যিলহজ্ব ১৪৩৬   ||   অক্টোবর ২০১৫

বাইবেল সংশোধন : কিছু কথা

আবূ মাইসারা মুনশী মুহাম্মাদ মহিউদ্দিন

আল্লাহর কালামঅনুপ্রাণিত পুস্তকহিসেবে দাবীকৃত বাইবেল রচিত, সম্পাদিত, সংশোধিত ও সংশোধনযোগ্য- এ কথা প্রায় সকল খ্রিস্টান পণ্ডিতই বিশ্বাস করেন। বাইবেল সংশোধনের ধারা বাইবেল রচনার পর থেকে আজও পর্যন্ত অব্যাহত আছে। খ্রিস্টান পণ্ডিতগণ বিভিন্ন সময় বাইবেল সংশোধন করে বলেছেন, এটি সংশোধিত ও নির্ভরযোগ্য বাইবেল। পরবর্তীতে সেই সংশোধিত বাইবেলেই পাওয়া গেছে হাজারো ভুল। পুনরায় খ্রিস্টান পণ্ডিতগণ আল্লাহর কালামসংশোধনে রত হয়েছেন! প্রকাশিত হয়েছে সংশোধিত সংস্করণ।

 বাইবেলের ভুল ও সংশোধন বিষয়ে লূক ম্যাগাজিনে(Look magayine) The truth about the bible  শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় ২৬ শে ফেব্রæয়ারি ১৯৫২ সংখ্যায়। লেখক হার্টজেল স্পেন্স তার প্রবন্ধটি শুরু করেন একটি প্রশ্ন দিয়ে, ‘আমরা আজ যে বাইবেলটি পড়ছি তা কতটুকু নির্ভুল?’ কিন্তু গোটা প্রবন্ধে লেখক কোথাও প্রশ্নটির উত্তর দেননি।

লেখক হার্টজেল স্পেন্স বাইবেলের শুধু নতুন নিয়মের (প্রচলিত ইঞ্জিলের) ভুলের পরিসংখ্যান দিয়ে বলেন, "as early  as 1720, an English authority estimated that there were at least 20,000 errors in the two editions of the Nwe Testament commonly read by Protestants and Catholics. Modern students say there are probably 50,000 errors."

অর্থাৎ ১৭২০ সালের দিকে এক ইংরেজ পণ্ডিত জরিপ করে দেখান যে, নিউ টেস্টামেন্টের (প্রচলিত ইঞ্জিল) দুটি সংস্করণ যেগুলো প্রোটেস্টেন্ট এবং ক্যাথলিক খ্রিস্টানগণ সাধারণভাবে পড়ে থাকেন, তাতে অন্তত ২০ হাজারের মত ভুল রয়েছে; আধুনিক শিক্ষার্থীদের মতে ভুলের সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার।

এরপর লেখক বাইবেলের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ভুলের কথা উল্লেখ করেন।

বাইবেলের বিকৃতি সম্পর্কে খ্রিস্টান পণ্ডিত পাদ্রী ফান্ডার আল্লামা রাহমাতুল্লাহ কীরানবী রাহ.-এর সাথে প্রকাশ্যে বিতর্কের সময় স্বীকার করেন যে, পুরাতন ও নতুন নিয়মের গ্রন্থগুলিতে ৪০ হাজার স্থানে ভুল আছে। (আল মুনাজারাতুল কুবরা, পৃষ্ঠা: ৩৩৭, দ্বিতীয় প্রকাশ: ১৪১০ হিজরী/১৯৯০ ইংরেজী, মাতাবেউস সফা, মক্কা)

দি প্লেইন ট্রুথ(The Plain Truth) পত্রিকার জুলাই, ১৯৭৫ সংখ্যায় John R. Schroeder তার The bible: world's most controversial book প্রবন্ধে বাইবেলের ভুল ও সংশোধনের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন,

"There are claimed contradictions that theologians have not resolved to every atheist's satisfaction. There are textual difficulties with which scholars are still wrestling. Only a Bible illiterate would deû these and other problems." অর্থাৎ এ সকল সুনিশ্চিত পরস্পরবিরোধী বিষয়ে খ্রিস্টান ধর্মতত্ত¡বিদেরা এমন কোনো সমাধান পেশ করতে পারেননি, যা ধর্মবিশ্বাসীদের সন্তুষ্ট করতে পারে। আর মূলগ্রন্থের পাঠ বা টেক্সটের সমস্যার সমাধানে আজও খ্রিস্টান পণ্ডিতগণ যার-পর-নাই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। শুধুমাত্র বাইবেলের বিষয়ে অজ্ঞ লোকেরাই অন্য আরো সমস্যাসহ এ সমস্যাগুলোকে অস্বীকার করে থাকেন।

যাহোক প্রায় পাঁচ বছর পর হার্টজেল স্পেন্সের সেই প্রবন্ধের পর্যালোচনামূলক একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় এ্যাওয়েক’ (অধিশব) নামের খ্রিস্টানদের একটি পাক্ষিক পত্রিকার ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৫৭ সংখ্যায়। প্রবন্ধটির শিরোনাম ছিল বাইবেলে ৫০,০০০ ভুল?’ (50,000 Errors in the Bible?)

উল্লেখ্য, ‘এ্যাওয়েকপত্রিকাটি জেহোভাজ উইটনেসেস’ (বাংলাদেশে যারা যিহোবার সাক্ষিনামে পরিচিত) নামক একটি খ্রিস্টান সম্প্রদায় কর্তৃক প্রকাশিত। মানুষের দুয়ায়ে দুয়ারে গিয়ে যারা সবচেবেশি খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার করে থাকেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন এ জেহোভাজ উইটনেসেসসম্প্রদায়। বাইবেলের এ পরিমাণ মারাত্মক ভুল সম্পর্কে তাদের মাথাব্যাথা হওয়ারই কথা!

