যিলক্বদ ১৪৩৮   ||   আগস্ট ২০১৭

আমার মুহসিন কিতাব

সায়্যিদ সুলাইমান নদবী রাহ.

[গবেষক, পণ্ডিত, ইতিহাসবেত্তা ও সাহিত্যিক আলেমেদ্বীন সায়্যিদ সুলাইমান নদভী রাহ. ২৩ সফর ১৩০২ হিজরী/১৩ ডিসেম্বর ১৮৮৪ সনে বিহারের ‘দিসনাহ’য় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি হযরত হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর বংশধর। ১৯০১ সালে তিনি দারুল উলূম নদওয়াতুল উলামায় ভর্তি হন। ১৯০৭ সালে ফারেগ হন। তখন আন-নদওয়া পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক এবং নদওয়াতুল উলামার আরবী সাহিত্যের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। তারপর কলকাতা গিয়ে মাওলানা আবুল কালাম আযাদের সঙ্গে আল-হেলাল পত্রিকার সম্পাদনা বিভাগে কাজ করেন। ১৯১৪ সালের শুরুর দিকে দাক্ষিণাত্যের পোনা কলেজে ফারসী ভাষার এসিস্টেন্ট প্রফেসর হিসাবে যোগ দেন। সে বছরের নভেম্বরে আল্লামা শিবলী নোমানী রাহ.-এর ইনতিকালের পর দারুল মুসান্নিফীন আযমগড়ে নিযুক্ত হন। ১৯১৬ সালে মাআরিফ প্রকাশ করেন, যা এখনো প্রকাশিত হচ্ছে। ১৯২৩ সালে দারুল উলূম নদওয়াতুল উলামার শিক্ষাসচিব নিযুক্ত হন। ১৯৪৬ থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত ভূপালের প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করেন। তবে নদওয়া এবং দারুল মুসান্নিফীনের সঙ্গে সম্পর্ক অব্যাহত রাখেন। ১৯৫০-এর মাঝামাঝি সময়ে তিনি পাকিস্তান হিজরত করেন এবং করাচিতে বসবাস শুরু করেন। অবশ্য হিন্দুস্তানের রাজনীতি ও স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে তখনও যুক্ত থাকেন। খেলাফত কমিটি, জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ ও কংগ্রেসের মিটিংগুলোতে নিয়মিত অংশগ্রহণ করেন। কয়েকটি সভায় তিনি সভাপতিত্বও করেন। তিনি ছিলেন হযরত থানবী রাহ.-এর বিশিষ্ট খলীফা । তাঁর প্রসিদ্ধ রচনা হল- সীরাতুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, খুতুবাতে মাদরাস, সীরাতে আয়েশা, তারীখে আরদুল কুরআন, আরব ও হিন্দ কে তাআল্লুকাত, আরবূ কি জাহাযরানী, হায়াতে শিবলী। বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী এই আলেমেদ্বীন ১৪ রবিউল আওয়াল ১৩৭৩ হিজরী/২৩ নভেম্বর ১৯৫৩ সালে করাচিতে ইন্তিকাল করেন। তাঁর সমাধি করাচি ইসলামিয়া কলেজ প্রাঙ্গণে।] আমার বড় ভাই মৌলভী হাকীম সায়্যিদ আবু হাবীব মুজাদ্দেদী ছিলেন মাওলানা আবদুল্লাহ গাজীপুরী ও তাঁর শিষ্য মওলবী শাহ আলী নেআমত ভাওয়ালপুরীর ছাত্র। মূলত