যিলহজ্ব ১৪৩৮   ||   সেপ্টেম্বর ২০১৭

জ্যোতির্বিজ্ঞানে মধ্যযুগের মুসলমানদের অবদান

ড. গোলাম কাদির লূন

[মুসলিম জ্ঞান-বিজ্ঞানের ইতিহাস সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখেন এমন ব্যক্তিমাত্রই অবগত আছেন যে, বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে মুসলমান পণ্ডিতগণ অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। অনেক কিছুর তো আবিষ্কারও তাঁরা করেছেন। এসব কাজে তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন তৎকালীন মুসলিম শাসকগণ। জ্ঞান-বিজ্ঞানের গবেষণায় অকাতরে অর্থ বিলিয়েছেন তাঁরা। এসব গবেষণাকর্ম পরবর্তী যুগে বিজ্ঞানের উন্নতিতে ব্যাপকভাবে সহায়ক হয়েছে। খোদ পশ্চিমের অমুসলিম বিজ্ঞানী ও ঐতিহাসিকগণও এ বাস্তবতা বর্ণনা করেছেন এবং এই সত্যের সাক্ষ্য দিয়েছেন। যদিও একতরফা পড়াশোনা ও হীনম্মন্যতার কারণে অনেক মুসলমান আজ নিজেদের এই ঐতিহ্যের খবর রাখেন না বা স্বীকার করেন না। বিশিষ্ট গবেষক ড. গোলাম কাদির লূন-এর এ সংক্রান্ত একটি প্রামাণ্য নিবন্ধের অনুবাদ করেছেন আমাদের স্নেহভাজন মাওলানা ওয়ালিউল্লাহ আবদুল জলীল। তরজমাটি বেশ প্রাঞ্জল হয়েছে। আশা করি পাঠক এতে চিন্তার ও আনন্দের  খোরাক পাবেন। -তত্ত্বাবধায়ক]

 

উমাইয়া শাসনামলের শেষ পর্যন্ত মুসলমানরা অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে প্রায় অনেকটাই ছিল অনবহিত। সর্বপ্রথম সিন্ধু অঞ্চলে সংস্কৃত ভাষায় রচিত اہرگنٹر -এর আরবী তরজমা زيج الأركند নামে করা হয়, যার ওপর ভিত্তি করে কান্দাহারে زيج الهنرزيج الجامع রচিত হয়। এরপর ৭৪২ খ্রিস্টাব্দে সংস্কৃত থেকে زيج الهرفن নামে আরেকটি তরজমা করা হয়। ১৫৪ হিজরী/৭৭১ খ্রিস্টাব্দে সিন্ধু রাজার এক দূত খলীফা আবূ জাফর মানসূরের দরবারে সঙ্গে করে সংস্কৃত ভাষার مهادسات -এর একটি কপি নিয়ে আসেন, যার বিষয়বস্তু ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞান। খলীফা মুহাম্মাদ ইবনে ইবরাহীম আলফাযারীকে এ বইয়ের আরবী তরজমা করার আদেশ দেন। আলফাযারী হিন্দুস্তানী দূত ও মুসলিম বিজ্ঞানী ইয়াকুব ইবনে তারেক (হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দী/খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দী)-এর সহযোগিতায় আরবী পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করেন। নাম রাখা হয় زيج السند هند الكبير এটা ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত আরবী ভাষার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কিতাব। খুব সম্ভব ৭৯০ খ্রিস্টাব্দে আলফাযারী আরবী প্রচলন অনুযায়ী জ্যোতির্বিজ্ঞানের একটি পঞ্জিকা তৈরি করেন, যা زيج على سن العرب নামে খ্যাতি লাভ করে। হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দীর অর্ধশতকে ইয়াকুব ইবনে তারেক দুটি কিতাব লেখেন,

এক. تركيب الأفلاك

দুই. كتاب الهلال 

এছাড়াও তিনি

زيج محلول في السند هند لدرجة درجة

নামে একটি পঞ্জিকা প্রস্তুত করেন। তখনই মুসলমানরা ইরানী জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে ধারণা লাভ করে। ইরানীদের কাছে পেহলভী ভাষায় রচিত একটি জ্যোতির্বিজ্ঞানের পঞ্জিকা ছিল। নাম زيك شتر وأيار যা তৃতীয় ইয়াযদ গরদ (২৫১ খ্রিস্টাব্দে নিহত)-এর শাসনামলে প্রকাশ করা হয়েছিল। মুসলমানরা  زيج الشاه অথবা زيج الشهر নামে অনুবাদ করে।

হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষের দিকেই গ্রিক ভাষায় রচিত টলেমির অ্যালম্যাজেস্টের আরবী অনুবাদ হয়েছিল। অনুবাদটি তেমন সন্তেুাষজনক ছিল না। ২১২ হিজরী/৮২৭-৮২৮ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদের গণিতবিদ হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ ইবনে মাতার (মৃত্যু : ২১৪ হিজরী/৮২৯ খ্রিস্টাব্দ) অ্যালম্যাজেস্টের আরবী অনুবাদ করেন। প্রথম অনুবাদের চেয়ে এটা ছিল উন্নত। হিজরী তৃতীয় শতাব্দীর শুরুর দিকে প্রসিদ্ধ চিকিৎসক হুনাইন ইবনে ইসহাক (৮০৯-৮৭৩ খ্রিস্টাব্দ) অ্যালম্যাজেস্টের আরেকটি তরজমা করেন। পরবর্তীতে বাগদাদের গণিতবিদ সাবেত ইবনে কুররা এর সম্পাদনা ও সংশোধনের কাজ করেন। এ অনুবাদ সিরিয় ও গ্রিক ভাষা থেকে করা হয়েছিল। জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত গ্রিক ভাষার অন্যান্য বই ও পঞ্জিকা তখনই অনুদিত হয়। এভাবে হিজরী তৃতীয় শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত হিন্দুস্তানী, ইরানী, গ্রিক ও সিরিয় ভাষায় জ্যোতির্বিজ্ঞানের সব উত্তরাধিকার মুসলমানদের হস্তগত হয়, যেগুলো বহু শত বর্ষ ধরে সভ্য সম্প্রদায়গুলো সংকলন করেছে।

