শাওয়াল ১৪৩৫   ||   আগস্ট ২০১৪

সততার ফল

মুহাম্মাদ ফজলুল বারী

সততা একটি মহৎ গুণ। যে সৎ তাকে সবাই ভালোবাসে। সৎ হতে পারা জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন। সৎব্যক্তি মানুষের আস্থাভাজন হয়, আল্লাহর প্রিয় হয়। দুনিয়ায় সফল হয়, আখেরাতে কামিয়াব হয়। সততার গল্প শুনলে সৎ হওয়ার আগ্রহ জন্মে। তাই এসো একজন সৎ মানুষের গল্প শুনি, একটি সততার গল্প শুনি।

কাজী আবু বকর মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল বাকী। তিনি খুব সৎ মানুষ ছিলেন, অত্যন্ত নেক বান্দা ছিলেন। তাঁর নিজের জীবনের একটি কাহিনী, তার মুখ থেকেই শোনা যাক।

তিনি বলেন, আমি মক্কায় ছিলাম। একদিন আমার খুব ক্ষুধা পেল। তখন আমার কাছে না ছিল কোনো খাবার, না ছিল কোনো অর্থকড়ি। এমন সময় আমি একটি থলে কুড়িয়ে পেলাম; রেশমের থলে, রেশমের ফিতা দিয়ে বাঁধা। আমি থলেটি নিয়ে বাড়ি এলাম। খুলে দেখি তাতে একটি মোতির হার। এমন হার জীবনে কোনোদিন দেখিনি।

কী করব ভেবে পাচ্ছি না। এরই মধ্যে এক বৃদ্ধের চিৎকার কানে এল, যে আমার থলেটি ফিরিয়ে দিবে তাকে আমি পাঁচশ দিনারের (স্বর্ণ মুদ্রা) থলেটি দিব। তখন আমি মনে মনে বললাম, আমি অভাবী, তাছাড়া আমি ক্ষুধার্তও, সুতরাং পাঁচশ দিনারের থলেটি নেব এবং তার থলেটি ফিরিয়ে দিব।

তাকে আমি বাড়িতে নিয়ে এলাম। সে আমার কাছে তার থলে, থলের ফিতা ও মোতির হারের হুবহু বর্ণনা দিল। এমনকি হারের মধ্যে কতটি মোতি ছিল তাও বলে দিল। তখন আমি তার থলেটি ফিরিয়ে দিলাম। সে আমাকে পাঁচশ দিনারের (স্বর্ণ মুদ্রার) থলেটি দিতে চাইল। সে জোর জবরদস্তি করা সত্ত্বেও আমি থলেটি নিলাম না। আমি বলালম, আপনার থলেটি আপনার কাছে ফিরিয়ে দেয়া তো আমার দায়িত্ব ছিল। আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি মাত্র। সুতরাং আমি এর কোনো বিনিময় গ্রহণ করব না। তারপরও সে আরো জোরাজুরি করল, কিন্তু আমি কিছুতেই তা গ্রহণ করলাম না। অবশেষে সে হারটি নিয়ে চলে গেল।

এবার ঘটল আরেক ঘটনা। এর কিছুদিন পর আমি সমুদ্রপথে সফরে বের হলাম। জাহাজ ভেঙে গেল এবং জাহাজের সকল আরোহী ডুবে মারা গেল। আর আমি জাহাজের একটি কাষ্ঠখন্ডে ভেসে বেঁচে গেলাম। কয়েকদিন সমুদ্রে ভাসতে থাকলাম। জানি না ভেসে ভেসে কোথায় চলেছি। কয়েকদিন পর কাষ্ঠখন্ডটি একটি দ্বীপে গিয়ে ঠেকল। সেই দ্বীপের অধিবাসীরা ছিল মুসলিম। আমি সেই দ্বীপের একটি মসজিদে গিয়ে উঠলাম। লোকেরা আমার তিলাওয়াত শুনে মুগ্ধ হল এবং তারা আমার কাছে কুরআন শেখার আবেদন জানালো। আমি তাদেরকে কুরআন শিক্ষা দিলাম। আমার হাতে কিছু অর্থ জমা হল। তারপর তারা আমার কাছ থেকে লেখাও শিখল। তাদের সন্তানদের লেখা শেখার জন্য আমার কাছে পাঠাতে লাগল। এখন আমার হাতে বেশ কিছু অর্থ কড়ি জমা হল। তখন তারা আমাকে একটি বিবাহের প্রস্তাব দিল। তারা বলল, আমাদের এখানে একটি এতিম মেয়ে আছে। সে ধন-সম্পদেরও মালিক। আমরা চাই যে আপনি তাকে বিবাহ করুন। আমি প্রথমে অসম্মতি জানালাম। কিন্তু তাদের অনেক জোরাজুরিতে পরে রাজি হলাম।

