সফর ১৪৩৮   ||   নভেম্বর ২০১৬

সমতা : সুবিচারের সুনজির

ওয়ারিস রব্বানী

প্রিন্স তুর্কি বিন সউদ আলকাবির। সৌদি আরবের রাজ পরিবারের এক যুবক সদস্য। গত কয়েক দিন আগে তার মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়েছে। সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে এই মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়। বাংলাদেশের গণমাধ্যমে এ খবরটি প্রচার হয় গত ১৯ ও ২০ অক্টোবর।

মৃত্যুদ-প্রাপ্ত রাজ পরিবারের এই যুবক সদস্য ঝগড়ার সময় তিন বছর আগে গুলি করে একজন সৌদি নাগরিককে হত্যা করেছিলেন। পরে তার মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হয়। অপরদিকে তার গুলিতে নিহত ব্যক্তির স্বজনরা মৃত্যুপণ গ্রহণ করে প্রিন্সকে ক্ষমা করতে অসম্মতি জানিয়ে দেন। এরপরই তার মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়। ধারণা করা হচ্ছে, শিরোচ্ছেদের মধ্য দিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। যে পরিবার দেশ শাসন করছে তাদের কোনো যুবক সদস্যের মৃত্যুদ- কার্যকরের ঘটনা সৌদি আরব শুধু নয়, সাম্প্রতিককালের সারা দুনিয়াতেই কম। অবশ্য সংবাদ মাধ্যমগুলো বলেছে, সৌদি আরবে প্রিন্সের মৃত্যুদ- কার্যকর করার ঘটনা বিরল। সাম্প্রতিক পৃথিবীর সব দেশকে সামনে নিয়ে কথা বললেও এ-জাতীয় ঘটনাকে বিরলই বলতে হবে। তবে ইসলামী বিচার ও মুসলিম জাতির ইতিহাসে এ জাতীয় ঘটনা খুব বিরল নয়। আমরা সেদিকটি নিয়েই দুটি কথা বলার চেষ্টা করতে পারি।

বর্তমান সৌদি আরব সরকার ও শাসক পরিবারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দ্বিমত ও অপছন্দ থাকতে পারে- এটা স্বাভাবিক। কিন্তু সৌদি আরবে ফৌজদারি  বিচারব্যবস্থায় বেশ কিছু ক্ষেত্রে যে ইসলামী আইনের অনুসরণ চলে তা অস্বীকার করার উপায় নেই এবং এ কারণেই পৃথিবীর উন্নত রাষ্ট্রগুলোর চেয়েও সেখানকার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সবসময় উন্নত থাকে এবং অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় ফৌজদারি অপরাধগুলো সে দেশে কম সংঘটিত হয়ে থাকে।

কখনো এমনও হয় যে কোনো কোনো রাষ্ট্রে ইসলামী নীতি ও আইনের পূর্ণাঙ্গ প্রয়োগ থাকে না। এই অপূর্ণাঙ্গতা দূর করে পূর্ণাঙ্গতা আনার চেষ্টা প্রশংসনীয় ও প্রয়োজনীয়। কিন্তু অপূর্ণাঙ্গতার মধ্যেও যতটুকু কল্যাণ ও মঙ্গল রয়েছে, সেটুকুও প্রশংসনীয়। তাই সেটুকুর প্রতিও মুগ্ধতার চোখে তাকানো দরকার। বাস্তবে সেটুকুর কল্যাণ ও সুফলও কম নয় বলে সময়ে সময়ে প্রতীয়মান হয়। হত্যার দায়ে সৌদি আরবে এক প্রিন্সের এই মৃত্যুদ- কার্যকরের ঘটনায় সেটি আরেকবার প্রমাণিত হলো। ইসলামী আইনের দৃষ্টিতে কোনো মানুষেরই কোনো আলাদা শ্রেষ্ঠত্ব কিংবা তুচ্ছতা নেই। রাজা-বাদশা কিংবা দল ও পদের কোনো প্রভাব নেই। নেই সংগঠনের নাম ভাঙ্গিয়ে খুন-জখম ও লুটপাট চালিয়ে যাওয়ার অবকাশ। শাস্তির প্রাপ্যতা ও কার্যকারিতা সবার ক্ষেত্রে সমান। বিচারের এই ঘটনাটির মধ্যে এই আইনী সমতার উজ্জ্বল নিদর্শনটি সামনে এলো।

