসেছে। যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছে- أي الكسب أطيب؟ কোন্ কামাইটা উত্তম? তখন প্রথম ওটা বলা হয়েছে- عمل الرجل بيده বা كسب الرجل بيده। নিজের শ্রমের মাধ্যমে উপার্জিত আয়। এরপর বলেছেন-كل بيع مبرور। মুসনাদে আহমাদ, মুসনাদে বাযযার, মুসতাদরাকে হাকেম ইত্যাদি হাদীসের কিতাবে আছে। ‘মাবরুর’ শব্দটা আপনাদের কাছে পরিচিত। কোথায় ব্যবহার হয়? হজে¦। আলহাজ্জুল মাবরুর। এ মাবরুর কিন্তু ‘বাই’-এর মধ্যেও আছে। ‘বাইউন মাবরুর’ কোন্ বাইকে বলা হয়? বাইউন মাবরুর হল, ওই বাই, ওই ব্যবসা, যে ব্যবসাটা শরীয়তের নির্দেশনা মতে হবে। যেখানে রিবা, সুদ, কিমার, জুয়া, গরর, ধোঁকা, ফাসেদ জিনিস,  শরীয়ত নিষিদ্ধ ব্যবসার উপাদানগুলো থাকবে না। ঐটাকেও উত্তম উপার্জনের মধ্যে শামিল করা হয়েছে। তাহলে দু’টো মাধ্যম হল।

দুনিয়াতে আমাদের বৈধ কামাইয়ের যত মাধ্যম আছে সবগুলো এ দু’ভাগে বিভক্ত। ফিকহের ভাষায় একটাকে বলা হয়, আলইজারা, আরেকটাকে আলবাই। মানুষ সাধারণত দুটো কাজই করে, হয়ত জব করে, চাকরি বাকরি করে, আর না হয় ব্যবসা করে। এ দুটো ছাড়া যেটা করতে পারে, সেটা হচ্ছে কৃষি জাতীয় কাজ। ংবষভ বসঢ়ষড়ুবব নিজের চাকরি নিজে করা।

এখন চাকরি বাকরি, নিজের কাজ নিজে করা এবং ব্যবসা, এসব কিছুর জন্য শরীয়তের নির্দেশনাগুলো কিছু মৌলিক, কিছু বিস্তারিত। এ বিস্তারিত নির্দেশনার উপর হাজার হাজার পৃষ্ঠা লেখা হয়েছে। সময়ে সময়ে ফুকাহায়ে কেরামের কাছে বিভিন্ন জিজ্ঞাসা এসেছে। এগুলোর জবাব ও ব্যাখ্যা দিতে দিতে লাইব্রেরী ভরে গেছে। গতবারও সম্ভবত আমি বলেছিলাম আমরা যে যেই পেশায় আছি, যে কাজে আছি, তার জন্য সে কাজের শুদ্ধটা খোঁজ করে নেওয়া আবশ্যক। সবসময় এটা দরকারি ছিল। এখনকার সময় বেশি দরকারি হয়ে গেছে। আপনারা যারা জেনারেল শিক্ষিত আছেন, তারা তো আছেনই। ব্যবসার সাথে যদি আমরা আলেমরাও লেগে যাই এবং আগে থেকে বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে হুঁশিয়ার না থাকি, তো বর্তমান সময়ে পদস্খলনের সম্ভাবনা খুব বেশি থাকে।

