রবিউল আখির ১৪২৯   ||   এপ্রিল ২০০৮

লু ট পা ট :এনজিওগুলোর আশকারা আকাশ ছুঁয়েছে

খসরূ খান

গ্রাহকদের টাকা মেরে দিয়ে কয়েকটি এনজিও আবার সংবাদে এসেছে। নাটোরের ফ্রিডম উন্নয়ন সংস্থা, গ্রাম উন্নয়ন সংস্থাসহ বগুড়া, রাজশাহী, দিনাজপুর ও কুষ্টিয়ার কিছু এনজিও-কর্মকর্তা গ্রাহকদের টাকা মেরে দিয়ে পালিয়েছে। ওইসব এলাকার দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর কয়েক হাজার কোটি টাকা এভাবে কয়েকটি এনজিও লোপাট করে দিয়েছে। মার্চ মাসের শুরু থেকেই সংবাদপত্রে এ নিয়ে প্রায়দিনই সংবাদ ছাপানো হয়েছে। এ দেশে এনজিওগুলোর ভালোমানুষী সুরতের আড়ালে লুটপাটের আরেকটি ঘটনা এভাবে সামনে চলে এসেছে। জানা গেছে, প্রভাবশালী এনজিওগুলো এসব ঘটনায় ভেতরে ভেতরে বিব্রত হলেও এ কারণে এনজিওগুলোকে যেন বিশেষ কোনো নজরদারির আওতায় আনা না হয় সেজন্য তারা কায় কসরত বজায় রেখেছে। এনজিওগুলোর নানা অপকর্মকান্ডের যে রূপ প্রায়ই সামনে চলে আসে তাতে একথা বলাই যেতে পারে যে, দেশে এনজিও বাড়ার মানেই প্রতারক সংগঠনের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া।

১৫ মার্চের একটি দৈনিকে সাম্প্রতিক এনজিও-প্রতারণা বিষয়ে  একটি  সবিস্তার রিপোর্ট ছাপিয়েছে। সেখানে এনজিওগুলোকে নিয়ন্ত্রণে সরকারের অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনার বিভিন্ন চিত্র ফুটে উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাশ উদ্দিন বলেছেন, এনজিও ঋণের সুদের প্রতারণা নিয়ে দীর্ঘদিন যাবতই বিতর্ক হয়েছে। এতো উচ্চ সুদ দিয়ে কখনো দারিদ্র্যবিমোচন সম্ভব নয়। তাছাড়া একেক এনজিও একেক মাত্রায় সুদ নিচ্ছে। সদস্যদের আমানতের লভ্যাংশ তারা ফেরত না দিয়ে এই অর্থও কিস্তি ও সুদ হিসেবে কেটে নিচ্ছে। অনেক এনজিও ইদানীং আবার সদস্যদের বেশী লাভ দেবার ও ভালো চাকরি দেবার প্রলোভনে ফেলে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু এসব দেখার কেউ নেই।

 

এনজিওগুলোর নিয়ন্ত্রণহীনতা বিষয়ে ড. ফরাশ উদ্দিন তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে আরো বলেছেন, এনজিওগুলোর একেক ধরনের কাজ একেক মন্ত্রণালয়ের অধীনে। কোনো একক কর্তৃপক্ষের অধীনে তারা বর্তমানে পরিচালিত হচ্ছে না। এ অবস্থায় একটি এনজিও রেগুলেটরি কমিশন গঠনের সুপারিশ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে এনজিওগুলোর ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমের তদারকি করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব আরো অনেক কাজ রয়েছে। ক্ষুদ্র ঋণ মনিটরিং করা তাদের পক্ষে কঠিন।...যদিও এনজিওগুলো বর্তমানে বেশির ভাগই ক্ষুদ্র কাজে জড়িয়ে গেছে, কিন্তু অন্যান্য ব্যাংকের মতো করে এসব এনজিওকে রেগুলেট করা সম্ভব নয়। তাদেরকে একটি নিয়ম-কানুনের মধ্যে পরিচালিত করতে পৃথক কর্তৃপক্ষ প্রয়োজন, যা একজন নিরপেক্ষ সৎ ও দক্ষ মানুষের নেতৃত্বে পরিচালিত হবে। ১৯৯৮ সালে তার নেতৃত্বে এ ব্যাপারে যে টাস্কফোর্স গঠিত হয়েছিল, তাতে ওই পৃথক এনজিও রেগুলেটরি কমিশন গঠনের সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু মুরববী এনজিওগুলো তা মানেনি। এ দেশের জনগণের নামে যারা বিদেশ থেকে টাকা আনে, সেসব মুরববী এনজিও মনে করে এনজিওগুলো নিজেরাই নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করবে। আলাদা কোনো কর্তৃপক্ষের প্রয়োজন নেই। কিন্তু বাস্তবে এটা ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে।

 

ওই রিপোর্টে আরো জানানো হয়েছে, এনজিওর সঠিক সংখ্যা কত তা খোদ সরকারই জানে না। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৬০ হাজারের মতো এনজিও রয়েছে এবং এই এনজিওর সংখ্যা প্রতিবছর ১ হাজার করে বাড়ছে। ... বর্তমানে দেশে ৪টি পৃথক আইনের অধীনে এনজিও গঠিত হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে সোসাইটি এ্যাক্ট, ট্রাস্ট এ্যাক্ট, কোম্পানী এ্যাক্ট, সোশাল ওয়েল ফেয়ার এ্যাক্ট। রিপোর্টে বলা হয়েছে এ কারণে কোথায় কতগুলো এনজিও নিবন্ধিত হচ্ছে এর কোনো সমন্বিত সংখ্যা নির্ধারণ এবং এগুলোর ওপর কোনো কেন্দ্রীয় তদারকি ব্যবস্থার গড়ে উঠেনি। যার ফলে বড় মুরববী এনজিওগুলোসহ মাঝারি, ছোট ও ক্ষুদ্র এনজিওগুলো কোথায় কার পকেট মারছে, ঘরবাড়ি উজাড় করছে, দারিদ্র্য দূরের নামে স্থায়ী দারিদ্রে্যর বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে- সুদ আদায়ের নামে ঘরের টিন-খুঁটি খুলে নিয়ে যাচ্ছে, তা নিয়ে সরকারী পর্যায়ে কোনো বাস্তব ও নিয়মতান্ত্রিক তদারকি নেই।

 

এনজিওগুলোর অপরাধ ও প্রতারণামূলক অনিয়ন্ত্রিত কর্মকান্ড এবং এ বিষয়ে সরকারের উদ্যোগহীনতা ও গা ছাড়া ভাবের কারণে এনজিওগুলোর আশকারা এখন আকাশ ছুঁয়েছে। একটি স্বাধীন দেশে এনজিও-শক্তিকে শক্তিমদমত্ত হওয়ার এবং যথেচ্ছ ধোকাবাজী করতে দেওয়ার সর্বনাশ সম্পর্কে কর্তাদের সতর্কতাই সবাই কামনা করে। 

 

 

advertisement