তার সাথে আমার বিবাহ হল। বিবাহের পর যখন আমি তাকে প্রথম দেখলাম আমার দৃষ্টি আটকে গেল তার গলার হারে। আমি তাকে দেখার পরিবর্তে থ হয়ে হারটির দিকে তাকিয়ে থাকলাম। এ-কী! এ দেখি হুবহু সেই হারটি যা আমি কুড়িয়ে পেয়েছিলাম এবং বৃদ্ধকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম।

আমার এ আচরণে মেয়েটি কষ্ট পেল; মেয়েটি ভাবছিল, আমার দিকে না তাকিয়ে সে কি না আমার মোতির হারের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

পরের দিন সকালে লেকেরা আমাকে বলল, আপনি আপনার আচরণে মেয়েটির মনে কষ্ট দিয়েছেন; তার দিকে না তাকিয়ে তার মোতির হারের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তখন আমি তাদেরকে সব ঘটনা খুলে বললাম, কীভাবে আমি হারটি পেয়েছিলাম এবং বৃদ্ধকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। কীভাবে জাহাজ ডুবে ভেসে ভেসে আমি এখানে পৌঁছলাম এবং...। আমার কাহিনী শুনে সকলে আল্লাহু আকবার বলে চিৎকার করে উঠল। তারা তখন আমাকে বলল, যেই বৃদ্ধকে আপনি হারটি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তিনিই হলেন এই মেয়েটির বাবা। তিনি বলতেন, আমি পৃথিবীতে তার চেয়ে ভালো মানুষ দেখিনি, যে আমার মোতির হারটি কুড়িয়ে পেয়ে আবার ফিরিয়ে দিয়েছিল এবং কোনো বিনিময় গ্রহণ করেনি। তিনি দুআ করতেন, হে আল্লাহ! আপনি এ মহৎ-হৃদয় মানুষটিকে আমার সাথে আবার সাক্ষাৎ করিয়ে দিন, যাতে আমার কলিজার টুকরা এই কন্যাকে তার সাথে বিবাহ দিতে পারি। তার সেই প্রার্থনা আজ বাস্তবে রূপ নিল। সুবহানাল্লাহ!

সেখানে আমি কিছুদিন থাকলাম। আল্লাহ আমাকে দুটি ছেলে সন্তান দান করলেন। কিছুদিন পর মেয়েটি ইন্তেকাল করল। তার কিছুদিন পর ছেলে দুটি ইন্তেকাল করল। এখন সেই মোতির হারটি আমার মালিকানায় চলে আসল। যেটি আমি কুড়িয়ে পেয়ে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম এবং সততার পরিচয় দিয়েছিলাম। আজ সততার ফল হিসেবে আল্লাহ সেই মোতির হারটি আমাকে দান করলেন। পরবর্তীতে আমি হারটি একলক্ষ দিনারে বিক্রি করলাম। এই যে আমার সম্পদ তোমরা দেখছ তা সেই সম্পদেরই অংশ। (যাইলু তাবাকাতিল হানাবিলা ১/৭৯)

লোকটি সততার পরিচয় দিয়েছে; পাঁচশ দিনার গ্রহণ করেনি। এর বিনিময়ে আল্লাহ তাঁকে দুনিয়াতেই পাঁচশ দিনারের দুইশ গুণ বেশি এক লক্ষ দিনার পুরস্কার দিলেন। আর আখেরাতের প্রতিদান তো আছেই। লোকটি যদি থলের মালিকের সন্ধান পেয়েও থলেটি না দিত বা অস্বীকার করত তাহলে সে হয়ত সাময়িক কিছু লাভবান হত, কিন্তু দুনিয়াতেই সে ক্ষতির সম্মুখীন হত। আর আখেরাতের আযাব তো ছিলই। কোনো বুদ্ধিমান কি দুনিয়ার সামান্য লাভের বিনিময়ে আখেরাতের আযাব চাইতে পারে? কখনোই না। কাজী আবু বকর ছিলেন বুদ্ধিমান। তাই তিনি থলেটি ফিরিয়ে দিলেন এবং বিনিময়ে পেলেন দুনিয়া ও আখেরাতের পুরস্কার। তাই আমরা সৎ হব। দুনিয়ায় সফল হব, আখেরাতেও কামিয়াব হব।

আমরা আল্লাহর কাছে দুআ করি, দুনিয়ার কোটি টাকার লোভও যেন আমাদেরকে আখেরাতের ক্ষতির কথা ভুলিয়ে না দেয়। আমাকে আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে হবে। এ কথা যেন অন্তরে সদা জাগরুক থাকে।

 

 

advertisement