কারণ হল, ব্যবসার গোড়াটা এখন অন্যদের হাতে। এখনকার ব্যবসার যে পদ্ধতি এটা অন্যদের কর্তৃক পরিচালিত। এবং অন্যদের কর্তৃক আবিষ্কৃত। যদিও ব্যবসা ছিল মানুষের ফিতরী ও স্বভাবজাত বিষয়। যুগ যুগ থেকে, আদিকাল থেকেই মানুষ ব্যবসা করে আসছে। কিন্তু বিগত কয়েক শ বছর থেকে, এখন বিশেষত ইউরোপে শিল্পবিপ্লবের পর থেকে  ব্যবসার নিয়ম-নীতি, একটু ভিন্ন ধরনের হয়ে গেছে। বিশ্বব্যাপী কিছু বিধি-বিধানের মাধ্যমে কিছু নিয়মের মাধ্যমে কিছু চর্চা এমন ব্যাপক হয়ে গেছে যে, সেভাবেই এখন ব্যবসাটা চলে। এখন এ ব্যবসার মধ্যে শরীয়ত নিষিদ্ধ বিষয় ঢুকে গেছে। যারা এ ব্যবসাগুলো চালু করেছে তারা তো আর মুমিন নয়। তারা ইসলামের বিধি-বিধান থেকে তো আর এগুলো করেনি। তো এখন যারা ব্যবসা করবে তাদের কর্তব্য হল, সেখানে কী কী ভেজাল ঢুকেছে তার খোঁজ-খবর রাখা এবং এগুলো দেখে-শুনে চলা। এটা ব্যবসায়ীদের জন্য আবশ্যক।

এরকমভাবে চাকরি। চাকরি বলতে আগে মনে হত যে, ছোটখাট বিষয়। চাকরি করা মানে কোনো রকম একটা করে চলা। এখনকার চাকরিটা এরকম নয়। ব্যবসায়ীদের ব্যবসায় বিস্তৃতি ঘটেছে, বড় হয়েছে। চাকরিওয়ালাদের একেবারে নিম্নস্তরের চাকরি তো আছেই। অনেক বড় বড় কামাইয়ের চাকরিওয়ালাও এখন আছে। এখানেও নতুন নতুন অনেক বিষয়াদি যোগ হচ্ছে। চাকরি করতে গিয়ে সে যে চাকরির স্থলে সুবিধাগুলো নিচ্ছে, পাচ্ছে, সে সুবিধাগুলোর মধ্যে হালাল-হারাম মিশ্রিত হচ্ছে। এখানে একেক সময় একেক ধরনের সুবিধা। যেমন একটি বিষয়, ইন্সুরেন্স। চাকরিজীবীকে বিভিন্ন প্রকারের ইন্সুরেন্স সুবিধা দেয়া হয়। এদেশেও এখন চালু হয়েছে। অনেক কোম্পানী দেয়। এভাবে বিভিন্ন জিনিস যোগ হয় সময় সময় চাকরিতে।

চাকরি করতে গিয়ে দায়িত্ব আদায় করা, কতটুকু করা। আদায় না করা, কতটুকু না করা। দায়িত্বের মধ্যে কমতি হলে বেতন কতটুকু নেওয়া ঠিক আছে, কতটুকু নেওয়া ঠিক নেই। কোন্ প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা যাবে, কোন্ প্রতিষ্ঠানে যাবে না। কিছু প্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে চাকরি করা উচিত নয়। কিছু প্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে চাকরি করা হয়ত যাবে, কিন্তু কিছু কিছু জিনিস বেছে চলতে হবে। আমাকে এ ডিপার্টমেন্টে দিয়েন না, ঐ ডিপার্টমেন্টে দিন- এভাবে অনুরোধ করে বদলি করে নেওয়া কোনো কোনো ক্ষেত্রে দরকার হয়ে যায়। প্রতিষ্ঠানের মৌলিক কারবার হয়ত ঠিক আছে, কিন্তু তার কিছু কিছু ডিপার্টমেন্ট আছে, যেখানে সমস্যা আছে। এ ধরনের অনেকগুলো ব্যাপার চাকরির ক্ষেত্রেও আছে।

এরকমভাবে চাকরিদাতা বা নিয়োগকর্তাদেরও মানার মত অনেক বিষয়াদি আছে। নিয়োগকর্তারা যাদেরকে চাকরিতে রেখেছে তাদের জন্য যে যে ক্ষেত্রে যে যে নিয়ম-নীতি তারা বানায়, মুমিন-মুসলমান নিয়োগদাতাদের জন্য জরুরি হল এগুলো আলেমদের কাছে গিয়ে যাচাই করে নেওয়া। সে যে বলছে, এখানে এ সুবিধা পাবে না। এখানে এটা পাবে না। অমুক জায়গায় বেতন কেটে দেওয়া হবে। অমুক জায়গায় এভাবে চাকরি চলে যাবে, এগুলো শুদ্ধ বলছে কি না? নিয়োগদাতার জন্য এগুলো যাচাই করে নেওয়া আবশ্যক। এ দুই শ্রেণিকে আমরা ফিকহের ভাষায় বলি আজীর এবং মুসতাজীর।

আজীর, যে চাকরি করছে। মুসতাজীর হল, নিয়োগকর্তা। এ দু’গোষ্ঠীর সমন্বিত বিষয় হল ইজারা বা চাকরি। উভয় গোষ্ঠীকেই অনেকগুলো বিধি-বিধান মেনে চলতে হয়। শরীয়তের মৌলিক বিষয়গুলো মেনে চলতে হয়।

আমি যে ভূমিকামূলক কথা বলতে চেয়েছি সেটা এ পর্যন্তই। অর্থাৎ ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকরি-বাকরি এ উভয় ক্ষেত্রেই কিছু বিধি-বিধান মেনে চলা জরুরি। হালাল রোজগার, হালাল কামাই, হালালভাবে জীবন-যাপন মুমিনের অত্যাবশ্যকীয় বিষয়। আম্বিয়ায়ে কেরামকে যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সেটাই মুমিন-মুসলমান সকল মানুষকে দেওয়া হয়েছে।

তাছাড়া হালাল-হারাম যদি বেছে না চলা হয় তাহলে ঈমান অসম্পূর্ণ থেকে যায়।  কারণ কুরআনে কারীমে ঈমান-আমলের সাথে হালাল রিযিকের কথাও আছে।

দুআ মুমিনের বড় সম্বল। যদি কামাই রোযগার শুদ্ধ না হয়, তাহলে দুআ কবুল হয় না। হাদীসে বলা হয়েছে- أنى يستجاب له । কীভাবে কবুল করা হবে তার দুআ?

কবুল করা হয় না, এ শব্দ বলা হয়নি। বরং বলা হয়েছে যার পরনের পোশাক হালাল নয়, যার খাবার হালাল নয়, সে খুব কান্নাকাটি করছে, কিন্তু  أنى يستجاب له কীভাবে তার দুআ কবুল করা হবে? ‘কীভাবে কবুল করা হবে’- হাদীসে এ শব্দ বলার অর্থ কী? এভাবে বলার অর্থ হল, সে তো আল্লাহর কাছে চাওয়ার মত অবস্থা নিজের মধ্যে তৈরি করতে পারেনি, করেনি। আল্লাহর কাছে চাচ্ছে, কিন্তু আল্লাহ যেভাবে তাকে রুটি-রুজির ব্যবস্থা করতে বলেছেন, পোশাক-পরিচ্ছদ, ভোগ-উপভোগ যে পন্থায় করতে বলেছেন সেভাবে তো সে করছে না। তাহলে সে চাচ্ছে কীভাবে? কবুল করা হবেও বা কীভাবে? أنى يستجاب له

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে হারাম থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন।

