রজব ১৪২৯   ||   জুলাই ২০০৮

সং ক ট : বিডিআরের দোকানে চাল বিক্রি বন্ধের পদক্ষেপ কতটা সমীচীন?

আবু তাশরীফ

বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের অল্প কিছুদিন পর থেকেই দ্রব্যমূল্য ও ব্যাপকার্থে খাদ্যমূল্যের উর্ধ্বগতি লক্ষ্য করে দরিদ্র মানুষের সুবিধার্থে বিডিআরের মাধ্যমে ন্যায্য মূল্যে চাল, ডাল, তেল, চিনি, পেঁয়াজসহ জরুরি কিছু খাদ্যপণ্য বিক্রির প্রোগ্রাম শুরু করেছিল। এতে চালের দাম ছিল সাধারণ বাজার মূল্যের চেয়ে ৮-৯ টাকা কম। এছাড়াও অন্যান্য পণ্যও বাজারমূল্যের চেয়ে ৫-১০ টাকা কমে বিডিআরের দোকানগুলো থেকে কেনা যেত। এটি ছিল রাজধানীর গরিব ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য একটি বড় রকম   স্বস্তির ব্যাপার। কিন্তু বর্তমান জুন মাসের অর্ধেক মেয়াদ পার হওয়ার পরই বিডিআরের দোকানগুলো চাল বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে। রাজধানীর ৭৫ টি বিডিআরের ন্যায্য মূল্যের দোকানের মধ্যে ১৫ টি পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বাকি ৬০টিতে চাল ছাড়া অন্য কিছু পণ্য এখনও বিক্রি অব্যাহত থাকার খবর ১৭ জুনের পত্রিকাগুলোতে ছাপা হয়েছে। বিডিআরের ন্যায্য মূল্যের দোকান থেকে এভাবে হঠাৎ করে চাল বিক্রি বন্ধ করে দেওয়ায় গরিব ও নিম্ন আয়ের নগরবাসী লাখ লাখ  মানুষ বেকায়দায় পড়ে গেছেন বললে ভুল বলা হবে না।

উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শুরু পর্বটি ছিল বিভিন্ন দল ও মহলের উপস্থিত অভিনন্দনে ধন্য। এরপর সঠিক ভোটার লিস্ট প্রণয়ন, দুর্নীতি বিরোধী সাঁড়াশি অভিযান, বড় রাজনৈতিক দলের বড় বড় নেতাদের বন্দিত্ব এবং কোনো কোনো অসাধু প্রভাবশালী আমলা-ব্যবসায়ীর গ্রেফতার এবং বেশ কিছু বিষয়ে অব্যবস্থাপনা, ধর্মীয় কিছু বিষয়ে ভুল নীতি ঘোষণার পর থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি বিভিন্ন রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক মহল থেকে বিরূপ মন্তব্য ও বিরুদ্ধাচরণ প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। রোডম্যাপ অনুযায়ী নির্বাচনের দিকে সব প্রোগ্রাম এগিয়ে যাওয়ার ঘোষণা উচ্চারিত হলেও এ বিরুদ্ধাচরণের মাত্রা বাড়তে থাকে। এর মধ্যেই খাদ্য সংকট, দুর্যোগ ও আমদানি নির্ভরতা, বিশ্বব্যাপী খাদ্যঘাটতি, আতংক ও এক শ্রেণীর মুনাফাবাজ ব্যবসায়ীর কারসাজিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য দিন দিন অসহনীয় পর্যায়ে চলে যেতে থাকে। তখন অন্য সব প্রোগ্রামের সঙ্গে ভর্তুকি মূল্যে গরিব জনগোষ্ঠীর মধ্যে খাদ্য বিক্রি ও বিতরণে বিডিআরের মাধ্যমে সরকারের ঝটিকা প্রোগ্রাম নিতে হয়। সে ধারাবাহিকতাতেই গত জুনের মধ্যভাগ পর্যন্ত বিডিআরের ন্যায্য মূল্যের দোকানগুলো থেকে চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, আলু, মসল্লা ইত্যাদি বিক্রির ব্যবস্থা চালু ছিল। রাজধানীবাসী গরিব মানুষ এ কারণে কিছুটা হলেও হাঁফ ছেড়ে নিঃশ্বাস নিতে পেরেছিলেন। কিন্তু গত মধ্য জুন থেকে বিডিআরের ন্যায্য মূল্যের দোকানগুলো বন্ধ করে দেয়া বা চাল বিক্রি বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নগরবাসী প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য আতংকের কারণ হয়ে গেছে। গত ১৯ জুন অর্থ উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেছেন, সরকার এখন ধান-চাল সংগ্রহ করছে। এ অভিযান শেষ না হওয়া পর্যন্ত খোলাবাজারে চাল বিক্রি বা ওএমএস চালু রাখা যাবে না। আগামী সেপ্টেম্বরে আবার এ প্রোগ্রাম শুরু হবে। তিনি ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে ২৮ টাকা কেজি দরে চাল কিনে ২৫ টাকা কেজিতে তা বিক্রি হলে দেখা যাবে আবার তা সরকারের কাছেই বিক্রি হচ্ছে। তার এ ব্যাখ্যা আপাত দৃষ্টিতে যৌক্তিক। কিন্তু এর সঙ্গে আরো তিনটি বিষয় বিবেচনাযোগ্য।

