জুমাদাল উলা ১৪৩৯   ||   ফেব্রুয়ারি ২০১৮

উম্মাহ : আসামে দুর্যোগের ঘনঘটা

আবদুল্লাহ নাসীব

পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ‘গণতান্ত্রিক’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাষ্ট্র ভারতে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার আরেকটি নমুনা দেখা যাচ্ছে বৃহৎ দেশটির আসাম রাজ্যে। এখানে শুরু করা হয়েছে নাগরিকত্বের জাতীয় নিবন্ধন (এনআরসি)। দেশটির অন্য কোনো রাজ্যে এই নিবন্ধন না হলেও আসাম রাজ্যে তা করা হচ্ছে এবং প্রাথমিক খসড়া তালিকা থেকে ১ কোটি ৩৯ লাখ লোকের নাম বাদ পড়েছে। উল্লেখ্য, ভারতের সকল রাজ্যের মধ্যে আসাম হচ্ছে দ্বিতীয় রাজ্য, যাতে বিপুলসংখ্যক মুসলিমের বাস। গোটা ভারতের জনসংখ্যার ৮০% হিন্দু, ১৪% মুসলমান ও অবশিষ্ট ৬% খ্রিস্টান, শিখ ও বৌদ্ধ। আর এ রাজ্যের অধিবাসীদের ৩৪% মুসলিম। একারণে বিপুলসংখ্যক মুসলিমঅধ্যুষিত আসাম রাজ্যে নাগরিকত্বের নিবন্ধনের নামে আসলে কী ঘটতে যাচ্ছে তা যথার্থই আশঙ্কাজনক। রাজ্যের ক্ষমতায় থাকা বিজেপির বক্তব্যও দায়িত্বপূর্ণ নয়। আসাম বিজেপির সাধারণ সম্পাদক ও মুখপাত্র রুপম গোস্বামী বলেছেন, ‘এতে বিজেপির কোনো হাত নেই। নাগরিকত্ব প্রক্রিয়ার পুরোটাই চলছে খোদ সুপ্রিম কোর্টের তদারকিতে।’ অথচ বিজেপি গত বছরের মে মাসে রাজ্য-সরকার গঠনের পরই ‘অনুপ্রবেশকারীরা’ স্থানীয় হিন্দুদের কর্মসংস্থান নষ্ট করছে দাবি করে ‘অবৈধ’ মুসলিমদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। সম্প্রতি বিজেপির রাজ্য-সভাপতি রঞ্জিত কুমার দাস সাংবাদিকদের বলেছেন, ২০১৪ সালের আগ পর্যন্ত আসামে আসা হিন্দুরা নিশ্চিন্ত। তবে ‘বিদেশি’ মুসলমানদের রাজ্য ছাড়তে হবে। বিজেপির জোট শরীক আসাম গণপরিষদের রাজ্য সভাপতি অতুল বরার দাবি, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর যাঁরাই আসামে অনুপ্রবেশ করেছে, জাতি ধর্ম নির্বিশেষে তাদের রাজ্য ছাড়তে হবে।’ কাজেই বাংলাদেশের প্রথম আলোর বিশ্লেষণ এক্ষেত্রে ভুল নয়- ‘বিষয়টি আইনি নয়, একান্তভাবেই রাজনৈতিক।’ (প্রথম আলো ০২-০১-২০১৮ সম্পাদকীয়) আর বিজেপির রাজনীতি যে সম্পূর্ণ হিন্দুত্ববাদী ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের দেশের একশ্রেণির মিডিয়া প্রতিবেশী দেশের উগ্র সাম্প্রদায়িক দৃষ্টান্তগুলোকেও ‘সাম্প্রদায়িকতা’ আখ্যা দিতে কুণ্ঠাবোধ করে থাকে। পক্ষান্তরে স্বদেশের খাঁটি রাজনৈতিক ঘটনাগুলোকেও নির্দ্বিধায় সাম্প্রদায়িক ঘটনা বলে ব্যাখ্যা করে থাকে। প্রশ্ন হচ্ছে, অন্তত নামধামে যে ধর্মের তারা অনুসারী সেই ধর্মের প্রতি তাদের যদি কোনো হৃদ্যতা যদি না-ও থাকে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমের ধর্মের প্রতিও যদি কোনোরূপ শ্রদ্ধাবোধ না থাকে, দেশের ভাবমর্যাদার প্রতিও কি কোনো দায়-দায়িত্ব নেই? কেউ তো বলছে না যে, দেশের ভাবমর্যাদা রক্ষার স্বার্থে অন্যায় গোপন করুন, কিন্তু অসত্য অবাস্তব বিশ্লেষণ দ্বারা দেশ ও জাতির ভাবমর্যাদা যারা ক্ষুণ্ন করেন, অন্যান্য জাতি-সম্প্রদায়ের সামনে স্বজাতি ও স্বদেশকে খাটো করে পুলকিত বোধ করেন তারা আবার দেশপ্রেমের কথা উচ্চারণ করেন কীভাবে? এটা কী ধরনের দেশপ্রেম? তারা দয়া করে জাতিকে জানাবেন কি- তাদের দেশপ্রেমের সংজ্ঞা ও স্বরূপ আসলে কী? তথাকথিত দেশপ্রেমিকেরা তাদের দেশপ্রেমের স্বরূপ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে থাকুন, আমরা এই অবসরে অন্যদিক থেকে কিছু কথা বলি। আমরা মনে করি, সম্প্রতি ভারতের আসামে যা ঘটছে, তা নতুন কিছু নয়। এটা ঐ জাহেলী ধারারই সমকালীন দৃষ্টান্ত, যা যুগ যুগ ধরে ইসলাম ও মুসলমানের বিরুদ্ধে চলে আসছে। মুসলমানদের কর্তব্য, সমকালীন ভাষা ও পরিভাষার গোলক ধাঁধায় চক্কর না খেয়ে বর্তমানকে নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের আলোকে মূল্যায়ন করা। কে না জানে যে, মুসলমানদের শুধু ধর্মীয় ও আদর্শগত পরিচয়ের কারণে সীমাহীন জুলুম-অত্যাচারের শিকার হতে হয়েছে। আপন মাতৃভূমি থেকে উচ্ছেদের ব্যাপারটি তো স্বয়ং শেষনবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনেই ঘটেছে। তাঁকে মক্কানগরী থেকে হিজরত করতে হয়েছে, মক্কার শ্রেষ্ঠ অধিবাসীদেরকেও ঐ ভূখ- থেকে হিজরত করতে হয়েছে। দ্বীন ও আদর্শের বিরোধী পৌত্তলিক গোষ্ঠীর এই অন্যায়-অবিচার তাই নতুন নয়। শুধু আল্লাহর শেষ রাসূল হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নন, তাঁর পূর্বসূরি নবী-রাসূল ও তাঁদের প্রতি ঈমান আনয়নকারী আল্লাহর বান্দাদের প্রতিও পৌত্তলিক ও অবিশ্বাসী সম্প্রদায়ের আচরণও ছিল এমনই- অন্যায়, অযৌক্তিক ও উদ্ধত। কুরআন মাজীদের মনোযোগী পাঠকের এই সত্য অজানা নয়। বর্তমানে মুসলিম জাতির সাথে দেশে দেশে পৌত্তলিক ও অমুসলিম জাতি-গোষ্ঠীর যে অন্যায়-অবিচার তা আমাদের সামনে কুরআন-সুন্নাহর সেইসব বৃত্তান্তেরই সমকালীন দৃষ্টান্ত উপস্থিত করছে। এইসব মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক দৃষ্টান্ত অতীতকালের পৌত্তলিক জাতি-গোষ্ঠীর মানসিক ও চারিত্রিক অবস্থাও আমাদের সামনে প্রত্যক্ষ করে তুলছে। এখন ভারতের আসাম রাজ্যে যা ঘটছে, অনুরূপ ব্যাপারই ঘটেছিল মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে। রোহিঙ্গা-মুসলিমদেরকে তাদের মাতৃভূমি থেকে উৎখাতের জন্য প্রথমে তাদের নাগরিকত্ব ছিনিয়ে নেয়ার কৌশলই অবলম্বন করা হয়েছিল। সেই একই পন্থার পুনারাবৃত্তি দেখা যাচ্ছে ভারতের আসাম রাজ্যে। এ কারণে বিজেপির মন্ত্রী-এমপিরা যখন আশ্বস্ত করবার জন্য বলছেন, এটি একটি খসড়া তালিকামাত্র। চূড়ান্ত তালিকা থেকে ‘বৈধ’ নাগরিকেরা কেউ বাদ পড়বে না তখন তা মুসলিমদের আরো বেশি উদ্বিগ্ন করছে। কারণ বৈধতা-অবৈধতার মানদ-ই যখন পরিবর্তন হয়ে যায় তখন এই সকল শব্দ-বাক্যই অন্যায়-অবিচারের আশঙ্কা ঘনীভূত করে। এখন আসাম রাজ্যেও ক্ষমতায় তারাই, যারা কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন। অর্থাৎ নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি। মোদীর গুজরাটের ইতিহাসও আসামের মুসলিমদের ভবিষ্যত সম্পর্কে শঙ্কিত হওয়ার এক বড় কারণ। ইসলাম আমাদের যে ভ্রাতৃত্ববোধের শিক্ষা দান করেছে সে হিসেবে কোনো মুসলিমই এখন নিশ্চিন্ত ও নিশ্চেষ্ট থাকতে পারে না। একইভাবে যারা স্বদেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতার ব্যাপারে সংবেদনশীল তাদেরও উদ্বিগ্ন না হয়ে উপায় নেই। কারণ আসামের মুসলিমদের অভিহিত করা হচ্ছে ‘বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী’ বলে। এই প্রচার অনেক আগে থেকেই হচ্ছে। বাংলাদেশ যেমন আমাদের স্বদেশ তেমনি তা একটি বৃহৎ মুসলিম ভূখণ্ড। এই ভূখণ্ডের শান্তি-স্থিতিশীলতার ব্যাপারে সচেতন থাকা তাই দুই দিক থেকেই জরুরি। প্রতিবেশী বৃহৎ দেশটির বন্ধুত্বের মৌখিক বুলির বিপরীতে এ দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা, উন্নতি-অগ্রগতি পরিপন্থী নানা তৎপরতার তাৎপর্যও এখানেই নিহিত। অর্থাৎ এই ভূখণ্ডটি একটি মুসলিমসংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল হওয়ার মধ্যেই নিহিত। কাজেই এই ভূখণ্ডের মুসলমানদের যেমন অন্যান্য ভূখণ্ডের মুসলিম ভাই-বোনের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হতে হবে তেমনি স্বদেশ ও স্বদেশবাসী মুসলিমদের শান্তি ও নিরাপত্তা, পার্থিব ও পারলৌকিক উন্নতি-অগ্রগতির ব্যাপারেও সচেতন ও কর্মনিষ্ঠ হতে হবে। এক্ষেত্রেও ঈমানদার জনগণই আস্থা ও ভরসার জায়গা। কারণ এক পরীক্ষিত বাস্তবতা হচ্ছে, মুসলিম ভূখণ্ডে দেশপ্রেমের দাবি ঈমান ও ইসলাম ছাড়া যথার্থ হয় না।

 

 

advertisement