রবিউল আউয়াল ১৪৩৯   ||   ডিসেম্বর ২০১৭

‘মূল বিষয় হল মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়ানো’

আব্দুল্লাহ

[গত কুরবানী ঈদের আগের রাতে আলকাউসারের অফিসে এলেন ভাই আব্দুল্লাহ (ছদ্মনাম ‘আল্লাহর বান্দা’ অর্থে)। আর্থিক অনটনের কারণে তিনি খ্রিস্টান মিশনারীদের অপতৎপরতার শিকার হয়ে গিয়েছিলেন। দীর্ঘ দশ বছরেরও বেশি সময় নিজেও মিশনারী কাজে জড়িত থাকার পর আল্লাহ তাআলা তাঁকে হেদায়েত দান করেন। কিছু মুখলিস আলিমের মাধ্যমে তিনি ইসলামের দিকে ফিরে আসেন। তার বিগত জীবনের অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি তিনি আলকাউসারের সাথে অকপটে বলে গেছেন। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন, মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া আবদুল্লাহ, মাওলানা মুহাম্মাদ ফজলুল বারী ও মাওলানা আনোয়ার হুসাইন। মুসাজ্জিলা থেকে তা পত্রস্থ করেছেন ওলী আমীন মুহাম্মাদ খাইরুল বাশার। আল্লাহ তাআলা সকলকে জাযায়ে খাইর দান করুন। সেই কথোপকথনের চুম্বক অংশ আলকাউসারের পাঠকদের সামনে উপস্থাপিত হল। আল্লাহ তাআলা সকলকে উপকৃত করুন- আমীন। -সম্পাদক] আলকাউসার : আমরা খুবই আনন্দিত। আপনার সাথে সাক্ষাৎ হল। আল্লাহ তাআলা আপনাকে ইসলামের ছায়াতলে নিয়ে এসেছেন। আলহামদু লিল্লাহ। আমরা আপনার কাছ থেকে কিছু শুনতে চাই। আব্দুল্লাহ : আমার নাম মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ। হোম ডিস্ট্রিক্ট জামালপুর। আমার এলাকার খ্রিস্টীয় প্রচারক ছিলেন জেমস কুলিন বিশ্বাস। ১৯৯১ সালে তার মাধ্যমেই আমি ঈসায়ী হয়েছিলাম। সংস্থার নাম ছিল খ্রিস্টান লাইফ বাংলাদেশ (সিএলবি)। ঐ সময় আসলে আমি বেকার ছিলাম। আমি বাবার বড় ছেলে। বাবা মারা যান। বাবা মারা যাওয়ার পর অর্থনৈতিকভাবে সমস্যায় পড়ে যাই। খ্রিস্টান ধর্ম কী জিনিস আসলে বুঝিইনি। মূলত ঐ সময় আমার চিন্তা ছিল, কীভাবে সংসার চলবে। কীভাবে নিজে লেখা-পড়া করব। ঐ সময় তারা আমাকে একটা চাকরির লোভ দেখায়- আপনার সংসারে অভাব থাকবে না, আপনার সংসার ভালোভাবে চলবে। টেনশন করতে হবে না। এসব বলে আমাকে নিয়েছে। আলকাউসার : আপনি কোথায় চাকরি করতেন তখন? আব্দুল্লাহ : আমি চাকরি করতাম সিএলবি তে। ওখানে সিএলবিতে যিনি ট্রেনিং ডিরেক্টর ছিলেন তিনি খ্রিস্টান লাইফ ছেড়ে দিয়ে প্রেসবাইটারিয়ান নামক মিশনে শিক্ষক হিসাবে আসেন, উত্তরায়। পরে তিনি আমাকে বলেন, আপনিও যেহেতু মুসলিম থেকে কনভার্ট হয়েছেন, আমিও মুসলিম থেকে কনভার্ট হয়েছি, একটা মিল তো আমাদের আছে, সুতরাং এখান থেকে আপনি একটা ট্রেনিং নেন। পরে আমি এক বছরের একটা ট্রেনিং করেছি। আলকাউসার : সিএলবিতে আপনার কী কাজ ছিল? আব্দুল্লাহ : ওখানে আসলে কাজ ছিল ফিল্ম টিমে। ফিল্ম টিম যীশু খ্রিস্টের ছবি দেখায়। কিন্তু আমি তা দেখাইনি। আমার ভয় করত এবং বিভিন্ন কারণে আমি নিজেকে প্রকাশ করতে চাইনি; আমার আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধু-বান্ধব কী বলবে! আলকাউসার : যিশু খ্রিস্টের ছবি দেখানো? আব্দুল্লাহ : জ্বী, তাদের প্রজেক্টর মেশিন আছে। মেশিনের মাধ্যমে পর্দায় দেখায়। যেমন পরিবার-পরিকল্পনার ছবি দেখায়, ঐ রকম। আলকাউসার : এটা কোথায় দেখানো হয়? আব্দুল্লাহ : গ্রামে-গঞ্জে দেখানো হয়। এলাকাভিত্তিক। মানে যে এলাকায় আমাদের পাঠাবে ঐ এলাকার কোনো বাড়িতে সিনেমার মত দেখানো হয়। যেমন আপনার বাড়িতে গেলাম, আপনার বাড়িতে একটা পর্দা লটকিয়ে কিছু সামাজিক ছবি দেখালাম, তারপর ঐ ছবিগুলো দেখালাম। এটা ভ্রাম্যমান। আলকাউসার : কোন্ এলাকা বা অঞ্চল আপনার দায়িত্বে