রজব ১৪৩৫   ||   মে-২০১৪

ইনহিমাক ও ইনকিতা : তালিবুল ইলমের বড় দুটি গুণ

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

 [ ৭-৪-১৪৩৫ হিজরী মুতাবেক ৮-২-২০১৪ ঈসায়ী তারিখে জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া ঢাকা তেজগাঁওয়ে তালিবুল ইলমদের মজলিসে কৃত বয়ান ]

আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ তাআলা একটি সুন্দর ও নেক মাহাওলে আমাকে বসার তাওফীক দান করেছেন। আমি মূলত চেয়েছিলাম এখানকার হুযুরদের কাছ থেকে কিছু শুনব। ইসতিফাদা করব। সেজন্যে কিছু বলতে মাযিরাত করলে মাওলানা আবদুল মতিন ছাহেব হুযুর বললেন, আপনি আপনার নিজেকেই কিছু কথা বলেন। এটা বড় কঠিন দায়িত্ব। আল্লাহ তাআলা সহজ করুন। তাওফীক দান করুন। আমীন। 

আমরা তালিবুল ইলম। আমাদেরকে আমাদের মাশগালামানসাব সম্পর্কে সব সময় সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের মাশগালা কী, মানসাব কী? মাশগালার কথা তো আমাদের নামের মধ্যেই আছে। তালিবুল ইলম। ইলমে ওহীর তালিব, ইলমে নাফের তালিব। পাহাড়পুরী হুযূর তো বলেন, তালিবুল ইলমি ওয়াল আমাল। পুরোটা উল্লেখ করা হয় না সংক্ষেপ করার উদ্দেশ্যে। আর যেহেতু এখানে ইলম বলে ইলমে ওহী বুঝানো হয় সেজন্যে আমলের কথা উল্লেখ না করলেও বিষয়টি তাতে থাকে। শুধু আমল কেন, আরো অনেক কিছুই থাকে। হাদীসে তো আছে

فمن أخذه أخذ بحظ وافر

সে হিসাবে আমাদের কথাবার্তা, আচার আচরণ সবকিছু থেকে যেন বুঝা যায়, আমরা সত্যিকারার্থেই তালিবুল ইলম।

প্রকৃত তালিবুল ইলমের দায়িত্ব হল ইলমের আমানতকে গ্রহণ করা। কিতাব পড়া আর ইলমের আমানত গ্রহণ করা কিন্তু এক জিনিস নয়। আমাদেরকে এমনভাবে ইলমের আমানত গ্রহণ করতে হবে যেন আমরা হামিলীনে ইলমের কাতারে শামিল হতে পারি। হামিলীনে ইলমের যে নূরানী সিলসিলা; তাতে যুক্ত হতে পারি। আর সেজন্যে প্রথম শর্ত হল ইনহিমাক ও ইনকিতা। নিমগ্নতা ও বিচ্ছিন্নতা। অর্থাৎ সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেকে ইলমের মধ্যে; পড়াশোনার মধ্যে ডুবিয়ে রাখতে হবে এবং নিমগ্নতায় বিঘ্ন ঘটায় এমন সবকিছু থেকে নিজেকে দূরে রাখতে হবে।

এখনকার তালিবুল ইলমের মধ্যে ব্যাপকভাবে একটা সমস্যা দেখা যায়। চিন্তাগত সমস্যা। তারা মনে করে, আমাদেরকে সবকিছু জানতে হবে। সবকিছু শিখতে হবে। যুগসচেতন হতে হবে।

من لم يعرف أهل زمانه فهو جاهل

 নিজের যামানা থেকে যে বেখবর সে জাহেল। কথা ঠিক। কিন্তু যামানার খবর রাখার পদ্ধতি কী? পত্রিকা পড়া? খবর দেখা? ইন্টারনেট ব্যবহার করা এসব?! ওরা কিন্তু এটাকেই ধরে নিয়েছে যুগ-সচেতনতা। অথচ তালিবুল ইলমের জন্য যামানা সম্পর্কে বাখবর বা যুগ সচেতন হওয়ার পদ্ধতি এটা নয়। তালিবুল ইলম প্রথমে সঠিকভাবে ইলমে ওহীকে ধারণ করবে। ইলমে ওহীকে গ্রহণ করবে এবং সেজন্যে মাদরাসার পরিবেশে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে আবদ্ধ রেখে পূর্ণ যোগ্যতা অর্জন করবে। এরপর যখন যামানাকে দিবে, যামানার সকল সমস্যার সমাধান পেশ করবে তখন দেখা যাবে তার আরো কী কী জানা দরকার। কিন্তু এখন তার নেয়ার সময়। গ্রহণ করার সময়। অর্জন করার সময়। দেয়ার সময় নয়। সেজন্যে একজন মুকতাদা আলেমের জন্য যমানা থেকে বেখবর হওয়া দোষের হলেও তালিবুল ইলমের জন্য এটা কামাল। এটা গুণ।

