রবিউল আখির ১৪৩১   ||   এপ্রিল ২০১০

বন্ধুত্ব! কবে আমাদের বোধোদয় হবে?

সমপ্রতি এমন কিছু ঘটনা পত্রিকার পাতায় এসেছে, যা একদিকে যেমন মর্মান্তিক অন্যদিকে তেমনি উদ্বেগজনক। আমাদের তরুণ-সমাজের অধঃপতন সর্বগ্রাসী ভোগ-প্রবণতা শুধু তাদেরকেই নিঃশেষ করে দিচ্ছে না; চারপাশের মানুষের জন্যও আতঙ্ক ও অশান্তি তৈরি করছে। তবে একটি চরম সত্য এই যে, এই পরিণতিগুলো অভাবিত নয়। পথিক যে গন্তব্যের দিকে পথচলা শুরু করে সেখানে পৌঁছে গেলে তার অবাক হওয়ার কিছু নেই। এ তো তার পথ চলারই অনিবার্য পরিণতি। পাশ্চাত্যের পুতি গন্ধময় সংস্কৃতিতে আমাদের গোটা সমাজ দুষিত ও বিষাক্ত হয়ে পড়েছে। পাশ্চাত্যের ভোগবাদ আমাদের মুসলিম দেশুগুলোতেও এমনভাবে বিস্তৃত হয়েছে যে, এখন মুসলমানিত্বের পরিচয় খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর হয়ে পড়েছে। চিন্তা-চেতনা এবং আচরণ-উচ্চারণে পাশ্চাত্যের অনুগামীতাই প্রকট হয়ে উঠেছে। আর সবচেয়ে মর্মান্তিক বিষয় এই যে, এই বিষয়গুলো এখন কারো ব্যক্তিগত বিষয় নয়; বরং তা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। এর অনিবার্য পরিণতি এই হয়েছে যে, পরিবার ও সমাজ এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও শিশু-কিশোররা নৈতিক উন্নতির কোনো উপাদান পায় না। একজন সৎ ও হৃদয়বান মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য চরিত্র ও নৈতিকতার যে মজবুত ভীত রচনা করা প্রয়োজন, দুঃখজনভাবে আমাদের শিক্ষা-ব্যবস্থা ও সমাজ-ব্যবস্থায় তার কোনো আয়োজন নেই। সুনির্দিষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ কোনো আদর্শ শিক্ষার্থীদের সামনে নেই। ফলে তারা ভাষা ও কৌশল রপ্ত করছে, কিন্তু হৃদয়বৃত্তি ও চারিত্রিক পবিত্রতা তাদের মাঝে তৈরি হচ্ছে না। স্নেহ-মমতা, ক্ষমা ও সহনশীলতা এবং ধৈর্য ও পরমতসহিষ্ণুতার মতো গুণাবলি নিতান্তই সেকেলে ও অপ্রয়োজনীয়। পুঁজিবাদী বিশ্ব-ব্যবস্থায় ভোক্তার প্রয়োজনটাই বড়। তাই আমাদের আরোপিত শিক্ষা-ব্যবস্থাও বিশ্ব-নিয়ন্ত্রক শক্তিদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যই বাস্তবায়িত হচ্ছে। বস্তুত এই শিক্ষা-ব্যবস্থা একটি বিশাল ভোক্তা শ্রেণীই তৈরি করে যাচ্ছে। সমাজের সর্বস্তরে ভোগবাদ এতই প্রকট হয়ে উঠেছে যে, অসংযমের যুপকাষ্ঠে বলি হয়ে যাচ্ছে সকল নীতি ও নৈতিকতা এবং সকল মানবীয় গুণাবলি। অর্থ-বিত্ত এবং ক্ষমতা ও নারীসঙ্গই এখন সমাজের একটি বিশাল শ্রেণীর আরাধ্য হয়ে ওঠেছে। তবে এর চেয়েও ভয়াবহ বিষয় এই যে, প্রচার-প্রচারণার সকল উপকরণ সর্বোপরি গোটা সমাজ-ব্যবস্থা একযোগে এই ধারাকেই উৎসাহিত করছে। অন্যদিকে নীতি ও নৈতিকতা চর্চার যে ধারাটি ক্ষীণ হলেও স্বকীয় শক্তিতে প্রবহমান তারও উজানে বাঁধ দিয়ে তা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেওয়ার সকল চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। মিডিয়া ও প্রচার-মাধ্যমগুলোর সর্বশক্তি নিয়োজিত করা হয়েছে সুনীতি ও সুস্থ জীবন বোধ চর্চার এই ধারাকে নিরুৎসাহিত ও নির্বাপিত করার জন্য। অবজ্ঞা ও অপবাদ এবং মিথ্যারোপ ও মিথ্যাচারের সকল অপকৌশল যেন উৎসর্গ করে দেওয়া হয়েছে এই উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য। একজন শিশু এই পরিবেশেই চোখ মেলছে এবং এই বিষাক্ত পরিবেশে তার দৈহিক ও মানসিক বৃদ্ধি ঘটছে। চারপাশের এই যুগল ধারা থেকে তার হাতে খড়ি হচ্ছে ভোগবাদে এবং হিংস্রতায়। সে হয়ে উঠছে একজন হিংস্র ও বুদ্ধিমান ভোগবাদী। এরই কিছু দৃষ্টান্ত যখন সংবাদপত্রে শিরোনাম হয় তখন আমরা উদ্বিগ্ন হই। প্রেমিকের হাতে প্রেমিকার পিতা-মাতার নিহত হওয়ার ঘটনা, কিংবা ‘বন্ধু’র হাতে বান্ধবী ও তার পিতা-মাতার ছুরিকাহত হওয়ার সংবাদ অতি সমপ্রতি পত্রিকায় এলেও এ ধরনের ঘটনা এই প্রথম নয়। এ ধরনের ঘটনায় আমরা মর্মাহত হলেও অবাক নই। তবে আমরা এই ভেবে উদ্বিগ্ন যে, খুব দ্রুত আমরা তা ভুলে যাব। পিছনের দীর্ঘ ইতিহাস বলে; আমরা বড় বিস্মৃতিপ্রবণ জনগোষ্ঠী!

 

advertisement