ছিল? আব্দুল্লাহ : আমাদের এলাকা ছিল টাঙ্গাইল। কিন্তু আমি ওখানে দেখাতাম না। কারণ ঐ দিকেও আমাদের আত্মীয়-স্বজন আছে। আলকাউসার : এই টিমটার নাম ছিল ফিল্মটিম, এই রকম টিমে কয়জন ছিল আপনার সাথে? আব্দুল্লাহ : আমার সাথে ছিল দুই জন। একজন হিন্দু থেকে কনভার্ট হয়েছে। আমাদের তিন জনের দায়িত্ব ছিল এলাকায় গিয়ে গিয়ে এটা দেখানো। কিন্তু আমি যেতাম না। তারা দুই জন কাজ করত। ওখানে উপজেলাভিত্তিক তাদের যে স্কুল আছে আমি সেখানে ক্লাশ নিতাম। সপ্তাহে দুই তিন দিন ক্লাশ নিতাম। আর আমি লেখা-পড়া করতাম। আমাদের সেলারী দিত। আলকাউসার : ওখানে কোন্ ক্লাশ পর্যন্ত ছিল? আব্দুল্লাহ : পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত ছিল। আলকাউসার : ওখানে আপনাকে কী পরিমাণ সেলারী দিত? আব্দুল্লাহ : পনের শত টাকা। আলকাউসার : পনের শত টাকা দিয়ে আপনার কী হত! আব্দুল্লাহ : তখন তো পনেরশ টাকায় আমার সংসার মোটামুটি চলতো। দুইশ, দেড়শ টাকা মন চাউল ছিল। ১৯৯১ সালের ঘটনা। প্রায় ছাব্বিশ বছর আগের কথা। আলকাউসার : আপনি বলছেন আপনার ভয় বা সংকোচ হত। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু ওদের কাজকর্মগুলো কি সম্পূর্ণ ওপেন? আব্দুল্লাহ : না, পুরা ওপেন না। ওরা ট্রেনিংগুলো করাতো একটা রুমের মধ্যে। তাদের মধ্যে অনেক শিক্ষক আছে, যারা বিদেশ থেকে লেখা-পড়া করে এসেছে। আলকাউসার : সিএলবির (খ্রিস্টান লাইফ বাংলাদেশ)-এর শাখা কোথায় কোথায় আছে? আব্দুল্লাহ : শাখা সারা বাংলাদেশেই আছে। আলকাউসার : কিন্তু এগুলোর নাম তো খুব একটা শোনা যায় না। আব্দুল্লাহ : ওরা তো গোপনেই কাজ করে বেশি। প্রচারক যারা, তারা গোপনে কাজ করে, এলাকাভিত্তিক কাজ করে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করে। কলেজ লাইফ শেয়ারিং লোক আছে। বিশ^বিদ্যালয়ে শেয়ারিং-এর জন্য লোক আছে। আমি অত বড় পোস্টে যেতে পারিনি। আমাকে ছোটখাট পোস্ট দিয়েছে। আলকাউসার : শেয়ারিং বলতে কি আলাপ-আলোচনা করার জন্য আলাদা টিম? আব্দুল্লাহ : জ্বী! টিম আছে। ওরা ঐ সমস্ত বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা চাকরি করে তাদের আলাদা টিম, যোগ্যতাও বেশি। তারপর কলেজ লাইফ শেয়ারিং, কলেজে যারা কাজ করে তাদের যোগ্যতাও বেশি। আলকাউসার : এটা কি কলেজের ছাত্রদের মধ্য থেকেই নাকি বাইরের লোক দিয়ে? আব্দুল্লাহ : হ্যাঁ, কলেজের ছাত্রদের মধ্যেই। ছাত্রদের মধ্যেই এই রকম টিম তৈরি করে নিয়েছে ওরা। আলকাউসার : এগুলোর কোনো সমন্বয় হয় না? যেমন মনে করেন, বিভিন্ন কলেজ-ভার্সিটিতে যেসকল টিম তৈরি করা হয়েছে, এদের কোনো সম্মেলন বা সমন্বয়? আব্দুল্লাহ : জ্বী! এদের সম্মেলন হয়। যেমন ধরেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি টিম পাঠানো হল বা দুইটা টিম পাঠানো হল। কিংবা টঙ্গি কলেজে একটা টিম পাঠাল। সব জায়গায় তো দেয়া সম্ভব না। সাপোর্টের ব্যাপার আছে। তো যেখানে যেখানে টিম পাঠানো হল, ওরা এক মাসে কতগুলো লোকের সাথে শেয়ারিং করেছে, কতগুলো লোক হা বোধক, কতগুলো লোক না বোধক উত্তর দিয়েছে এর জন্য মাসে মাসে রিপোর্ট দেওয়া হত। রিপোর্ট ফরম ছিল। মাস শেষে একটা রিপোর্ট নিত। আলকাউসার : সিএলবি ছাড়া আর কোনো প্রতিষ্ঠানে কি কাজ করেছেন? আব্দুল্লাহ : জী, সিএলবি থেকে পরে আমি এসে যাই প্রেস বাইটারিয়ানে। সেখানে আমি কুড়িগ্রাম ছিলাম। সেখান থেকে দুই মাস আগে এসে গেছি। আমাকে ওখানে প্রজেক্ট ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছিল। আলকাউসার : ওখানে আপনার কী দায়িত্ব ছিল? আব্দুল্লাহ : ওখানে একটা চার্চ আছে। চার্চ পরিচালনা করা। আর ফোর বিঘা প্রজেক্ট-স্কুল আছে, ওখানে মূলত ছয়/সাত বিঘা জমি আছে। কাগজ-কলমে ফোর বিঘা প্রজেক্ট। ওখানে চারটা বিষয়ের উপর কাজ হয়। রিলিজিয়ন প্রোগ্রাম, ফিশারিজ প্রোগ্রাম, কৃষি প্রোগ্রাম আর এডুকেশন প্রোগ্রাম- চারটা প্রোগ্রাম বা কাজ হয়। সবগুলোর দেখা-শুনা আমি করতাম। সবগুলোরই আমি ম্যানেজার ছিলাম। আলকাউসার : এগুলোর দরকার কী? চার্চে এই প্রোগ্রামগুলোর দরকার কেন? আব্দুল্লাহ : এই প্রোগ্রামগুলোর জন্য তো ফান্ড আছে। তাছাড়া এগুলো তাদের আয়ের একটি উৎস। যেমন ধরেন, ছয় বিঘা জমি কিনেছে। আরো দশ বিঘা পেলে আরো দশ বিঘা জমি কিনবে। এর দ্বারা স্থানীয়ভাবে তারা ওখানে মিশন পরিচালনা করতে পারছে। বাংলাদেশের মধ্যে নিজেদের একটা এরিয়া নিয়ে নেয়া। মিরপুর, মাগুরা, বরিশাল এরকম বিভিন্ন জায়গায় তাদের প্রোগ্রাম আছে এবং জমি কিনছে। সারা বাংলাদেশে বিভিন্ন জায়গায় জমি কিনে স্থায়ীভাবে তারা স্কুল চালু করে, তারপর চার্চ ওঠায়- এরকম। মোটকথা, এলাকায় কাজকর্ম করার জন্য স্থায়ী একটা কেন্দ্র। এগুলো না করলে তো দেখা যাবে, মিশনের দুই-চারজন মানুষ গেল বা এক-দুইটা পরিবার গেল, একপর্যায়ে পাবলিক সেন্টিমেন্টাল হয়ে একদিনেই ভয়ভীতি দেখিয়ে সরিয়ে দিল। তাহলে ওখানে তাদের আর কাজ করা হবে না। যখনই স্থায়ী হবে, তখনই ইউএনও, ডিসি, এসপির নলেজে থাকবে যে, আমাদের এখানে একটা স্থায়ী প্রতিষ্ঠান আছে। আলকাউসার : কী ভয়াবহ ব্যাপার! এভাবে মুসলিম ভূখ-গুলোতে ছোট ছোট খ্রিস্টান এলাকা গড়ে তুলছে। আচ্ছা, মুসলমানদের মধ্যে ঈসাইয়্যাতের যে প্রচার, এটার কৌশল কী ছিল? আপনাদের যে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে সেখানে ঈসাইয়্যাতের প্রচারের কৌশল কী শেখানো হয়েছিল? আব্দুল্লাহ : অনেকগুলি কৌশল আছে। প্রচার কীভাবে করতে হয়- এই ধরনের একটা বই আমাদের দিয়েছিল। অনেক বড় বই। ঐ বইয়ের ভেতরে অনেকগুলো নিয়ম আছে। যেমন আমরা একটা এলাকায় গেলাম। প্রথমে বন্ধুত্ব করলাম। পরে সে আমাদের চার্চে আসল। আমরা কিছু আপ্যায়ন করলাম। আবার আরেক সময় তাদের বাড়িতে গেলাম। তাদের বিপদ-আপদে সহযোগিতা দিলাম। অর্থনৈতিক বা যেকোনো সহযোগিতা। এভাবে আস্তে আস্তে বন্ধুত্ব করার পরে তাদের মধ্যে একটা সেল সেন্টার হিসেবে আগে আমরা তাদেরকে কিছু শিক্ষা দেই বা ঢাকা পাঠাই। আমাদের খরচায়। ওখানে ট্রেনিং নেয় দেখে। ওখানেও ভালো আপ্যায়ন করা হয়। পরে তাকে আস্তে আস্তে ঈসা মসীহের কথা বলা হয়। আলকাউসার : কীভাবে বলা হয়- ঈসা আ.-এর উপর তো তোমরা ঈমান রাখো, এই রকম? আব্দুল্লাহ : ওরা শিখিয়ে দিয়েছে, ঈসা মসীহ নাজাতদাতা, মুক্তিদাতা, তিনি ছাড়া মুক্তির কোনো পথ নেই। তিনি মানব আকারে পৃথিবীতে এসেছেন মানুষের কল্যাণের জন্যে- এই রকম কথা তারা শিখিয়ে দেয়। আলকাউসার : আপনি যে চার্চে ছিলেন, ওখানে মুসলমানদেরকে খ্রিস্টান হতে দেখেছেন? আব্দুল্লাহ : আমার মনে করেন যে, মূলত দায়িত্ব ছিল প্রচার করা। যিনি ঢাকার কান্ট্রি ডিরেক্টর শুধু তিনি তরিকাবন্দি দিতেন। ওটাকে বাইবেলের ভাষায় বলা হয়- ব্যাপ্টিজম বা অবগাহন। কেউ বলে, তরিকাবন্দি; যে যেটা বুঝে। এটা দেওয়ার যোগ্যতা সবার নেই! আমাদেরও দেওয়ার মত যোগ্যতা দিয়েছে। আমরা দেই না, সাধারণত সে-ই দেয়। আলকাউসার : তিনি কোথায় থাকেন? আব্দুল্লাহ : গাজীপুরে। সাধারণত ওখানে গিয়ে দিতে হয়। কখনো কখনো এখানেও আসতেন। যেমন, আমাদের এখানে যখন এলাকাভিত্তিক পাঁচ জন মোটামুটি ঈসায়ী ধর্ম গ্রহণ করার মত আগ্রহী হয়েছে তখন সংবাদ দিলে তারা একটা ডেট দেয়। ডেট মোতাবেক এসে তরিকাবন্দি করা হয়। অথবা তিনি