 لب بہ بند وگوش بند وچشم بند    +

   گر نہ بينی نور حق بر ما بخند        

চোখ কান মুখ সব কিছু বন্ধ করে নিজেকে ইলমের মধ্যে ডুবিয়ে রাখতে হবে এবং এখনই আমাকে সব কিছু জেনে ফেলতে হবে, এমন চিন্তা থেকে যেহেনকে মুক্ত করতে হবে। খোদ রায়ী থেকে নিজেকে রক্ষা করতে না পারলে তালিবে ইলমীর যমানা কামিয়াব হতে পারে না। কিতাবী ইসতিদাদ এবং ফন্নী ইসতিদাদকে যে তালিবুল ইলম দ্বিতীয় পর্যায়ের মনে করে সে আবার কিসের তালিবুল ইলম?

মাদরাসী যিন্দেগীতে তালিবুল ইলমের প্রধান মাশগালা হল কিতাবের মধ্যে ডুবে থাকা। আসাতিযায়ে কেরামের ফিকির থেকে ভিন্ন ফিকির পোষণ করলে সেই তালিবুল ইলমের দ্বারা কোনো কাজ আশা করা যায় না। আসাতিযায়ে কেরামের সাথে ফিকরী হাম আহেঙ্গী বা চিন্তার ঐক্য তালিবুল ইলমের জন্য খুবই জরুরি। তোমার ভালো কোনো নিজস্ব ফিকির থাকলে সেটা হেফাযত করে রাখ। এখন উস্তাযের ফিকিরটাই গ্রহণ কর। এরপর তোমার কাছে অনেক ফিকির জমা হলে একসময় সবচে ভালো এবং সবচে উপকারী ফিকিরকে তারজীহ দিও। কিন্তু এখন ইসতিফাদার জন্যে তোমাকে আসাতিযায়ে কেরামের ফিকির অনুযায়ীই চলতে হবে।

ইলমের অবস্থান হল কলবে। তাই কলবকে খুব পরিষ্কার রাখতে হবে। দেমাগ, চোখ, কান, মুখ এগুলো হল কলবের প্রবেশপথ। এই পথগুলো দ্বারাই কলবে সবকিছু প্রবেশ  করে। সেজন্যে এই প্রবেশপথগুলোকেও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা দরকার। পবিত্র রাখা দরকার। শরীয়তের পরিভাষায় এই পবিত্রতাকেই তাকওয়া বলা হয়। ইলমে নাফের জন্য এই পবিত্রতা হল বুনিয়াদি শর্ত।

আল্লাহ তাআলা বলেন, 

لَا يَمَسُّهُ إِلَّا الْمُطَهَّرُونَ

পবিত্রতা হাসিল করা ব্যতিত যেন কেউ এই কুরআনকে স্পর্শ না করে। এর বাহ্যিক অর্থ তাহারাতে যাহেরা বা অযু গোসলের পবিত্রতা হলেও কলবের পবিত্রতা এ আয়াতের মর্মেরই অংশ। সুতরাং কলব পবিত্র করা ছাড়া কুরআনের এবং হাদীসের ইলম হাসিল করা সম্ভব নয়। আর কলব পবিত্র রাখার জন্য জরুরি হল কলবের প্রবেশপথগুলোকে পবিত্র রাখা। অর্থাৎ চোখ, কান, মুখ এবং মস্তিষ্ককে পবিত্র রাখা।

আর এগুলো পবিত্র না হলে যেহেন মুনতাশির ও বিক্ষিপ্ত থাকে। মুতালাআয়ও ইনহিমাক সৃষ্টি হয় না। আর ইনহিমাক ও নিমগ্নতা ছাড়া তাফাক্কুহ কীভাবে হাসিল হবে?! 