এই দুই হযরতের প্রভাবেই তিনি ছিলেন সুন্নতের বড় আশেক। তাই সুন্নতের অনুসরণ আর খোদাভীরুতার মাঝেই তাঁর পুরো জীবন কেটেছে। তিনি আমার আঠারো বছরের বড়। ফলে তাঁর আদর ¯স্নেহেই আমি বড় হয়েছি। তাঁরই সার্বিক নির্দেশনায় পড়াশোনা করেছি। আমার মনে আছে, তিনি যখন প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা সমাপ্ত করে বাড়ি এলেন তখন সুন্নত পরিপালনের এক বড় মিশন নিয়ে তিনি কাজ শুরু করলেন। এক পর্যায়ে তিনি দেখলেন, বিদআতের প্রচলন মহিলাদের মাধ্যমে খুব বেশি হয়। তাই প্রথমে আত্মীয় ও গ্রামের মহিলাদের দ্বীনের সহীহ তালীম দেওয়ার উদ্যোগ নিলেন। সপ্তাহে একদিন তাদের জন্য ওয়ায ও বয়ানের ব্যবস্থা করলেন। তখন আমি সবেমাত্র ফারসী শেষ করে মীযান পড়ছি। ছোট ছিলাম বলে পর্দার ভেতরে মহিলাদের ওখানেই বসতাম। শাহ ইসমাঈল শহীদ রাহ.-এর তাকবিয়াতুল ঈমান থেকে তাদের পড়ে শোনাতাম। ভাইজান তখন পর্দার এপাশ থেকে আমার পড়া অংশটুকুর ব্যাখ্যা করতেন। তিনি তাদেরকে বুঝাতে গিয়ে যা বলতেন তা আমার হৃদয়েও গেঁথে যেত। এভাবে কুরআনুল কারীমের পর তাকবিয়াতুল ঈমানই ছিল আমার হাতে আসা প্রথম দ্বীনী কিতাব। এর মাধ্যমেই আমার দ্বীন-শিক্ষার শুরু। আলহামদু লিল্লাহ সেই শিক্ষা ছিল বড় মজবুত। যার ফলে পরবর্তী জীবনের অধ্যয়নে যখন বিভিন্ন ধরনের কথা, নানা রকমের ব্যাখ্যা সামনে এসেছে তখনও ভেতরে শেকড় গেড়ে বসা সেই কিতাবের শিক্ষা নড়চড় হয়নি। একসময় তো ইলমে কালামের নানা বিষয়, আশআরী-মুতাযিলাদের মতানৈক্য, রাযী, গাযালী ও ইবনে রুশদ রাহ.-এর বহু দলীল প্রমাণ সামনে এসেছে। কিন্তু শাহ সাহেবের সেই কিতাবের প্রভাব আপন জায়গায়ই ছিল স্থির। ১৯০১ সালে আমি দারুল উলূম নদওয়াতুল উলামায় দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হলাম। সেখানে যাওয়ার সময় বাড়ি থেকে কিছু কিতাব সঙ্গে নিয়েছিলাম। তন্মধ্যে হাদীসের মূলনীতি বিষয়ে ছিল শাহ আবদুল আযীয মুহাদ্দিসে দেহলবী রাহ.-এর ‘উজালায়ে নাফেয়াহ’। উসূলে হাদীসের এই সংক্ষিপ্ত ফারসী কিতাবটি পড়েই হাদীসশাস্ত্রের প্রতি আমি আগ্রহী হয়ে উঠি। এরপর এক সময় নদওয়ার কুতুবখানায় শাহ সাহেবের ‘বুসতানুল মুহাদ্দিসীন’ কিতাবটি দেখি। সেটিও খুব আগ্রহের সঙ্গে পড়ি। সেই কিতাব পড়ার পর মুহাদ্দিস ইমামগণের মধ্য থেকে ইমাম মালেক রাহ.-এর প্রতি আমার হৃদয়ে গভীর মহব্বত সৃষ্টি হয়। সেইসঙ্গে তাঁর কিতাব মুআত্তার প্রতিও আগ্রহ জন্মে। ওদিকে নদওয়ার ‘দারুল মালুমাতে’ আলাদা করে কিছু কিতাব রাখা ছিল। হাফেয যাহাবী রাহ.