রমযান ১৪২৯   ||   সেপ্টেম্বর ২০০৮

সাহস করলেই কেল্লা ফতে

ইসহাক ওবায়দী

কিছুদিন হল, একাকীত্ব ঘোচানোর জন্যেই হয়তো আমার গিন্নী সাহেবা কয়েকটি হাসের বাচ্চা পালতে আরম্ভ করেছে। আমি দেখলাম, হাঁসের বাচ্চাগুলোর সব আবেদন-নিবেদনই সে বুঝতে পারে এবং ওরাও তার ভাষা বুঝতে পারে অনায়াসেই। এমনকি মায়ের কাছে শিশুর আগমনে মা ও শিশুর যে আনন্দ আমরা দেখি ও অনুভব করি, এখানেও তা স্পষ্টভাবে দেখা যায়।

 

দিন আগে দেখলাম, বাচ্চাগুলো বাসা থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ঘরের পাশে অবস্থিত মাদরাসার জমিতে পানি হওয়ায় সেখানে সাঁতার কাটতে কাটতে মাদরাসায় আমার কামরার দক্ষিণ পার্শ্বে একটি উঁচু জায়গায় বিশ্রাম করছে। সামান্য ব্যবধানে বাড়ির অন্যান্য বড় হাঁসগুলোও সেখানে বিশ্রাম করছিল। কিছুক্ষণ পর দেখলাম, আমাদের বাচ্চা হাঁসগুলো আবার পানিতে নেমে গেল। তবে একটি বাচ্চা পানি থেকে ডাঙ্গায় বড় হাঁসগুলোর সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলার জন্যই মনে হয় আবার একটু অগ্রসর হচ্ছিল। বাচ্চাটা তাদের কাছাকাছি হওয়ার সাথে সাথেই একটি বড় হাঁস বাচ্চাটাকে গলা উঁচিয়ে তাড়াতে চাইল।

 

অমনি দেখলাম, বাচ্চাটা সাহস করে উল্টো তাকেই হামলা করে বসল। সে কি অবস্থা! না দেখলে বোঝার উপায় নেই। এতোটুকু বাচ্চার তাড়া খেয়ে সব কটি বড় হাঁসের বিশ্রামই একেবারে ভেস্তে গেল। তারা সবাই পালানোর উপায় খুঁজছিল। এরই মধ্যে দেখতে পেলাম, সফল বিজয় লাভের পর বাচ্চাটা তার নিজ কাফেলার মধ্যে গিয়ে বিজয়োল্লাস করছে।

আমি বিষয়টাকে যতটা না উপভোগ করেছি, তার চেয়ে ঢের বেশি   চিন্তার খোরাক হিসাবে গ্রহণ করেছি। আমার কাছে মনে হয়েছে, এখানে বিরাট এক শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। আর তা হল, সাহস করলেই কেল্লা ফতে। আর কথাটা শুধু এই হাঁসের বাচ্চার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় সমগ্র প্রাণীজগতের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। যত দুর্বলই হোক যত অসম যুদ্ধই হোক, দুর্বলও যদি একটু সাহস করে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাহলে প্রতিপক্ষ সক্ষমতা সত্ত্বেও থমকে যায় এবং ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে এক পর্যায়ে পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হয়। এ সত্য কোনো কল্প-কাহিনী নয়, নিরেট দার্শনিক বক্তব্যও নয়; বরং একটি শাশ্বত বাস্তব সত্য। আমি বহুবার দেখেছি, একটিমাত্র দুর্বল কুকুরকে চার-চারটে তাগড়া কুকুর মার মার করে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এক পর্যায়ে ঐ দুর্বল কুকুরটিই যখন সশব্দে ফিরে দাঁড়াল, দেখলাম, তাগড়ারা আর অগ্রসর হচ্ছে না। এক জায়গায় জড়ো হয়ে শুধু ঘেউ ঘেউ শব্দে গালাগাল বা ধমক-সমকই দিচ্ছে, আর বেশি কিছু নয়। এভাবে আপনি চিন্তা করে দেখলে সকল প্রাণীকুলেই এই একই অবস্থা দেখতে পাবেন।

 

গিন্নীর এই পুত্রবৎ পালিত বাচ্চাদের দুরন্ত এই সাহসের কথা যখন তার কাছে বললাম, সে আনন্দে আত্মহারা হয়ে হাসতে লাগল। মনে হল, যেন তার ছেলেরা দুই পরাশক্তির কোনো একটিকে এইমাত্র পরাজিত করে এসেছে। শত বেদনার মাঝেও যে মানুষকে আল্লাহ তাআলা আনন্দ উপভোগ করার উপায়-উপকরণ যোগান দেন, তারই প্রকৃষ্ট প্রমাণ পেলাম আমার গিন্নীর আনন্দের মাঝে।

 

