রজব ১৪৩৬   ||   মে ২০১৫

চান্দ্রমাস: একটি পর্যালোচনা-৩ : আল-বেরুনী কী বলেছেন?

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

ইচ্ছা ছিল, এ সংখ্যায় ইঞ্জিনিয়ার সাহেব কর্তৃক হেলালের বিকৃতি বিষয়ে লিখব। পরে মনে হলো, প্রথমে হিলাল ও অমাবস্যা বিষয়ে আল-বেরুনীর বক্তব্য তুলে ধরি। কারণ শুনেছি, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব যে চান্দ্রমাস অমাবস্যা থেকে শুরু হওয়ার কথা বলেন- তার সুযোগ নিয়েছেন তিনি আল-বেরুনীর নামে পাওয়া একটি ভুল তথ্য থেকে। তাই এ সংখ্যায় আল-বেরুনী কী বলেছেন এ বিষয়ে লেখা হল।

ইঞ্জিনিয়ার সাহেব অন্য অনেক বিষয়ের মতো অমাবস্যার ব্যাপারেও বিপরীতমুখী কথা বলেছেন। তবে বেশিরভাগ এটাই বলেছেন যে, ইসলামে এবং বিজ্ঞানের কাছে অমাবস্যার কোনো স্থান নেই।!!

অমাবস্যা একটি বাস্তবতা। ইসলাম কখনো কোনো বাস্তব বিষয়কে অস্বীকার করে না। প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানও তাই। অতএব ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের এই কথা সত্যিই বড় আশ্চর্যের যে, ইসলামে এবং বিজ্ঞানে অমাবস্যার কোনো স্থান নেই।

শুনেছি, একজনের সাথে আলাপকালে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব তার এই বক্তব্য নিয়ে গর্ব করছিলেন এবং নিজেই এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলছিলেন যে, (বিখ্যাত মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানী) আল-বেরুনী একথা লিখেছেন, এটা নাকি তাকে এক মুফতী সাহেব বলেছেন। তিনি হলেন জনাব এ কে এম নেছার আহমদ খান লক্ষীপুরী। যাইহোক তার সাথে যোগাযোগ করা হল। তাকে জিজ্ঞেস করা হল: আল-বেরুনীর কোনো গ্রন্থ জনাবের কাছে আছে কি না? বললেন, না। তিনি বুঝতে পারলেন যে, তার ঠিকানা দিয়েছেন ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মাদ এনামুল হক! প্রশ্ন সম্পর্কে জ্ঞাত হয়ে বললেন,হাঁ,আল-বেরুনীর একটি ভাষ্য আমার কাছে লেখা আছে। ইনশাআল্লাহ বাড়িতে গিয়ে লিখিয়ে দেব। যে ভাষ্যটি তিনি লেখালেন তা নিম্নরূপ: বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক অনুবাদকৃত এগারশত শতাব্দী আল-বেরুনী গ্রন্থে ৮৯ পৃষ্ঠায় পরিষ্কার ভাষায় উল্লেখ আছে যে, চান্দ্রমাসের হিসাব গণনা অমাবস্যা হতে আরম্ভ হয়ে থাকে (চন্দ্রকলা)।

চন্দ্রকলা কার লিখিত? তিনি ফাউন্ডেশন কর্তৃক অনূদিত বই থেকে আল-বেরুনীর বক্তব্য সরাসরি উদ্ধৃত করছেন নাকি অন্য কারো মারফতে? মুহতারাম নেছার আহমদ সাহেব এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি! যাইহোক, নেছার সাহেবের শোকর আদায় করা হল।

এখানে অবাক করা বিষয় হল, এনাম সাহেব তো বলছিলেন, অমাবস্যার কোনো স্থানই নেই। ইসলামেও না, বিজ্ঞানেও না। এখন আল-বেরুনীর নামে বলা উক্তিতে এর অস্তিত্বই শুধু প্রমাণিত হচ্ছে না; বরং এত বেশি গুরুত্ব যে, চান্দ্রমাস শুরুই করা হবে অমাবস্যা থেকে! নাউযু বিল্লাহিল আযীম।

যাইহোক, এটা তো পরিষ্কার যে, আল-বেরুনীর এরকম কোনো গ্রন্থ নেই। উদ্ধৃতিতে অবশ্যই কোনো ত্রুটি থাকবে। আর অমাবস্যার বিষয়টি যে কেবল একের পর এক অনুবাদ নির্ভরতার ফল তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

