শাওয়াল ১৪৩৮   ||   জুলাই ২০১৭

একটি ভিন্নধর্মী কলাম : এক গুনাহগারের দুআ

হামিদ মীর

সাংবাদিক ও কলামিস্ট হামিদ মীর দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করেন নিজস্ব ভঙ্গিতে। তার দৃষ্টিতে যা ভুল বা অন্যায় ও অপরাধ, সেগুলোর প্রকাশ এবং অপরাধীর ময়না তদন্ত করেন তিনি নিঃসংকোচে। কিন্তু তার এ কলামটি ভিন্ন রকমের। এতে হয়তবা প্রচলিত ব্যবস্থার ওপর তার হতাশা ও মানুষকে সর্বশেষ আশ্রয়স্থল দেখাবার ইঙ্গিত রয়েছে। -সহসম্পাদক

আয় পরওয়ারদেগার! সম্পদের লালসা ও তা থেকে সৃষ্ট অন্যায়-অনাচার থেকে আমাদের বাঁচান। আমাদের ক্ষমতাধরদের ধন-সম্পত্তিই তাদের দুর্গতির কারণ।

হে আল্লাহ! তাদের দুর্গতির নিছক দর্শক হওয়ার পরিবর্তে আমাদেরকে নিজের দিকে তাকানোর হিম্মত দান করুন। আমরা যেন চিন্তা করি যে, আমাদের মনে ধন-সম্পত্তি বৃদ্ধির আশা কেন উঁকি দেয়। আর এমন ধন-সম্পত্তি ও ক্ষমতা দিয়েই বা কী হবে, যা জায়েয কি নাজায়েয তা নিয়েই প্রশ্ন উঠে?! একদিকে ক্ষমতাবানরা আরো সম্পদ ও ক্ষমতার জন্য একে অপরকে লাঞ্ছিত করছে অন্যদিকে ক্ষমতাহীনেরাও ক্ষমতা লাভের জন্য পরস্পরে লড়াই করছে।

হে বিশ্বজাহানের সৃষ্টিকর্তা! আমাদের এ চিন্তা করার শক্তি দিন, যেই প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে আমরা নিজেদের উৎসর্গ করার দাবি করি তিনি তো সম্পদ থেকে দূরে থাকতেন অথচ আমরা সম্পদের পেছনে ছুটছি। আমাদের প্রিয় নবী তো ‘আমীর’ নয়; ‘ফকীর’ ছিলেন। তবে এ ফকিরীতে ছিল না কোনো মুখাপেক্ষিতা । ছিল শুধু সম্পদের প্রতি অমুখাপেক্ষিতা। আর এই অমুখাপেক্ষিতাই ছিল তাঁর এক অনন্য বৈশিষ্ট্য, যা বড় বড় রাজা-বাদশাহরও ছিল না।

হে আমাদের প্রভু! আমাদেরকে এই উপলব্ধি দান করুন যে, দারিদ্র্যের মাঝে ইসলামের আবির্ভাব হয়েছে এবং একজন এতীম মিসকীনের কোলে লালিত পালিত হয়েছে। আর এ দারিদ্র্যই আমীর-গরীব সকলকে ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করেছে। আমাদের নের্তৃবৃন্দ যতদিন নিঃস্বতার এই রহস্য অনুধাবন করতে পেরেছে ততদিন তারা বড় বড় সাম্রাজ্য ও শক্তিশালী সৈন্যদলকেও পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু যখন নিঃস্বতার এই রহস্য ভুলে বিত্ত-বৈভবের দিকে আকৃষ্ট হয়েছে তখনই তারা নিজেদের বীরত্বপূর্ণ জৌলুস হারিয়ে ফেলেছে।

আফসোস, শত আফসোস! দুনিয়ার সবখানে আজ মুসলিম জাতি লাঞ্ছনার শিকার। অথচ মুসলিম শাসকদেরও কিছু করার নেই। কারণ তারা নিজেরাই লাঞ্ছিত। মুসলিম জাতি ভুলেই বসেছে যে, তাদের প্রকৃত মর্যাদা রাসূলপ্রেম। আজ তারা নিজেদের মর্যাদা রক্ষা করতেও লজ্জাবোধ করছে। অথচ প্রিয়ের সব আচরণ ও চাল-চলনের প্রতি মুহাব্বত পোষণ ছাড়া মুহাব্বতের দাবিই তো নিরর্থক।