"50,000 Errors in the Bible?" প্রবন্ধের লেখক বাইবেলের ৫০,০০০ ভুলের কথা প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে তা স্বীকার করেছেন। এমনকি বাইবেলের মারাত্মক কয়েকটি ভুল (যেগুলোর কথা হার্টজেল স্পেন্স তার প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন) তুলে ধরে  সেগুলো ভুল হওয়ার প্রমাণও উল্লেখ করেছেন। অবশেষে আল্লাহর কালামবাইবেল সংশোধনের দাবি করে বলেছেন, “অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, লেখকের (হার্টজেল স্পেন্সের) প্রবন্ধে উল্লেখিত ভুলগুলো সবচেয়ে আধুনিক অনুবাদে ইতিমধ্যেই সংশোধন করা হয়েছে।

এ নিবন্ধে ঐ ভুলগুলো এবং সে সম্পর্কে খ্রিস্টান গবেষকদের বক্তব্য ও বাস্তবতা নিয়ে কিছু কথা নিবেদন করতে চাই।

এক. প্রক্ষিপ্ত পদ

হার্টজেল স্পেন্সের উল্লেখিত ভুলগুলোর একটি ছিল, যোহন সুসমাচারের ৭ : ৫৩ থেকে ৮ : ১১ পদ, মার্ক সুসমাচারের ১৬ : ৮-২০ পদ এবং ১ যোহন ৫ : ৭-৮ পদদুটি। অর্থাৎ এ পদগুলো বাইবেলে প্রক্ষিপ্ত হয়েছে। বাইবেলের পুরাতন পাণ্ডুলিপিতে এগুলো নেই। আর প্রবন্ধকারের দাবি অনুযায়ী বাইবেলের আধুনিক অনুবাদগুলোতেও এগুলোকে সংশোধন করা হয়েছে। অন্য ভাষায়, বাইবেল থেকে পদগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে। অথচ পাঠক বাংলা বাইবেলের কোনো একটি কপি হাতে নিয়ে সংশ্লিষ্ট অধ্যায়গুলো দেখুন, উপরোক্ত পদগুলো আজও বাইবেলে বিদ্যমান। এমনকি মঙ্গলসমাচারে পাদটীকায় সেগুলোর প্রক্ষিপ্ত হওয়ার বিষয়টি স্পষ্টভাবে স্বীকার করেও পদগুলো আপন জায়গায় বহাল রাখা হয়েছে। একি এ জন্য যে, এগুলো বাদ দিলে খ্রিস্টানদের মৌলিক আকীদা-বিশ্বাসই প্রমাণহীন হয়ে পড়বে?

প্রথম ভুলটি যোহন সুসমাচারের ৭ : ৫৩- ৮ : ১১ পদ সম্পর্কিত। বাংলা বাইবেল থেকে তা উদ্ধৃত করছি।

এর পরে লোকেরা প্রত্যেকে যে যার বাড়ীতে চলে গেল, কিন্তু ঈসা  জৈতুন পাহাড়ে গেলেন। ...

হুযুর, এই স্ত্রীলোকটি জেনায় ধরা পড়েছে। তৌরাত শরীফে মূসা এই রকম স্ত্রীলোকদের পাথর ছুঁড়ে হত্যা করতে আমাদের হুকুম দিয়েছেন। কিন্তু আপনি কী বলেন?’...

আপনাদের মধ্যে যিনি কোনো গুনাহ্ করেননি তিনিই প্রথমে ওকে পাথর মারুন।এর পরে তিনি নীচু হয়ে আবার মাটিতে লিখতে লাগলেন।...

স্ত্রীলোকটি জবাব দিল, ‘জ্বী না হুযুর, কেউই করেননি।

তখন ঈসা বললেন, ‘আমিও করি না। আচ্ছা যাও; গুনাহে জীবন আর কাটায়ো না।’” (যোহন ৭ : ৫৩-৮ : ১১, ধর্ম্মপুস্তক, ১৮৬৬ ইং; যোহন ৮ : ১-১১, ধর্ম্মপুস্তক, ১৮৭৭ ইং; যোহন ৮ : ১-১১, ধর্ম্মপুস্তক, ১৯০৯ ইং; যোহন ৭ : ৫৩-৮ : ১১, মঙ্গলবার্তা, ১৯৮৫ ইং; যোহন ৮ : ১-১১, পবিত্র বাইবেল, বি.সি.বি ২০০০ ইং; যোহন ৮ : ১-১১, নতুন নিয়ম, বি.বি.সি ২০০১ ইং; ইউহোন্না ৮ : ১-১১, ইঞ্জিল শরীফ, বি.সি.বি ১৯৮০ ইং; ইউহোন্না ৮ : ১-১১, কিতাবুল মোকাদ্দস, বি.সি.বি ২০০৬ ইং; যোহন ৭ : ৫৩-৮ : ১১, জুবিলী বাইবেল, ২০০৬ ইং বাংলাদেশ কাথলিক বিশপ সম্মিলনী)

ব্যভিচারের শাস্তি রহিতকরণ সম্পর্কিত বাইবেলের এ বর্ণনা সম্পর্কে "৫০,০০০ ঊৎৎড়ৎং রহ ঃযব ইরনষব?" প্রবন্ধের লেখক বলেন, “‘সিনেইটিক ম্যানুস্ক্রিপ্ট’, ‘১২০৯ নং ভ্যাটিক্যান ম্যানুস্ক্রিপ্টএবং সিনেইটিক সিরিয়াক কোডেক্সে’ (বাইবেলের প্রাচীন পাণ্ডুলিপিতে) এই কথাগুলো (উল্লেখিত পদগুলো) নেই।