এক  ওএমএস বা বিডিআরের দোকানে চাল তো ৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি শুরু হয়ে গিয়েছিল সপ্তাহ দেড়েক আগে থেকে। দু টাকা ব্যবধানে এ চাল আবার লস করে সরকারের কাছে বিক্রি করার সুযোগ তো ছিল না। সেই ৩০ টাকা রেখেই কিংবা ২৮ করেও যদি চাল বিক্রির ব্যবস্থা করা যায় তাহলে তো আর এ ধরনের সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

দুই আল্লাহ তাআলার অশেষ দয়ায় বোরো উৎপাদনে ব্যাপক সাফল্য আসার পর পর্যাপ্ত পরিমাণে তা সরকারীভাবে সংগ্রহে রাখার উদ্যোগ গ্রহণ প্রশংসনীয়। কিন্তু এর জন্য কত মাস সময় দরকার? এই জুন মাসেই কি সে পর্বটি সেরে ফেলা যায় না? এজন্য গরিব জনগোষ্ঠীর এই চড়ামূল্যের দমবন্ধ করা বাজারে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বাধ্য না হলেই কি ভালো হতো না?

তিন বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষ ৬ মাসের (শেষ এক চতুর্থাংশ সময়) সময় এখন চলছে। জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হয়েছে আগামী ডিসেম্বরের ৩য় সপ্তাহ। স্থানীয় কিছু নির্বাচনের সিডিউলও ঘোষিত হয়ে গেছে।  এ নিয়ে উত্তেজনাও চলছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ চলছে। চলছে দরকষাকষি ও সমঝোতার নানা পর্যায়। সরকারের প্রতি আক্রোশ ও জেদ পোষণকারী মহলগুলো সরব হতে শুরু করেছে। নানা মেরুকরণ চলছে ভেতরে-বাইরে। এ সরকারের নিরাপদ একটি বিদায় বা বহিঃর্গমন পথ রচনার যেখানে নানা উদ্যোগ গৃহীত হচ্ছে সেখানে নগরবাসী গরিব শ্রেণীকে উত্তেজিত করার কোনো কৌশল বা উপাদান সুযোগসন্ধানী কোনো গোষ্ঠীর হাতে তুলে না দেওয়াই সরকারের জন্য মঙ্গলজনক হবে। যে ভর্তুকি প্রায় এক বছর টানা গেল, কোনো অজুহাতেই শেষ মুহূর্তে তা থেকে সরকারের হাত গুটিয়ে নেওয়া সঙ্গত কি না আবারো তা ভেবে দেখা দরকার। বিশেষত অতি সম্প্রতি ঘোষিত বাজেটকে যেখানে কোনো কোনো মহল উচ্চাভিলাষী বলেছে, কোনো কোনো মহল তাৎক্ষণিক প্রয়োজন পূরণের প্রেরণা এ বাজেটে বেশি বলে মত প্রকাশ করেছে, সে বাজেট ঘোষিত হওয়ার পর থেকেই বিডিআরের দোকান এবং ওএমএস এর চাল বিক্রি বন্ধ হয়েছে। অথচ এ বাজেটে খাদ্যে ভর্তুকি, কৃষিতে ভর্তুকি এবং এ দুখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির কথা জোরালো গলায় উচ্চারণ করা হয়েছে। সে রকম পরিস্থিতিতে বিডিআরের দোকান থেকে কম মূল্যে চাল বিক্রি বন্ধের প্রোগ্রাম নিয়ে নানা দিক থেকে নানা কারণে পুনঃবিবেচনার জন্য সরকারের নীতি নির্ধারক মহলের কাছে আবেদন আমরা রাখতেই পারি। কারণ এতে যেমন গরিব দেশবাসীর উপকার হবে তেমনি দেশের স্থিতির জন্যও তা মঙ্গলজনক হবে বলে মনে করা যায়। 

 

 

advertisement