যদি বলেন যে, ঢাকা নিয়ে আসেন, তাহলে ঢাকা নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু আমার জীবনে এরকম সুযোগ হয়নি। প্রথম থেকেই আমার মাঝে একটা সন্দেহ কাজ করত। ঈসা মসীহ যে প্রভু, এটা আমি কখনো মনে প্রাণে বিশ্বাস করিনি। আমার মেয়ে, স্ত্রীকে তরিকাবন্দি দেওয়ার জন্য অনেক সময় ডেট দিয়েছে, কিন্তু আমি যে কোনোভাবে এড়িয়ে গিয়েছি। আমি যে থাকব না, এটা আমার আগে থেকেই পরিকল্পনা ছিল। আলকাউসার : আপনি যে চলে এসেছেন, কীভাবে আসলেন? আব্দুল্লাহ : ওখানে একটা কওমী মাদরাসা হয়েছে। আমাদের মিশনের পাশেই। আমার ঢাকার যে বিগ বস আছে, তার কাছে বিভিন্ন অভিযোগ গিয়েছে, বিশেষ করে আমাদের ওখানের বিভিন্ন স্টাফ বসকে উল্টাপাল্টা বুঝিয়েছে, তারা প্রতিষ্ঠান ভেঙে ফেলবে, আমাদেরকে মারবে, ধরবে, আমাদের স্কুলের ছাত্র নিয়ে যাবে ইত্যাদি। তো তিনি আমাকে বললেন, আপনি এসপি অফিসে, ডিসি অফিসে দরখাস্ত করেন। ইউএনও অফিসে দরখাস্ত দেন। একটা প্রতিষ্ঠান আরেকটা প্রতিষ্ঠানের পাশে ওঠাতে যেন না পারে। দেশীয় একটা আইন তো আছে- এক প্রতিষ্ঠান থেকে আরেক প্রতিষ্ঠানের দূরত্ব পাঁচ কিলো অথবা দুই-তিন কিলো না হলে প্রতিষ্ঠান হয় না। পরে বাধ্য হয়েই দরখাস্ত দেওয়া হয় ডিসির কাছে। পরবর্তীতে আস্তে আস্তে ইউএনও মহোদয়, উপজেলা চেয়ারম্যান, থানার ওসি- তারা গিয়ে আমাকে বলেছে যে, ভাই আমাদের এটা জনবহুল দেশ, ছোট দেশ, রাস্তার এই পাশে মন্দির, ঐ পাশে মসজিদ, কোনো সমস্যা তো হয় না। তো আপনাদের কী সমস্যা? বললাম যে এই এই কারণ। আমাদের এই এই লোকজন ঢাকায় জানিয়ে দিয়েছে। এখন ঢাকা থেকে আমাকে নির্দেশ দিয়েছে। তাই আমি বাধ্য হয়ে দরখাস্ত করেছি। চাকরি করি, না গেলে তো চলে না। আমার চাকরি থাকবে না। তারা বলল, আমরা অনুরোধ করছি, আপনি আর অভিযোগ করবেন না। মাদারাসায় বাধা সৃষ্টি করবেন না। তারা আপনাদের কোনো সমস্যা করবে না। পরে আমি এটা ঢাকায় জানালাম। আমি বললাম, স্যার তারা আইনের লোক, জনপ্রতিনিধি। আমার মত একটা নগণ্য মানুষের কাছে রিকোয়েস্ট করেছে, কোনো সমস্যা হবে না। এ কথা বলাতে তারা মেনে নেন। ঐ কওমী প্রতিষ্ঠান হওয়ার পরে ওখানের যে হুযুরগণ আছেন সকালে-বিকালে সবসময়ই তো তাদের সাথে দেখা হয়। পাশাপাশিই তো। তারা বলত, ভাই আপনি তো মুসলমানের সন্তান, এখানে কেন আসলেন? আপনি কেন ধর্ম ত্যাগ করলেন? এটা তো ভালো করেননি। তারা আমাকে বুঝাত, পরে আমিও দেখলাম যে, নাহ! তারা তো ঠিকই বলছে, সত্যিই বলছে। আমারও কনফিওশন ছিল। প্রথম থেকেই বিপদে পড়ে এসেছি। তাদের বলতাম, আমার জন্য দুআ করবেন। আমি বেশি দিন থাকব না। পরে কয়েকজনকে বলেছি যে, হুযুরদের সাথে আমাকে একটু গোপনে রাত্রে দেখা করান। আমি তো আসলেই থাকব না। চলেই যাব। আমার মোটামুটি চলার মত একটা ব্যবস্থা করে দিন। এই রকম কথা তাদেরকে বলেছি। পরে তারা বলেছেন যে, ঠিক আছে। আপনার আর সমস্যা হবে না। পরে দুই মাস আগে চলে এসেছি। বাড়ির সমস্যার কথা বলে চলে এসেছি। এই অবস্থায় আছি। আলকাউসার : আলহামদু লিল্লাহ! আল্লাহ পাকের মেহেরবানী, আল্লাহ তাআলা আপনাকে অনেক বড় বিপদ থেকে ফিরিয়ে এনেছেন। আপনি যে চলে এসেছেন, আপনাকে কোনো হুমকি-ধমকি দেয় না? আব্দুল্লাহ : হুমকি-ধমকি তো একটু দেয়ই! কিন্তু ব্যক্তি হিসেবে তো আমার স্বাধীনতা আছে! এখন যদি কেউ বিপদে ফেলতে চায় বা একটা কিছু করে তাহলে তো করার কিছু নেই। করতে পারে। আলকাউসার : ঈসায়ী বা কনভার্ট হওয়ার কারণে আপনার যে অস্থির লাগে, এটা তাদের কারও সাথে আলোচনা করেছেন? আব্দুল্লাহ : হ্যাঁ, আমাদের ওখানের যারা স্টাফ আছে সবার সাথেই শেয়ার করেছি যে, আসলে