শাওয়াল ১৪৩৭   ||   জুলাই ২০১৬

তলাবায়ে কেরামের খিদমতে কিছু নিবেদন

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

অনেক দিন যাবৎ তালিবে ইলম ভাইদের খিদমতে হাজির হতে পারিনি। গত সংখ্যায় জনাব মাওলানা আবু সাইফুল্লাহর রোযনামচার পাতার উপর মাওলানা আব্দুল মাজীদের একটি পর্যালোচনা প্রকাশিত হয়েছে। আশা করি তাদের ইলমী সংলাপে পাঠক উপকৃত হয়েছেন। শিক্ষার্থীদের পাতায় এই দীর্ঘ অনুপস্থিতির আফসোস যেমন আমার অন্তরে রয়েছে তেমনি এ-ও সত্য কথা যে, আমার মাঝে এই বিভাগের খাদিম হওয়ার যোগ্যতা নেই। আমি নিজেই কি তালিবে ইলম যে, তালিবানে ইলমের খিদমত করতে পারি?

মাওলানা ফজলুল বারীর বারবার তাগাদায় আজ কিছু লিখতে বসেছি। কিন্তু কী লিখব? কী বিষয়ে লিখব? আরব-আজমের কয়েকজন বুযুর্গের ইলম ও তালিবে ইলম বিষয়ে বেশ কিছু লেখার উপর নজর বুলিয়েও কোনো বিষয় নির্ধারণ করতে পারছি না। কারণ, তাঁদের নির্দেশনাগুলো আমাদের জন্য প্রযোজ্য মনে হচ্ছে না। আমাদের অবস্থা তো খুবই শোচনীয়। তাদের পরামর্শ ও নির্দেশনা আমাদের চেয়ে অনেক ভালো অবস্থার তালিবানে ইলমের জন্য। তো শেষে মনে হল, বিশেষ কোনো বিষয়বস্তুর বদলে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু প্রয়োজনীয় কথা নিবেদন করি। উপকার দেয়া আল্লাহর কাজ। তাঁরই কাছে উপকারের জন্য দুআ করছি।

আমার প্রিয় তালিবানে ইলম!

গভীর কল্যাণকামিতার সাথে কিছু কথা নিবেদন করছি। আশা করছি অনুরূপ চেতনার সাথেই আপনারা তা গ্রহণ করবেন।

১. মঞ্জিল কী?

আজকাল অনেক তালিবে ইলম এই দ্বন্দ ও দ্বিচারিতার শিকার যে, মাদরাসায় তারা যে নেসাব-নেযামের উপর চলে তাদের দৃষ্টিতে এই নেসাব-নেযামের লক্ষ্য তাদের জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থেকে আলাদা। এ কারণে তারা স্বনির্ধারিত লক্ষ্যে উপণীত হওয়ার জন্য আলাদা ও স্বনির্বাচিত নেসাব-নেযামের প্রয়োজন বোধ করে। তো এক ব্যক্তি একই সাথে দুই নেসাব ও নেযামের অনুসারী কীভাবে হতে পারে? বিশেষত, যখন মাদরাসার কর্তৃপক্ষ তার হাকিম ও দায়িত্বশীল আর তালিবে ইলম মাহকুম ও অধীন। কারণ সে ভর্তি ফরমে অঙ্গিকার করে মাদরাসা কর্তৃপক্ষের আনুগত্য স্বীকার করে নিয়েছে। এখন যদি সে আলাদা নেযাম অবলম্বন করতে চায় তাহলে চিন্তার বিক্ষিপ্ততার পাশাপাশি অনেক সময় কর্মক্ষেত্রেও তাকে বা তার প্রতিষ্ঠানকে নানা পেরেশানীর মুখোমুখি হতে হয়।

কথা এখনও পরিষ্কার হয়নি। আমি আরজ করতে চাচ্ছি যে, অনেক তালিবে ইলম, আরো সতর্কভাবে বললে, আজকাল কিছু তালিবে ইলম মাদরাসার নেসাব ও নেযামের গন্তব্য মনে করে পুরনো ধারার একজন মৌলভী হওয়া। অর্থাৎ একজন তালিবে ইলম মাদরাসার নেসাব ও নেযামের প্রাচীন ধারার একজন ভালো মৌলভী হতে পারে কিন্তু ওরা একে নিজের জীবনের লক্ষ্য মনে করতে রাজি নয়; বরং ওরা মনে করে ওদের লক্ষ্য নীচের এক বা একাধিক বিষয়-