জেনে রাখা ভালো যে, ‘সিনেইটিকএবং ১২০৯ নং ভ্যাটিক্যান ম্যানুস্ক্রিপ্টহচ্ছে চতুর্থ শতাব্দিতে বিদ্যমান সবচে প্রাচীণ দুটি পাণ্ডুলিপি। এই শ্লোকগুলো পাওয়া যায় ষষ্ঠ শতাব্দীর কোডেক্স বিজায়চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীর ল্যাটিন ভালগেতএবং ষষ্ঠ শতাব্দীর জেরুজালেম সিরিয়াক ভার্সনে। কিন্তু যেহেতু সর্বপ্রাচীন গ্রীক পাণ্ডুলিপিগুলোতে এই পদগুলো নেই সেহেতু এগুলোর উৎপত্তি সন্দেহজনক।

পদগুলো সম্পর্কে মঙ্গলবার্তার টীকাকার লেখেন, “(৭ : ৫৩-৮ : ১১) যেসব গ্রীক পাণ্ডুলিপি সবচেয়ে প্রাচীন ও নির্ভরযোগ্য বলে গৃহীত, সেগুলির শুধুমাত্র একটিতেই এই কাহিনীর উল্লেখ আছে।... গ্রীক মণ্ডলীর প্রাচীন মহাচার্যদের কোনো রচনায় এর উল্লেখ নেই,... আজকাল প্রায় সকলেই মনে করেন যে, এই অংশটি সাধু যোহনের (যোহন সুসমাচারের লেখকের) লেখা নয়। এটি কার লেখা, এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়।” (মঙ্গলবার্তা, পৃষ্ঠা ২৬৭, দ্বিতীয় প্রকাশ ১৯৮৫, জেভিয়ার প্রকাশনী ৩০, পার্ক স্ট্রীট, কলিকাতা) যোহন সুসমাচারের ৭ : ৫৩-৮ : ১১ পদগুলোর প্রক্ষিপ্ত হওয়ার এত স্বীকারোক্তির পরও খ্রিস্টান পণ্ডিতগণ বাইবেলের এ ভুলটি সংশোধন করেননি। আগেকার বাইবেলের বাংলা অনুবাদকগণ পদগুলোকে তৃতীয় বন্ধনীর মধ্যে লিখতেন এবং টীকায় প্রক্ষিপ্ত হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করতেন- যাতে পাঠক বুঝতে পারেন যে, বিষয়টি সন্দেহজনক। কিন্তু সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলা বাইবেলে না আছে তৃতীয় বন্ধনী, না আছে কোনো টীকা। তবে তারা বাড়তি আরেকটি কাজ করেছেন, যোহন সুসমাচারের ৭ : ৫৩ পদটিকে ৮ : ১ পদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে ৭ অধ্যায়কে ৫২ পদেই শেষ করেছেন।

দুই. মার্ক সুসমাচারের শেষ বারটি পদ

হার্টজেল স্পেন্সের উল্লেখিত ভুলগুলোর দ্বিতীয়টি ছিল, মার্কের ষোলতম অধ্যায়ের শেষ বারটি পদ সম্পর্কিত। পদগুলো হল:

সপ্তার প্রথম দিনের ভোর বেলায় ঈসা মৃত্যু থেকে জীবিত হয়ে উঠলেন। ... ঈসা জীবিত হয়েছেন ও মরিয়ম তাঁকে দেখেছেন, এই কথা শুনে তাঁরা বিশ্বাস করলেন না।... তাঁরা ফিরে গিয়ে বাকী সবাইকে সেই খবর দিলেন, কিন্তু তাঁদের কথাও অন্য সাহাবীরা বিশ্বাস করলেন না।

এর পরে ঈসা তাঁর এগারোজন সাহাবীকে দেখা দিলেন। তখন তাঁরা খাচ্ছিলেন। বিশ্বাসের অভাব ও অন্তরের কঠিনতার জন্য তিনি তাঁদের বকলেন, কারণ তিনি মৃত্যু থেকে জীবিত হয়ে উঠবার পরে যাঁরা তাঁকে দেখেছিলেন তাঁদের কথা তাঁরা বিশ্বাস করেননি।

ঈসা সেই সাহাবীদের বললেন, ‘তোমরা দুনিয়ার সব জায়গায় যাও এবং সব লোকদের কাছে আল্লাহ্র দেওয়া সুসংবাদ তবলিগ কর।

যে কেউ ঈমান আনে এবং তরিকাবন্দী নেয় সে-ই নাজাত পাবে; কিন্তু যে ঈমান আনে না আল্লাহ্ তাঁকে দোষী বলে স্থির করে শাস্তি দেবেন।...

সাহাবীদের কাছে এইসব কথা বলবার পরে হযরত ঈসাকে বেহেশতে তুলে নেওয়া হল। সেখানে তিনি আল্লাহর ডান দিকে বসলেন।

পরে সাহাবীরা গিয়ে সব জায়গায় তবলিগ করতে লাগলেন। হযরত ঈসা তাঁদের মধ্য দিয়ে তাঁদের সংগে কাজ করতে থাকলেন এবং তাঁদের অলৌকিক কাজ করবার শক্তি দিয়ে প্রমাণ করলেন যে, তাঁরা যা তবলিগ করছেন তা সত্যি।” (মার্ক ১৬ : ৯-২০, প্রগুক্ত)

এ বারটি পদ সম্পর্কে "50,000 Errors in the Bible?" প্রবন্ধের লেখক বলেন, “কারণ, বাইবেলের প্রাচীন কিছু ভার্সন এবং পাণ্ডুলিপিতে একটি দীর্ঘ উপসংহার প্রক্ষিপ্ত হয়েছে। কিন্তু, ‘সিনেইটি’, ‘১২০৯ নং ভ্যাটিক্যান’, ‘সিনেইটিক সিরিয়াক কোডেক্সএবং চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দির আমেরিকান ভার্সনে এই অনুচ্ছেদটি নেই। এ কারণে এর সত্যতা সন্দেহজনক।