গ্রহ-নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করার জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে কাজ শুরু হয় ইরানের জুন্দিশাপুরে খলীফা মামুনুর রশীদের আমলে (১৯৮-২১৮ হিজরী/৮১৩-৮৩৩ খ্রিস্টাব্দ) বাগদাদের শাম্মাসিয়া মহল্লায় শাহী ফরমানে নওমুসলিম ইঞ্জিনিয়ার আবু তাইয়িব সনদ ইবনে আলীর (মৃত্যু : ২২৪ হিজরী/৮৩৮-৮৩৯ খ্রিস্টাব্দ) তত্ত্বাবধানে একটি মানমন্দির নির্মাণ করা হয়। খলীফা মামুনের শাসনামলে কাসিয়ূন পাহাড়ে আরেকটি মানমন্দির নির্মিত হয়। যার প্রধান নিযুক্ত করা হয়েছিল ইয়াহইয়া ইবনে মানসূরকে (মৃত্যু : ২১৪ হিজরী/৮২৯ খ্রিস্টাব্দ)। এ দুই মানমন্দির ছাড়াও বাগদাদে জ্যোতির্বিজ্ঞানী তিন আপন ভাই আহমাদ ইবনে মূসা ইবনে শাকের (মৃত্যু : ২৪০ হিজরী/ ৮৫৪ খ্রিস্টাব্দ) মুহাম্মাদ ইবনে মূসা ইবনে শাকের (মৃত্যু : ২৫৩ হিজরী/৮৬৭ খ্রিস্টাব্দ) হাসান ইবনে মূসা ইবনে শাকের (মৃত্যু : ২৫৪ হিজরী/৮৬৮ খ্রিস্টাব্দ) দজলার তীরে বাবুত তাকে একটি মানমন্দির নির্মাণ করেছিলেন। হিজরী চতুর্থ শতাব্দী/খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীতে সুলতান শরফুদ্দাওলা (৩৭৬-৩৭৯হিজরী/৭৮৬-৮৯৬ খ্রিস্টাব্দ) বাগদাদে একটি মানমন্দির নির্মাণ করেন, সেখানে কর্মরত ছিলেন, আব্দুর রহমান আসসুফী (২৯১-৩৮৬হিজরী/৯০৩-৯৯৬ খ্রিস্টাব্দ) আবুল ওয়াফা মুহাম্মাদ ইবনে আহমদ আলবুযজানী (৩২৮-৩৮৮ হিজরী/৯৪০-৯৯৮ খ্রিস্টাব্দ) এবং আহমাদ আস-সাগানী (মৃত্যু : ৩৭৯ হিজরী/৯৯০ খ্রিস্টাব্দ)।

মিশরের ফাতেমী খলীফা আলহাকেম ছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানে আগ্রহী। তার আমলে মিশরের মানমন্দির পূর্ণতা লাভ করেছিল, যার নির্মাণ শুরু করেছিলেন তার বাবা। মিশরের সবচে’ বড় জ্যোতির্বিদ আবুল হাসান ইবনে আব্দুর রহমান ইবনে আহমাদ ইবনে ইউসুফ সদফী ওরফে ইবনে ইউনুস (মৃত্যু : ৩ শাওয়াল ৩৯৯ হিজরী/৩১ মে ১০০৯ খ্রিস্টাব্দ) এ মানমন্দিরেই গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার কাজ আঞ্জাম দেন।

সেলজুকী বাদশাহ জালালুদ্দীন মালিক শাহ (৪৬৫-৪৮৫ হিজরী/১০৭২-১০৯২ খ্রিস্টাব্দ) রাই শহরে একটি মানমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন, যার মধ্যে ওমর খৈয়ামের (৪৪০-৫২৬ হিজরী/১০৪৮-১১৩২ খ্রিস্টাব্দ) তত্ত্বাবধানে জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা হত। বাগদাদ ধ্বংসের এক বছর পর হালাকু খান (মৃত্যু : ১২২৫ খ্রিস্টাব্দ) আযারবাইজানের মারাগা অঞ্চলে একটি মানমন্দির নির্মাণ করেন, যার তত্ত্বাবধানে ছিলেন নাসীরুদ্দীন তূসী। এরপর ৮২৩ হিজরী/১৪২০ খ্রিস্টাব্দে তাইমুর বংশের শাহযাদা উলুগ বেগ (৮৪০হিজরী/১৪৪৯ খ্রিস্টাব্দে নিহত) সমরকন্দে একটি মানমন্দির স্থাপন করেন। কাজী যাদা রুমি (মৃত্যু : ৮৪০ হিজরী/১৪৩৫খ্রিস্টাব্দ) ও আলকাশীর (মৃত্যু : ৮৩৩হিজরী/১৪২৯ খ্রিস্টাব্দ) মতো মহান বিজ্ঞানীরা সেখানে কাজ করতেন। সমরকন্দে নির্মিত মানমন্দিরের অনুসরণ করে মুসলিম বিশ্বের অন্যত্রও মানমন্দির নির্মিত হয়েছিল। শুধু হিন্দুস্তানেই জয়পুর, আজীন, দিল্লী, মথুরা ও বেনারসে পাঁচটি মানমন্দির নির্মিত হয়। মুসলমানরা সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ মানমন্দির স্থাপন করে ইস্তাম্বুলে। ৯৮৩ হিজরী/১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দ-৯৮৫ হিজরী/১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝিতে নির্মাণ করা হয় এ মানমন্দির। এসব মানমন্দির ছাড়াও মুসলিমবিশ্বের বিভিন্ন শহরে ছোট ছোট মানমন্দির ছিল, যেখানে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা কাজ করতেন। (Encyclopaedia of Islam 1971, Vol. III  P. 1135-1138)