হে আল্লাহ! আমাদেরকে আপনার প্রিয় নবীর জীবন ও আদর্শকে বোঝার তাওফীক দান করুন। আমাদের মনে রাখা উচিত যে, রাসূলের ওফাতের সময় তাঁর বাড়িতে মাত্র সাতটি স্বর্ণমুদ্রা ছিল। অথচ তিনি তাও গরীবদের মাঝে বিলিয়ে দেওয়ার অসিয়ত করে গেছেন এবং বলেছেন, আমার লজ্জা হচ্ছে, ঘরে পার্থিব সম্পদ রেখে রাসূল আল্লাহর সান্নিধ্যে যাবে। (মুসনাদে আহমাদ, হাদীস  ২৪২২২)

হে আল্লাহ! আমরা আপনার ঐ রাসূলেরই অনুসারী। আমাদের অন্তরে গরীবের মুহাব্বত দান করুন এবং আমাদেরকে হিম্মত দান করুন; আমরা যেন পার্থিব যশ-খ্যাতি ও প্রদর্শনীর পেছনে অর্থ খরচ না করে গরীবের সহযোগিতা করতে পারি। আমাদের উসওয়া ও আদর্শ হচ্ছেন রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, যাঁর নামের আলোয় সকল তুচ্ছও বড় হতে পারে। যিনি শুধু মুসলমানদের জন্যই রহমত নন; বিশ্বজগতের জন্যই রহমত। তাঁর জীবন -চরিত ছিল কুরআন মাজীদেরই বাস্তব রূপ। হে আল্লাহ! আমাদেরকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নত ও কুরআনী শিক্ষা পরিপালনে অটল থাকার তাওফীক দান করুন।   

হে উভয় জাহানের পালনকর্তা! আমাদের এই বুঝ দিন যে, আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মূল শক্তি তরবারি ছিল না; বরং তাঁর কর্ম ও চরিত্র মাধুরি মানুষকে আকর্ষণ করেছে। ‘ইসলাম কবুলের ক্ষেত্রে কোনো জোর-জবরদস্তি নেই’- তিনি ছিলেন এই কুরআনী ঘোষণার বাস্তব নমুনা। নাজরানের খ্রিস্টানদের সাথে তিনি যে সন্ধিচুক্তি করেছিলেন তাতে শুধু তাদের জানের নিরাপত্তাই দেননি; বরং এই প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন যে, তাদের ভূখ-, জমিজমা ও ধন-সম্পদ করায়ত্ত করা হবে না। এমনকি তাদের উপাসনালয়গুলোও সংরক্ষণ করা হবে। (তাবাকাতে ইবনে সা‘দ ১/১৭২) তাঁর ক্ষমা ও উদারতার চিত্র তো এই ছিল যে, বদর যুদ্ধের ৭০ বন্দিকে পণ নিয়ে মুক্ত করে দিয়েছিলেন। যার কাছে পনবন্দি ছিল না তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি পড়াশোনা জান? বন্দি হাঁ বললে তাকে দশজন মুসলমানকে পড়ালেখা শেখানোর বিনিময়ে মুক্তি দিয়েছেন। (মুসনাদে আহমদ ২/২৬০) শিক্ষার এতই গুরুত্ব ছিল যে, অমুসলিম বন্দি থেকেও জ্ঞান অর্জনে কোনো কুণ্ঠা ছিল না।

আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেমনি মানবতার জন্য রহমত তেমনি নারীর জন্যও ছিলেন রহমত। তিনি কন্যাসন্তানকে জীবিত কবরস্থ করতে নিষেধ করেছেন। মায়ের অবাধ্যতাকে হারাম ঘোষণা করেছেন। নারীকে তার সত্তাগত স্বাধীনতা ও উত্তরাধিকার প্রদানের পাশাপাশি (নির্যাতনকারী স্বামী থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রয়োজন হলে) খোলা-তালাক গ্রহণ ও বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার দিয়েছেন। তালাকপ্রাপ্তা ও বিধবা নারীকে দিয়েছেন দ্বিতীয় বিবাহের অধিকার।

হে আল্লাহ! আমাদেরকে নারীর সকল অধিকার যথাযথভাবে আদায় করার তাওফীক দান করুন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুদ্ধের সময়ও নারী, শিশু ও বৃদ্ধকে হত্যা করতে নিষেধ করেছেন।

হে আমাদের প্রভু! আমাদেরকে সঠিকভাবে দ্বীন বোঝার তাওফীক দান করুন এবং ভ্রষ্ট মুসলমানদের অনিষ্ট থেকে মুসলিম জাতিকে হেফাযত করুন।