মঙ্গলবার্তার টীকাকার লেখেন, “অনেক ভাষ্যকার মনে করেন যে, মার্কের মঙ্গলসমাচারের শেষ অংশটি হারিয়ে গেছে। তাদের মতে তা হারিয়ে যাওয়ার পর তার রচনাটিকে সমাপ্ত করার জন্য শেষ অংশটি (৯-২০) যোগ করা হয়েছিল। এই শেষ অংশটি প্রথম শতাব্দীতেই লেখা হয়েছিল। মার্ক নিজেই কি এ অংশটির লেখক, এই বিষয়ে জোর দিয়ে কিছু বলা যায় না।

টীকাকার সামনে আরো বলেন, “পঞ্চম শতাব্দীর একটি পাণ্ডুলিপিতে ৯-২০ অংশটির পরিবর্তে এই ক্ষুদ্রতর সমাপ্তিপাওয়া যায়:...। পরবর্তী আরও চারটি পাণ্ডুলিপি আছে, যেখানে একইসঙ্গে দুটি সমাপ্তির উল্লেখ রয়েছে।” (মঙ্গলবার্তা, পৃষ্ঠা ১৪৬-১৪৭)

ব্রিটিশ ও ফরেন বাইবেল সোসাইটি, কলকাতা থেকে ১৯০৯ সালে প্রকাশিত বাংলা বাইবেলের সংশোধিত সংস্করণ ধর্ম্মপুস্তকেমার্কের ১৬ অধ্যায়ের শেষ বারটি পদকে একটু আলাদা করে লেখা হয়েছে; দুই পরিচ্ছেদের মাঝে রাখা হয়েছে একটু ফাঁকা। অথচ বাংলা বাইবেলের ঐ সংস্করণটিতে সাধারণত দুই পরিচ্ছেদের মাঝে কোন ফাঁকা রাখা হয় না। কিন্তু মার্কের ১৬ অধ্যায়ের শেষ বারটি পদের ক্ষেত্রে অনুবাদকগণ এ ভিন্নতা অবলম্বন করেছেন।

মার্ক সুসমাচারের এ শেষ বারটি পদ নিয়ে এতকিছু- কোনো সংস্করণে পাদটীকা  লেখা হচ্ছে। কোনো ভার্সনে লেখা হচ্ছে টীকা; আবার কোনোটিতে  ছোট অক্ষরে লেখা হচ্ছে। কোন সংস্করণে ফাঁকা রাখা হচ্ছে। এতকিছু কিন্তু তা বাদ দেওয়া হচ্ছে না কেন? কেন এত কাঠখড় পোড়ানো?

আসলে বর্তমান খ্রিস্টান ধর্মের মৌলিক আকীদা-বিশ্বাস ও খ্রিস্টানদের ধর্মপ্রচারের মূলমন্ত্র হচ্ছে মার্ক সুসমাচারের এ শেষ বারটি পদ, যা মূলত পরবর্তীতে প্রক্ষিপ্ত। এ কথা খোদ খ্র্রিস্টান পণ্ডিতগণও স্বীকার করেন। এগুলো বাদ দিলে তো খ্রিস্টানধর্ম প্রাণহীন হয়ে পড়বে, এজন্যই শত স্বীকারোক্তির পরও ঐ পদগুলোকে মূল বাইবেলের অংশ হিসেবে বহাল রেখেছেন খ্রিস্টান পণ্ডিতবর্গ। আর সান্ত¡নার জন্য তারা বলতে চান, “তবে অংশটি যদি মার্কের লেখা নাও হয়, কাথলিক মণ্ডলী সুপ্রাচীন সময় থেকেই তা মঙ্গলসমাচারের প্রামাণিক অংশ বলেই-অর্থাৎ ঐশী বাণী বলেই গণ্য করে।”(মঙ্গলবার্তা, মার্কের ১৬ : ৮ পদের পাদটীকা, )

যাহোক মার্কের শেষ বারটি পদ প্রক্ষিপ্ত হওয়ার কথা স্বীকার করা সত্তে¡ও খ্রিস্টান পণ্ডিতগণ এ পদগুলোকে বাদ দিয়ে বাইবেল সংশোধনে সমর্থ হননি।

তিন. পবিত্র ত্রিত্ববাদের প্রমাণ সম্বলিত পদ

এবার হার্টজেল স্পেন্সের উল্লেখিত শেষ ভুলটি সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। এ বিষয়ে "50,000 Errors in the Bible?" প্রবন্ধকারের ভাষ্য ছিল, “যোহন কি তার প্রতি আরোপিত পবিত্র ত্রিত্ববাদেরপ্রমাণ হিসেবে ১ যোহন এর ৫ : ৭-৮ পদটি লিখেছেন? এ বিষয়ে গ্রীক বাইবেলের একজন অনুবাদক বেনজামিন উইলসন তার লিখিত দি এমফ্যাটিক ডায়াগলট(the emphatic diaglott by benjamin wilson) বইয়ে লেখেন, স্বর্গীয় সাক্ষীযুক্ত এই পাঠাংশটি পঞ্চদশ শতাব্দীর পূর্বের কোনো গ্রীক পাণ্ডুলিপিতে পাওয়া যায় না। এটা না কোনো গ্রীক যাজকীয় লেখক উদ্ধৃত করছেন না কোনো ল্যাটিন ফাদার কর্তৃক উদ্ধৃত হয়েছে। এমনকি যখনই তারা এ বিষয়ে আলোচনা করতেন স্বাভাবিকভাবেই তারা এর উৎসের পূর্ণ পরীক্ষার দিকে ধাবিত হতেন। সুতরাং স্পষ্টভাবেই এটা কৃত্রিম। আধুনিক অনুবাদগুলোতে (ল্যাটিন থেকে রোমান ক্যাথলিক অনুবাদগুলোর কথা ভিন্ন) এই বাক্যাংশকে মূল পাঠের অন্তর্ভুক্ত না করাই এ বক্তব্যের সত্যতা নিশ্চিত করে।