স্পেনে মুসলমানরা ইশবিলায় একটি মানমন্দির নির্মাণ করে, যা মিনার ও মানমন্দির উভয়টির কাজ দিত। স্পেনে জ্যোতির্বিজ্ঞানী জাবের ইবনে আফলাহ (হিজরী পঞ্চম শতাব্দী/একাদশ খ্রিস্টাব্দ) এই মানমন্দিরে বসেই গ্রিক রচনা অ্যালম্যাজেস্ট সংশোধনের কাজ করেছিলেন। (The Age of Faith P. 329)

এসব মানমন্দিরে মুসলমানরা জ্যোতির্বিজ্ঞানের পঞ্জিকা তৈরি করে, যার নাম দেওয়া হয়েছিল زيج। শব্দটি ফার্সী ভাষা থেকে নেওয়া। প্রথমে জুন্দীশাপুর মানমন্দিরের পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে আহমদ নাহাওয়ান্দী রচনা করেন الزيج المشتمل। খলীফা মামুনের আমলে বাগদাদ ও দিমাশকের মানমন্দিরের গবেষণার ওপর ভিত্তি করে হাকিম ইয়াহইয়া ইবনে মানসূর الزيج الممتحن নামে একটি নির্ভরযোগ্য জ্যোতির্বিজ্ঞানের পঞ্জিকা তৈরি করেন, যাকে زيج ماموني-ও বলে। কায়রোর মানমন্দিরে ইবনে ইউনুস زيج الحاكمي তৈরি করেন। রাই শহরের মানমন্দিরে ওমর খৈয়াম একটি পঞ্জিকা তৈরি করেন, যা زيج ملك شاه নামে খ্যাত। মারাগার মানমন্দিরে নাসীরুদ্দীন তূসীর তত্ত্বাবধানে যে পঞ্জিকা তৈরি হয়েছিল তা زيج أبلخاني নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। সমরকন্দের মানমন্দিরে কাশী ও কাজী জাদা زيج سلطاني নামে একটি পঞ্জিকা প্রস্তত করেন। (Encyclopaedia of Islam, Vol. III PP. 1136-1138 ) আলকাশীও নিজের মতো করে একটি পঞ্জিকা প্রস্তুত করেন, যা زيج الخاقاني নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে।

মানমন্দির ছাড়াও কিছু কিছু বিশেষজ্ঞ স্বাধীন গবেষণা ও পর্যবেক্ষণের ধারা অব্যাহত রাখে। কেউ কেউ রাজদরবারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকে আকাশ ও গ্রহ-নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ ও অধ্যয়ন করেন। এইসব যৌথ ও ব্যক্তিগত গবেষণার ফলে জ্যোতির্বিজ্ঞানের সুবিশাল ভাণ্ডার গড়ে ওঠে, যা মানবেতিহাসের অনন্য পুঁজি।

মুসলমানরা জ্যোতির্বিজ্ঞান ও গণিতশাস্ত্রে সবচেয়ে বেশি আগ্রহের পরিচয় দেয়। আব্বাসী যুগ থেকে নিয়ে হিজরী দশম শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত হাজারো বিজ্ঞানী জ্যোতির্বিজ্ঞানের ওপর বই-পত্র ও পঞ্জিকা প্রস্তুত করে, যার সংখ্যা হাজারে উপনীত হয়েছে। এটা আতিশয়োক্তি নয় বরং বাস্তবতা। কিন্দি একাই জ্যোতির্বিজ্ঞানের ওপর ত্রিশটি কিতাব রচনা করেন, অথচ তার কর্মক্ষেত্র জ্যোতির্বিজ্ঞান নয়, ছিল দর্শন। মুসলমানদের এসব কিতাবের পাণ্ডুলিপি পড়ে আছে পূর্ব-পশ্চিমের লাইব্রেরীগুলোতে। ইউরোপীয়দের মাধ্যমে এ পর্যন্ত যা প্রকাশিত হয়েছে তা হাজার ভাগের এক ভাগও না।