হে আল্লাহ! মুসলমানকে মুসলিম জাতির রক্ষক বানিয়ে দিন। আমাদেরকে অসুস্থ ও নির্যাতিত ভাই-বোনের সাহায্য করার তাওফীক দান করুন।

আনাস রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমরা নিজ ভাইয়ের সাহায্য কর। চাই সে যালিম হোক বা মাযলুম। আনাস রা. আরয করলেন, মাযলুমের তো আমরা সাহায্য করব, কিন্তু যালিমের সাহায্য কীভাবে করব? তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা তাকে যুলুম থেকে নিবৃত্ত কর। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৯৫২)

আবু সায়ীদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, অত্যাচারী শাসকের সামনে সত্য বলাই উত্তম জিহাদ। (জামে তিরমিযী, হাদীস ২১৭৪)

হে আল্লাহ! আমাদেরকে দুনিয়ার সকল নির্যাতিত মানুষের সাহায্য করার শক্তি দিন এবং অত্যাচারী শাসকদের সামনে সত্য বলার তাওফীক দান করুন। যালিমদের ভয় আমাদের অন্তর থেকে দূর করে শুধু আপনার ভয় আমাদের অন্তরে বদ্ধমূল করে দিন।

হে আল্লাহ! আমাদেরকে মিথ্যা বলা থেকে  হেফাযত করুন। মুনাফেকি থেকে বাঁচান। গীবত-অহংকার থেকে বাঁচান এবং অন্যের সম্মান নষ্ট করা থেকে হেফাযত করুন।

হে আল্লাহ! আমাদেরকে স্বর্ণের আংটি, রূপার তৈজসপত্র ও রেশমি কাপড়ের লোভ-লালসা থেকে দূরে রাখুন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  তো আমাদেরকে সুন্দর চরিত্রের শিক্ষা দিয়েছেন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকে অর্ধেক ঈমান ঘোষণা করেছেন।

হে আল্লাহ! আমাদের নিজেদেরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার এবং আমাদের চারপাশ পরিচ্ছন্ন রাখার তাওফীক দান করুন। 

হে আল্লাহ! আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীগণের সাথে মিলেমিশে বৃক্ষ রোপণ করেছেন। হে আল্লাহ! আমাদেরকেও আপনি বৃক্ষ রোপণের ও তার পরিচর্যা করার তাওফীক দান করুন।

আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের অধিকারের পাশাপাশি পশু-পাখির অধিকারের ব্যাপারেও সচেতন ছিলেন। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, বনী ইসরাঈলের জনৈকা অসতী নারী একটি কুকুরকে তৃষ্ণায় মারণাপন্ন দেখতে পায়। (কোনো কিছু না পেয়ে) সে নিজের চামড়ার মোজা খুলে নিজের ওড়নার সাথে বেঁধে কুয়া থেকে পানি তুলে কুকুরকে পান করায়। এর বদৌলতে সে মাগফিরাত পেয়ে যায়। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৩২১)

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর তালীম ও শিক্ষা-দীক্ষার আলোকে ফকীহগণ এই আদব বর্ণনা করেছেন যে, যবাই করার সময় প্রাণীকে হেঁচড়ানো ও অন্য প্রাণীর সামনে যবাই করা যাবে না।

হে আল্লাহ! আমাদেরকে মানুষ ও পশুপাখির বদ দুআ থেকে বাঁচান। আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সম্পূর্ণ রহমত। হে আল্লাহ! আমাদেরকেও আপনার নবীর পথে চলার তাওফীক দান করুন।

হে প্রিয় প্রভু! আমরা বড়ই অপরাধী। আমাদের হৃদয়-মন বড়ই অশান্ত। আমরা একে অন্যের কারণে ভীত-সন্ত্রস্ত। হে আল্লাহ! আমাদের অন্তরে একে অপরের প্রতি ভালোবাসা-সৌহার্দ্য দান করুন। আমাদেরকে ক্ষমা ও সহিষ্ণুতা দান করুন।

হে আল্লাহ! আমাদেরকে বিচ্ছিন্নতা থেকে বাঁচান এবং শত্রুদের ষড়যন্ত্র থেকে হেফাযত করুন।

হে বিশ্বজাহানের সৃষ্টিকর্তা! গুনাহগারের দুআ কবুল করুন। আমীন।

[অনুবাদ : মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ ফাহাদ]

 

 

 

advertisement