আশ্চর্যের একটি ব্যাপার হলো, এ ঘটনাটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে সেভাবে প্রচারই করা হয়নি। মুসলিম বিশ্বের যে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতিদেখলেই যারা দফায় দফায় খবর প্রচার করেন- তারা যেন বিরস বদনে বড় অনিচ্ছায় খবরটি প্রকাশ করেছে। বড় ভয় তাদের- এ জাতীয় ঘটনার খবরে যদি আবার ইসলামী শাসনের ন্যায়পরায়ণতার কিছু ঝলক সামনে চলে আসে। এতে যদি আবার জনতার ভেতরে মুগ্ধদৃষ্টি সৃষ্টি হয়ে যায়। ইসলাম আর মুসলমানের প্রতি বিতৃষ্ণাঅনীহাকমে যায়।

কেউ কেউ আছেন, কথায় কথায় পশ্চিমা আইন ও বিচারের প্রতি সর্বাত্মক মুগ্ধতা ও আস্থা সমর্পণ করে থাকেন। তারা মনে করেন, যা কিছু কল্যাণ তার সব রয়েছে প্রগতিসম্পন্ন পশ্চিমের মধ্যে। তারা সেখানকার নারী-পুরুষের প্রতি অবিচার, হত্যা-ধর্ষণে বড় বড় নেতা ও ক্ষমতাধরদের সম্পৃক্ততা এবং তাদের বিচারের মুখচোরা কার্যক্রম দেখে এ ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে পারেন। আবার দেশের মধ্যে এমনও কিছু মানুষ রয়েছেন, যারা সৌদি আরবে শিরোচ্ছেদের ইতিপূর্বেকার কোনো কোনো ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, এসব মৃত্যুদণ্ডের বিচার কেবল গরিব ভিনদেশিদের বেলাতেই ঘটে থাকে। প্রভাবশালী সৌদি নাগরিকদের ক্ষেত্রে এমন বিচার ঘটতে দেখা যায় না। এ ঘটনা থেকে তারাও তাদের ভুল মত ও চিন্তাটাকে শুধরে নিতে পারেন। অপরদিকে এ ঘটনার পর এদেশীয় কেউ কেউ রসিকতা করে বলেছেন, সৌদি প্রিন্সের দুর্ভাগ্য, তিনি সৌদি আরবের রাজপরিবারে জন্ম নিয়েছেন। তিনি যদি বাংলাদেশের কোনো এমপি-মন্ত্রীর সন্তান হতেন, তাহলে তার জন্য যে কোনো রকম বে-আইনি কর্মকাণ্ডের সুযোগথাকতো অবারিত!  যে বা যারা এসব কথা বলেছেন, তারা খুব একটা ভুল কথা বলেছেন বলে দাবি করা যায় না। কারণ, গত কয়েকদিনে কয়েকজন মহিলা-এমপির ছেলেদের হত্যাকা--গুলি আর নানামুখি তা-বে থানা-পুলিশকে অস্থির হয়ে ছুটতে দেখা গেছে। এরপরও সফল কোনো ভূমিকা কিংবা কার্যকর কোনো বিচার চোখে পড়েনি।

বাস্তবে এই দল, সেইদল নেই- সব দলের দাপটেই এমপি-মন্ত্রী ও নেতা-নেত্রীদের এবং তাদের নিষ্পাপবাচ্চাদের দৌরাত্ম্য অনেক সময় মানুষের চোখের পানি ঝরিয়ে ছাড়ে। কিন্তু সেসবের সহজে কোনো বিচার পাওয়া যায় না।

ইসলামী আইনের সঠিক ও সমতাপূর্ণ এই বিচারের ঘটনাটি থেকে সব দেশের সবাই শিক্ষা নিতে পারেন। ইসলামী নীতি ও আইনের সাধারণ সুগন্ধিও যেখানে থাকে- সেখানেও সুবিচারের আলো বহু অন্যায়ের অন্ধকার দূর করে দিতে পারে। আমাদের বোধ, চিন্তা ও আকাক্সক্ষার পুনঃবিন্যাসে এই সুবিচারের ঘটনাটি অনেক বড় একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। 

 

 

advertisement