আমাদের ব্যবসা বাণিজ্য, চাকরি-বাকরি সবকিছুর বিধি-বিধান, নিয়মনীতি যেহেতু অন্যদের অনুসরণে করা হচ্ছে, এজন্য সময় যত বাড়ছে বিষয়গুলো কঠিন হচ্ছে এবং নতুন নতুন পন্থা বের হচ্ছে। শর্টকাট বড়লোক হওয়ার কিছু পন্থাও বের হচ্ছে। এসব হচ্ছে টেকনোলজির উন্নতির কারণে এবং মানুষের মধ্যে সম্পদের মোহ বেড়ে যাওয়ার কারণে। সম্পদ এখন এক শ্রেণির কাছে বেশি, এক শ্রেণির কাছে কম, আবার এক শ্রেণির কাছে নেই। এ বৈষম্যটা বাড়ার কারণে সম্পদের মোহ সবাইকে ধরছে। যাদের কাছে নেই, তাদের অনেকের মধ্যে হিংসা তৈরি হচ্ছে। আমরা চাচ্ছি শর্টকাট বড়লোক হয়ে যেতে। এজন্যই নতুন নতুন পন্থা বের হয়। মাল্টিলেভেল মার্কেটিং, অমুক কমিশন পদ্ধতি, তমুক কমিশন পদ্ধতি। এটা সেটা এবং ধোঁকা, প্রতারণা। এসব পথে মানুষ প্রবেশ করে। এগুলোতে প্রবেশ করার আগে দশবার চিন্তা করে নিতে হবে। জিজ্ঞেস করে নিতে হবে যে, এগুলো শরীয়ত অনুযায়ী হচ্ছে কি না? সহীহ কি না? চিন্তা করলে এবং জিজ্ঞাসা করলে আমরা জানতে পারব এবং আত্মরক্ষা করতে পারব।

নতুন নতুনভাবে অনেকে শরীআর নাম দিয়েও করে। মাল্টিলেভেল মার্কেটিং যে এ দেশে ছিল, তাদেরও শরীআ কাউন্সিল ছিল। এবার বুঝতে পারেন। তাদের শরীআ কাউন্সিলেও তো কেউ না কেউ গেছে।

এজন্য এগুলো যাচাই-বাছাই করে চলা দরকার এবং খুব চোখ-কান খোলা রাখা দরকার। নিজেদের কামাই-রুজির ব্যাপারে চোখ-কান খোলা রাখা আবশ্যক। আজকে আর আমি বিস্তারিত বললাম না।  কারণ একটা বিষয়ের তাফসীলে ঢুকলেই অনেক লম্বা হয়ে যাবে।

আপনাদের যদি ছোটখাট কোনো জিজ্ঞাসা থাকে তাহলে বলতে পারেন।

 

প্রশ্নোত্তর

প্রশ্ন : কোম্পানির কাজে কোথাও গেলে কখনো কখনো তারা কোনো উপঢৌকন দিয়ে দেয়। যেমন, মাছ, তরকারি, মিষ্টি ইত্যাদি। তো এসব গ্রহণ করতে কোনো সমস্যা আছে কি না?

উত্তর : আমার কথা হল এসব ক্ষেত্রে মালিককে বলে নেবে। কারণ এরা মালিকের প্রতিনিধি হিসেবে যায়। এসব ক্ষেত্রে ইসলামের নির্দেশনা হল, যা যা মাঝখানে পায়, এগুলো মালিককেই দিতে হবে। বর্তমান পরিবেশে এখন এটার প্র্যাকটিস নেই। মালিকরাও চায় না। এরাও দেয় না।  এক্ষেত্রে উচিত হল, মালিকদেরকে বলে নেওয়া। এবং মালিকদের উচিত হল, এসব ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া। আচ্ছা, তোমাকে দিয়েছে, তুমি নাও।

কিন্তু এটাকে ব্যাপক প্রসার করলে ক্ষতিও আছে। তখন অসৎ রাস্তা খুলতে পারে। উপঢৌকনটা প্রথমে থাকবে হালকা। দু শ টাকার মাছ ধরিয়ে দিল। একসময় তিন হাজার টাকার বোয়াল মাছ দিয়ে দেবে এবং উদ্দেশ্য থাকবে ভিন্ন কিছু হাসিল করা। অন্য কোনো সুবিধা হাসিল করা। এজন্য এগুলো এড়িয়ে চলাই উচিত।

প্রশ্ন : ভাত খাওয়া অবস্থায় কোন্ হাত দ্বারা চামচ ধরবে? চামচ ধরার পদ্ধতি কী হবে?