কিতাব তো সত্য না, বাইবেল তো সত্য না। এটাকে তারা বিকৃত করেছে। আর ওখানে যা কিছু ভালো জিনিস লেখা আছে, সেটা তারা মানে না। তারা এক ধরন আমাদের আরেক ধরন। ওখানের প্রতিটা স্টাফের মধ্যেই এক ধরনের অশান্তি কাজ করে। আলকাউসার : যারা কনভার্টেড তাদের কি মুসলিম নামই বহাল থাকে? আব্দুল্লাহ : অনেকে নাম পাল্টায় বা পাল্টাতে পারে। অনেককে উৎসাহিত করে যে, আপনি যেহেতু খ্রিস্টান হয়েই গেছেন, তাহলে আপনার মুসলিম নাম রাখা দরকার নেই। আপনি জেমস রাখেন বা রোজারিও রাখেন ইত্যাদি। এরকম খ্রিস্টানদের কৃস্টি কালচারের সাথে সামঞ্জস্য রেখে নামগুলো তারা রাখে। তারা কোর্টে এফিডেভিট করে। আমাদের ওখানেরও দুই-তিন জন কোর্টে এসে এফিডেভিট করেছে। জলিল নামে একটা ছেলে কোর্টে এফিডেভিট করেছে। আর রবিন নামে একটা ছেলে সেও কোর্টে এফিডেভিট করেছে। আলকাউসার : আপনি যেখানে ছিলেন, ওখানে নাকি আসপাশে এরকম আরও ৬/৭টা খ্রিস্টান মিশনারী সংস্থা আছে? আব্দুল্লাহ : ওখানে আছে, ফ্রেড বাইবেল। ফ্রেড বাইবেল নামে একটা মিশন ওখানে কাজ করে। তারপরে আছে এসেম্বলীস অব গড চার্চ। সংক্ষেপে বলে এজি। এটা একটা মিশন। বৃহৎ আকারে কাজ করে। তারপর প্রেসবাইটারিয়ান, রিফর্ম প্রেসবাইটারিয়ান। কালভেরি (জিশুকে যে স্থানে ক্রুশে দেওয়া হয়েছিল সে স্থানের নামানুসারে) ওটা একটি সংস্থা। ক্যাথলিক অনেক গ্রুপ আছে। আলকাউসার : এই খ্রিস্টান মিশনারীদের অপতৎপরতা থেকে সাধারণ মুসলমানদের ঈমান হেফাযতে যারা দাওয়াতী কাজ করেন, মানুষকে জানান, বুঝান তাদের বিরুদ্ধে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়? আব্দুল্লাহ : যেমন ধরুন, আমি যেখানে ছিলাম সেখানে আমি যদি ক্ষতি করতাম, কঠিন হতাম তাহলে তো মাদরাসা হত না। অলরেডি থানা পুলিশ এসে বাধা দিয়েছিল। ওখানে আমি নমনীয় হয়েছি বিধায় প্রতিষ্ঠানটা হয়েছে। তো আমি নমনীয় না হলে অফিস আমাকে বলত যে, আপনি কেইস করেন। অলরেডি আমরা উকিল খুঁজে কেইসের সিদ্ধান্তও নিয়েছিলাম। কিন্তু আমি চিন্তা করেছি, না এখানে দ্বীনী প্রতিষ্ঠান হবে, মসজিদ হবে, আর আমি বাধা দিব? এই গুনাহ আমার করা ঠিক হবে না। এরই মধ্যে ইউএনও মহোদয় ওখানে গিয়েছে এবং তারা আমাকে রিকোয়েস্ট করেছে। তাদের তুলনায় তো আমি একজন নগণ্য মানুষ। তাদের মর্যাদার ব্যাপার আছে। এ কথা বলে আমি উপরে বুঝিয়েছি। ফলে প্রতিষ্ঠানটি হয়েছে। আমাকে তো এসপি এবং ওখানের ওসি বারবার বলেছে কোনো হুমকি বা কোনো প্রকার সমস্যা সৃষ্টি করলে আমাদের সাথে সাথে জানাবেন। তার অর্থ, আমি যে কোনো সময় আলেম ওলামাদের বিপক্ষে কথা বললে তারা এরেস্ট হত। কিন্তু আমি তা করিনি। কারণ আমার মধ্যে ঐ চিন্তা ছিল না। মূলত প্রশাসন খ্রিস্টানদের পক্ষে জোরালোভাবে কাজ করে। আলকাউসার : প্রশাসন কেন তাদের এত সাপোর্ট দেয়? এর কোনো কারণ জানতে পেরেছেন কোনো সময়? আব্দুল্লাহ : জাতিসংঘ থেকে বাংলাদেশ সরকারের উপর একটা চাপ থাকে। ধর্ম মন্ত্রণালয়ে একটা চাপ দেয় জাতিসংঘ। এবং যখন জাতিসংঘ থেকে চাপটা আসে তখন সরকারের মাথা নষ্ট হয়ে যায়। তখন বিভিন্নভাবে ডিসি এসপি ছোটাছুটি শুরু করে দেয়। না হলে আমার মত লোকের পেছনে কীভাবে একটা ক্যাম্প পাহারা দেয়, নিরাপত্তার জন্য কাজ করে? একটা ক্যাম্পে তো গভর্মেন্টের মিনিমাম পাঁচ লক্ষ টাকা খরচ আছে। সেখানে আমার পাহারার জন্য একটা ক্যাম্প দিচ্ছে। এসপি, এডিশনাল এসপি এবং জেলা গোয়েন্দা- এরা সপ্তাহ সপ্তাহ আমার কাছে এসেছে এবং জিজ্ঞাসা করেছে, কোনো সমস্যা আছে কি না? কেউ আপনাকে হুমকি-ধমকি দেয় কি না, কোনো খারাপ কথা বলে কি না? আমি কারও বিরুদ্ধে কিছু বলিনি। আলকাউসার : পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে কিছু জানেন কি? আব্দুল্লাহ : ওখানে যারা বিশেষ করে উপজাতি এবং বুদ্ধিস্ট, বিভিন্ন ধর্মের লোকই আছে ওখানে, ওরাই বেশি খ্রিস্টান হচ্ছে। ওদেরকে ঢালাওভাবে খ্রিস্টান বানানো হচ্ছে। যেমন, আমাদের জামালপুরের পাশে মধুপুর ধনবাড়ী থানা, ওখানে ৫০/৬০ হাজারের মত গারো উপজাতি রয়েছে, তাদেরকে আমরা গারো হিসেবে চিনি। ওখানে অলরেডি আমেরিকান ফরেইনাররা এসে স্কুল করে দিয়েছে। ষাট-সত্তর লক্ষ টাকা খরচ করে চার্চ করে দিয়েছে। অনেক লোককে তারা মাসিক সাপোর্ট দিচ্ছে। এলাকাভিত্তিক ছোট ছোট চার্চ করে দিচ্ছে। তারা প্রায় সব খ্রিস্টান হয়ে গেছে। তো মনে করেন, এই উপজাতিরা যদি ওখানে হাজারে হাজারে খ্রিস্টান হতে পারে, মুসলমান হতে পারবে না কেন? কিন্তু দেখবেন যে, ওখানে হাজারে একজন মুসলিম আছে কি না সন্দেহ। আলকাউসার : ফরেনারদের সাথে তো আপনার সরাসরি সাক্ষাৎ হয়নি, নাকি হয়েছে? আব্দুল্লাহ : জী, জী, সাক্ষাৎ হয়েছে। বছরে তো আমাদেরকে মনে করেন ৪/৫ বার করে ডাকে। হেড অফিস গাজীপুরে ডাকে। বিভিন্ন সময় ফরেনাররা আসে, ঐ সময় মিটিং হয়। কীভাবে আপনারা প্রচার করছেন, কী কী সমস্যা, এগুলো শুনে। কী করলে আরও প্রচার ভালো হবে, পরামর্শ দেয়। তারপর কী কী প্রয়োজন। এরকম বিভিন্ন তথ্য নেয় এবং পরামর্শ দেয়। বছরে এমন মিটিং চার-পাঁচ বার হয়, চার-পাঁচ বারই ফরেনাররা আসে। আর সারা বছর তো আসেই। দুই-তিন মাস পরপরই আসে। আমেরিকানরা যে অর্থ দেয়, এটার মনিটরিং-এর জন্য এশিয়া মহাদেশের মধ্যে তাদের মনিটরিং কর্মকর্তা আছে। আমেরিকা থেকে সরাসরিও আসে। আবার এশিয়া মহাদেশের যেমন ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ কিংবা মায়ানমার এসকল দেশের মনিটরিং কর্মকর্তা থাকে। এখানে আবার এশিয়া মহাদেশের মনিটরিং কর্মকর্তা আছে। তারা এটা তদারকি করে। একেক সময় একেক রাষ্ট্রে যায়। খোঁজ-খবর নেয়। তারা কী অবস্থায় আছে। কাজ করে কি না? কতদূর কাজ করল। কতদূর করতে পারল বা পারল না। আবার অনেক সময় দেখা যায় বাংলাদেশের যিনি কান্ট্রি ডিরেক্টর তাকে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর বা আমেরিকায় ডাকে। তাকে প্রশিক্ষণ দেয়। এরকম সারা বছর চলতে থাকে। আলকাউসার : মিশনারী নাম ছাড়া যে সমস্ত এনজিও আছে এই এনজিওগুলোর মধ্যে কারা কারা আসলে বেশি কাজ করে? আব্দুল্লাহ : যেমন ধরেন, আমি বাঁশখালীতে কাজ করে এসেছি। ওরা তো লিখেছে- বিসিডিপি। বিসিডিপি মানে, বাংলাদেশ কমিউনিটি ডেভলপমেন্ট প্রোগ্রাম। কিন্তু আসলে এরা পুরোটাই খ্রিস্টান মিশনারী। ওরা সাইনবোর্ডে লিখেছে, বিসিডিপি। বিশাল সাইনবোর্ড। নিচ দিয়ে লিখেছে ‘এবিএমএস বাংলাদেশ’। এবিএমএস বাংলাদেশ মানে কী? এটা তো সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছে না। মনে করছে, আর দশটা প্রতিষ্ঠানের মতোই এটাও একটা প্রতিষ্ঠান। ওখানে লেখা আছে সমাজ উন্নয়ন প্রকল্প। বিসিডিপি-বাংলাদেশ কমিউনিটি ডেভলপমেন্ট প্রোগ্রাম। সুন্দর নাম। কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমাদের বলেছে যে তোমরা সমিতি গঠন কর। ওখানে কোনো ক্রেডিট প্রোগ্রাম নেই। মনে করেন, সেলাই মেশিন প্রশিক্ষণের উপর আমরা কাজ করেছি। বিশজন মেয়ে নিয়ে দেখা গেল যে আমরা বিশটি সেলাই মেশিন কিনলাম। ৩ মাস প্রশিক্ষণ দিলাম ফ্রি। প্রশিক্ষণ দিয়ে ১ টি করে মেশিন পাঁচ হাজার টাকা দাম। আমরা আড়াই হাজার টাকায় দিয়ে দিলাম। তাদের উন্নয়নের জন্য। তাদের কর্মসংস্থানের জন্য। তাহলে ২০টি মেশিন যদি আমরা দিই অর্ধেক মূল্যে তাহলে অনেক লস না? আবার কিছু কিছু