যাই হোক, যেকথা বলছিলাম তা আবারো বলছি। দূরন্ত সাহসী কোনো মানুষের দিকেও যদি কোনো কুকুর বা কোনো গরু অথবা কোনো হাঁস-মোরগও হঠাৎ করে তেড়ে আসে তখন দেখা যায় ঐ সাহসী ব্যক্তিরও পিলে চমকে যায়। দেখা যায়, এত সাহস থাকা সত্ত্বেও সামান্যতম একটি প্রাণীর সাহসের কাছে সে হার মানতে বাধ্য হচ্ছে। এটাই প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম। প্রাণীজগতকে আল্লাহ তাআলা মানুষের উপকারার্থে তাদের অধীন করে রেখেছেন বলেই তারা সাহস করে এধরনের ঘটনার অবতারণা করে না। না হয় শুধু একটি গরুও যদি অবাধ্য হয়ে ছুটতে থাকে তাহলে দেখা যাবে তার ভয়ে গ্রামের সকল নারী-পুরুষই দৌড়াতে আরম্ভ করেছে।

বেশি দিনের কথা নয়। বড় রাস্তা থেকে গ্রামের দিকে রিক্সায় যাচ্ছিলাম। একটু পর দেখলাম অনেক মানুষের সমাগম। জিজ্ঞাসা করলাম, ব্যাপার কী? বলা হল, সেনবাগের কসাইদের খামার থেকে একটি মহিষ পাগল হয়ে বেরিয়ে পড়েছে। কয়েক গ্রামের মানুষকে আতঙ্কিত করে অবশেষে এখানে এসেছে। এখন ট্রাক্টর দিয়ে তাকে বার বার হামলা করা হচ্ছে, যাতে সে দুর্বল হয়ে পড়ে। আমি নিজেও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলাম, ট্রাক্টরটা শুধু তার পায়ের ওপর আঘাত করছে। এক পর্যায়ে সে দুর্বল হয়ে পড়লে বেঁধে জবাই করে দেওয়া হয়। শুনেছি, তার ভয়ে নাকি এক হিন্দু ভদ্রলোক একটি গাছে আশ্রয় নিয়েছিল। মহিষটি তখন ঐ গাছটিকে বার বার আঘাত করতে থাকে। তখন হিন্দু ভদ্রলোক ঐ মহিষকেই ভগবান  ভগবান বলে ডাকতে আরম্ভ করে। একটা মহিষের কাছে এতগুলো মানুষ পরাজয় বরণ করল কেন? শুধু তার সাহসের কারণেই।

 

ইসলামের ইতিহাস দেখলে আমরা এ ধরনের অনেক ঘটনাই দেখতে পাই। তাঁদের ঈমানী সাহসই বিজয়ের জন্য যথেষ্ট হতে পেরেছিল। পবিত্র কুরআনেও এ সত্যের পক্ষে সাক্ষ্য পাওয়া যায়।

কত স্বল্প সংখ্যক লোক অধিক সংখ্যক লোকের ওপর বিজয় লাভ করেছে। আল্লাহরই হুকুমে।

 

মাত্র বার জন মুসলিম প্রতিনিধি দলের সম্মানে বিছানো কার্পেটের ওপর দিয়ে পায়ে হেঁটে না গিয়ে ঘোড়া চালিয়ে যাওয়া ও তরবারি দ্বারা কার্পেট খোঁচানোর ইতিহাসও আমাদের জানা আছে। রাজার সাথে মত-বিনিময়ের সময় দলনেতাকে রাজার মুখোমুখি করে দিয়ে বাকিরা সবাই তাদেরকে পিঠ দিয়ে খোলা তরবারি হাতে চর্তুদিকে বেষ্টন করে থাকার ইতিহাসও আমাদের জানা আছে। একপর্যায়ে মুসলিম দলনেতাকে রাজা প্রশ্ন করলেন, এখন যদি আপনাকে এখানে হত্যা করা হয় তাহলে কী করবেন। সাথে সাথেই মুসলিম দলনেতা হাতের তরবারিখানা মুক্ত করে উত্তোলন করে বললেন, আমাকে নিহত করার আগেই আপনি হত্যা হয়ে যাবেন। রাজা তখন ভয়ে নড়ে চড়ে উঠলেন।

 

এ সকল ঐতিহাসিক ঘটনা একমাত্র সাহসেরই ফসল ছিল। যেকোনো সাফল্য অর্জনের জন্যই উন্নত সাহসের প্রয়োজন। বিজয়ের জন্য উন্নত সাহসের বিকল্প আর কিছু নেই। আজ বাঘের বাচ্চারা ছাগলের বাচ্চার সাথে চলতে চলতে নিজেদের শাশ্বত স্বভাবের কথা পর্যন্ত ভুলতে বসেছে। আয়নায় নিজেদের মুখ দেখা দরকার। তখনই তাদের প্রকৃত পরিচয় স্মরণে আসবে। মুসলিম জাতি যদি একবার তার ঈমানী সাহস নিয়ে ঘুওে দাঁড়ায়, পৃথিবীর তাবত শক্তি তথা ইঙ্গ-মার্কিন, ইহুদী-খৃষ্টানদের যাবতীয় শক্তি খান খান হয়ে যেতে বাধ্য। আল্লাহ করুন, এ অবস্থাটা যেন দেখে যেতে পারি। আমীন।

 

[লক্ষৌ থেকে প্রকাশিত উর্দু মাসিক রাহে হেরা অক্টোবর-২০০৩ সংখ্যায় জনাব হাবীবুর রহমান রচিত প্রবন্ধ অবলম্বনে]

 

 

advertisement