ক. আরবী ভাষার সাহিত্যিক হওয়া

খ. বাংলা ভাষার সাহিত্যিক হওয়া

গ. ইংরেজী ভাষায় পারদর্শী হওয়া

ঘ. লেখক হওয়া

ঙ. সার্টিফিকেট অর্জন করা (যেমন, আলেম, ফাযেল, কামেল বা ডক্টর হওয়া)

চ. কায়েদে মিল্লাত হওয়া

ছ. রাজনৈতিক নেতা হওয়া

জ. জনসেবার নানা কাজের সূচনা

ঝ. আপডেট থাকার জন্য মোবাইল, কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের সব বিষয়ে পারদর্শী হওয়া ইত্যাদি।

আমি আদবের সাথে আরজ করতে চাই যে, ঐ বন্ধুরা না মাদরাসার নেসাব ও নেযামের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সঠিকভাবে উপলব্ধি করেছেন, না তারা নিজেদের জন্য যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন তা কোনো তালিবে ইলমের লক্ষ্য ও গন্তব্য হতে পারে। উপরের কিছু বিষয় তো একেবারেই বেহুদা। আর কিছু বিষয় হচ্ছে দ্বীনের খেদমতের কিছু অঙ্গন, যা তালিবে ইলমের জন্য ভবিষ্যতে মশোয়ারা অনুযায়ী ইখলাস ও ইতকানের শর্ত সাপেক্ষে কর্মের ময়দান হতে পারে। কিন্তু সেটা তালিবে ইলমের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কখনো নয়।

আমাদের কওমী মাদরাসাগুলোর নেসাব ও নেযামের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য তো আমরা কুরআন-সুন্নাহ থেকেই গ্রহণ করতে পারি। আর তা এই-

১. তাফাক্কুহ ফিদ্দীন (দ্বীনের গভীর প্রজ্ঞা অর্জন করা) অর্থাৎ দ্বীনের ঐ পর্যায়ের প্রজ্ঞা অর্জন করা যা কওমের এক মুনযিরও রাহনুমার প্রয়োজন। [সূরা তাওবা (৯) : ১২২ থেকে গৃহীত]

২. রুসূখ ফিল ইলম (ইলমের দৃঢ়তা ও পরিপক্কতা) অর্থাৎ ইলম এত দৃঢ় ও পরিপক্ক হবে যে, ‘মুহকামাত’ (দ্বীনের কাওয়াইদও দ্ব্যর্থহীন অকাট্য মর্ম বিশিষ্ট নুসূস)-এর আলোকে মুতাশাবিহাতসম্পর্কে যা বোঝা ও বর্ণনা করা কাম্য তা বুঝতে ও বর্ণনা করতে পারে, আর কোনো বাতিলপন্থীর প্রশ্ন ও কূটযুক্তির কারণে নিজের সত্য জ্ঞানে কোনো সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি না হয়। [সূরা আলে ইমরান (৩) : ৭ থেকে গৃহীত]

৩. ইলম বিল্লাহ ও ইলম বি আমরিল্লাহ (আল্লাহকে জানা ও তাঁর আদেশসমূহ জানা) আর এই ইলমের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দাবিসমূহ যথা ইত্তেবায়ে সুন্নত, তাকওয়া, আমল ও ইসলামী আদব যা নবীগণের মীরাছ, তা অর্জন করা। [সূরা ফাতির (৩৫) : ২৮-এর অধীনে তাফসীরে ইবনে কাছীর এবং হাদীস العلماء ورثة الأنبياء থেকে গৃহীত]

. সালাহিয়্যাত যোগ্যতা। অর্থাৎ ইলমে ওহীর হেদায়াত ইনযারে ক্বওমের যোগ্যতা অর্জন করা। [সূরা তাওবা () : ১২২ এবং হাদীস-  يَحْمِلُ هَذَا الْعِلْمَ مِنْ كُلِّ خَلَفٍ عُدُولُهُ ... থেকে গৃহীত]