লোক আছে তাদেরকে নার্সারী করার জন্য ৫০০০ টাকা দিয়েছে। আমাদের উপরে নির্দেশ ছিল, ঐ টাকা একেবারে না দিলেও কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আমরা বলেছি যে, কিছু লাভ দিয়েন। কারণ, একেবারে মওকুফ করে দিলে তো তারা দিবেই না। এজন্য আমরা উৎসাহ দিয়েছি যে, কিছু লাভ দিয়েন। তারা খুশি হয়ে দিয়েছে। আমরা ওখানে যে ক’জন স্টাফ ছিলাম সবাই মুসলিম থেকে কনভার্টেড। আমরা আটটা বা দশটা পরিবার ওখানে ছিলাম, সবাই কনভার্টেড। কিন্তু আমাদেরকে গোপনে বলে দিয়েছে যে, আপনারা প্রতি রবিবার অফিসে গেট লাগিয়ে দিয়ে অফিসে বসে বাইবেল প্রচার করবেন। আলোচনা করবেন। আমরা তাই করেছি। আলোচনা করেছি, শুনেছি। আজকে একজন আলোচনা করল, পরের রবিবারে আরেক জন আলোচনা করল। এই রকম। আলকাউসার : সারা সপ্তাহে আর কোনো কাজ ছিল না? ওদের ধর্মীয় আর কোনো কাজ ছিল না? আব্দুল্লাহ : সারা সপ্তাহে কাজ আছে, সমিতির কাজ। ধর্মীয় কাজ ঐ অতটুকুই। শুধু রবিবারে। ওখানে প্রচারের কোনো ক্ষেত্র তো নেই। কারণ, এত আলেম-উলামা, ওখানে প্রচার করতে গেলে তো মার খেতে হবে। প্রচার করার নির্দেশ ছিল, কিন্তু আমরা প্রচার করতে পারিনি। উপর থেকে আমাদেরকে বলেছে যে, সমস্যা নেই, আপনারা নিজেরা ঠিক থাকেন তাহলেই হবে। আলকাউসার : এখনও তো কাজ চলছে? সমাজকল্যাণমূলক কাজ? সেলাই প্রশিক্ষণ। আব্দুল্লাহ : হ্যাঁ, এখনও আছে। সেলাই প্রশিক্ষণ, কম্পিউটার ট্রেনিং, নার্সারীর উপর কিছু ঋণ। প্রতি সপ্তাহে বা মাসে মহিলাদের কয়েকটা মিটিং থাকত। যেমন, দুর্যোগের উপর, নার্সারীর উপর, পশু-পালনের উপর, মাছ চাষের উপর। আসলে এগুলো কিছু না। এগুলো হল এলাকায় ফোকাস করা। মানুষের সাথে মেশার একটা কৌশল। লক্ষ্য আসলে প্রচার। আলকাউসার : এদের অর্থের উৎস সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন? আব্দুল্লাহ : অর্থের উৎস তো আসলে আমেরিকা, কোরিয়া ইত্যাদি দেশ। যে যে দেশ থেকে সাপোর্ট আনতে পারছে আনছে। আলকাউসার : ঐ অর্থগুলো ওদের ব্যাক্তিদের দান করা? আব্দুল্লাহ : আমেরিকা হোক আর কোরিয়া হোক, ওরা আয়ের এক দশমাংশ চার্চে দান করে। মুসলিমদের মধ্যে যেমন যাকাতের একটা সিস্টেম আছে, ওদের মধ্যেও এক দশমাংশ সিস্টেম। ওরা বলে, এক দশমাংস। বাইবেলেও আছে। ওরা আয়ের দশ ভাগের এক ভাগ চার্চে দান করে একুরেটভাবে। বাংলাদেশের মানুষ তো আসলে ঠিকমত যাকাত দেয় না। ওরা একুরেটভাবে দেয়। ঐ দেশে তো গরীব নেই। ঐ টাকাগুলো এ সমস্ত গরীব দেশগুলোতে ওরা পাঠিয়ে দেয়। ইন্ডিয়া, বাংলাদেশ এই সমস্ত গরীব দেশগুলোতে তারা মিশনের কাজে ব্যয় করে। আলকাউসার : কিন্তু এটার ক্ষেত্রে সরকারি বিধিনিষেধ আছে না? আব্দুল্লাহ : শুনেছি যে, এ অর্থ তারা নাকি সরাসরি দিতে পারে না। রাষ্ট্রীয়ভাবে নাকি কী সমস্যা আছে। যেমন ধরেন, বাংলাদেশে যদি একবারে আমেরিকা থেকে ৫০ কোটি টাকা আসে, তাহলে এটার উপরে সরকারের ট্যাক্স-এর একটা ব্যাপার আছে। আমরা তো অত বুঝি না, যতটুকু শুনেছি ততটুকুই। তারা বলে যে, এ দেশের মানুষের সেবামূলক কাজে আমরা এ অর্থ ব্যয় করি। এরকম কথা বলে নিয়ে আসে। বলে, দেশের উন্নয়নমূলক কাজ করব- ঘর-বাড়ী করে দিব, রাস্তা করে দিব। দেশের ডেভলপমেন্টের কথা বলে টাকা নিয়ে আসে, কিন্তু তা ব্যয় হয় খ্রিস্টধর্ম প্রচারের কাজে। স্যালারি হিসেবে দেওয়া হয় বা প্রচারের ক্ষেত্রে মানুষকে লোভ দেখিয়ে, ঘর-বাড়ী দিয়ে, টাকা-পয়সা দিয়ে মানুষকে খ্রিস্টধর্মে আনা হয়। সরকারকে তারা এটা বলে না, এটা বললে তো সরকার মেনে নিবে না। এজন্য তারা বলে যে, আমরা দেশের উন্নয়নের কাজে এগুলো ব্যয় করি। শিক্ষার খাত দেখায়। যেমন, ওদের