রজব ১৪৩৬   ||   মে ২০১৫

দুআর সঙ্গে দাওয়া

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

হযরত হাফেজ্জী হুযুর রাহ.-এর বিশিষ্ট খলীফা লক্ষীপুর জেলার বটতলীর নিকটবর্তী অঞ্চলের বাসিন্দা বর্ষীয়ান আলেমেদ্বীন হযরত মাওলানা মুমিনুল্লাহ ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম-এর এখন অনেক বয়স হয়ে গেছে। অসুস্থতাও থাকে। থাকে বার্ধক্যজনিত নানা অপারগতা। এজন্য তিনি আগের তুলনায় ঢাকায় কম আসেন। মাঝেমধ্যে ঢাকায় এলেও বেশিদিন থাকেন না। সে হিসেবে মারকাযুদ দাওয়াহতেও সেভাবে এখন তাঁর উপস্থিতি ঘটে না। আলহামদুলিল্লাহ এক সময় তিনি খুব আসতেন। দশ-পনের বছর আগের কথা। মারকাযুদ দাওয়াহর মোহাম্মাদপুর-যাত্রাবাড়ির যুগে তিনি বহুবার তাশরীফ এনেছেন। মিরপুরেও এসেছেন দু-তিনবার। হযরতপুরে এসেছেন একবার।

তিনি যখনই মারকাযুদ দাওয়ায় আসতেন হযরত হাফেজ্জী হুযুর রাহ.-সহ অন্যান্য আকাবির বুযুর্গের বিভিন্ন ঘটনা শোনাতেন। তাঁদের বক্তব্য, আচরণ ও উদ্ধৃতির কথা শোনাতেন। হযরত হাফেজ্জী হুযুর রাহ.-এর সূত্রে একটি কথা তিনি অনেকবার শুনিয়েছেন। তিনি তো হযরত হাফেজ্জী হুযুর রাহ.-এর খলীফাও, আবার বেশ কিছুদিন হযরতের বাড়ির মাদরাসা লুধুয়া এশাআতুল উলূম-এরও ছিলেন যিম্মাদার। ওই সময় তিনি বিভিন্ন প্রয়োজন-উপলক্ষে কিংবা হালের উন্নতির জন্য হাফেজ্জী হুযুর রাহ.-এর কাছে দুআ চাইতেন। হযরত হাফেজ্জী হুযুর রাহ. দুআ করতেন তাঁর আবেদনের প্রেক্ষিতে। আবার কখনো কখনো দুআ চাওয়ার পর হাফেজ্জী হুযুর রাহ. বলতেন, দুআ তো চাও। কিন্তু দুআর সঙ্গে তাআল্লুক মাআল্লাহ-ও (আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কও) দরকার। অর্থাৎ যবানী দুআর সঙ্গে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের অবস্থা, দুআর সময় মনের দৃঢ়তা এবং আমলী যিন্দেগীতে নেকির হাল বজায় রাখা দরকার। এই কথাটি হযরত মুমিনুল্লাহ ছাহেব বারবার বলতেন। তাঁর মুখে বারবার উচ্চারিত এই উদ্ধৃতিটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য উপলব্ধি করতাম। করার চেষ্টা করতাম। আর এই কথাটির তাকাযা আমার দ্বারা পূরণ হত না বলে অপরাধবোধেও ভুগতাম। এর মধ্যেই হঠাৎ একদিন মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবার ১৫তম খন্ডের ১৩৮ নম্বর পৃষ্ঠায় কিতাবুদ্দুআর মধ্যে একটি পরিচ্ছেদ: الدعاء بلا نية ولا عمل (আমলের নিয়ত ও আমল ছাড়া দুআ নজরে পড়ল। তখন মুমিনুল্লাহ ছাহেব হুযুরের ওই কথাটা আবার মনে পড়ে গেল এবং তাঁর কথাগুলোর গুরুত্ব ও প্রভাব মজবুতির সঙ্গে দিলে বসে গেল।