উত্তর : ওজর হলে তো বাম হাতে ধরতে পারে। আমি ডান হাতে ধরি। চামচের একটু গোড়ার দিকে এভাবে ধরি। তবে ওজরের কারণে বাম হাতেও ধরা যায়। মৌলিকভাবে খাওয়ার সময় ডান হাত ব্যবহার করা নিয়ম। আমরা তো এক হাতে খেয়ে ফেলতে পারি। বিদেশীদেরকে দেখা যায়, হাঁড় থেকে গোশত বের করতে, অথবা মাছ খেতে ওরা এক হাতে খেতে পারে না। দুই হাত লাগে। তো এটা ওজর। এতে অসুবিধা নেই। সাধারণ অবস্থায় ডান হাত ব্যবহার করতে হবে।

প্রশ্ন : বর্তমানে দেশে এবং দেশের বাইরে ব্যবসা, বিশেষত ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে ইসলামসম্মত করার মেহনত চলছে এবং তা অতি বিস্তৃত। আবার কেউ কেউ বলছে যে, এ মেহনতটি বিশেষ কোনো ফলদায়ক হচ্ছে না। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই?

উত্তর : এটা দীর্ঘ বিষয়। ব্যাংকিং পদ্ধতিটি যেন সুদবিহীন হয়, ইসলামী ব্যাংকিংয়ের কথা বলছি না। বলছি সুদবিহীন ব্যাংকিং। একটি হল ইসলামী বিনিয়োগ ব্যবস্থা। সেটা এখনো কোথাও কার্যকরী হয়নি। ব্যাংকিং এর বর্তমান যে অবস্থা সেটা ঘষামাজা দিয়ে কোনো রকম সুদ থেকে বের হওয়া যায় কি না- এ প্রচেষ্টা চলছে। অনেক জায়গায় সফল হয়নি। কোনো কোনো জায়গায় অগ্রসর হচ্ছে। কিছু কিছু কাজ করা হচ্ছে। নিরুৎসাহিত করা উচিত না, উৎসাহিত করতে হবে, কাজ হোক। কিন্তু যেগুলো ভুল হচ্ছে সেগুলো ঠিক করার চেষ্টা করা উচিত। একেবারেই ফল দিচ্ছে না- এ কথা বলা ঠিক না। বিষয়টাকে আমরা এভাবে বলি না। কারণ এটা একটা প্রচেষ্টা। প্রচেষ্টাতে ভুল থাকতে পারে। ভুল আছেও। এটাকে শুদ্ধ করার চেষ্টা করতে হবে। তবে একেবারে খালেস ইসলামী বিনিয়োগ পদ্ধতি যেগুলো, সেগুলো এখনো ঠিক ওভাবে প্র্যাকটিস হচ্ছে না। যদি সঠিক বিনিয়োগ ব্যবস্থা চালু হয়, ধীরে ধীরে ঐদিকেও মানুষ অগ্রসর হবে।

প্রশ্ন :

نهى رسول الله صلى الله عليه وسلم أن يتلقى الجلب

হাদীসটির ব্যখ্যা কী?

উত্তর : আমাদের বাংলাদেশে এটার এখন ব্যাপক প্রচলন। এই যে, এ সমস্ত ক্ষেতে ফসল উৎপাদিত হয়, এ তরকারিগুলো অনেক ক্ষেত্রেই কৃষকেরা বাজার পর্যন্ত নিতে পারে না। গাবতলী বা কারওয়ান বাজারের যারা আড়তদার তাদের লোকেরা বা তারা নিজেরা এসে এ জায়গা থেকে এগুলো কিনে নিয়ে যায়। এ হাদীসে বলা হয়েছে যে, এ কারবারটা করো না। একে গাবতলী পর্যন্ত আসতে দাও। তাকে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত আসতে দাও। এখানের কৃষক যদি সরাসরি কারওয়ান বাজারে ঢুকতে পারে, যদি তার তরকারিগুলো নিয়ে ওখানে ঢোকে, তাহলে তরকারির দাম তুলনামূলক কম থাকবে। মাঝখানে একটা মধ্যস্বত্ব তৈরি হবে না। কিন্তু ঐ ব্যবসায়ী অথবা তৃতীয় কেউ যখন এখানে চলে আসে, সে একটা দাম ধরে উৎপাদক থেকে নিয়ে চলে যায়। ১০ টাকা কেজি নিয়ে চলে গেল। ওখানে গিয়ে সে পাইকারিই বিক্রি করছে ২০ টাকা ২২ টাকা। তো এ মধ্যস্বত্বটা শরীয়ত নিরুৎসাহিত করে। অপ্রয়োজনীয় মধ্যস্বত্ব।

