যিলকদ ১৪৩৭   ||   আগস্ট ২০১৬

দায়িত্ব : নজরদারির সুখ-দুঃখ

ওয়ারিস রব্বানী

খুতবা যেন এখন সবার। যে যেভাবে পারে এই খুতবায় শরিক হওয়ার ধুম লেগে গেছে। ২৪ জুলাইয়ের খবর, সংসদীয় কমিটির এমপিরাও এখন জুমা-পূর্ব খুতবা প্রণয়নে ভূমিকা রাখতে চাচ্ছেন। ফাউন্ডেশনের ডিজি একা মাতব্বরি দেখাবেন! এটা চলতে পারে না। এমপিরা কী করতে বসে আছেন! সুতরাং ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির সদস্য-এমপিরাও খুতবা রচনায় নিজেদের নাম জড়াতে চাচ্ছেন। অসহায় খুতবা! কোথায় কার হাতে গিয়ে পড়বে!

জুমাপূর্ব আরবি খুতবা এবং এর পূর্বের বাংলা বয়ানে এবার ইসলামিক ফাউন্ডেশনের নজর পড়েছে। গুলশান ও শোলাকিয়ার সন্ত্রাসী ঘটনার পর এ ইস্যুটির শুরু। জুলাইয়ের ১০ তারিখে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রিসভা কমিটির বিশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সে বৈঠক শেষে শিল্পমন্ত্রী আমীর হোসেন আমু বলেন, প্রতি শুক্রবার মসজিদে ইমামরা যে বয়ান দেন তার ধরন কী তা মনিটরিং করা হবে। ধর্মের অপব্যবহার করে যে অপকর্মগুলো ঘটানো হচ্ছে সে ব্যাপারে শুক্রবারের খুতবায় ইমামদের বলতে হবে।এরপর থেকেই শুরু হয় প্রতি শুক্রবারে মসজিদে মসজিদে নজরদারি এবং সরকারের তরফ থেকে সরবরাহ করা খুতবা পাঠের আয়োজন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে প্রথমে ১৫ জুলাই শুক্রবারের খুতবার আরবি ও বাংলা কপি মসজিদে মসজিদে পাঠানো হয়। সরাসরি সে খুতবা পড়তে কিংবা তা অনুসরণ করে বক্তব্য দিতে আহ্বানজানানো হয়। বাস্তবে ওই খুবতা পাঠ করা থেকে কেউ যেন বিরত না থাকে- সেজন্য মসজিদের ভেতরে-বাইরে পুলিশ ও দলীয় নেতাকর্মীদের থাকতে বলা হয়। এমনকি একজন মন্ত্রী হুংকার দিয়ে এ-ও বললেন, খুতবা মনিটরিং করা হচ্ছে। যেসব ইমাম ইসলামিক ফাউন্ডেশনের খুতবা পড়বেন না তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর মধ্যেই সরকারি খুতবা না পড়ায় নোয়াখালীর একজন ইমাম-হাফেয বেলালকে মারধর করে গ্রেফতার করানো হয়। যতদূর জানা গেছে, ফাউন্ডেশনের সরবরাহ করা খুতবার আরবি-বাংলা কপিতে প্রচুর ভুলত্রুটি পাওয়া গেছে। অভিযোগ উঠেছে, সরকার বিরোধী কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের নাম উল্লেখ করে তাদেরকে জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত বলে গালমন্দ করা হয়েছে লিখিত খুতবায়। এমনকি ইসলামী সরকারের কাঠামো নিয়ে প্রশ্নও তোলা হয়েছে। এর প্রায় সবকটি খবরই গণমাধ্যমের বরাতে দেশবাসী জানতে পেরেছেন।

তবে খুতবার মতো একটি ফরয ইবাদত বিষয়ে নজিরবিহীন এই টানাহেঁচড়া নিয়ে দেশের নিরপেক্ষ সুশীলদের কেউ কোনো কথা বলেছেন বলে শোনা যায়নি। দেশের সর্বোচ্চজন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে পর্যন্ত এ বিষয়ের যথাযথ চিত্র অবগত করানো হচ্ছে কি না - তা নিয়েও সন্দেহ দেখা দিয়েছে। অপর দিকে ইমাম-খতিবদের ওপর চালিয়ে দেওয়া এই এক-পাক্ষিক খুতবা নিয়ে সাধারণ দ্বীনদার নাগরিক কিংবা ছোট-বড় দুনিয়াবাদী রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক সংগঠনের লোকেরাও কোনো প্রতিবাদ করার ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না। এরই মধ্যে ২২ জুলাই দ্বিতীয়বার সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় খুতবা ছাপিয়ে মসজিদগুলোতে পাঠানো হয়েছে। ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, এখন থেকে অভিন্নখুতবা সরকারি প্রতিষ্ঠান ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রণয়ন করে সরবরাহ করা হবে এবং মসজিদে মসজিদে ইমামদের সেটাই পাঠ করতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, এগুলো কি ধর্মীয় কাজে সরকারি খবরদারি ও রাষ্ট্রীয় অনুপ্রবেশের একেকটি নযীর হিসেবে সাব্যস্ত হতে পারে না? দেখুন, সংবিধানে রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষকরা হয়েছে। অর্থাৎ রাষ্ট্রাচারের মধ্যে ধর্ম প্রবেশ করতে পারবে না। কিন্তু এসব ঘটনায় উল্টো একটি ব্যাপার ঘটতে দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, ধর্মের মধ্যে রাষ্ট্রাচারের প্রবেশ ঘটানো হচ্ছে। নমায-জুমা-খুতবা এগুলো তো নিরেট ধর্মীয় আচার। প্রশ্ন হতে পারে, এসবের মধ্যে রাষ্ট্রীয় খবরদারি, মনিটরিং, প্রণয়ন, সরবরাহ- এসব কি পরিষ্কার অনুপ্রবেশ নয়? রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ বানানো হলো রাষ্ট্রের মধ্যে ধর্মাচারের অনুপ্রবেশ না করাতে কিংবা কোনো একটি ধর্মের প্রাধান্য বন্ধ করতে। কিন্তু উল্টোটা তো নিশ্চয়ই উদ্দেশ্য হতে পারে না। ধর্মাচারের মধ্যে রাষ্ট্রাচারের অনুপ্রবেশ কিংবা কোনো একটি ধর্মের ধর্মাচারের মধ্যে রাষ্ট্রীয় নজরদারি ও খবরদারি কি ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞা কিংবা চেতনার মধ্যে পড়ে? ধর্মকে রাষ্ট্রের মধ্যে নিচ্ছেন না, ঠিক আছে। তাহলে রাষ্ট্রকে ধর্মের মধ্যে এবং একটি ধর্মের মধ্যে যে চাপিয়ে দিচ্ছেন এটা কি ঠিক হচ্ছে?