অনুসন্ধানের পর ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে যা পাওয়া গেল তা হচ্ছে: জনাব এম আকবর আলী মরহুমের লেখা আল-বেরুনী।১  এটা তার মুসলিম বিজ্ঞানী সিরিজের চতুর্থ বই। এই বইয়ে জনাব আকবর আলী সাহেব আল-বেরুনীর জীবনচরিত এবং তাঁর গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থাবলী বিষয়ে নাতিদীর্ঘ পর্যালোচনা লিখেছেন। স্বভাবতই এতে আল-বেরুনীর গ্রন্থ আত-তাফহীম লি আওয়া-ইলি সিনাআতিত্ তানজীম সম্পর্কেও আলোচনা রয়েছে। যা বইটির ৭৯-৯৩ পৃষ্ঠা পর্যন্ত বিস্তৃত।

আকবর আলী সাহেব কিতাবুত্ তাফহীম-এর মূল্যায়ন করতে গিয়ে আত-তাফহীম-এর ইংরেজী অনুবাদক প্রফেসর র‌্যামসে রাইট (Ramsay Wright)-এর বক্তব্য তুলে দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন : অনুবাদক র‌্যামসে রাইট-এর মতে গ্রন্থখানি যদিও জ্যোতিষ সম্বন্ধে উপদেশাবলী সম্বলিত তবুও একে একাদশ শতাব্দীর বিজ্ঞানের প্রথম পুস্তক বলে অভিহিত করা যেতে পারে। (আল-বেরুনী পৃ. ৭৯)

খানিক পরে আকবর আলী সাহেব কিতাবুত তাফহীম-এর কিছু কিছু আলোচনা সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে সেসবের সারসংক্ষেপ আল-বেরুনী রাহ.-এর আত-তাফহীম থেকে উদ্ধৃত করেছেন। তার সামনে ছিল প্রফেসর র‌্যামসে রাইটের অনূদিত বই। যদিও এই অনুবাদের সাথে আরবী মূল পাঠও সংযুক্ত আছে। কিন্তু উদ্ধৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রে আকবর আলী সাহেবের ভরসা ছিল র‌্যামসে রাইটের ইংরেজি অনুবাদের উপর।

মরহুম আকবর আলী সাহেব আত-তাফহীমের উদ্ধৃতিতে তার বইয়ের ৮৮-৯১ পৃষ্ঠায় বিভিন্ন জাতি ও সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত মাসের নামসমূহের তালিকা দিয়েছেন। এ তালিকার প্রথম ছকটি ইসলামোত্তর আরবী মাসের নাম বর্ণনার জন্য। বারো মাসের নাম উল্লেখ শেষে নীচে নোট দেয়া হয়েছে : অমাবস্যা থেকে মাস শুরু হয়। ৩৫৪ দিনে বৎসর। মলমাস জুড়ে দেওয়া হয় না। (আল-বেরুনী, এম. আকবর আলীকৃত, পৃ. ৮৯, প্রকাশক : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, চতুর্থ প্রকাশ, রমযান ১৪০২ হি. মোতাবেক জুন ১৯৮২ খৃ.)।

এই হল ঘটনা। এগারো শত শতাব্দী নামে আল-বেরুনীর কোনো গ্রন্থ নেই। ইসলামিক ফাউন্ডেশনও তা অনুবাদ করায়নি। আল-বেরুনী নামে আল-বেরুনীর জীবনী বিষয়ে লেখা বইটি এম আকবর আলী সাহেবের রচনা। যা ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রকাশ করেছে মাত্র। আর এগারো শত শতাব্দীর রহস্য হচ্ছে, যেমনটি একটু আগেই বলা হয়েছে- আল-বেরুনীর গ্রন্থ আত-তাফহীম লি আওয়া-ইলি সিনাআতিত্ তানজীম, যা ৪২০ হি: মোতাবিক ১০২৯ খৃষ্টাব্দে রচিত- এর মূল্যায়ন করতে গিয়ে আত-তাফহীমের ইংরেজি অনুবাদক র‌্যামসে রাইট তার অনূদিত বইয়ের ভমিকায় লিখেছেন, এই গ্রন্থটিকে বিজ্ঞান বিষয়ে এগারো শত শতাব্দীর প্রথম পুস্তক আখ্যা দেওয়া যেতে পারে।

এখন দেখুন চন্দ্রকলা-এর লেখক অথবা যার বরাতে তিনি উদ্ধৃত করেছেন, তিনি কথা কোত্থেকে কোথায় নিয়ে গেছেন?!