পূর্ব-পশ্চিমের আধুনিক রেফারেন্স বইগুলোতে যাদের অবদানের আলোচনা এসেছে তারা হলেন, মুহাম্মাদ ইবনে মূসা খাওয়ারযমী (মৃত্যু : ২৩২ হিজরী/৮৪৬ খ্রিস্টাব্দ), আব্বাস ইবনে সাইদ আল-জুওয়াইরী (মৃত্যু : ২২৯ হিজরী/৮৪৩ খ্রিস্টাব্দ), খালেদ ইবনে আব্দুল মালিক আলমারওয়াযী (মৃত্যু : ২৩১ হিজরী/৮৪৫ খ্রিস্টাব্দ), আবুল আব্বাস আহমাদ ইবনে কাসীর আলফারগানী, আলী ইবনে ঈসা আলউসতুরলাবী (মৃত্যু : ২২৪ হিজরী/৮৩৮ খ্রিস্টাব্দ), আহমাদ আব্দুল্লাহ হাবশ আলহাসেব আলমারওয়াযী (মৃত্যু : ২১২ হিজরী/৮২৭ খ্রিস্টাব্দ) সাবেত ইবনে কুররা, সিনান ইবনে সাবেত, ইবরাহীম ইবনে সাবেত, ইবরাহীম ইবনে সিনান (মৃত্যু : ২৯১ হিজরী/৯৩৪ খ্রিস্টাব্দ), আবূ মাশার বলখী, আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনে ঈসা আলমাহানী, আবুল আব্বাস আলফজল ইবনে হাতেম আততাবরিযী (মৃত্যু : ৩১০ হিজরী/৯২২ খ্রিস্টাব্দ) আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনে জাবের সিনান আলহাররানী ওরফে আলবাত্তানী (২৪৪-৩১৭ হিজরী/৮৫৮-৯২৯ খ্রিস্টাব্দ) ইবনে সিনা, ইবনুল হায়সাম, আলবেরুনী, আলখাযেনী (মৃত্যু : ৫১৪ হিজরী/১১৩০ খ্রিস্টাব্দ), কুতবুদ্দীন শিরাযী, কামালুদ্দীন আলফারেসী, ইবনে শাতের (মৃত্যু : ৭৭৭ হিজরী/১৩৭৫ খ্রিস্টাব্দ) মাহমুদ চুগমিনী (মৃত্যু : ৭৩৫ হিজরী/১৩৩৫ খ্রিস্টাব্দ) জামশিদ কাশী, কাজী যাদা রুমী, বাহাউদ্দীন আমেলী (মৃত্যু : ১০৩১ হিজরী/১৫৯৩ খ্রিস্টাব্দ) প্রমুখ। স্পেনের জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মধ্যে আবুল কাসেম মাসলামা ইবনে আহমাদ আলমাজরিতী (মৃত্যু : ৩৭৮ হিজরী/১০০৭ খ্রিস্টাব্দ), ইবনুস সামাহ (মৃত্যু : ৪২৬ হিজরী/১০৩৮ খ্রিস্টাব্দ) আবূ ইসহাক ইবরাহীম ইবনে ইয়াহইয়া আননাক্কাশ ওরফে আযযারকালী (মৃত্যু : ৪৯৩ হিজরী/১১০০ খ্রিস্টাব্দ) জাবের ইবনে আফলাহ, আবুল হাসান আলী ইবনে আবীর রিজাল (মৃত্যু : হিজরী পঞ্চম শতাব্দী/খ্রিস্টিয় একাদশ শতাব্দী) ইবনে বাজা, ইবনে তোফায়ল, ইবনে রুশদ ও আবূ ইসহাক আলবাতরুজীর (মৃত্যু : ৬১৪ হিজরী/১২১৭ খ্রিস্টাব্দ) অবদানের আলোচনা বেশি হয়। এদের মধ্যেও কম জ্যোতির্বিজ্ঞানী আছেন এমন, যাদের কিতাব ও পঞ্জিকা গভীরভাবে যাচাই বাছাই করা হয়েছে।

মুসলমানরা যেসব সম্প্রদায় থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়েছে তাদের কাছেও এ জ্ঞানটির অধিকাংশই ছিল দর্শন পর্যায়ের। গ্রিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের খ্যাতি সর্বত্র ছিল কিন্তু আকাশ ও নক্ষত্র পর্যবেক্ষণের জন্য তাদের কাছে সামান্য যন্ত্রপাতিই ছিল। মুসলমানরা সবার আগে যন্ত্র তৈরি, স্থাপন ও ব্যবহারের দিকে মনোনিবেশ করে জ্যোতির্বিজ্ঞানকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করায়। আলফাযারীই প্রথম ব্যক্তি যিনি اصطرلاب—এ্যাস্ট্রোল্যাব আবিষ্কার করেন। মুহাম্মাদ ইবনে মূসা খাওয়ারযমী এ্যাস্ট্রোল্যাব ও এ্যাস্ট্রোল্যাব তৈরির বিষয়ে দু’টি গ্রন্থ রচনা করেন। আলী ইবনে মূসা আলউস্তুরলাবী এ যন্ত্রের ইতিহাস লেখেন। জাবের ইবনে সিনান মান নির্ণয়ের এমন যন্ত্র আবিষ্কার করেন, যার মাধ্যমে কোণের হিসাব মিনিট পর্যন্ত করা যেত। এ যন্ত্রকে اصطرلاب كروي (Spherical Astrolabe) নাম দেওয়া হয়। এ্যাস্ট্রোল্যাব বিষয়ে অনেক মুসলিম বিজ্ঞানী গ্রন্থ রচনা করেন। যারকালী এর মধ্যে সবচে বেশি উন্নতি সাধন করেন, যা صحيفه زرقالية নামে খ্যাত হয়। সফীহায়ে যারকালিয়া জ্যোতির্বিজ্ঞান রচনায় এমন কীর্তি ছিল, যা জ্যোতির্বিজ্ঞান-ইতিহাসের আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়। আলী ইবনে ঈসা আলউস্তুরলাবী আরেকটি Sextant—সেকসট্যান্ট উদ্ভাবন করেন, যার দ্বারা সর্বনিম্ন দূরত্বের পরিমাপ করা যেত। এছাড়াও মুসলমানরা Triquetrum যন্ত্র, প্রতিবিম্ব যন্ত্র Quardrant I Dioptra তৈরি করে। সঠিক পরিমাপের জন্য ইবনে সিনা একটি যন্ত্র তৈরি করেন। (The Age of Faith P. 248)  

সময় গণনার জন্য মুসলমানরা কয়েক ধরনের ঘড়ি আবিষ্কার করে। ঘড়িতে প্যান্ডুলাম ও দোলকের ব্যবহার মুসলমানরাই প্রথম করে।

