সফর ১৪৩০   ||   ফেব্রুয়ারী ২০০৯

স্মৃতির পাতা থেকে

মাওলানা আতাউর রহমান খান

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

আমি হযরত সুলাইমান নদভীকে দেখেছিলাম বটে, কিন্তু তখন আমি এত ছোট যে, তার কোনো কথা মনে নেই। আল্লামা সুলাইমান নদভী ছিলেন একজন বড় আলেম। অনেক বড় আলেম। তিনি মাওলানা শিবলী নোমানীর শাগরেদ। শিবলী নোমানী সীরাতুননবী লিখেছিলেন। কিন্তু সমাপ্ত  করে যেতে পারেননি। আল্লামা সুলাইমান নাদভী তা সমাপ্ত করেন। তার সম্পর্কে একটি কথা বলতে হয়, তার একজন সাহেবজাদা আছেন সালমান নাদভী। এক সালমান নাদভী তো আছেন আলী মিয়ার ভাগ্নে। ইনি হলেন সুলাইমান নদভীর ছাহেবজাদা। কিছুদিন আগে তিনি শহীদুল ইসলাম (সাবেক এম.পি.)-এর আলমারকাযুল ইসলামীতে এসেছিলেন। তখন আমি তাকে বলেছিলাম যে, হযরত, মাই নে আপকে ওয়ালিদে মুহতারাম কো দেখা হ্যায় লেকীন বাচপন মে। আব উনকী তাছানীফ মুতালাআ করতা হুঁ। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন-কোনসী কিতাব? আমি বললাম, খুতবাতে মাদ্রাস। তিনি বললেন-আচ্ছা, আচ্ছা ইয়ে বহুত আলা কিতাব হ্যায়। ইস কা বাংলা হুয়া হ্যায়? আমি বললাম, জ্বী হাঁ, হুয়া হ্যায়। তিনি খুব খুশি হলেন। খুতবাতে মাদ্রাজ কিতাবটা পড়া আমার কাছে তার সাথে সাক্ষাতের মতোই। (যেহেতু তাকে আমি দেখেছিলাম)।

ইংরেজদের আমলে একটা সভার আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে প্রত্যেক ধর্মের আলেমরা নিজ নিজ ধর্মের প্রধান ব্যক্তিকে অন্যদের উপর প্রাধান্য দিয়ে আলোচনা করবে। হিন্দুরা তাদের ধর্মপ্রবর্তকদের আলোচনা করবে। খৃষ্টানরা হযরত ঈসা আ.-এর আলোচনা করবে। বৌদ্ধরা বুদ্ধের আলোচনা করবে। এভাবে শিখরা গুরু নানকের আলোচনা করবে। আলেমরা পরামর্শ করলেন যে, এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ মজলিসে কে আলোচনা করবেন। এমন মজলিসে আলোচনা খুব শানদার হওয়া চাই। শেষে সিদ্ধান্ত হল যে, হযরত সুলাইমান নদভী আলোচনা করবেন। হযরত সুলাইমান নদভী রাহ. এই প্রতিযোগিতামূলক সমাবেশে হুযুরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তুলে ধরেছিলেন। তিনি সর্বমোট আটটি তাকরীর পেশ করেছিলেন। এই আটটি তাকরীর খুতবাতে মাদ্রাস নামে সংকলিত হয়েছে। এটার বাংলা তরজমা হয়েছে। এর মধ্যে মাশহুর হল পয়গামে মোহাম্মাদী নামের একটি তরজমা। অন্য নামেও কিছু তরজমা প্রকাশিত হয়েছে। সেগুলো এখন আর বেশি দেখা যায় না। এটি এমন এক কিতাব যা পড়লে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে পূর্ণ বছীরত হাসিল হয়। এতে এমন কতগুলো দিক রয়েছে যা অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। তিনি বিষয়গুলো এমনভাবে পেশ করেছিলেন যে, অন্য ধর্মের লোকদের আলোচনা ম্লান এবং নিষ্প্রভ হয়ে গিয়েছিল। ঐগুলোর যে কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই তা প্রকাশিত হয়ে যায়। একটা ধর্ম বা ধর্মপ্রবর্তকের মধ্যে কয়েকটা জিনিস থাকতে হবে। তার ঐতিহাসিক ভিত্তি থাকতে হবে। এই ঐতিহাসিক ভিত্তি একমাত্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আছে, আর কারো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই।