ওই পরিচ্ছেদে মুসান্নিফ রাহ. তাবেয়ী হযরত ওহাব ইবনে মুনাব্বিহ রাহ.-এর একটি উক্তি উদ্ধৃত করেছেন। সেটি হল :

 مثل الذي يدعو بغير عمل مثل الذي يرمى بغير وتر

(আমল ছাড়া দুআকারী হচ্ছে টানাসুতা ছাড়া পাথর নিক্ষেপকারীর মতো -মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা ৩৫১৭০)। ওই পরিচ্ছেদে আরেক মর্যাদাবান তাবেয়ী হযরত রবী ইবনে খুসাইম রাহ.-এর একটি উক্তিও উদ্ধৃত করা হয়েছে। তাকে একবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, মানুষ বিভিন্ন হাল বদলানোর জন্য এতো দুআ করে। কিন্তু তাদের দুআ তো কবুল হয় না এবং হালেরও বদল হয় না। কী কারণে এমন হয়? তখন তিনি উত্তর দিলেন-

 إن الله لا يقبل إلا النخيلة من الدعاء (নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা খাঁটি দুআ ছাড়া অন্য কিছু কবুল করেন না।)

খাঁটি দুআর মানে হল, যে দুআয় দিল উপস্থিত থাকে। দুআকারী নিজে দুআর ব্যাপারে পুরোপুরি আন্তরিক থাকে এবং দুআর বিষয়টিকে মনেপ্রাণে চায় ও কামনা করে। অনেক সময় দেখা যায়, আমরা বিভিন্ন সদগুণের প্রার্থনা করি। ভালো হালের প্রার্থনা করি। কিন্তু ওই বিষয়ে নিজের ভেতরে যথাযথ গুরুত্ব থাকে না। দুআ-উপযোগী চেষ্টা কিংবা দুআর সঙ্গে দুআর বাইরের অন্য কাজকর্মের কোনো  সামঞ্জস্য থাকে না।

হযরত রবী ইবনে খুসাইম ছিলেন প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর শাগরিদ। হযরত ইবনে মাসউদ রা.-এর আরেকজন শাগরিদ ছিলেন আব্দুর রহমান ইবনে ইয়াযীদ রাহ.। তো হযরত আব্দুর রহমান ইবনে ইয়াযীদকে যখন দুআ বিষয়ে হযরত রবী ইবনে খুসাইমের উক্তিটি শোনানো হল তখন তিনি বললেন, তোমরা কি শোনো নাই আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. দুআ সম্পর্কে বলেছেন :

 والذي لا إله غيره لا يسمع الله من مسمع ولا مراء ولا لاعب ولا داع، إلا داع دعا بتثبت من قلبه. 

(শপথ সেই সত্তার, যিনি ব্যতিত কোনো ইলাহ নেই। তিনি শুধু ওই দুআকারীর দুআ শুনেন যে দিলের উপস্থিতি ও ইয়াকীনের সঙ্গে দুআ করে। এছাড়া তিনি কোনো শ্রবণকরানেওয়ালা, প্রদর্শক, খেল-তামাশাকারী ও বাহ্যিক দুআকারীর দুআও শুনেন না।-মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা ২৯২৭০)