এ পর্যন্ত তো ছিল তার মামলা। কিন্তু আসল বিপদ যেটা তৈরি হয়েছে সেটা আকবর আলী মরহুমের অসতর্কতার কারণে। তিনি আল-বেরুনীর ভাষ্যে رؤية الأهلة  (নতুন চাঁদের দর্শন) শব্দবন্ধের প্রতি লক্ষ করেননি। ইংরেজি অনুবাদে নিউমুন শব্দ দেখে তিনি একে জ্যোতির্শাস্ত্রীয় নিউমুন মনে করে অমাবস্যার কথা লিখে দিয়েছেন। ব্যস, এই বিচ্যুতিকে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব এখন নিজের জন্য رأس المال  (মূলধন) গণ্য করছেন।

পাঠকগণ আল-বেরুনীর মূল ভাষ্য লক্ষ্য করুন : আল্লামা আবুর রায়হান মুহাম্মাদ ইবনে আহমদ আল-বেরুনী (৩৬২ হি. -৪৪০ হি. মোতাবেক ৯৭৩ খৃ.-১০৪৮ খৃ.) নিজেই কিতাবুত্ তাফহীমটি রচনা করেছেন দুই ভাষায়; আরবীতে এবং ফারসীতে। প্রথমে ফারসী বক্তব্য দেখুন। মুহাররম থেকে যিলহজ্ব এই বারোটি ইসলামী মাসের নাম তালিকার প্রথম ছকে উল্লেখ করেছেন। ছকের শুরুতে লিখেছেন,

ماہ ہاۓ عرب اندر اسلام قمری اند وایں تقدیر میانہ است

এখানে তিনি বলেছেন, ইসলামী আরবী মাসসমূহ চন্দ্রনির্ভর। এরপর ছকের শেষে লিখেছেন :

بدیدار ماہ نو بکار دارند، واندر آں ہیچ کبیسہ ونسیئ بکار نیست، وعدد روزگار سال سیصد وپنجاہ وچہار روزاست

অর্থাৎ এগুলোর সম্পর্ক নতুন চাঁদ দেখার সাথে। এতে কোন কবিসা (মলমাস/অধিমাস) নেই। বছরে সর্বমোট দিন সংখ্যা তিনশ চুয়ান্ন। (আত-তাফহীম লি-আওয়া-ইলি সিনাআতিত-তানজীম আবু রায়হান বেরুনী, মুদ্রণ ১৩১৬ হি.)

এখন দেখুন আরবী ভাষ্য। ছকের শুরুতে লিখেছেন,

" شهور العرب في الإسلام، وهي قمرية، بالتقدير"

বলছেন,ইসলাম-উত্তর আরবের মাসসমূহ চন্দ্রনির্ভর। আর ছকের শেষে লিখেছেন,

" يستعمل برؤية الهلال ولا يستعمل فيها شيء من النسيئ، وعدد أيامها 354 يوما"

(এই মাসসমূহ)-এর ব্যবহার চাঁদ দেখার মাধ্যমে। এতে মলমাসের নিয়ম মোটেও নেই। এর সর্বমোট দিন তিনশ চুয়ান্ন। (আত-তাফহীম লি-আওয়াইলি সিনাআতিত্ তানজীম, (লন্ডন, ১৯৩৪ খৃ.)  পৃ. ১৬৬)২

প্রফেসর র‌্যামসে রাইট এই বক্তব্য-ভাষ্যের অনুবাদ করেছেন, They work entirely by the new Moon : do not intercalate and have 354 days in the year.3 