এভাবে যে ধর্ম তিনি দিবেন তাও মুসনাদ (সনদ ভিত্তিক) হতে হবে। তার মধ্যে ইসনাদ থাকতে হবে। আর এরূপ মুসনাদ দ্বীন একমাত্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আছে। এটা তিনি প্রমাণ করেছেন।

এভাবে এই ধর্মটা  হতে হবে সর্বজনীন। অর্থাৎ সকল শ্রেণীর মানুষের আহকাম তাতে থাকতে হবে। শুধু একটা শ্রেণীর হলে হবে না। নারী-পুরুষ, ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, আযাদ-গোলাম, শাসক এবং শাসিত এই যে বিভিন্ন শ্রেণী এদের সকলের জন্য তাতে শিক্ষা ও পথনির্দেশ থাকতে হবে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে শুধু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই আর কেউ টিকে না।

এমনিভাবে জামিইয়ত অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গতা থাকতে হবে। পরিপূর্ণতা থাকতে হবে। ব্যাপকতা থাকতে হবে। সর্বজনীনতা থাকতে হবে। ঐতিহাসিক ভিত্তি থাকতে হবে। আরেকটা পয়েন্ট বলেছিলেন। যিনি ধর্ম প্রচার করবেন তিনি স্বয়ং তার ধর্মের পূর্ণ অনুসারী হতে হবে। শুধু তিনি উপদেশ দেন অথচ   বাস্তব জীবনে তিনি কেমন এই খবর কেউ রাখে না-এটাও অনুসরণীয় হতে পারে না।

তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলতেন তার উপর অন্যরা যতটুকু আমল করত স্বয়ং হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার চেয়ে বেশি আমল করতেন। এভাবে তিনি হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উপস্থাপন করেছেন তার এই প্রবন্ধগুলোর মধ্যে।

এছাড়া আমাদের দেশে যে সকল আকাবির অতীত হয়েছেন তাদের মধ্যে সর্বপ্রথম বলতে হয় হযরত মাওলানা আতহার আলী রাহ.-এর কথা। তিনি হযরত থানভী রাহ.-এর খলীফা। তাঁর খেলাফত প্রাপ্তিরও অনেক ঘটনা আছে, সেগুলো দরকার নেই। তাঁকে আমি আমার বাল্যকাল থেকে নিয়ে যতদিন দুনিয়ায় বেঁচেছিলেন ততদিন দেখেছি, তাঁর সঙ্গে থেকেছি এবং একেবারে ছায়ার মতো তাঁর অনুসরণ করেছি।

তাঁর কাছেই আলিফ-বা এর সবক নিয়েছি। দাওরা পর্যন্ত তাঁর কাছেই, তাঁর মাদরাসায় লেখাপড়া করেছি। যে  বছর আমি ফারিগ হলাম সে বছরই তিনি আমাকে তাঁর মাদরাসার মুদাররিস হিসেবে নিয়োগ দিলেন। তার সাথে আন্দোলনে সারা দেশ সফর করেছি। তিনি নেযামে ইসলাম পার্টি করতেন। পার্টির কাজে তাঁর সাথে সারা দেশ সফর করেছি তাঁর পি.এস. (প্রাইভেট সেক্রেটারি)  হিসেবে। তিনি এমন এক ব্যক্তি, যার বর্ণনা এই অল্প সময়ে দেওয়া যাবে না। তিনি অনেক উঁচু, অনেক গভীর, অনেক প্রশস্ত এবং অনেক ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। যার দৃষ্টান্ত দেওয়া যায় যে, কিছুটা অমুকের মতো এমন বলার মতো লোকও নেই। এই মাওলানা আতহার আলী সাহেবের সাথে তো জীবনই কাটল। মিসরে হাসানুল বান্না ইখওয়ানুল মুসলিমীন গঠন করেছিলেন ইসলামী হুকুমত করার জন্য। আমাদের ভারতবর্ষে মাওলানা আতহার আলী রাহ.-এর আগের বুযুর্গরা সংগ্রাম করেছেন এবং জেহাদ করেছেন ব্রিটিশ তাড়াবার জন্য। ব্রিটিশ বিরোধী ব্যাপক আন্দোলন হয়েছিল। সাইয়েদ আহমদ শহীদ বেরলভী রাহ. ইসলামী হুকুমত কায়েম করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এরপর থেকে শুধু ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন হয়েছে, ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠা করার আন্দোলনের সুযোগ পাওয়া যায়নি। আগে তো ব্রিটিশ তাড়াতে হবে তারপর ইসলামী হুকুমত।