মঙ্গলবার্তার টীকাকার এ বিষয়ে লেখেন, “(৭-৮) ভালগেৎ অনুবাদের অপেক্ষাকৃত আধুনিক কয়েকটি পাণ্ডুলিপিতে একটি বাক্য প্রক্ষিপ্ত হয়েছে। সেইসব পাণ্ডুলিপিতে এই অংশটি দাঁড়িয়েছে এই রকম: তাহলে দেখা যাচ্ছে, স্বর্গে তো সাক্ষী আছেন তিনজন: পিতা, স্বয়ং বাণী আর পবিত্র আত্মা। আর এরা তিনে মিলে এক। আর পৃথিবীতেও তেমনি তিন সাক্ষী রয়েছে: আত্মা, জল আর রক্ত। আর তিনে মিলে একই সাক্ষ্য দিচ্ছে।আজ খুব সম্ভবত কেউই প্রক্ষিপ্ত অংশটিকে মূল লেখাটির অংশ বলে মনে করেন না। ওই অংশটি তো কোনো প্রাচীন পাণ্ডুলিপিতেই পাওয়া যায় না।” (মঙ্গলবার্তা, পৃষ্ঠা ৬৩৫)

সম্প্রতি প্রকাশিত বাইবেলগুলোতে ১ যোহন ৫ ; ৭-৮ পদ দুটি সংশোধন করে ৭ নং পদটিকে বাদ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রেও খ্রিস্টান পণ্ডিতগণ ধোকার পথ বেছে নিয়েছেন। যাতে পাঠকের দৃষ্টিতে বিষয়টি ধরা না পড়ে। কোনো সংস্করণে ৮ নং পদটিকে দুই ভাগ করে প্রথম অংশকে ৭ নং ও দ্বিতীয় অংশকে ৮ নং পদ বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেমন, মঙ্গলবার্তায় ১ যোহন ৫ : ৭-৮ পদ দুটি লেখা হয়েছে এভাবে:

৭তাহলে দেখা যাচ্ছে, এখানে তিন সাক্ষী রয়েছে: ৮আত্মা, জল আর রক্ত। আর তিনে মিলে একই সাক্ষ্য দিচ্ছে।

এই একই কাজ করেছেন বাংলাদেশ কাথলিক বিশপ সম্মিলনী থেকে প্রকাশিত জুবিলী বাইবেলের অনুবাদকগণ।

আবার কোনো সংস্করণে অনুবাদে হেরফের করে লেখা হয়েছে এভাবে:

৭-৮ পাক-রূহ, পানি ও রক্ত- এই তিনের মধ্য দিয়ে সেই সাক্ষি আসছে এবং সেই তিনের সাক্ষি এক।” (কিতাবুল মোকাদ্দস, ১ ইউহোন্না, ৫ : ৭-৮, বি.সি.বি ২০০৬ ইং; ইঞ্জিল শরীফ, ২৩শ সিপারা: ১ ইউহোন্না, ৫ : ৭-৮, বি.সি.বি, ১৯৮০ ইং; পবিত্র বাইবেল, বি.সি.বি, ২০০০ ইং)

 কোনো কোনো সংস্করণে ৬ নং পদের শেষ অংশকে ৭ নং পদ বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভারত বাইবেল সোসাইটি থেকে ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত পবিত্র বাইবেলেলেখা হয়েছে এভাবে:

৬ সেই যিনি জল ও রক্ত দিয়া আসিয়াছিলেন, যীশু খ্রীষ্ট; কেবল জলে নয়, কিন্তু জলে ও রক্তে। ৭আর আত্মাই সাক্ষ্য দিতেছেন, কারণ আত্মা সেই সত্য। ৮বস্তুত তিনে সাক্ষ্য দিতেছেন, আত্মা, জল ও রক্ত। এবং সেই তিনের সাক্ষ্য একই।”(পবিত্র বাইবেল, ভারত বাইবেল সোসাইটি, ১৯৮৫ ইং)

ঐ একই ধরনের কাজ করেছেন কলকাতা ব্রিটিশ ও ফরেন বাইবেল সোসাইটি, ২৩ চৌরঙ্গী রোড থেকে ১৯০৯ সালে প্রকাশিত বাংলা বাইবেলের সংশোধিত সংস্করণ ধর্ম্মপুস্তকের সম্পাদকগণ।

যাহোক বাইবেল পণ্ডিতগণ ১ যোহনের ৫ : ৭ পদের সংশোধন করেছেন অনেক ছলচাতুরির মাধ্যমে। কিন্তু ১ যোহনের ৫ : ৮ পদের কী হবে? পদটি আজও বহাল আছে। এ বিষয়ে বাইবেল কি ঐশী গ্রন্থ?’ বইয়ের লেখক মুহাম্মাদ সিরাজুল হক -এর বক্তব্য উদ্ধৃতিযোগ্য। তিনি তার বইয়ে লেখেন, “পৃথিবীর তিন সাক্ষ্য হল আত্মা (পবিত্র আত্মা নয়), পানি আর রক্ত (বলা নেই যে তা হবে যীশুর রক্ত)। ঘওঠ-র সাক্ষ্য থেকে স্পষ্টরুপেই প্রমাণিত হয় যে পৃথিবীতে এই তিন সাক্ষ্যদাতার উল্লেখ ১৬ শ শতাব্দীর আগের কোনো গ্রীক মূল পাঠেই পাওয়া যায় না। অর্থাৎ ১৬ শ শতাব্দীর পরেই এই নামগুলো শাস্ত্রের ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। শাস্ত্র জালিয়াতির এর চাইতে জ্বলন্ত প্রমাণ আর কী হতে পারে?” (বাইবেল কি ঐশীগ্রন্থ?, পৃষ্ঠা ৩৭৫, জনতা প্রেস এণ্ড পাবলিকেশন্স, বাংলাবাজার ঢাকা, প্রথম প্রকাশ সেপ্টেম্বর ২০০০ ইং)