এই অনুবাদে এম. আকবর আলী সাহেব নিউমুন শব্দ দেখে এই শব্দের প্রচলিত অর্থ বাদ দিয়ে জ্যোতির্শাস্ত্রীয় নিউমুন-এর দিকে চলে গিয়েছেন। আর সেটারই তরজমা করেছেন অমাবস্যা। (এই ক্ষেত্রে অনুবাদক র‌্যামসেরও ত্রুটি আছে। একে তো তিনি ক্রিসেন্টমুন-এর জায়গায় নিউমুন লিখেছেন; অথচ প্রথম শব্দটিই পরিষ্কার এবং যথার্থ ছিল। তার ওপর رؤية বা দেখা কথাটি একদমই গায়েব করে দিয়েছেন)। আল-বেরুনীর লেখায় হিলাল-এর কথা রয়েছে, অমাবস্যা নয় এবং তিনি رؤية বা দেখা শব্দটি স্পষ্ট করেই লিখেছেন : يستعمل برؤية الهلال  র‌্যামসে যদি তার অনুবাদে দেখা কথাটি ফেলে না দিতেন তাহলে আকবর আলী সাহেব শুধু নিউমুন-এর ধাঁধার কারণে বিভ্রমে পড়তেন না।

তালিকার দ্বিতীয় ছকে আল-বেরুনী ইসলাম-পূর্ব আরবদের মাঝে প্রচলিত মাসমূহের নাম লিখেছেন। সেখানে নোট দিয়েছেন, (ফারসী)  تازيان آنرا نسيئ همى كردند بنوبت وديدار ازماه همى داشتند زيرانكه شمار نمى دانستند 

আরবী ভাষায় : " كانت منسأة لنوبة في الشهور برؤية الأهلة، إذ لم يكونوا يعرفون حسابا."

এখানে তিনি বলছেন, এরা মলমাস ধরতো। কিন্তু আবার নতুন চাঁদও দেখতো কেননা এরা হিসাব গণনা জানতো না। র‌্যামসে রাইট এ বাক্যের অনুবাদ করেছেন : : They practised intercalation, Judging when necessary by The position of The Moon. They were ignorant of calculation.

এই অনুবাদে একদিকে তো হিলাল এবং দেখ  দুটোরই রফাদফা করে ছেড়েছেন। আবার এ জায়গায় নিজের তরফ হতে পজিশন-এর ব্যাপার জুড়ে দিয়েছেন। যে কারণে বক্তব্যের শুরু ও শেষে স্ববিরোধিতার সৃষ্টি হয়েছে।

মোটকথা, এম. আকবর আলী সাহেব যেহেতু মূল আরবী এবং ফারসী আত-তাফহীম থেকে সাহায্য নিতে পারেননি, সেজন্য র‌্যামসের অস্পষ্ট এবং ত্রুটিযুক্ত তরজমার কারণে তিনি লিখে দিয়েছেন যে, অমাবস্যা থেকে মাস শুরু হয়!! তিনি চিন্তাই করেননি যে, আল- বেরুনী কীভাবে এই গলদ কথা লিখতে পারেন। আল-বেরুনীর আসল ভাষ্য পড়ে নেয়ার পর আশা করি ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক প্রকৃত সত্যকে মেনে নিবেন এবং আল-বেরুনীর দিকে সম্পৃক্ত করে না-হক কথা বলা থেকে বিরত থাকবেন।

আল-বেরুনীর আরো কিছু ভাষ্য:

হিলাল এবং অমাবস্যা- দুটো আলাদা জিনিস। ইসলামী মাস আরম্ভ হয় হিলাল দেখে; অমাবস্যার সময় থেকে নয়। কিংবা গণনার মাধ্যমে চাঁদের অবস্থান জানার মাধ্যমেও নয়। এবিষয়ে পাঠক ইতোমধ্যে আল-বেরুনীর বেশ কিছু বক্তব্য-ভাষ্য পড়ে ফেলেছেন। এখানে তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে আরো কিছু বক্তব্য উদ্ধৃত করা হচ্ছে,

১.আত-তাফহীমের এক জায়গায় আল-বেরুনী চাঁদের সবগুলি পর্যায়ের উল্লেখ করেছেন এবং লিখেছেন,

" القمر يستهل بالعشيات في أول الشهر، ويرى هلالا ضئيلا في المغرب، ولا يزال يزداد بعده عن الشمس..."

অর্থাৎ মাসের শুরুতে চাঁদ সন্ধ্যায় পশ্চিম আকাশে দৃশ্যমান হয় এবং প্রথমে তা শীর্ণকায় হিলালের আকারে দেখা যায়। এরপর তা সূর্য থেকে দূরে সরতে থাকে এবং তার আলো বৃদ্ধি পেতে থাকে...।

আল-বেরুনী তাঁর আলোচনা অব্যাহত রেখে চাঁদের অন্যান্য পর্যায়গুলির বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন,

" إلى أن يعود إلى صورة الهلال الأول الدقيق في جهة المشرق بالغداوات، والنور منه في جميع الأحوال في الجانب الذي يلي الشمس، ثم يستتر بعد ذلك بشعاع الشمس، فيسمى مدة استتاره سرارا لذلك، ومحاقا لمحاق الضوء فيه إلى أن يعود إلى صورة الهلال في المغرب بالعشي. ويجتمع مع الشمس في وسط هذه المدة، يسمى ذلك اجتماعا مطلقا."