ব্রিটিশ তাড়াবার পর হিন্দুস্তান হল, হিন্দুস্তানের কথা তো আলাদা। পাকিস্তান হওয়ার পরও যখন ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হল না শাসকদের কারণে তখন মাওলানা আতহার আলী রাহ. পূর্ব পাকিস্তানে সর্বপ্রথম ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার আওয়াজ তোলেন।

জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম গঠন হয় ১৯৪৬ সালে। পাকিস্তান হল ৪৭ সালে। জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের প্রথম সভাপতি ছিলেন মাওলানা শাবিবর আহমদ উছমানী। পাকিস্তান হওয়ার পর তিনি করাচিতে সর্বপ্রথম    পাকিস্তানের ঝান্ডা উত্তোলন করলেন। আর ঢাকায় উত্তোলন করলেন মাওলানা যফর আহমদ উছমানী। পাকিস্তানে শাববীর আহমদ উছমানী ও মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহর ইন্তেকালের পর দেশের মধ্যে একটা নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়ে গেল যে, ইসলামী আন্দোলন কে করবে, কীভাবে করবে? সে সময়ে মাওলানা আতহার আলী রাহ. নেযামে ইসলাম পার্টি গঠন করলেন। যা জমিয়তে উলামায়ে ইসলামেরই একটা রূপ। এর মাধ্যমে তিনি মুসলিম লীগের সাথে বিদ্রোহ করলেন। তার বক্তব্য ছিল, তোমরা ইসলামের দোহাই দিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেছ, কিন্তু ইসলাম কায়েম করছ না। কাজেই তোমাদের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই-এই বলে তিনি মুসলিম লীগ থেকে আলাদা হয়ে গেলেন। এসময়ে অনেকেই তাঁকে আলাদা না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি কারো কথা মানলেন না। আলাদা হয়ে গেলেন। আলাদা হয়ে তিনি নেযামে ইসলামের আওয়াজ তুললেন। জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মধ্য থেকেই আমরা নেযামে ইসলাম চাই। এভাবে নেযামে ইসলাম পার্টি হল। জমিয়তের উলামায়ে ইসলামের বাচ্চা হল নেযামে ইসলাম পার্টি। নেযামে ইসলাম হল জমিয়তের একটি অংশ এবং জমিয়তের একটা দাবি। তার কথা ছিল, ইসলামী হুকুমত করতে হবে। এর জন্য যত ধরনের প্রক্রিয়া অবলম্বন করা দরকার তাও করতে হবে। যেহেতু পাকিস্তান হয়েছে ইসলামের দোহাই দিয়ে তাই মুসলিম লীগের নেতাদেরকে বেঈমানী করতে দেওয়া যাবে না।  এভাবে মুসলিম লীগের নেতাদের সাথে তার একটা বিরোধ সৃষ্টি হয়ে গেল। মুসলিম লীগের নেতা নূরুল আমীন, মোনায়েম খাঁ ও আরো যারা ছিল সকলের সাথে বিরোধ হয়ে গেল। তারপরও তিনি নেযামে ইসলাম পার্টি গঠন করলেন এবং পার্টিকে এত শানদার করলেন যে, পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান অল-    পাকিস্তান নেযামে ইসলাম পার্টি গঠন করলেন এবং ১৯৫৪ সালে যখন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচন হল তখন এই দেশে মাওলানা ভাসানী এবং সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ, শেরে বাংলা এ.কে.এম. ফজলুল হকের নেতৃত্বে কৃষক শ্রমিক পার্টি ছিল। আর মাওলানা আতহার আলী রাহ.-এর নেতৃত্বে নেযামে ইসলাম পার্টি এই তিন পার্টির (নেতা চারজন, দল তিনটা) সমন্বয়ে নির্বাচন হল। নির্বাচনে তারা জয়ী হলেন। এর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান থেকে নেযামে ইসলাম পার্টির ৩০/৩৫ জন সদস্য জয়ী হলেন। এর মধ্যে মাওলানা সৈয়দ আহমদ, কুমিল্লার মাওলানা আশরাফ আলী আরো অনেকে ছিলেন। যেমন নাছির উদ্দীন সাহেব, আবদুল ওয়াহহাব এঁরা পাশ করলেন। তারপর তারা সরকার গঠন করলেন। এর মধ্যে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী হলেন আশরাফ আলী চৌধুরী কুমিল্লা নেযামে ইসলাম পার্টি, ধর্মমন্ত্রী হলেন সৈয়দ আহমদ সাহেব। এভাবে তারা মন্ত্রীসভা গঠন করেছিলেন। শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক এবং হযরত মাওলানা শেষ পর্যন্ত একই ছিলেন। কিন্তু যা কারণেই হোক শেষ পর্যন্ত এই সরকার টিকেনি। এভাবে তিনি রাজনীতি করেছিলেন। তিনি বলতেন, রাজনীতি আলাদা কোনো জিনিস নয়। রাজনীতি আমাদের দ্বীনের- মাযহাবেরই একটা অংশ।