সুতরাং দুআর হালতের সঙ্গে দুআর বাইরের হালতের সামঞ্জস্য থাকতে হবে। দুআয় তো আমরা দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতের হাসানা বা কল্যাণ কামনা করি। কিন্তু বাস্তবে শুধু দুনিয়ার হাসানা পেলে আমরা খুশি হয়ে যাই। এতেই আমাদের আগ্রহ নিবদ্ধ থাকে। আখিরাতের হাসানার জন্য বাস্তবিকপক্ষে কোনো পেরেশানি বা ব্যাকুলতা থাকে না। গুনাহ থেকে বাঁচা এবং নেকির যিন্দেগি গ্রহণের কোনো চেষ্টা থাকে না। এ অবস্থা পরিহার করতে হবে। দুআ কবুল না হওয়ার পেছনে এ অবস্থাও একটি বড় কারণ। উপরের উক্তিতে যে দুআর ক্ষেত্রে لاعب বা খেলতামাশাকারী  বলা হয়েছে- তার একটি অর্থ এটাই। দুআয় খেলতামাশার প্রধান অর্থ হল দুআর মধ্যেই অমনোযোগী থাকা, গাফেল থাকা। তবে দুআর মধ্যে খেলতামাশার আরেকটি অর্থ দুআর বাইরের বাস্তব জীবনে দুআর তাকাযা অনুযায়ী না থাকা, দ্বীনের ওপর না চলা। একথাই এই উক্তিতে বলা হয়েছে। সেজন্যেই দুআর সঙ্গে বাস্তব যিন্দেগি বা আমলি যিন্দেগির যোগসূত্র থাকা উচিত। আর দুআয় যে تثبت বা দৃঢ়তা-এর কথা বলা হয়েছে, সেটি হচ্ছে মনের দৃঢ়তা, যা দুআর প্রাণ। সেটা হওয়ার জন্য আমলী যিন্দেগির অনুশীলন একটি শর্ত। কারণ, যিন্দেগির মধ্যে দুআর প্রভাব না থাকলে দুআয় তাসাব্বুত বা দৃঢ়তা আসে না।

নিয়ত ছাড়া দুআ কবুল না হওয়ার যে উক্তি বর্ণিত হয়েছে তার উদ্দেশ্য হচ্ছে এক. দুআয় যা চাইব দৃঢ়তার সাথে চাইব। দুই. যা চাইব সেটার জন্য চেষ্টার নিয়ত করব এবং চেষ্টা করতে থাকব। যদি চেষ্টার নিয়ত ও চেষ্টা না থাকে তাহলে সেটা নিয়তের শর্তের অনুপস্থিতি হিসেবেই গণ্য হবে। পক্ষান্তরে যদি দুআর সাথে সাথে تثبت বা দুআর সময় মনের দৃঢ়তা এবং বাস্তব জীবনে তাকওয়ার ব্যাপারে আমরা যতœবান হই তাহলে দুআর সুফল আরো বেড়ে যাবে। সে সুফল ইনশাআল্লাহ অনুভবও করা যাবে।

প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবু যর গিফারী রা. বলেন :

يكفي من الدعاء مع البر ما يكفي الطعام من الملح

(অল্প লবণ যেমন খাবারে যথেষ্ট হয় তেমনি নেকির সঙ্গে অল্প দুআই যথেষ্ট হয়। মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা ২৯২৭২) এই উক্তিতে নেকির সঙ্গে অর্থাৎ বাস্তব জীবনে তাকওয়ার অবস্থা অবলম্বনের সঙ্গে কম পরিমাণ দুআর আছর বা কার্যকারিতা যে অনেক বেশি সে কথাটিই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এর দ্বারা অবশ্য সার্বিকভাবে দুআ কম করতে উৎসাহিত করা মাকসাদ নয়। সে জন্যই দিলের উপস্থিতি, মনের প্রত্যয় এবং বাস্তব জীবনে দুআর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ আমলসহ আল্লাহ তাআলার দরবারে আমাদের দুআ করতে হবে।

দুআ তো বিভিন্ন পরিস্থিতিতেই করা হয়। কিন্তু কবুল না হওয়া বা হালের বদল না হওয়ায় অনেকের মধ্যে হতাশা কাজ করে। কিন্তু আমরা তো দুআ কবুলের শর্তাবলীর প্রতি খেয়াল করি না। দুআর সাথেও যে নিয়তের দৃঢ়তা ও আমল দরকার সেদিকে আমাদের মনোযোগ দেওয়া উচিত। আল্লাহ তাআলা আমাদের দুআর মধ্যে প্রাণ সৃষ্টি করে দিন এবং আমলী যিন্দেগির মধ্যে দুআর অনুগামী থাকার চেষ্টা করার তাওফীক দান করুন। 

(আলোচনা থেকে প্রস্তুতকৃত। প্রস্তুতকরণ : শরীফ মুহাম্মদ)

 

 

advertisement