অর্থাৎ চাঁদ (তিথির পর তিথি অতিক্রম করতে করতে) অবশেষে পূর্ব দিকে ভোরবেলায় আগের সেই চিকন হিলালের আকৃতিতে ফিরে আসে। সর্বাবস্থায় চাঁদের ঐ অংশই আলোকিত থাকে, যেটা সূর্যের সামনে থাকে। এরপর চাঁদ সূর্যের আলোকরশ্মির মাঝে প্রবেশ করে (অর্থাৎ সূর্যের আলো যখন চাঁদের ঐ পৃষ্ঠে পড়ে যা সূর্যের দিকে থাকে এবং অপর পৃষ্ঠ যাতে তখন কোন আলো পড়ে না সেটা থাকে পৃথিবীর দিকে। ফলে তা পৃথিবী থেকে দেখা যায় না।)। তার এই আড়ালে থাকার সময়কে তাই সিরার বলা হয়। (কারণ সিরার অর্থ লুকায়িত থাকা) এবং এই সময় চাঁদের আলো সম্পূর্ণ নিঃশেষিত হয়ে যাওয়ায় একে মিহাক বলা হয়  (কেননা মিহাক অর্থ, কোনো কিছু ক্ষয় হয়ে যাওয়া অথবা সম্পূর্ণরূপে অপসারিত হওয়া। امحق القمر বলা হয় যখন চাঁদ আলোহীন হয়ে যায়)। অতপর চাঁদ আবার পশ্চিম আকাশে সন্ধ্যায় হেলালের আকারে ফিরে আসে। (উল্লেখ্য,) মিহাকের সময়ের মাঝামাঝিতে এসে সূর্যের সাথে চাঁদের সম্মিলন ঘটে, যাকে বলা হয় ইজতিমা (conjunction)। (আত-তাফহীম পৃ. ৬৫)

বোঝা গেল, আল-বেরুনী অমাবস্যাকে অস্বীকার করেন না। তিনি অমবস্যার দুটি আরবী নাম বলেছেন। একটি সিরার। অপরটি হল মিহাক। তিনি আরো বলেছেন যে, অমাবস্যা চলাকালে সূর্য ও চন্দ্রের মিলন ঘটে। যেখান থেকে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা নিজেদের চান্দ্রমাস গণনা আরম্ভ করে। হিলাল অমাবস্যা থেকে আলাদা জিনিস। হিলাল তো অমাবস্যার স্তর পার হয়ে আসার পর ক্রিসেন্ট (ধনুক)-এর আকৃতিতে সূর্য ও শীর্ণকায় অবস্থায় সন্ধ্যাবেলায় পশ্চিমাকাশে দৃষ্টিগোচর হয়। ইসলামের অনুসারীরা এই হিলাল থেকেই নিজেদের চান্দ্রমাস গণনা আরম্ভ করে।

আল-বেরুনী বলেন,

2.  (... ، ولكنها (أي شهور اليهود مع شهور العرب) [1] لا تتلازم في الأسامي فإنها غير مكبوسة وشهور اليهود مكبوسة، وكذلك شهور الهند مع شهور العرب، ولا تزال تتقدم أوائلها، لأنها محبوسة من اجتماع النيرين، شهور الهند تلازم شهور اليهود....)