এই চার মাকসাদের মৌলিক স্তর অর্জনের জন্য সাধারণভাবে মাদরাসাগুলোতে (নানাবিধ ত্রুটি ও দুর্বলতা সত্ত্বেও) নিম্নোক্ত কাজগুলো জারি রয়েছে :

১. দরসী নেসাব

এর মূল উদ্দেশ্য ইলমী ইসতিদাদ তৈরি করা।

২. আমলী তামরীন

এটি প্রথমটিরই পরিশিষ্ট ও পরিপূরক। অবস্থাভেদে এর আরো কিছু মাকসাদও হতে পারে।

৩. ইযাফী মুতালাআ

যা প্রত্যেক জামাআতের; বরং প্রত্যেক তালিবে ইলমের যোগ্যতা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠান বা উস্তাযের দিক-নির্দেশনায় সম্পন্ন হওয়া চাই। এর মূল উদ্দেশ্য তো দ্বীন ও ঈমান এবং দ্বীনী উলূমের ঐ সকল প্রয়োজনীয় বিষয়াদির সাথে পরিচিতি লাভ করা, যা দরসী নেসাবে নেই। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য, মুনযিরে ক্বওম বা জাতির সতর্ককারীর গুণ ও বৈশিষ্ট্যের সাথে পরিচিত করা। অবস্থাভেদে আরো কিছু উদ্দেশ্যও রয়েছে।

৪. সোহবত ও তরবিয়ত

মাদরাসাসমূহের তরবিয়তী কার্যক্রম এবং উস্তাযের সোহবত ও সাহচর্য থেকে গ্রহণের বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এর মূল উদ্দেশ্য, তালিবে ইলমের জীবনে যেন ইসলামী আহকাম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত এসে যায়। আর তার কর্ম ও চরিত্রে ইসলামী আদব আসে। অন্তরে তাকওয়া ও তাওয়াযু আসে। চিন্তা-ভাবনায় বিশুদ্ধি আসে, রুচি ও মেযাজে ভারসাম্য আসে এবং তার মধ্যে নিজের ঈমানের দরদ ও উম্মতের দরদ পয়দা হয়। এই সকল বিষয় সামনে রেখে যে স্থিরচিত্তে সত্যিকার অর্থে চিন্তা-ভাবনা করবে ইনশাআল্লাহ, সে উপলব্ধি করতে পারবে যে, তালিবে ইলমকে মাদরাসার জীবন থেকে যা কিছু গ্রহণ করতে হবে তন্মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে :

ক. ইসলামী আদব-কায়দা, বিশেষত বেশভূষা ও সমষ্টিগত জীবনের আদব-কায়দা।

খ. ইসলামী আখলাক, বিশেষত ইখলাস, তাওয়াযু, তাকওয়া ও ইনাবত।

গ. পাকা ইলমী ইসতিদাদ, অন্তত কিতাবী ইসতিদাদের পর্যায়ে।

ঘ. দ্বীনের সাধারণ বুঝ, চিন্তার শুদ্ধতা ও মেযাজের ভারসাম্য।

এসকল গুণ ও বৈশিষ্ট্য যদি কোনো তালিবে ইলম মাদরাসার জীবনে অর্জন করতে পারে তাহলে তলব ও মেহনত অব্যাহত থাকলে ইনশাআল্লাহ সে এমন সকল গুণ ও যোগ্যতা অর্জনেও সক্ষম হবে যা খেদমতে দ্বীনের যে কোনো বিভাগে কাজ করার জন্য প্রয়োজন। বা যা কোনো যুগসচেতন রাহবার ও রাহনুমার জন্য অপরিহার্য।

আর যদি এসকল গুণাবলী মাদরাসা থেকে অর্জিত না হয় তাহলে দ্বীনের খেদমতের কোনো বুনিয়াদী কাজ করা তো দূরের কথা, নিজেকে সিরাতে মুসতাকীমের উপর রাখাও কঠিন বরং ক্ষেত্রবিশেষে অসম্ভব হয়ে পড়বে।

আফসোসের বিষয় এই যে, আমাদের এক শ্রেণীর তালিবে ইলম মাদরাসার জীবনে এই চার বুনিয়াদী গুণ অর্জনে উদাসীনতার পরিচয় দিয়ে থাকে, যা তার পুরা ইলমী ও আমলী যিন্দেগীর বুনিয়াদ। এগুলো ছেড়ে তারা স্ব স্ব নির্ধারিত লক্ষ্যে উপণীত হওয়ার জন্য স্ব-নির্ধারিত পথে চলে।

আমার প্রিয় ভাইয়েরা!