এখানে একটা কথা বলতে হয়, জামাতে ইসলামীর সাথে আমাদের বিরোধটা কোন জায়গায়। বিরোধ অনেক জায়গায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, জামাতে ইসলামী সম্পূর্ণ দ্বীনটাকে একটা রাজনৈতিক প্রোগ্রাম মনে করে। দ্বীন এবং রাজনীতি একই, দ্বীন মুআয়ইদ আর সিয়াসত হল মুআয়আদ। অর্থাৎ রাজনীতির জন্য দ্বীন-ধর্ম। এটা হল মওদুদী সাহেবের বক্তব্য। আর আমাদের উলামায়ে কেরাম দ্বীনকে রাজনীতি মনে করেন না। তারা রাজনীতিকে দ্বীনের একটা অংশ মনে করেন। আর রাজনীতিকে মনে করেন মুআয়ইদ আর দ্বীনকে মনে করেন মুআয়আদ। রাজনীতির জন্য দ্বীন নয়; বরং দ্বীনের জন্য রাজনীতি। তাদের দর্শনটাই উল্টা। মওদুদী সাহেবের ধারণা, দ্বীন হল হুকুমতের সহায়ক। হুকুমতের জন্য দ্বীন এসেছে। হুকুমতের জন্য আম্বিয়া আ. এসেছেন। হুকুমতের জন্যই শরীয়ত এসেছে। হুকুমতের জন্যই ইবাদত-বন্দেগী। অন্যদিকে আমাদের উলামায়ে কেরাম দ্বীনকেই উদ্দেশ্য মনে করেন, হুকুমতকে নয়।

এই সিয়াসতই মাওলানা আতহার আলী রাহ. করেছেন। পশ্চিম পাকিস্তানে তাঁর সাথে ছিলেন মুফতী শফী রাহ., হযরত মাওলানা ইহতিশামুল হক থানভী রাহ., মাওলানা যফর আহমদ উছমানী রাহ., মুফতী রশীদ আহমদ সাহেব। আরেক জন বড় ব্যক্তি ছিলেন তাঁর নাম আমরা অনেকে হয়ত জানি না। তিনি জাফর আহমদ আলসায়ী, জাফর আহমদ উছমানী না। তিনি একজন রাজনীতিবিদ এবং পার্লামেন্টারিয়ান এবং সংবিধান প্রণয়নকারী ছিলেন। তিনি হযরত মাওলানা আতহার আলী রাহ.-এর সাথী ছিলেন।

আমি হযরত মাওলানা শামছুল হক ফরীদপুরী রাহ.কে দেখেছি। রশীদ আহমদ সাহেবকে দেখেছি। দ্বীন মুহাম্মদ সাহেবেরও দেখা পেয়েছি। ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার হযরত মাওলানা তাজুল ইসলাম সাহেব, মাওলানা মাহমুদ মুস্তফা মাদানী বরিশাল মাহমুদিয়ায় ছিলেন। মদীনার লোক ছিলেন এবং আওলাদে রাসূল ছিলেন। তাঁদের সাথে আমার দেখা-সাক্ষাত, চলাফেরা হয়েছে। মাওলানা আতহার আলী রাহ.-এর সাথে থাকার কারণে আমি এই বড়দের কাছে ভিড়তে পেরেছি।

হযরত মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রাহ. একজন মুজাহিদ মানুষ ছিলেন এবং একজন মুখলিছ মানুষ ছিলেন। উঁচু হিম্মতের মানুষ ছিলেন। তাঁর অনেক ঘটনা আছে।