ড্রেপারের বর্ণনা হল,

Arabian astronomers also devoted themselves to the construction and prefection of astronomical instruments , to the measurement of time by clocks of various kinds, by clepcydras and sundials, they were the first to introduce for this purpose the use of pendulum. (History of the Conflict Between Religion and Science P. 116 History of the Intellectual Development of Europe Vol. II  P. 49)

আরব জ্যোতির্বিদরা জ্যোতির্বিজ্ঞানের যন্ত্রপাতি আবিষ্কার ও পূর্ণতা সাধনে নিজেদের উৎসর্গ করেন। উপরন্তু তারা বিভিন্ন ধরনের ঘড়ি, পানি ঘড়ি, সূর্য ঘড়ির মাধ্যমে সময় পরিমাপের দিকে মনোযোগ দেন। এ উদ্দেশ্যে সর্বপ্রথম তারাই প্যান্ডুলাম ও দোলকের ব্যবহার করে। গ্রহ-নক্ষত্র বোঝা ও বোঝানোর জন্য তারা স্কাইগ্লোব তৈরি করেন, যার মাধ্যমে তারকারাজি সঠিক দূরত্বে দেখা যেত। ওয়েলডোরান একটি স্কাইগ্লোবের আলোচনা এভাবে করেন,

In 1081 Ibrahim al-Sahdi of valencia constructed the oldest known celestial globe, a brass sphere 209 millimeters (81.5 inches) in dimeter; upon its surface, in fortyseven constellations, were engraved 1015 stars in their respective magnitudes. (The Age of Faith P. 329)

১০৮১ খ্রিস্টাব্দে ইবরাহীম আসসাহদী (সাদী) বেলেনসী তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে সবচেয়ে প্রাচীন গ্লোব তৈরি করেন। পিতলের তৈরি এ গ্লোবের ব্যস ছিল ২০৯ মিলি মিটার (৮১.৫ ইঞ্চি) গায়ে ৪৭ টি তারকাপুঞ্জ খোদাই করা হয়েছিল, যার মধ্যে ১০১৫ টি তারকা সঠিক আয়তনে দেখা যেত।

মুসলমানদের তৈরি যন্ত্রগুলো গুণে ও মানে ছিল উচ্চ পর্যায়ের। বাদশাহ ও আমীর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মানমন্দিরে যেসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার হত, সেগুলো তৈরিতে বেশ অর্থ ব্যয় হত। ওয়েলডোরান মুসলমানদের যন্ত্রপাতি সম্পর্কে লেখেন,

Costly instruments were built for the muslim astronomers: not only astrolabs and armillary spheres, known to the Greeks, but quadrants with a radius of thirty feet, and sextants with a radius of eighty. (The Age of Faith P. 242) ////////////

মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের জন্য মূল্যবান যন্ত্রপাতি তৈরি করা হত। শুধু এ্যাস্ট্রোল্যাব আর গ্লোবই নয়, যা গ্রিকদের জানা ছিল বরং ত্রিশ ফিট ব্যাসার্ধের সিকসটেন্ট বানানো হত। লেখকের বক্তব্য হল এ্যাস্ট্রোল্যাব দশম শতাব্দীতে ইউরোপ পৌঁছে। সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত জাহাজের নাবিকরা ব্যাপকহারে এ যন্ত্রটি ব্যবহার করত। আরবরা এ যন্ত্রটি অসম্ভব সুন্দর করে বানিয়েছিল, যা একইসাথে বিজ্ঞানের যন্ত্র ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় আবদানে পরিণত হয়। (The Age of Faith P. 242)

মারাগা, সমরকন্দ ও ইস্তাম্বুলের মানমন্দিরে ব্যবহৃত যন্ত্রগুলো শৈল্পিক গুণে অনন্য নমুনা ছিল। মারাগায় একটি Wall quadrants (কৌণিক পরিমাপের সাহায্যে উচ্চতা মাপবার যন্ত্র) ছাড়াও নক্ষত্র চলাচল পৃথক পর্যবেক্ষণের বিভিন্ন যন্ত্র ব্যবহার হত। কিছু কিছু যন্ত্রপাতি বিভিন্ন বৃত্তে বিভক্ত ছিল। গ্রহণের পর্যবেক্ষণ যে যন্ত্র দিয়ে হত তা পাঁচটি বৃত্তে বিভক্ত ছিল। সবচে’ বড় বৃত্তটি বারো ফিট প্রশস্ত ছিল। এর মধ্যে সেকেন্ড ও মিনিট দেখা যেত। (The Legacy of Islam P. 396)

 প্রসিদ্ধ প্রাচ্যবিদ Carra de vaux বর্ণনা হল, আরবরা টলেমি ও আলেকজান্ডারিয়ার গ্লোবে পূর্ণতা আনেন। তাতে আরও দুটি হালাকা বৃদ্ধি করেন। (The Legacy of Islam P. 396) রবার্ট ব্রেফাল্টের বক্তব্য অনুযায়ী মুসলমানরা পর্যবেক্ষণের জন্য অত্যন্ত কার্যকর যন্ত্র তৈরি করে, যেগুলো গ্রিকদের যন্ত্রপাতির চেয়েও উন্নত ছিল। সঠিক ও নির্ভুলতায় ছিল ওসবের উর্ধ্বে, যেগুলো ইউরেনবার্গের প্রসিদ্ধ কারখানায় তৈরি করা হয়েছিল।

 (تشکیل انسانیت: ২৬০)

মুসলমানদের মানমন্দিরের ব্যবস্থাপনাগত বৈশিষ্ট্য ও যন্ত্রপাতির শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকারোক্তি ইনসাইক্লোপিডিয়া অফ ইসলামের প্রবন্ধ লেখক D.PINGREE এ শব্দে দেন,