সারকথা, খ্রিস্টান পণ্ডিতদের স্বীকৃত ভুলগুলো আজও বাইবেলে রয়েছে। এ বিষয়ে আরো আশ্চর্যের কথা হল, বাইবেলের স্বীকৃত এ ভুলগুলো বাদ দেওয়ার পরও তা পুনরায় জুড়ে দেওয়া হয়েছে। রিভাইজড স্ট্যান্ডার্ড ভার্সনের (জঝঠ) ১৯৫২ সংস্করণ থেকে  যোহন ৭ : ৫৩-৮ : ১১ ও মার্ক ১৬ : ৯-২০ পদগুলো বাদ দেওয়া হয়েছিল। তবে রক্ষণশীল পুরোহিতদের চাপে বাইবেল কমিটি আবার ঐ পদগুলোকে   রিভাইজড স্ট্যান্ডার্ড ভার্সনের (জঝঠ) ১৯৭১ সংস্করণে জুড়ে দিয়েছেন। এ বিষয়ে রিভাইজড স্ট্যান্ডার্ড ভার্সনের (জঝঠ) ১৯৭৩ সংস্করণের ভূমিকায় সম্পাদকগণ লেখেন, "Maû proposals for modification were submitted to the Committee by individuals and by two denominational committees. All of these were given careful attention by the Committee.

Two passages, the longer ending of Mark (16.9-20) and the account of the woman caught in adultery (Jn 7.53f-8.11), are restored to the text.

"অনুবাদ: ব্যক্তিগত পর্যায়ে এবং দুইটি সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠানের কমিটির পক্ষ থেকে সম্পাদনা পরিষদের নিকট সংশোধনের অনেক প্রস্তাব পেশ করা হয়। সবগুলো প্রস্তাবকেই সম্পাদনা পরিষদ অত্যন্ত গুরত্ব সহকারে বিবেচনা করেন।

দুটি পরিচ্ছেদ, মার্ক লিখিত সুসমাচারের দীর্ঘ উপসংহার (১৬ : ৯-২০) এবং ব্যভিচারী স্ত্রীলোকের বিচার (যোহন ৭ : ৫৩- ৮ : ১১) মূলপাঠে পুনঃসংযোজন করা হয়।

এ থেকেই স্পষ্ট হয়, খ্রিস্টানগণ বাইবেলের ভিত্তিতে নিজেদের আকীদা-বিশ্বাস ও ধর্ম-বিশ্বাস সংশোধন করেন না। বরং নিজের লালিত আকীদা-বিশ্বাসের ভিত্তিতেই বাইবেল সংশোধন করেন। এরচেবড় উপহাস আর কী হতে পারে! সংক্ষেপে খ্রিস্টান পণ্ডিতদের বাইবেল সংশোধনের আরো দুএকটি উদাহরণ দিচ্ছি।

ঈসা আলাইহিস সালামের ব্যাপারে খ্রিস্টানদের বিশ্বাস হল, তিনিও ঈশ্বর; ত্রিত্বের একজন। তবে খ্রিস্টানগণ যখন দেখলেন আদি ধর্মীয় মূল পাঠে এ ধরনের বাণী রয়েছে যে, যেরুজালেমের বিনাশ ও যীশুর পুনরাগমনের বিষয় পিতা ঈশ্বর ছাড়া আর কেউই জানেন না। এধরনের বাণীর কারণে তারা প্রশ্নের সম্মুখীন হলেন, যীশু যদি ত্রিত্তে¡র একজন এবং পুত্র ঈশ্বর হয়ে থাকেন তাহলে এই বিষয়টি তিনি জানবেন না কোন যুক্তিতে? এর কোনো জবাব দিতে না পেরে, অবশেষে খ্রিস্টান পণ্ডিতগণ বাইবেল সংশোধন করে মথির ২৪ : ৩৬ পদে পুত্রও না(nor the son) অংশটুকু যোগ করে দেন। যাতে করে উত্তর দেওয়া যায় যে, ‘এ কথা আল্লাহর কালামে আছে। আমরা এ ব্যাপারে এটুকুই বলতে পারি।

পুরাতন বাংলা অনুবাদে পদটি ছিল এভাবে:

আর সেই দিবসের ও সেই দণ্ডের তত্ত¡ কেহই জানে না, স্বর্গস্থ দূতগণও জানেন না, কেবল আমার পিতা তাহা জানেন।” (ধর্ম্মপুস্তক অর্থাৎ পুরাতন ও নতুন ধর্ম্মনিয়ম, কলিকাতা, ১৮৭৭ ইং; ধর্ম্মপুস্তক অর্থাৎ পুরাতন ও নতুন ধর্ম্মনিয়ম, কলিকাতা, ১৮৬৬ ইং)

বর্তমানের বাংলা অনুবাদগুলোতে সংশোধনসহ পদটি আছে এভাবে:

সেই দিন ও সেই সময়ের কথা কেউই জানে না, স্বর্গের দূতেরাও না পুত্রও না; কেবল পিতাই জানেন।” (মথি ২৪ : ৩৬, পবিত্র বাইবেল, ; কিতাবুল মোকাদ্দস, ; মঙ্গলবার্তা, ; জুবিলী বাইবেল, ;)