এই যে তাফসীর মাহফিল আমাদের দেশে চলছে এর প্রথম উদ্ভাবক হযরত মাওলানা মুফতী দ্বীন মুহাম্মদ সাহেব। তিনি বহু দিন পর্যন্ত রেঙ্গুনে তাফসীর করেছেন। এরপর চকবাজার মসজিদে তাফসীর করতেন। তাফসীর মাহফিলের একটা রেওয়াজ হযরত মাওলানা দ্বীন মুহাম্মদ সাহেব করেছিলেন।

হযরত তাজুল ইসলাম রাহ. ছিলেন মুনাযিরে ইসলাম। তাঁকে ফখরে বাঙ্গাল বলা হত। তিনি মিসর গিয়েছিলেন। মিসরের আলিমরা দাড়ি রাখে না। তারা দাড়ি রাখাকে জরুরি মনে করে না। হযরত যাওয়ার পর সেখানে তাদের সাথে কথা হল। তিনি যখন তাদেরকে দাড়ি সম্পর্কে বললেন, তখন তারা দাড়ির মধ্যে দ্বীন নয়-এই ধরনের একটা কথা বলেছিলেন। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে জবাব দিলেন, দাড়ির মধ্যে দ্বীন আছে কিনা সে আলোচনা থাক, কিন্তু দ্বীনের মধ্যে তো দাড়ি আছে।  এরপর বিষয়টা তিনি প্রমাণ করে দিলেন। তারা লা-জওয়াব হয়ে গেল। এমন আরো অনেক ঘটনা আছে। বাইরের উলামায়ে কেরামের সাথে প্রতিযোগিতায় তিনি সব সময় বিজয়ী থাকতেন এজন্য তাকে ফখরে বাঙ্গাল বলা হত।

হযরত মাওলানা সিদ্দীক আহমদ সাহেব খতীবে আজম। তিনি যে বয়ান দিতেন সেরকম অতুলনীয় বয়ান এখন আর কেউ দিতে পারে না। এই রকম আন্দাজ, এই রকম উঁচা বয়ান, এই রকম হাকীমানা বয়ান, উনি দিতে পারতেন। ঘন্টার পর ঘন্টা তিনি বয়ান দিলে মানুষ পক্ষের হোক আর বিপক্ষের হোক উঠে চলে যাবে এরকম কেউ পারত না। এজন্যই তাকে খতীবে আযম বলা হয়। তিনি যখন অল পাকিস্তান নেযামে ইসলাম পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি তখন পাকিস্তানের কোনো কোনো জায়গায় উর্দূতে বয়ান দিতেন। পাকিস্তানের লাহোরে বা করাচিতে বা মুলতানে কিংবা পেশোয়ারে বিভিন্ন প্রদেশে তিনি বয়ান দিতেন। তাঁর বয়ান শুনে     পাকিস্তানের উলামায়ে কেরাম যারা আগে মনে করত পূর্ব পাকিস্তানে কোনো বড় আলেম নেই,  তাঁরা স্বীকার করেছিলেন যে, পূর্ব  পাকিস্তানেও অনেক বড় আলেম আছেন। এই কারণে তাঁকে      পাকিস্তান থেকে খতীবে আযম উপাধী দেওয়া হয়েছে। পরে এটাই আমাদের দেশে মশহুর হয়েছে।

মাহমুদ মুস্তফা মাদানী এত সুন্দর লোক ছিলেন, তাকে দেখেই অনেক মানুষ মুসলমান হয়েছে বলে শোনা যায়।  মদীনা শরীফের লোক ছিলেন। বিদআতের বিরুদ্ধে কাজ করতেন। বিদআতীরা একবার তাঁকে মারধোর করে নদীতে ফেলে দেয়। তিনি তখন যুবক বয়সের ছিলেন। তারা এমনভাবে মেরেছিল যে, মনে করেছে তিনি হয়ত মারাই গেছেন। তারা তাঁকে নদীতে ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু ঘটনাক্রমে তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন। পরে তাঁকে উদ্ধার করা হল এবং তিনি সুস্থ হলেন। ঐ সময়ে বৃটিশ সরকার তাঁকে একটা বন্দুকের লাইসেন্স দিয়েছিল আত্মরক্ষার জন্য। আমরা তাকে দেখেছি, তার সাথে একজন বন্দুকধারী লোক (বডিগার্ড) থাকত। তিনি ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় ওয়াজ করতেন। তার ওয়াজ শুনে বহু মানুষের হেদায়েত হয়েছে। নেযামে ইসলাম পার্টির নায়েবে সদর ছিলেন।   