A more fruitful influence of the later Muslim observatories on their neighbours was that exercised by Maragha, Samarkand, and Istambul upon European astronomy; several of the instruments and some of the organisational features of these establishments appeared at Tycho brahe's Uraniborg (1576) and stjernborg (1584) observatories. (The Encyclopaedia of Islam Vol.  III  P. 1138)

পরবর্তীকালের মারাগা, সমরকন্দ ও ইস্তাম্বুলের মুসলিম মানমন্দিরগুলো দ্বারা মিত্র দেশগুলো বেশ প্রভাবিত হয়। ইউরোপীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানে এসব মানমন্দিরের প্রভাব পড়ে। এসব প্রতিষ্ঠানের একাধিক যন্ত্র ও ব্যবস্থাপনাগত বৈশিষ্ট্য ট্যুকো ব্রাহের মানমন্দিরে Uraniborg (১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দ) stjernborg  (১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দ) আপন করে নেওয়া হয়।

ট্যুকো ব্রাহের (১৫৪৬-১৬০১) এই মানমন্দিরগুলো ছিল ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ মানমন্দির, যেগুলোতে ডেনমার্কের এ মহান জ্যোতির্বিজ্ঞানী গবেষণা করতেন। যন্ত্র তৈরিতে মুসলমানদের দক্ষতার খ্যাতি ইউরোপ জোড়া ছিল। ক্যাস্টিলার আলফনসু দশম (Alfonso of castile—1252-1282) একটি ভালো armillary sphere বানানোর মনস্থ করেন, এ কাজের দিকনির্দেশনা লাভের জন্য তাকে আরবদের দ্বারস্থ হতে হয়েছে। রেজিও মন্টেনাস (Regiomontanus)-কে একবার টলেমির একটি যন্ত্র দ্বিতীয়বার বানানোর জন্য আরবদের রচনা ব্যবহার করতে হয়। যেখানে তিনি Alidade (العضادة) সম্পর্কে অবগতি লাভ করেন, যার নামটিই আরবী। (The Legacy of Islam P. 396)

মুসলমানরা গ্রিকদের বিপরীত জ্যোতির্বিজ্ঞানে প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণে জোর দেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা গ্রহ-নক্ষত্রের চলাচল প্রত্যক্ষ করেই কোনো ফলাফল বের করতেন। ওয়েল ডোরান বলেন,

These astronomers proceeded completely on scientific principles; they accepted nothing as true which was not confirmed by experience or experiment. (The Age of faith P. 242)

এই জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা পরিপূর্ণ বৈজ্ঞানিক নিয়ম-নীতি মেনেই অগ্রসর হতেন। প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে না মিললে তা সঠিক বলে মেনে নিতেন না।

অভিজ্ঞতা অর্জন ও পর্যবেক্ষণ বছরের পর বছর অব্যাহত থাকত। এরপর বিশ্বস্ততা ও সতর্কতার সঙ্গে চূড়ান্তরূপে পেশ করা হত। আযযারকালী শুধু সূর্যের শীর্ষবিন্দু জানার জন্য ৪০২ দিন পর্যবেক্ষণ করেছিলেন।

মারাগার মানমন্দিরে কয়েক বছর পর্যবেক্ষণ ও অধ্যয়নের পর زيج أبلخاني প্রস্তুত হয়েছিল। শুধু মারাগায় নয় অধিকাংশ মুসলিম মানমন্দিরে বছরের পর পর্যবেক্ষণের পর ফলাফলে উপনীত হত। রবার্ট ব্রেফাল্ট মুসলমানদের এমন গবেষণার ওপর আলোকপাত করেছেন এভাবে, প্রত্যেক গবেষক স্বাধীন কাজ শুরু করার পরিবর্তে ব্যক্তিগত আগ্রহ ও প্রবণতা একেবারে বিলুপ্ত করার চেষ্টা করতেন এবং অব্যাহত পর্যবেক্ষণ নিয়মতান্ত্রিকভাবে চালু রাখতেন। কখনো দিমাশক, বাগদাদ ও কায়রোর মানমন্দিরে এমন পর্যবেক্ষণ বারো বছর পর্যন্ত অব্যাহত থাকত। তারা নিজ ডায়েরীর শুদ্ধতার প্রতি এতই গুরুত্বারোপ করতেন যে, ডায়েরীতে আইনি হলফ নেওয়ার পর দস্তখত করা হতো।

 تشکیل انسانیت:২৬০)

বিজ্ঞানীরা কখনো কখনো পরস্পরে সিদ্ধান্ত নিত, আগামী গ্রহণ ভিন্ন ভিন্ন শহর থেকে পর্যবেক্ষণ করার। ২৪ মে ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে যে চন্দ্রগ্রহণ হয়েছিল পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আলবেরুনী খাওয়ারযমের কাস শহরে এবং আবুল ওয়াফা বোযজানী বাগদাদে পর্যবেক্ষণ করেন। পরিমাপের সময় যে পার্থক্য বের হয়েছে তার মাধ্যমে কাস ও বাগদাদের দ্রাঘিমা বের করেন।

মুসলমানরা জ্যোতির্বিজ্ঞানের অসংখ্য কিতাব রচনা করেন। এর মধ্যে কম-বেশি একশ’টি কিতাব এমন রয়েছে, যা জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাসে মহা মূল্যবান সংযোজন। এসব কিতাবের বদৌলতে ইউরোপীয়রা জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে। এক্ষেত্রে শুরু যুগের লেখকদের মধ্যে আলফারগানী রচিত المدخل إلى علم هيئة الأفلاك বড় গুরুত্ত্বপূর্ণ রচনা, একে বহু শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপের নির্ভরযোগ্য উৎসগ্রন্থ মানা হত। ওয়েল ডোরান লিখেছেন,