সেই বারজনকেযীশুর দর্শন দান সম্বলিত পদ

খ্রিস্টানদের বিশ্বাস মতে, ঈসা আলাইহিস সালাম মৃত্যু থেকে পুনরুত্থিত হওয়া পর শিষ্যদের দর্শন দান করেন। এ কথা প্রায় সকল সুসমাচারেই উল্লেখ হয়েছে। এছাড়া পত্রাবলিতেও এর উল্লেখ রয়েছে।

এ বিষয়ে পৌল করিন্থীয়দের নিকটে লেখা পত্রে বলেন,

৪তাঁকে সমাধি দেওয়া হল; এবং শাস্ত্র অনুযায়ী তিনি তৃতীয় দিনে পুনরুত্থিত হলেন; ৫এবং তিনি কেফাসকে এবং পরে সেই বারোজনকে দেখা দিলেন;” (জুবিলী বাইবেল, ১ করিন্থীয়, ১৫ : ৪-৫)

 সেই বারোজন অর্থাৎ ঈসা আলাইহিস সালামের বারোজন শিষ্য হলেন,

১৬তাই তিনি সেই বারোজনকে নিযুক্ত করলেন, তথা: সিমোন, যাঁকে তিনি পিতর নাম দিলেন, ১৭এবং জেবেদের ছেলে যাকোব ও সেই যাকোবের ভাই যোহন- এই দুজনকে বোয়ানের্গেস অর্থাৎ বজ্র-সন্তান  এই নাম দিলেন- ১৮আর আন্দ্রিয়, ফিলিপ, বার্থলমের, মথি টমাস, আল্ফেয়ের ছেলে যাকোব, থাদেয়, উগ্রধর্মা সিমোন ১৯ও সেই যুদা ইস্কারিয়োৎ যিনি পরে তাঁর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করলেন।” (জুবিলী বাইবেল, মার্ক, ৩ : ১৬-১৯)

সেই যুদা ইস্কারিয়োৎ যিনি পরে তাঁর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করলেনতিনি ঈসা আলাইহিস সালামের পুনরুত্থানের পূর্বেই আত্মহত্যা করেন। এ ব্যাপারে মথি বলেন,

যখন যুদা -তাঁর সেই বিশ্বাসঘাতক- দেখলেন যে,... তখন তিনি ওই টাকাগুলো পবিত্রধামের মধ্যে ফেলে দিয়ে চলে গেলেন এবং এক জায়গায় গিয়ে গলায় দড়ি দিয়ে মরলেন।” (মথি, ২৭ : ৩-৫)

এ ব্যাপারে পিতর যিনি নিজে একজন শিষ্য ছিলেন, তিনি বলেন,

ভাইয়েরা, যীশুকে যারা গ্রেপ্তার করেছিল, তাদের যে পথপ্রদর্শক হয়েছিল, সেই যুদা সম্বন্ধে পবিত্র আত্মা দাউদের মুখ দিয়ে যে ভবিষ্যদ্বাণী দিয়েছিলেন, সেই শাস্ত্রবচন পূর্ণ হওয়া আবশ্যক ছিল। সে তো আমাদেরই একজন ছিল, এবং তাকেও এই সেবাদায়িত্বের সহভাগী হতে দেওয়া হয়েছিল। অপর্কম করে যে টাকা পেয়েছিল, তা দিয়ে সে এক খণ্ড জমি কিনেছিল এবং উচু থেকে উল্টে পড়ে গেলে তার পেট ফেটে গিয়েছিল, আর নাড়িভুঁড়ি সব বেরিয়ে পড়েছিল।” (শিষ্যচরিত, ১ : ১৬-১৮)

এ পদগুলো থেকে আমরা জানতে পারি যুদা ইস্কারিয়োৎ যীশুর পুনরুত্থানের পূর্বেই আত্মহত্যা করেছিল। (মথি, ২৭ অধ্যায় ও শিষ্যচরিত ১ অধ্যায়)

মোটকথা সুসমাচারের স্পষ্ট ভাষ্য হল যুদা ইস্কারিয়োৎ যীশুর পুনরুত্থানের পূর্বেই আত্মহত্যা করেছিল। সুতরাং করিন্থীয়দের নিকট লিখিত প্রথম পত্রে পৌল যে বলেছেন, “যীশু সেই বারোজনকে দেখা দিলেনতার এই কথা সম্পূর্ণ মিথ্যা। যীশুর দর্শন দানের সময় বারোজন শিষ্য ছিলেন না। একথা মার্ক ও লুক সুসমাচারে স্পষ্টভাবে স্বীকার করা হয়েছে। দেখুন,

শেষে, সেই এগারোজন যখন ভোজে বসেছিলেন, তখন তিনি তাঁদের দেখা দিলেন ...।” (মার্ক, ১৬:১৪)

সেই ক্ষণেই উঠে তাঁরা যেরুসালেমে ফিরে গেলেন; সেখানে দেখতে পেলেন, সেই এগারজন ও তাদের সঙ্গীরা সমবেত আছেন।” (লুক, ২৪ : ৩৩)

লুক সুসমাচারের এর পরবর্তী পরিচ্ছেদের শিরোনাম হল সেই এগারোজনের কাছে যীশুর দর্শনদান। যা থেকে সুস্পষ্ট হয়, যীশু তার এগারোজন শিষ্যকে দর্শন দিয়েছিলেন।