অর্থাৎ ইহুদীদের মাস মুসলমানদের মাসের সাথে নামে নামে মিল থাকে না। কারণ মুসলমানরা মলমাস গণনা করে না। কিন্তু ইহুদীরা গোনে। হিন্দুদের মাসের অবস্থাও মুসলমানদের মাসের সাথে এমনই; (অর্থাৎ নামে নামে মিল থাকে না, তাছাড়া) তাদের মাসের সূচনা হয় আগে। কারণ তাদের মাস গণনা আরম্ভ হয় ইজতিমা (অমাবস্যার মধ্যে চাঁদ ও সূর্য একই রেখায় এসে যাওয়ার সময়, যাকে ইংরেজিতে বলে conjunction) থেকে। (আত-তাফহীম পৃ. ১৬৮)। অন্যদিকে ইসলামী মাসসমূহ সম্পর্কে আল-বেরুনীর বক্তব্য আমরা ইতোপূর্বে পড়ে এসেছি যে-

৩. হিজরী তারিখের ভিত্তি চান্দ্রবর্ষের উপর। হিলাল (নতুন চাঁদ) দেখার উপর তা নির্ভরশীল। হিসাব গণনার উপরে নয়। সমস্ত মুসলমানের আমল এই তরিকা মোতাবেকই। (আলআছারুল বাকিয়া আনিল কুরুনিল খালিয়া আল-বেরুনী পৃ. ৩১) আল-বেরুনীর এই বক্তব্যও গত হয়েছে-

৪. আরবগণ হিলাল দেখে মাস আরম্ভ করে। ইসলামে এ নির্দেশই দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন :

 يَسْأَلُونَكَ عَنِ الْأَهِلَّةِ قُلْ هِيَ مَوَاقِيتُ   (আল-আছারুল বাকিয়া পৃ. ৬৪)।

তাঁর এই বক্তব্যও গিয়েছে যে, ইহুদী-খ্রিস্টানরা তো পূর্ব-প্রস্তুতকৃত ক্যালেন্ডার দিয়ে মাসের হিসাব বের করে এবং এর মাধ্যমেই তাদের রোযার সময় অবগত হয়ে থাকে। অন্যদিকে-

৫. মুসলমান হিলাল দেখতে বাধ্য এবং এ অনুসন্ধানও তাদের জন্য অপরিহার্য যে, চাঁদ আলো গ্রহণপূর্বক তার কোনো অংশ দৃষ্টিগোচর হওয়ার পর্যায়ে এসেছে কি? (আল-আছারুল বাকিয়া পৃ. ৬৪)।

আল-বেরুনী রাহ.-এর এসব বক্তব্য থেকে পুরোপুরি স্পষ্ট হয়ে গেল, হিলাল আর অমাবস্যা এক জিনিস নয়। তিনি এও পরিষ্কার করে বলে দিয়েছেন যে, অমাবস্যার মাঝখানে সংঘঠিত conjunction থেকে চান্দ্রমাস শুরু করে হিন্দুরা। আর হিসাবের মাধ্যমে পূর্ব প্রস্তুতকৃত ক্যালেন্ডার দিয়ে রোযার তারিখ ঠিক করে ইহুদী-খৃস্টানরা। এদের সকলের বিপরীতে মুসলিম উম্মাহ কুরআনের নির্দেশ মোতাবেক হিলাল দেখে চান্দ্রমাস শুরু করে।

আল-বেরুনী রাহ.-এর কিতাব তাহকীকু মা লিল হিন্দি মিন মাকুলাতিন মাকবূলাহ ফিল আকালি আও মারযূলাহ-এর ইংরেজি অনুবাদ আল-বেরুনী ইজ ইন্ডিয়া নামে এবং বাংলা অনুবাদ আল-বেরুনীর ভারততত্ত্ব নামে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু অনুবাদের সীমাবদ্ধতা এবং ত্রুটি-বিচ্যুতি অনেক সময় অনেককে বিভ্রান্তিতে ফেলে দেয়। বিশেষত পাঠকের মধ্যেও যদি সাধারণ জ্ঞানের অভাব, তথ্যের স্বল্পতা, সংশ্লিষ্ট শাস্ত্রের সাথে অপরিচিতি এবং কোনো মতের ব্যাপারে বিশেষ পক্ষপাতিত্বসহ বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা তার মাঝেও আগে থেকেই হাযির থাকে তাহলে তো কথাই নেই!