One of them, Abul fargani of Transoxiana wrote (c.860) an astronomical text remained in Europe and western Asia for 700 years. (The Age of Faith P. 242)

এদের মধ্যে আলফারগানী (প্রায় ৮৬০ খ্রিস্টাব্দ) ট্রান্স অক্সিয়ানার অধিবাসী ছিলেন। তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানের একটি কিতাব লেখেন, যা ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়ায় সাতশো বছর পর্যন্ত নির্ভরযোগ্য উৎস ছিল। ড্রেপারের বক্তব্য হল, ইউরোপে জ্যোতির্বিজ্ঞান শুরুর ভিত্তি হল, আলফারগানীর কিতাবের তরজমা। (History of the Intellectual Development of Europe Vol. II  P. 42)

কারা দাউদ আলফারগানীর সম্পর্কে লেখেন,

Al-Fargani (Alfragnus) Is one of the astronomers of time who were known to the medieval west. He belonged to farghana in Transoxiana. His compendium of astronomy, a work much esteemed into Latin by Gerard of Cremona and by johannes Hispalenesis. (The legacy of Islam P. 381)

মধ্যযুগের যে জ্যোতির্বিদদের পশ্চিমারা চিনত তাদের একজন হলেন আলফারগানী। তিনি ছিলেন ট্রান্সঅক্সিয়ানার মানুষ। জ্যোতির্বিদ্যার ওপর তার রচিত গ্রন্থ বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। এর তরজমা করেন Gerard of Cremona ও johannes Hispalenesis।

আব্দুর রহমান আসসূফী রচিত জ্যোতির্বিজ্ঞানের কিতাব الكواكب الثابتة মধ্য যুগের বড় অবদান মনে করা হয়। আব্দুর রহমান আসসূফী রাই শহরে জন্মগ্রহণ করেন। বুআইহী শাসকদের সঙ্গে যুক্ত থেকে তিনি ৩৬৫ হিজরী/৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে স্থির গ্রহগুলো নিয়ে কিতাব রচনা করেন। তাতে ৪৮টি নক্ষত্রপুঞ্জ ছাড়াও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তারকার বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হয়। কিতাবটি সচিত্র। এতে মানুষ ও প্রাণীর আকৃতিতে আকাশের কক্ষপথ দেখানো হয়। কিতাবে একাধিক ম্যাপ ও পঞ্জিকা রয়েছে। তারকার অবস্থান, আয়তন ও বর্ণের ব্যাপারে লেখক বাস্তব পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেন। উজ্জ্বলতার বিবেচনায় তিনি যে তারকার শ্রেণিভাগ করেছেন পরবর্তী জ্যোতির্বিদরাও তার প্রশংসা করেছেন। صور الكواكب الثابتة কিতাব থেকে ইউরোপের জ্যোতির্বিদরা যথেষ্ট সহযোগিতা নিয়েছেন। তেরো শতকের ক্যাস্টিলার আলফনসু দশম নিজ কিতাব রচনা-কালে صور الكواكب الثابتة অধ্যয়ন করেছিলেন। খ্রিস্টীয় পনেরো ও ষোলো শতকে এই কিতাব ভিয়েনা ও ইউরেনবার্গের মানমন্দিরে নির্ভরযোগ্য উৎসগ্রন্থের মর্যাদা লাভ করেছিল। কিতাবটির ল্যটিন অনুবাদ তেরো শতকের পূর্বেই করা হয়েছিল। ১৯৩১ সালে ফ্রেঞ্চ তরজমাসহ প্রকাশিত হয়। ফিলিপ হিট্টির ভাষায়,

a masterpiece of observational astronomy (History of the Arabs P. 376)

এ কিতাব নিঃসন্দেহে জ্যোতির্বিদ্যা পর্যবেক্ষণের অনন্য কীর্তি।

বুআইহী মানমন্দিরে আব্দুর রহমান আসসূফীর একজন সহকর্মী ছিলেন আবুল ওয়াফা বুযজানী, যিনি মহান মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মধ্যে গণ্য ছিলেন। ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে L.A.Sadilot আবিষ্কার করেন, চাঁদের তৃতীয় পরিবর্তন অথবা চান্দ্র প্রকরণ (Lunar variation) সবার আগে আবুল ওয়াফা বোযজানী আবিষ্কার করেন। দুটি পরিবর্তন গ্রিকদের পূর্ব থেকেই জানা ছিল, Sadilot -এর এ তথ্য আবিষ্কারের পূর্বে ইউরোপে তৃতীয় ‘চান্দ্র প্রকরণ’-কে ডেনমার্কের জ্যোতির্বিদ ট্যুকো ব্রাহের আবিষ্কার বলা হত, যিনি আবুল ওয়াফার ৫৪৮ বছর পর জন্মগ্রহণ করেন। ওয়েল ডোরান এ আবিষ্কারের সংক্ষেপে আলোচনা এভাবে করেন-

Working under the patronage of the early Buwayhid rulers of Baghdad, Abu'l-wafa (in the disputed openion of sedillot) discovered the third lunar variation 600 years before Tycho Brahe. (The Age of faith P. 242)

বাগদাদে বুআইহী শাসকদের অধীনে গবেষণাকালে আবুল ওয়াফা (Sadilot  -এর গবেষণা মোতাবেক) ট্যুকো ব্রাহের ছয় শ বছর পূর্বে চাঁদের তৃতীয় প্রকরণ আবিষ্কার করেন।