স্কুল আছে। আসলে ওখানে ওদের কয় টাকা লাগে? টাকা তো বেশিরভাগ ব্যয় হচ্ছে প্রচারকাজে। রিলিজিয়ন প্রচার। এজন্য তারা অনুমোদন নিয়ে প্রাইমারি লেভেল বা কলেজ লেভেল প্রতিষ্ঠান করে দেখাচ্ছে যে, আমরা মানুষের সেবা দিচ্ছি। আলকাউসার : আপনার পক্ষ থেকে কোনো প্রস্তাব যদি থাকে- আমাদের করণীয় সম্পর্কে, যা দ্বারা সাধারণ মুসলমানদের ঈমান নিরাপদ থাকতে পারে। আব্দুল্লাহ : করণীয় হল, যে সমস্ত বন্যাদুর্গত এলাকা এবং বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষগুলো রয়েছে, বিপদে আপদে ওদের পাশে দাঁড়ানো এবং সহযোগিতা দেওয়া। শুধু যে টাকা দিতে হবে তা তো না! মূল বিষয় হল, মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়ানো। যেমন মনে করেন অনেক মানুষ আছে, যারা নদীভাঙনের শিকার। দুধকুমার একটা নদী। আমার মিশনের পাশেই। ভারত থেকে এসেছে। নদীটা ভাঙার কারণে বহু লোক ওখানে রেলওয়ের উপর বসতি করে আছে। কেউ রাজের কাজ করে। কেউ রিক্সা চালায়। অনেক মেয়ে মাটি কাটে। অনেক মেয়ে আমাকে বলত, স্যার! আমরা মাটি কাটব, সারা দিন মাটি কাটব। সারা বছর মাটি কাটব। আমাদের দেড়শ বা দুইশ টাকা দিলেই চলবে। এর কারণ হল, আমরা মিশনের কাজে একবার মাটি কাটিয়েছিলাম। এজন্য আমাকে রাস্তায় দেখলেই বলে, স্যার আপনাদের ওখানে মাটি কাটা নাই। মেয়ে মানুষ, কিন্তু মাটি কাটার মত কঠিন কাজ করবে! তাহলে দেখেন, তারা কত অসহায়। আমি নিজেও চিন্তা করেছি, ঐ সমস্ত ফ্যামিলি, যার মেয়েরা মাটি কেটে সংসার পরিচালনা করে, অশিক্ষিত বা অল্প শিক্ষিত, যে কোনো মিশন পাঁচ হাজার-দশ হাজার টাকা দিলে ওদের তো হুঁশই থাকবে না। ওরা তো আসবেই। ওরা তো ধর্ম-কর্ম বুঝে না। তো তাবলীগ বলেন, আর যত ইসলামী দল আছে, তারা যদি তাদের পাশে দাঁড়ায়, সহযোগিতা দেয়, একটু সহানুভূতি, পরামর্শ দেয় তাহলে আমার মনে হয় অনেকে বুঝবে। এবং আর ঐ ভুল পথে পা দিবে না। মিশনের সমস্যা কমে যাবে। যেমন আমার জীবনের কথাই ধরেন। আমার ঐ বিপদের সময় যদি কোনো বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয়-স্বজন বা যে কোনো সামাজিক লোক আমার পাশে দাঁড়াত তাহলে আমি বিপথগামী হতাম না। আলকাউসার : জীবনের একটা মূল্যবান সময় যে সমস্ত কাজের মধ্যে কেটে গেছে, ঐ সময় যদি আপনার ইন্তেকাল হয়ে যেত তাহলে তো বিরাট ক্ষতিগ্রস্ততার ব্যাপার ছিল। আল্লাহ পাক আপনাকে রক্ষা করেছেন, নিজ অনুগ্রহে ফিরিয়ে এনেছেন। আব্দুল্লাহ : হ্যাঁ, আমি ভুল করেছি। এখন বুঝতে পারছি। আলকাউসার : আল্লাহ পাক আপনাকে ফিরিয়ে এনেছেন এবং তাবলীগে সময় লাগাচ্ছেন। আপনার কি মনে হয় ঐ সমস্ত মানুষের পেছনে মেহেনত করবেন, যারা কনভার্টেড হয়ে গেছে। আব্দুল্লাহ : হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্যই আমি তাদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করব, আল্লাহ যদি দয়া করেন। বাংলাদেশের যেখানে যেখানে আমার পরিচিত বন্ধু-বান্ধব বা মিশনের লোকজন আছে, আমি চেষ্টা করব তাদের ফিরিয়ে আনার জন্য। আমি যেন মৃত্যু পর্যন্ত ঈমানের উপর বহাল থাকতে পারি সে জন্য দুআ চাই সবার কাছে। আলকাউসার : আগামীকাল ঈদ, মাশাআল্লাহ ঈদের দিন বের হয়ে যাচ্ছেন আল্লাহর রাস্তায়! আব্দুল্লাহ : আল্লাহর রাস্তায় আমি যে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছি এটার জন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করি। আলকাউসার : আমরা দুআ করি, আল্লাহ আপনার অভিভাবক হয়ে যান। আমাদেরকে আপনার মূল্যবান সময় দেয়ার জন্য অনেক অনেক শুকরিয়া। জাযাকাল্লাহু খাইরান।

 

 

advertisement