এমনিতে কোনো সময় ব্যবসার মধ্যে মধ্যস্বত্বের প্রয়োজনও তৈরি হয়। একটা জিনিস দু হাতেই বিক্রি হয়ে যাবে অনেক ক্ষেত্রে এটা সম্ভব হয় না। মাঝখানে দুটো স্তর তৈরি হতে পারে। কিন্তু শরীয়ত চায়, যত কম মধ্যস্বত্ব তৈরি হওয়া যায় ততই ভালো। এক্ষেত্রে শরীয়ত ভোক্তা বা কনজ্যুমারের দিকটাকে প্রাধান্য দেয়। তাছাড়া এতে উৎপাদকেরও লাভ কারণ সে বাজারে যেতে পারলে ১০ টাকার জায়গায় ১২ বা ১৪ টাকা পাবে।

আর ভোক্তার যেটা ৩০ টাকায় কিনতে হত এখন সেটা ২০ টাকায় কিনবে। বা ছোট পাইকারও ধরুন সে হয়ত ২০ টাকায় নিত, এখন সে ১৫ টাকায় কিনবে এবং এটা খুচরা বাজারে ৩০ টাকা না হয়ে ২০ টাকা বিক্রি হবে। দামটা গড়ে ১০ টাকা কমে আসবে। শরীয়ত এটা চায়।

আমাদের কাছে এরকম অনেক প্রশ্ন আসে। যাত্রাবাড়ীর যে মাছের আড়ত, আড়তওয়ালারা ভোলা বরিশালে দূরে দূরে জেলেদেরকে টাকা দিয়ে রাখে। বলে যে, আমরা কোনো লাভ-টাভ নেই না। অথচ শর্ত দিয়ে দেয় যে, অন্য কিছু না; শুধু ওনারা যে মাছ পাবে, ঐ মাছগুলো আমাদের আড়তে বিক্রি করবে। দাদনের মত আর কী। বলে যে, ঋণের উপর আমরা কোনো সুদ নেই না। ওটা ওর কাছে এমনিতেই পড়ে আছে।

তো দেখুন, সে যে জেলেকে মাছটা তার আড়তে বিক্রি করতে বাধ্য করছে, এতে বেচারা জেলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না? সে তার আসল দামটা পাচ্ছে না। এবং কিছু লোক এ বিষয়টাকে আবদ্ধ করে ফেলার কারণে পরবর্তী ভোক্তা ও ছোট দোকানদাররা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই ইসলাম এটাকে নিষেধ করেছে।

‘তালাক্কিল জালাব’ শিরোনামের এই হাদীসে মূলত মধ্যস্বত্বভোগীকে উঠিয়ে দিতে বলা হয়েছে। ‘তালাক্কিল জালাব’ বলা হয় রাস্তার মধ্যে আটকে দেওয়া। এখান থেকে মাল নিয়ে যাচ্ছে। আমিন বাজার ঢোকার আগেই বলিয়ারপুরে বা সালেহপুর ব্রীজে ব্যবসায়ী লোকেরা দাঁড়িয়ে গেছে। বলে যে, ওখানে যেয়ো না। ওখানে এত দাম নেই। কষ্ট করে গিয়ে কী করবে? আমাদের কাছে বিক্রি করে দাও। আমরা নগদ টাকা দিচ্ছি। ইসলাম বলে, এটা করতে দিবে না। এটা নিষেধ। জানি না, তখন এটার কেমন প্রচলন ছিল? কিন্তু এখন আমরা হাড়ে হাড়ে দেখি যে, এ হাদীসগুলোর প্রয়োগ ও অনুশীলন এখানে কত বেশি দরকার। এগুলোর অনুশীলন না হওয়াতে ভোক্তা পর্যায়ের মানুষের কত ক্ষতি হয়। বিনা প্রয়োজনে মধ্যস্বত্বভোগী তৈরি হওয়ার কারণ নেই।

প্রশ্ন : আমি একজন ব্যবসায়ী। অনেক পণ্য খরিদের সময়ই আমাদেরকে মাপে কম দেওয়া হয়। সেক্ষেত্রে আমি তা বিক্রি করার সময় কী করব?