খ্রিস্টান পণ্ডিতগণ যখন দেখলেন যে, তাদের ধর্মপুরুষ ও প্রচলিত খ্রিস্টানধর্মের প্রতিষ্ঠাতা সাধু পৌলের কথা মিথ্যা প্রমাণিত হচ্ছে। তাই তারা অতি সুকৌশলে ১ করিন্থীয়, ১৫ : ৫ পদটির সেই বারোজনকেশব্দটি পরিবর্তন করে তাঁর সাহাবীদেরকোনো কোনো অনুবাদে তাঁর প্রেরিতদেরকরে দিয়েছেন।

পুরাতন বাংলা অনুবাদে পদটি ছিল এভাবে:

এবং অগ্রে কৈফার কাছে, পরে দ্বাদশ শিষ্যের কাছে দর্শন দিলেন;” (1 Kwišxq, 15 : 5, The NEW TESTAMENT of our lord and saviour JESUS CHRIST, in The Bengali language, Richard watts, printer, crown court, temole bar, London, 1839;   ধর্ম্মপুস্তক, ১৮৬৬ ইং; ধর্ম্মপুস্তক, ১৮৭৭ ইং; ধর্ম্মপুস্তক, ব্রিটিশ ও ফরেন বাইবেল সোসাইটি, ১৯০৯ ইং; নূতন নিয়ম, বি.বি.এস., ২০০১ইং )

বর্তমানের অনেক বাংলা অনুবাদে সংশোধনসহ পদটি আছে এভাবে:

আর তিনি পিতরকে ও পরে তাঁর সাহাবীদের দেখা দিয়েছিলেন।” (১ করিন্থীয়, ১৫ : ৫, কিতাবুল মোকাদ্দস, বি.বি.এস. ২০০৬ ইং; পবিত্র বাইবেল, বি.বি.এস. ২০০০ইং; ইঞ্জিল শরীফ, বি.বি.এস. ১৯৮০ ইং; মঙ্গলবার্তা বাইবেল, নবসন্ধি, দ্বিতীয় প্রকাশ : মে, ২০১১)

 রোযা বা উপবাস সম্বলিত পদ

ঈসা আলাইহিস সালামসহ সকল নবী রাসূলই রোযা পালন করেছেন এবং উম্মতদের রোযা পালনের আদেশ করেছেন। ইঞ্জিলেও রোযার কথা উল্লেখ ছিল। কিন্তু খ্রিস্টান পুরোহিতরা রোযা পালন না করায় এ বিষয়ে প্রশ্ন উঠে। মুসলমানদের প্রশ্নের মুখে সংশ্লিষ্ট পদ থেকে রোযা বা উপবাস শব্দটিকে বাদ দেওয়া হয়েছে। মার্কের ৯ : ২৯ পদটি ছিল এভাবে:

তিনি (ঈসা) কহিলেন, প্রার্থনা ও উপবাস বিনা আর কোন মতে এই প্রকার ভূত ছাড়ান যায় না।” (মার্ক ৯ : ২৯  ধর্ম্মপুস্তকের অন্তরভাগ, কলিকাতা, ১৯৪৭ ইং; ধর্ম্মপুস্তক অর্থাৎ পুরাতন ও নতুন ধর্ম্মনিয়ম, ১৮৬৬ ইং; ধর্ম্মপুস্তক অর্থাৎ পুরাতন ও নতুন ধর্ম্মনিয়ম, ১৮৭৭ ইং; মঙ্গলবার্তা বাইবেল, নবসন্ধি,  দ্বিতীয় প্রকাশ মে ২০১১)

আর উপবাস শব্দকে বাদ দিয়ে লেখা হয়েছে এভাবে:

তিনি তাদের বললেন, প্রার্থনা ছাড়া অন্য উপায়ে এই ধরনের অশুচি আত্মাকে তাড়িয়ে দেওয়া যায় না।” (মার্ক ৯ : ২৯ জুবিলী বাইবেল, ২০০৬ ইং বাংলাদেশ কাথলিক বিশপ সম্মিলনী; পবিত্র বাইবেল, বি.সি.বি ২০০০ ইং; ইঞ্জিল শরীফ, বি.সি.বি ১৯৮০ ইং; কিতাবুল মোকাদ্দস, বি.সি.বি ২০০৬ ইং)

এ হল খ্রিস্টানদের বাইবেল সংশোধনের স্বরূপ।

প্রসঙ্গত আরেকটি বিষয়, ভুলে ভরা বাইবেল সম্পর্কে পাঠকের মনে যেন নেতিবাচক প্রভাব না পরে সেজন্য বাইবেলের এসব মারাত্মক ভুলগুলোর কারণ বর্ণনা করে প্রবন্ধকার 50,000 Errors in the Bible? প্রবন্ধের শেষ পর্যায়ে বলেন, “যখন এই অনুবাদগুলো গ্রীকের কয়েনভাষা থেকে করা হয়, তখন বাইবেল এমন ভাষায় লেখা ছিল যা আজকের মত এতটা বোধগম্য নয়। তাই অনুবাদকেরা অনুবাদে ভুল করেছেন, যা আধুনিক পণ্ডিতগণ সংশোধন করেছেন।অর্থাৎ অনুবাদকদের না-বুঝার কারণেই বাইবেলের এতসব ভুল-বিচ্যুতি।

কিন্তু প্রশ্ন এই যে, ভাষার দূর্বোধ্যতা ও জটিলতার কারণে শব্দের বিকৃতি ও অর্থগত বিকৃতি ঘটতে পারে- তবে তাও আল্লাহর কালামের জন্য অবশ্যই নিন্দনীয়। কিন্তু পনের থেকে বিশটা পদ প্রক্ষিপ্ত হওয়ার কারণও কি ভাষার দুর্বোধ্যতা? তাহলে কি অনুবাদকগণ বাইবেলের কয়েনভাষার বক্তব্য না বুঝে নিজে থেকেই বাইবেল রচনাকরে বসেছেন? 

 

 

advertisement