দেশের একটি প্রধান ধর্মের প্রতিষ্ঠান (মসজিদ), একটি প্রধান ধর্মের ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব (ইমাম-খতিব), একটি প্রধান ধর্মের ইবাদত (খুতবা ও জুমার নামায) নিয়ে নজরদারি, হস্তক্ষেপ ও ব্যবস্থা গ্রহণের পদক্ষেপ নেয়ার বক্তব্য ও কর্মসূচি ধমকের সঙ্গে ধ্বনিত হচ্ছে এবং পুলিশি কায়দায় বাস্তবায়িতও হচ্ছে। এগুলো কি ইনসাফ ও সমতার দিক থেকে সঠিক হচ্ছে? কিংবা সংশোধিত সংবিধানে ঘোষিত ধর্মনিরপেক্ষতারচেতনায় কি এই অসম নীতি সঠিক বলে স্বীকৃত হতে পারে? উল্টো করে একটা কথা বলি। এ পর্যন্ত কোনো দিন কোনো কারণে কি সরকারি ভাষ্যে এমন কথা বলা হয়েছে যে মন্দির ও গির্জাগুলোতে সরকারি নজরদারি হবে! ঠাকুর-ফাদার-পুরোহিতদের বক্তব্য ও প্রার্থনার ভাষা মনিটরিং করা হবে! তাদের ভাষায় আশানুরূপ বিবরণ পাওয়া না গেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে?’ এ রকম বলা হলেও কি সেটা সঙ্গত হতো? তাই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে এভাবে শিষ্টাচারশূন্য ভাষায়, আচরণে কিংবা সিদ্ধান্তে অভিযুক্তকরা কতটা সমীচীন হতে পারে? আশা করতে পারি সর্বোচ্চ দায়িত্বশীলদের কেউ না কেউ বিষয়টি গভীরভাবে ভেবে দেখবেন।

শুক্রবারে শুক্রবারে মসজিদে নজরদারি ও সরকারি খুতবা সরবরাহের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে হেফাজতে ইসলামসহ কোনো কোনো ইসলামী সংগঠন বক্তব্য দিয়েছে। এমনকি বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী পর্যন্ত প্রচ- ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘এরকম খুতবা ১০ বার দিলে দেশ থাকবে না।আমরাও এ বিষয়ে একটি কথা বলতে চাই। সরকারি প্রতিষ্ঠানের লিখিত খুতবা পড়িয়ে মুসল্লীদের কোনো কিছুই শেখানো যাবে না। উদ্বুদ্ধও করা যাবে না। বুঝানোও যাবে না। প্রশাসনের তৈরি জিনিসের প্রতি তীব্র অনীহার কারণেই এ খুতবায় কোনো ফায়দা হবে না। বরং এতে করে ইমাম-খতিবদের অনানুষ্ঠানিক মৌখিক বক্তব্যের কদর আরো বেড়ে যাবে। আইন করে, হুমকি দিয়ে, ভয় দেখিয়ে মসজিদের পরিবেশ নষ্ট না করে সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চলতে দিন। ইমামরা নিজ দায়িত্বেই সন্ত্রাস ও সশস্ত্র তৎপরতার বিরুদ্ধে বলবেন। অনাচার, অধর্ম ও অসততার বিরুদ্ধে বলবেন। আল্লাহর ইবাদতের দিকে মানুষকে ডাকবেন। ইমামদের এই স্বতঃস্ফূর্ত ডাকের পথে উৎপীড়কের ভূমিকা গ্রহণ করা শোভনীয় নয়। দিনশেষে সুফলদায়কও নয়। যারা সরকারের কর্তাদের কানে এ ভুল প্রক্রিয়ার সাফল্য  তুলে ধরছেন- তারা নির্ঘাত সরকারের ক্ষতি করছেন। 

 

 

advertisement