মুসলমানদের প্রস্তুত করা জ্যোতির্বিজ্ঞানের পঞ্জিকাগুলোও বেশ মর্যাদাশীল। কিছু কিছু পঞ্জিকা পুবে-পশ্চিমে প্রসিদ্ধ। আব্বাসী শাসনামলে মুহাম্মাদ ইবনে মূসা খাওয়ারযামী একটি পঞ্জিকা তৈরি করেছিলেন, দেড়শ বছর পর মাসলামা আলমাজরিতী এ পঞ্জিকা নতুন আঙ্গিকে স্পেনে প্রচলন করেন।

প্রসিদ্ধ পঞ্জিকার মধ্যে زيج الصابي একটি। লেখক, আবূ আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনে জাবের আলবাত্তানী। জন্মগ্রহণ করেছেন হাররানে। তিনি বছরের পর বছর শহরের বাইরে রাক্কায় স্বাধীনভাবে মহাকাশ পর্যবেক্ষণের পর এ পঞ্জিকা প্রস্তুত করেন। ইন্সাইক্লোপিডিয়া অফ ব্রিটানিকা তার ব্যক্তিত্ব ও অবদানের কথা এভাবে স্বীকার করে-

astronomer and mathematician, who found more accurate values for the length of the seasons, for the annual precession of the equinoxes, and for the inclination of the ecliptic. He showed that the position of the sun's apogee, or the farthest point from the earth. is variable and that annular (central but incomplete) eclipase of the sun are possible he  improved Ptolemy's astronomical calculations by replacing geometrical methods with trigonometry. From 877 he carried out many years of remarkable accurate observations at ar-Raqqah in Syssia. He was the best known of Arab astronomers in Europe during the middle ages. His principal written work. a book of astronomical tables. was translated into Latin c.1116 and into Spanish in the 13th century. A printed edition titled De motu Stellrum (on Siellar Motion') was published in 1537. (Encyclopaedia of Britanica Vol. I  P. 962)

তিনি বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও গণিতশাস্ত্রবীদ। বছর ও মৌসুমের দৈর্ঘ, পরিবর্তনের ফলে সূর্যের বিষুবরেখার অতিক্রমণে প্রতি বছর এগিয়ে আসা, আকাশে সূর্যের পরিক্রমণ পথে ঝুঁকে থাকার বিশুদ্ধতম পরিমাণ আবিষ্কার করেন। তিনি বলেছেন, সূর্যের শীর্ষবিন্দুর অবস্থান অথবা পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরতম বিন্দু পরিবর্তনশীল এবং বার্ষিক সূর্যগ্রহণ (কেন্দ্রিয় কিন্তু অসম্পূর্ণ) সম্ভব। তিনি টলেমির পঞ্জিকায় জ্যামিতিক পদ্ধতির বদলে ত্রিকোণমিতি ব্যবহার করে তার সংশোধন করেন। ৮৭৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে রাক্কায় অব্যাহত পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন, যা অনন্য পর্যায়ের সঠিক। মধ্যযুগে তিনি ছিলেন ইউরোপে সবচে’ প্রসিদ্ধ আরব জ্যোতির্বিজ্ঞানী। তার গুরুত্বপূর্ণ রচনা کتاب زیچ  -এর ১১১২ খ্রিস্টাব্দের দিকে ল্যাটিন তরজমা হয় এবং তেরো শতাব্দীতে স্পেনিশ তরজমা হয়। এ বইয়ের মুদ্রিত সংস্করণ On Stellar Motion নামে ১৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়।

দি নিউ কলম্বিয়া ইন্সাইক্লোপিডিয়ায় বলা হয়েছে, আলবাত্তানী টলেমির বর্ণনার সংশোধন ও সংস্কারের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রশিদ্ধ। তার রচিত কিতাব الزيج -এর ল্যাটিন তরজমা মধ্যযুগে অনেক প্রভাবশালী ছিল। কিতাবে জ্যোতির্বিজ্ঞান পঞ্জিকার বেশ সমৃদ্ধ সংগ্রহ রয়েছে। এসবে জ্যোতির্বিজ্ঞানের সুবিস্তৃত প্রায়োগিক বিষয়গুলোর ওপর আলোকপাত করে। (The New Columbian Encyclopaedia  P. 51)

লেখায় আরও বলা হয়েছে,

He recognized the possibility of on annular eclipse of the sun and obtained the very accurate velue of 23.35 for the obliquity of an annular eclipse 23.35  

তিনি  বাৎসরিক সূর্যগ্রহণের সম্ভাবনাকে মেনে নেন এবং গ্রহণরেখা তথা সূর্যের পরিক্রমণ পথের ঝুঁকার সঠিক মান ২৩.৩৫ আবিষ্কার করেন।

 (চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

১.(মাওয়ারাননহর (ট্রান্সঅক্সানিয়া বা ট্রান্সঅক্সিআনা নামেও পরিচিত) মধ্য এশিয়ার অংশবিশেষের প্রাচীন নাম। বর্তমান উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, দক্ষিণ কিরগিজস্তান ও দক্ষিণ-পশ্চিম কাজাখাস্তান জুড়ে এই অঞ্চল বিস্তৃত। ভৌগলিকভাবে এর অবস্থান আমু দরিয়া ও সির দরিয়া নদীদ্বয়ের মধ্যে। রোমানরা একে ট্রান্সঅক্সানিয়া (অক্সাস অববাহিকা) বলত। আরবরা একে বলত মাওয়ারাআননহর (নদীর অববাহিকা)। ইরানীদের কাছে এই অঞ্চল তুরান বলে পরিচিত ছিল। ফারসি মহাকাব্য শাহনামায় তুরান নামটি ব্যবহার হয়েছে। সূত্র : উইকিপিডিয়া। -অনুবাদক)

 

 

 

advertisement