-এর ‘তাযকিরাতুল হুফফায’ কিতাবটিও ছিল সেখানে। এই কিতাব পড়ে মুহাদ্দিস মনীষীদের কর্ম-কীর্তির এক আশ্চর্য জগৎ সম্পর্কে ধারণা পাই। এভাবেই ইলমুল হাদীস ও ইমাম মালেক রাহ.-এর প্রতি আমার আগ্রহ বাড়তে থাকে। যার ফলে ১৯০৫ সালে আমার সর্বপ্রথম যে লেখা আন-নদওয়ায় ছাপে তা ছিল ইলমুল হাদীস বিষয়ে। আল্লাহর হুকুমে বড়রা তখন সে লেখার এত প্রশংসা করেন যে, আমার হিম্মত এবং এই শাস্ত্রের প্রতি আগ্রহ আরো বেড়ে যায়। পরে আমার সর্বপ্রথম রচনাও হয় এই শাস্ত্রে। ‘হায়াতে ইমাম মালেক’ নামে। শেষ বছরের কথা। বুখারী শরীফের ছবক শুরু হয়েছে। সহপাঠীদের মধ্যে তখন কয়েকজন ছিল ফিকহে আগ্রহী। মজবুত হানাফী। আবার কারও ছিল হাদীসের প্রতি ঝোঁক। আমি ছিলাম দ্বিতীয় দলে। শ্রেণিকক্ষে প্রতিদিনই দু’দলের মাঝে তীব্র রকমের প্রশ্নোত্তর পর্ব চলত। তখন প্রত্যেকেই নিজ নিজ বক্তব্যের পক্ষে বিভিন্ন কিতাবের সহায়তা নিত। আমাদের দ্বিতীয় পক্ষ খুঁটি হিসেবে গ্রহণ করত ইমাম তাহাবী ও হাফেয আইনী রাহ.-কে। আর আমি হাফেয ইবনে হাজার রহ.-কে আশ্রয় বানাতাম। সে সূত্রেই তখন ফাতহুল বারীর ভূমিকা মুতালাআ করি। সেই মুতালাআকে কেন্দ্র করে ইমাম বুখারী রাহ.-কে নিয়ে একটি প্রবন্ধও লিখি যা ১৯০৬ সালে আন-নদওয়ায় ছাপে। একসময় হাদীসশাস্ত্রের এই আগ্রহ আমাকে নিয়ে গেছে রিজাল শাস্ত্রের দিকে। রিজাল শাস্ত্র নিয়ে গেছে ইতিহাসের দিকে। সেই সূত্রে ইবনুন নাদীম রাহ.-এর ‘আল-ফিহরিস্ত’, হাজী খলীফা রাহ.-এর ‘কাশফুয যুনূন’ ও ইবনে খাল্লিকানের ‘ওফায়াত’ মুতালাআ করি। ইবনে খাল্লিকানের এই কিতাব তখন এতবার মুতালাআ করি যে, তার উপর লেখা আমার বিভিন্ন টীকা আর গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোর উদ্ধৃতিতে কিতাবটির শুরু শেষের খালি পৃষ্ঠাগুলো ভরে যায়। এরপর ১৯০৮ সালে মাওলানা শিবলী নুমানী রাহ. হায়দারাবাদ সফর থেকে ফিরে এসে ইংরেজ বা ফরাসী এক অনুবাদকের একটি পর্যালোচনাপত্র দেখান। ইবনে খাল্লিখানের ওফায়াতের উপর লেখা সেই পর্যালোচনার প্রশংসা করে তিনি বলেন, দেখো, ‘ইউরোপিয়ানরা কত সূক্ষ্মদৃষ্টিতে কিতাব মুতালাআ করে’। এ কথা শুনে আমার মনে খুব চোট লাগল। ফলে এরচে’ অনেক ভালো একটি পর্যালোচনা আমি লিখলাম, যা আন-নদওয়ায় তখন ছাপা হয়। একটি কথা বলতে ভুলে গেছি। বিহারের নায়েবে আমীরে শরিআত মাওলানা মুহাম্মাদ সাজ্জাদ সাহেবের উস্তায ও শ্বশুর মাওলানা ওয়াহিদুল হক রাহ.