আল-বেরুনীর ভারততত্ত্ব পঁয়ত্রিশতম পরিচ্ছেদের (পৃ ২০৯) প্রথম বাক্যটি এই : প্রাকৃতিক মাস হচ্ছে চন্দ্রের এক সংযোগ (অমাবস্যা) থেকে অন্য সংযোগ পর্যন্ত সময়ের পরিমাণ

কেউ যদি কেবল এই একটি বাক্য পড়ে, সামনের কথাগুলো আর না পড়ে, মূল আরবী কিতাব খুলে না দেখে এবং আল-বেরুনীর অন্যান্য গ্রন্থ অধ্যয়ন না করে তাহলে খুবই সম্ভব যে, সে এই একটি বাক্যের সূত্র ধরে ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হকের মত এটাই বুঝতে শুরু করবে যে, আল-বেরুনীর দৃষ্টিতে চান্দ্রমাস এক অমাবস্যা থেকে আরম্ভ হয় এবং আরেক অমাবস্যায় গিয়ে সমাপ্ত হয়। কিন্তু অসম্পূর্ণ অধ্যয়ন এবং বোঝার অসম্পূর্ণতার কোনো চিকিৎসা আমাদের কাছে নেই! এখানে তো উল্লেখিত বাক্য দিয়ে আল-বেরুনীর কথা আরম্ভ হয়েছে, সামনে গিয়ে তিনি এই বক্তব্যের বিস্তারিত লিখেছেন। তিনি বলেন-

৬. " كذلك نور القمر في جرمه على هذا النهج إذا بدا من المحاق هلالا ثم قمرا ثم بدرا، وتراجع منه كذلك إلى السرار الذي هو كالعدم بالإضافة إلى الحس"

এতে তিনি চাঁদের অমাবস্যা থেকে হিলালের আকারে আত্মপ্রকাশ করাকে সূচনা সাব্যস্ত করেছেন। অতপর পুনরায় অমাবস্যার মাঝে অন্তরীণ হওয়াকে সমাপ্তি বলে স্বীকৃতি দিচ্ছেন। (দেখুন, তাহকীকুল মা লিল হিন্দ আল-বেরুনী : পৃ. ২৯১, পরিচ্ছেদ : ৩৫, দাইরাতুল মাআরিফিল উছমানিয়া, হায়দারাবাদ, হিন্দুস্তান থেকে প্রকাশিত ১৩৭৭ হি. মোতাবিক ১৯৫৮ খৃ.)।

৭.  "ثم كان الشهر بنور القمر ناشيا وبالغا النهاية، ثم منحطا وممحقا، وعلى عدة الأيام مشتملا."

এতে বলেছেন, মাসের শুরু হয় চাঁদের রোশনি থেকে। এভাবে একসময় তা পূর্ণিমার আকারে রোশনির চড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায়। তারপর আবার হ্রাস পেতে পেতে অমাবস্যায় উপনীত হয়। (আল-কানূনুল মাসউদী, আল-বেরুনী ১/৬৭ পৃ. পঞ্চম অধ্যায়, হায়দারাবাদ প্রকাশিত ১৩৭৩ হি. মোতাবিক ১৯৫৪ খৃ.)

৮. " كما أن الشهر هو من أي شكل فرض للنور في القمر إلى مثله قدرا ووضعا، والمبدأ المتفق عليه من الهلال الغربي، لأنه كالوجود بعد العدم، وخروج المولود من الظلم."

তিনি বলছেন, চাঁদের আলোকিত অবয়বসমূহের মধ্য হতে কোনো একটি অবয়ব থেকে আরম্ভ করে সেই অবয়বে পুনরায় ফিরে আসা পর্যন্ত সময়কে মাস গণনা করা যেতে পারে। কিন্তু যেই সূচনার ব্যাপারে ঐকমত্য রয়েছে সেটা হল পশ্চিম আকাশের হিলাল। কেননা তা নিঃশেষিত হয়ে যাওয়ার পর আবার অস্তিত্ব লাভেরই মত এবং অন্ধকার থেকে নবজাতকের বেরিয়ে আসার মত। (আল-কানুনুল মাসউদী, আল-বেরুনী ১/৬৮)।

আল্লামা আবু রায়হান মুহাম্মাদ ইবনে আহমদ আল-বেরুনী তাঁর এই অতি মূল্যবান গ্রন্থ আল-কানূনুল মাসউদীর অষ্টম প্রবন্ধের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে দর্শনযোগ্য নতুন চাঁদের অবস্থান ও স্থান সনাক্ত করার জন্য একটি মূলনীতি বর্ণনা করেছেন। এ থেকে কারো এই ভুলবোঝার সম্ভাবনা ছিল যে, তিনি বোধহয় হিলাল দেখার পরিবর্তে হিসাবের আলোকে কেবল দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনাকে ভিত্তি বলে গণ্য করতে চাচ্ছেন। অতএব তিনি এই পরিচ্ছেদের প্রারম্ভে একটি নোট সংযুক্ত করে দিয়েছেন, যাতে এরকম কোনো ভুল ধারণার সৃষ্টি না হয়। তিনি লিখেছেন,