উত্তর : এরকমই একটি মাসআলা এক লোক জিজ্ঞেস করেছিল। সে পেট্রোল পাম্প করবে। একটু সমস্যা হল, সেখানে মাপে কম দিতে হয়। আমি বললাম যে, সেখানে তো মিটার লাগানো থাকে। কম দেওয়ার কী দরকার? সে বলল যে, মিটারেই কম দেওয়ার ব্যবস্থা করে রাখা হয়। এক লিটার পুরো হওয়ার আগেই মিটারে এক লিটার দেখানো হয়। আমি বললাম, এটা কীভাবে সম্ভব? এটা যে জায়েয নয় আপনি নিজেই বোঝেন। সে বলল, ঘটনাটা হল আমরাও কম নেই। আমাদেরও কম দেওয়া হয়। গাড়ীতে করে এনে আমাদেরকে দিতেই কম দেয়। এখন যেহেতু কম দেয়া হল তাই এরাও মানুষকে কম দেয়। সমান সমান করে ফেলে। এটা নাকি একটা স্বীকৃত রীতি। কত চুরি এখন এমন স্বীকৃত হয়ে গেছে। ওপেন সিক্রেট।

ওই লোক ঘর দুয়ার জায়গা সব রেডি করে তারপরে এসেছে মাসআলা জানতে। প্রথমে বললাম যে, এ ব্যবসা আপনার না করলে চলে না? বলে যে, আমি সব প্রস্তুত করে ফেলেছি। এখন না করলে কত বড় লস হবে। এ হবে সে হবে।  এখন মনে হয় উদ্বোধনের বাকি। এমন একটা পর্যায়ে ছিল। আমি ওকে ঘুরিয়েছি। আরো যাচাই করেছি। পরে শুনলাম যে, এ লাইনে এরকমই করা হয়। যে ক’টা কোম্পানি তেল সাপ্লাই দেয়, সবাই এরকম করে। মাপে কম দেয়ার একটা স্বীকৃত পন্থা ওদের কাছে আছে। কত পার্সেন্ট যেন কম দেয়।

তাকে আমি যা বলেছি তা তো ছিল তাৎক্ষণিক জবাব। একজন লোককে বলা হয়েছে। কিন্তু আসলে এগুলোর চিকিৎসা এটা নয়। বরং উচিত হল একটা সামাজিক আন্দোলন তৈরি হওয়া। এগুলোকে শুদ্ধ করার জন্য মানুষের মধ্যে সচেতনতাও বাড়ানো দরকার।

এখন তো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, এটা সেটা বহু কিছু বের হয়ে গেছে। সেগুলোর মাধ্যমেও জনমত তৈরি করা যেতে পারে।

বর্তমানে তো ডিজিটাল পাল্লাতে ডিজিটাল কারচুপি। এটাকে চলতে দেওয়া উচিত না। কোনো না কোনোভাবে এসব পদ্ধতি বন্ধ করার চেষ্টা করার জন্য প্রতিবাদ করা দরকার। কদমে কদমে মিথ্যা ও মাপে কম দেওয়া এখন স্বাভাবিক হয়ে গেছে। মুসলমানদের মাঝে যদি উল্টো জিনিসগুলোই খুব চালু হয়ে যায় এবং স্বীকৃত হয়ে যায় তার ক্ষতি তো ব্যাপক। স্পষ্ট কথা এই যে, আমরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছি এবং হব।

শুকরিয়া। জাযাকুমুল্লাহ। 

মুসাজ্জিলা থেকে পত্রস্থকরণ : মুহাম্মাদুল্লাহ মাসুম

 

 

advertisement