-এর একটি ছোট কিতাব ছিল ‘মুগনিস সিবয়ান’। কিতাবটি আমার হাতে আসে আমাদের নিকটবর্তী এলাকা ‘ইস্তানওয়া’য়। তাতে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন আরবী শব্দ ছিল অর্থসহ। যা আমার জন্য তখন অমূল্য সম্পদ। তাই নিজ হাতে কিতাবটির একটি নুসখা আমি লিখে নিই। এরপর পুরো কিতাব মুখস্থ করে ফেলি। সেটাই ছিল আমার আরবী সাহিত্যের প্রথম ধাপ। এরপর যখন এই বিষয়ে কিছু কাজ করার চিন্তা মাথায় আসে তখন এই কিতাবের ছাঁচেই প্রথম কিতাব লিখি ‘দুরুসুল আদব’ নামে। আমার আরবী সাহিত্যের উস্তায ছিলেন মাওলানা ফারূক সাহেব ও মাওলানা সায়্যিদ আবদুল হাই রাহ.। তাঁরা দুজনই ছিলেন আধুনিক ধারার সাহিত্যের পক্ষে। তাই পরে যখন মাওলানা শিবলী নুমানী রাহ.-এর কাছে জুরজানীর ‘দালাইলুল ইজায’ পড়ার সুযোগ হয় তখনই প্রথম দেখি প্রাচীন ধারার রচনা। তাই খুব আগ্রহের সঙ্গে কিতাবটি পড়ি এবং সেই ধারা অনুসরণ করার চেষ্টা করি। অল্পকিছু আরবী বলার ও লেখার প্রস্তুতি যখন হল তখন হাতে পেলাম ‘দেওয়ানে হামাসা’ ও ‘নকদুশ শের’। কিতাবদুটি তখন আমার সে প্রস্তুতি ও আগ্রহে যেন ভিন্ন গতি আনল। ফলে তাঁদের অনুকরণে কিছু কবিতাও তখন লিখলাম। ইলমে কালামের প্রতি যেটুকু আগ্রহ ছিল তার সবটুকুই ছিল মাওলানা শিবলী নুমানী রাহ.-এর সান্নিধ্যের প্রভাবে। তখন তাঁর রচনা পড়তাম। তাঁর উদ্ধৃত কিতাব খুলে দেখতাম। সেইসাথে শাহরাস্তানি রাহ.-এর ‘আল-মিলাল ওয়ান-নিহাল’ এবং ইবনে হাযম রাহ.-এর ‘আল-ফিছাল ফিল মিলালি ওয়ান-নিহাল’ অধ্যয়ন করতাম। এরপর যখন ইবনে রুশদ রাহ.-এর ‘কাশফুল আদিল্লাহ’ আর শাহ ওয়ালি উল্লাহ রাহ.-এর ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ’ অধ্যয়ন করলাম তখন এই কিতাবগুলো যেন আগের অধ্যয়নকে আরও রাঙিয়ে দিল। এক সময় আল্লামা ইবনে তাইমিয়া ও হাফেয ইবনুল কায়্যিম রাহ.-এর রচনাবলি মুতালাআ করতে শুরু করলাম। তখন মনে হল যেন তাঁদের রচনাগুলো আগের সব অধ্যয়নের রঙ মলিন করে দিয়েছে। এক পর্যায়ে কুরআনের আলো আমার চোখে পড়ল। এ আলো প্রথম দেখালেন মাওলানা শিবলী নুমানী রাহ.। মাওলানা হামীদুদ্দীন রাহ.-এর সান্নিধ্যে এসে সে আলো আরো উজ্জ্বল ও তীব্রভাবে অনুভূত হল। ফলে সীরাতে নববী লিখতে গিয়ে সব আলোচনাকেই কুরআনের ভিত্তিতে নির্মাণ করলাম। আর হাদীসে নববী দিয়ে কেবল তার নকশা আঁকলাম। এখন এ দুটিই আমার পুঁজি। এ দুটিই আমার পাথেয়। একটি মূল অপরটি তার ছায়া। একটি ‘ওহীয়ে জলী’ অপরটি ‘ওহীয়ে খফী’। একটি দলীল অপরটি তার উপসংহার। দুটিকে যে ভিন্ন মনে করে ভিন্ন চোখে দেখে সত্যিই সে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ। ভাষান্তর : তাওহীদুল ইসলাম তায়্যিব

 

 

advertisement