৯. "الفصل الثاني في سمت الهلال أحكام الشهور في الإسلام من الحج والصيام راجعة إلى رؤية الهلال، فهي إذن من أجل ما يصرف إليه الإهتمام، وهي وإن فرضت برؤية العيان دون الحساب الذي ماله إلى الاعتبار والامتحان، فشتان بين من يحوم في طلبه حول موضعه وبين من يجيل بصره في آفاق السماء ويطلبه في الظلام..."

এতে বলেছেন, ইসলামে মাসসমূহের বিধান হজ ও সিয়াম যেহেতু হিলাল দেখার সাথে সম্পৃক্ত তাই হিলালের দিক নির্ধারণের ব্যাপারে খুবই গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এসমস্ত ইবাদত যদিও হিলালকে চোখে দেখার ভিত্তিতে ফরয করা হয়েছে, হিসাবের ভিত্তিতে নয়, তথাপি হিলাল দেখার সুবিধার জন্য তার সম্ভাব্য অবস্থান ও স্থান সম্পর্কে অবগত হওয়া দরকার। একজন নির্ধারিত স্থানের আশেপাশে হিলাল তালাশ করছে আরেকজন আন্দাযে চারদিকে কেবল দেখে বেড়াচ্ছে- দুটোর মাঝে পার্থক্য আছে...

সামনে এ বিষয়ের মূলনীতি উল্লেখের পর লিখছেন,

১০. "و إذا نصب على الهلال كما وصفنا ثم نظر الناظر إليه من طرفه الأسفل إلى ما يسامته من السماء لم يخف فيه الهلال الممكن الرؤية، و إذا أدركه منه نفر انعقد برؤيتهم أحكام الشريعة."

এ বক্তব্যের সারমর্ম হল, যদি উপরিউক্ত পন্থায় হিলাল তালাশ করা হয় তাহলে দর্শনযোগ্য হিলাল ইনশাআল্লাহ এতে দৃষ্টির অগোচর থাকবে না। এখন এ অবস্থায় যদি কিছু মানুষ হিলাল পেয়ে যায় তাহলে তাদের দেখার ভিত্তিতে শরীয়তের বিধান সাব্যস্ত হয়ে যাবে। (আল-কানূনুল মাসউদী ১/৯৬৪)।

মুহতারাম ইঞ্জিনিয়ার মুহাম্মাদ এনামুল হক সাহেব বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় প্রাচীনকালের মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবদানের প্রতি ইঙ্গিত করে তাদের নামের সংক্ষিপ্ত সূচী দিয়েছেন। যা তার বইয়ের পৃ. ৭৭, পর্ব ৪৮-এ রয়েছে। ঐ সূচীতে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞান ও পদার্থবিজ্ঞান উভয় ক্ষেত্রে আল-বেরুনী রাহ.-এর নাম উল্লেখ করেছেন। আল-বেরুনী রাহ. জ্যোতির্বিজ্ঞানে পারদর্শী হওয়ার পাশাপাশি কুরআন-সুন্নাহ এবং ফিকহ শাস্ত্রেও প্রাজ্ঞ ছিলেন। সেজন্য আমরা আশা করছি, তাঁর কথাগুলো ইঞ্জিনিয়ার সাহেব গুরুত্বের সাথে পড়বেন এবং তাঁর কাছ থেকে শেখার চেষ্টা করবেন। আল্লাহ তাআলা তাঁকে সকল কল্যাণ কাজের তাওফীক দান করুন এবং সবরকম অকল্যাণ থেকে নিরাপদ রাখুন। আমীন।

(পরবর্তী শিরোনাম: ইঞ্জিনিয়ার সাহেব কর্তৃক হিলাল এর বিকৃতি সাধন ও তার খণ্ডন। যা ইনশাআল্লাহ যিলহজ্ব ১৪৩৬ হিজরী সংখ্যায় প্রকাশিত হবে।) 



[1] قال الراقم : المراد بالعرب في كلامه هنا الأمة المسلمة، كما هو مصرح في عبارته هذه في "التفهيم" الفارسي له، فانتبه. انتهى قول الراقم

 

 

advertisement