১৯৭১ সালে যখন মুক্তিযুদ্ধ চলছিল তখন তাকে শহীদ করে দেওয়া হয়। ঐ সময় তিনি এক মাহফিলে বসে ওয়াজ করছিলেন। লালবাগ মাদরাসার পার্শ্বে  তাঁর কবর আছে।

এমনিভাবে হযরত মাওলানা মকছুদুল্লাহ রাহ. হাকীমুল উম্মত থানভী রাহ.-এর খলীফা ছিলেন। তাঁকে দেখেছি। থানভী রাহ. যেমন উসূলী লোক ছিলেন, তিনিও ঠিক তেমনি ছিলেন।

এভাবে অনেক বড় বড় ব্যক্তিত্বকে দেখেছি। মাওলানা আতহার আলী রাহ. একটা কথা বলতেন, ঐ কথাটা শেষে বলছি। তিনি বলতেন, উলামায়ে কেরামকে এই রকম ঢিলাঢালা হয়ে থাকলে চলবে না। উলামায়ে কেরামকে কিছুটা স্মার্ট হতে হবে। স্মার্ট শব্দ তিনি ব্যবহার করতেন না। কিশোরগঞ্জের মানুষ ছিলেন, বলতেন, এই রকম উলুজুলু হয়ে থাকলে ছলত না। মৌলভীদেরকে কিছু চালু হইতে হবে। আরেকটা কথা ছিল, উলামায়ে কেরামকে বাংলা ভাষা শিখতে হবে এবং বাংলা ভাষায় কিতাবপত্র লিখতে হবে। বাংলা ভাষায় পত্রিকা বের করতে হবে। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে অগ্রসর হতে হবে। তিনি সর্বপ্রথম তার মাদরাসা জামেয়া এমদাদিয়ায় বাংলা ভাষা নেসাবভুক্ত করেছিলেন। ক্লাস এইট পর্যন্ত। ভালো মাস্টার রেখে বাংলা পড়ানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। তার এই কাজকে অনেক আলেম পছন্দ করেননি। তারা বিদ্রূপ করে বলেছিলেন, মাওলানা আতহার আলী তো তার মাদরাসাকে কলেজ বানিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু তিনি এইসব বিদ্রূপের পরোয়া করেননি। তিনি তাদেরকে বলতেন, একদিন আপনারাও বাংলা ভাষাকে নেসাবভুক্ত করবেন। এখন তো সবাই বাংলা পড়াচ্ছেন। কিন্তু হযরত মাওলানা যখন এটা শুরু করেন তখন তাকে অনেক বিদ্রূপের সম্মুখীন হতে হয়েছে। হযরত মাওলানা নিজে পত্রিকা বের করেছেন। সাপ্তাহিক নেযামে ইসলাম বের করেছেন। দৈনিক নাজাত পত্রিকা বের করেছেন। মাসিক মুনাদী পত্রিকাও তিনি বের করেছেন এবং বাংলা ভাষায় কমিউনিজম এর বিরুদ্ধে, স্যোশালিজমের বিরুদ্ধে কিছু বইপত্র তিনি লিখিয়েছিলেন। মাওলানা ফরীদউদ্দীন মাসউদ ইসলামে শ্রমিকের অধিকার সম্পর্কে ছাত্রজীবনে একটা বই লিখেছিলেন। এটা মাওলানা আতহার আলী সাহেবই লিখিয়েছিলেন।

পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র ও ইসলাম নামে একটা বই আমি লিখেছিলাম। এটি সরাসরি আমার না, মাওলানা শামছুল হক আফগানী সাহেবের একটা পুস্তিকার অনুবাদ ছিল। মাওলানা আবদুল হান্নান সাহেব ছিলেন সিলেটের। তিনি মক্কা শরীফে গিয়ে ইন্তেকাল করেছেন। তিনি লিখেছিলেন বাস্তবক্ষেত্রে সমাজতন্ত্রও সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর বাস্তব অবস্থা। এগুলো মাওলানা আতহার আলী রাহ.-এর প্রেরণায় লেখা হয়েছিল। 

 (চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

 

advertisement