ভালোভাবে বুঝে নিন, আমার লক্ষ্য, কওমের খাদিম হওয়া। কিন্তু আমার মধ্যে যদি পাকা ইলমী ইসতিদাদ না থাকে তাহলে যবান ও কলমের দ্বারা কওমের কাছে আমি কী পেশ করব? দ্বীন ও শরীয়তের দলীল ও দ্বীনী-উলূমের উৎসসমূহ থেকে কওমকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা আমি কীভাবে দিব? তাদের সমস্যাগুলোর সমাধান কীভাবে আহরণ করব?

আমার মধ্যে যদি দ্বীনের সাধারণ বুঝ এবং চিন্তা-ফিকিরের শুদ্ধতা ও ভারসাম্য না থাকে তাহলে আমার খেদমত বিশুদ্ধ ও প্রান্তিকতামুক্ত কীভাবে হবে?

আমার মধ্যে যদি ইখলাস, আদব ও তাওয়াযু না থাকে; বরং আমি হই আত্মগর্ব এবং ইলম ও হেদায়েতের অহমিকাগ্রস্ত তাহলে আমার খেদমত আল্লাহর কাছেই বা কীভাবে মকবুল হবে, আল্লাহর বান্দাদের জন্যই বা কীভাবে উপকারী হবে? আর আমাকে স্বীকৃত খাদেমে দ্বীন হিসেবেই বা কে গ্রহণ করবে?

সুতরাং আমার ভাইয়েরা! আমাদের ভালোভাবে বুঝে নেওয়া উচিত যে, আমরা যদি মাদরাসার জীবনে সবকিছু অর্জন করি কিন্তু উপরের ঐ চার গুণ অর্জন না করি তাহলে আমাদের জীবন ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর যদি ঐ চার গুণ ছাড়া আর কিছুই অর্জন করতে না পারি তাহলেও অন্য সব কিছুর জন্য আমার পথ মসৃণ। আল্লাহ করুন, এ কথাটি আপনাদের হৃদয়ঙ্গম হোক।

আমার প্রিয় ভাই!

নিজের আকাবিরের সীরাত পড়ন। তাদের সকলের পারদর্শিতার বিষয় অভিন্ন ছিল না, কর্মক্ষেত্রও এক ছিল না। কিন্তু প্রত্যেকের তালিবে ইলমীর যিন্দেগী মনোযোগের সাথে পাঠ করুন। এই সাধারণ বিষয়টি প্রত্যেকের মধ্যে পাবেন যে, তালিবে ইলমীর যিন্দেগীতে উপরের চার গুণের কোনো একটি অর্জনেরও প্রতিবন্ধক হতে পারে এমন কোনো ব্যস্ততা বা অধ্যয়নে তাঁরা লিপ্ত হননি। তাঁদের ইযাফী মুতালাআ ও তামরীনী কাজ সব কিছুই সীমার ভিতরে ছিল এবং বড়দের নির্দেশনা অনুসারে সুচিন্তিত ছিল।

অথচ নিজের জন্য আলাদা মানযিল ও আলাদা পথ নির্বাচনকারীদের ইযাফী মুতালাআ ইযাফীনয়, বিলকুল আজনবী। এবং সীমা-সরহদবিহীন লাগামহীন মুতালাআ। এই আজনবীমুতালাআর পাশাপাশি তাদের আজনবীকর্মেরও কোনো সীমা নেই।

আমার বন্ধুরা!

নিজের বড়দের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ো না। তাঁদের চলার পথ থেকে বিচ্যুত হয়ো না।

নোট : লেখার ইচ্ছা ছিল কিছুকথা, কিন্তু এখন একটি কথা বলেই শেষ করছি। আল্লাহ যদি তাওফীক দান করেন বাকী কথা সামনে কখনো বলার ইচ্ছা রইল ইনশাআল্লাহ।

ওয়াস সালাম

বান্দা মুহাম্মদ আবদুল মালেক

৮ রমযানুল মুবারক ১৪৩৭ হি.

 

 

advertisement