বর্তমানে যেহেনকে মুনতাশির করে এমন জিনিসের তো অভাব নেই। তবে পত্রিকা আর জাওয়াল (মোবাইল) এব্যাপারে সবচে বেশি ক্ষতিকর। সেজন্যে পত্রিকা পড়া বন্ধ রাখতে হবে। দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক সব। হ্যাঁ তোমার উস্তায যদি তোমার জন্য মুনাসিব মনে করেন এবং যেটুকু মুনাসিব মনে করেন সেটুকুই পড়। এরচে বেশি পুরোটাই তোমার ক্ষতির কারণ। মাসিক আল কাউসার বা অন্য যেকোনো পত্রিকার ক্ষেত্রে একই কথা। তুমি তোমার উস্তাযের, তোমার তালিমী মুরুববীর অনুমতি ছাড়া পড়বে না।

আর জাওয়ালের বিষয়ে কথা বলতে তো ভয় লাগে। তবে মাদরাসায় তো আশা করি কেউ জাওয়াল ব্যবহার কর না। বাড়িতে গেলে অনেকে মা বাবা কিংবা বড় ভাই বা অন্য কারো জাওয়াল হাতে নেয়। সেটাও না করা উচিৎ। একান্তই কোনো প্রয়োজন হলে, যেমন তুমি তোমার উস্তাযের সাথে যোগাযোগ করতে চাও, তো সেজন্যে অবশ্যই তাদের অনুমতি নিবে। অনেকে মায়ের জাওয়াল বা বাবার জাওয়াল হওয়ায় অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন মনে করে না। এটা কিন্তু সম্পূর্ণ আদব পরিপন্থী। অতএব অনুমতি নিয়ে তাদের জাওয়াল ধরবে এবং ফোন করা শেষ হলেই রেখে দেবে। অযথা কখনো জাওয়াল হাতে রাখবে না। বিশেষ করে যেসব জাওয়ালে শাবাকার (ইন্টারনেটের) সংযোগ আছে সেগুলোর ধারে কাছেও যাওয়ার চেষ্টা করবে না। শাবাকা মানে  পুরো দুনিয়া। একজন তালিবুল ইলমের ইনহিমাক নষ্ট করে দেওয়ার জন্যে এরচে বড় মাধ্যম আর কী আছে? এমনকি তিন মাস পর কোনো বিরতিতে বাড়ি গিয়ে তুমি শাবাকা ব্যবহার করবে, আর এই দীর্ঘ সময়ে যা কিছু অর্জন করেছ তার সবটুকু বরবাদ করে দিবে এ আশঙ্কা অসম্ভব কোনো আশঙ্কা নয়।

এক তালিবুল ইলম আমাকে বলে, মাদরাসায় তো জাওয়াল নিষিদ্ধ, সেজন্যে আমি ব্যবহার করি না। তবে বাসায় গেলে বাসার জাওয়াল ব্যবহার করি আর তখন শাবাকা থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারি না। সে অনেক ভালো মানুষ। সেজন্যে সমস্যা অনুভব করেছে এবং তার সমস্যার কথা ইসলাহের উদ্দেশ্যে পেশ করেছে। আমি তাকে বললাম, এটা শুধু তোমার হিম্মতের বিষয়। তুমি হিম্মত কর। ইনশাআল্লাহ বেঁচে থাকা সম্ভব। তুমি হিম্মত কর যে, তুমি জাওয়াল ধরবে না। শাবাকার কাছেও যাবে না।

আজকাল আমাদের আরেকটা বড় সমস্যা হল, সব বিষয়ই আমরা দুআ দিয়ে সমাধান করতে চাই। আত্মশুদ্ধির জন্য, খারাপ অভ্যাস পরিত্যাগের জন্য শুধু দুআ চাই। অথচ শুধু দুআ দিয়ে খারাপ অভ্যাস ত্যাগ করা যায় না। আত্মশুদ্ধি করা যায় না। সেজন্যে হিম্মতকে কাজে লাগাতে হয়। এরপর দুআ-কান্নাকাটি করে যেতে হয়। 

হাকীম মাযহার সাহেবের কাছে আমি শুনেছি-আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী রাহ. বলতেন, তাহাজ্জুদ পড়ে, দুআ করে করে, কাঁদতে কাঁদতে বুযুর্গ হওয়া  যায়, কিন্তু আলেম হওয়া যায় না। তাফাক্কুহ অর্জন করা যায় না। সেজন্য দরকার মেহনত। মুজাহাদা। অধ্যবসায়। অর্থাৎ সুন্নাতুল্লাহ বা আল্লাহ তাআলার নীতিই হল, হিম্মত যে করে তিনি তাকে তাওফীক দেন। তো ইসলাহের জন্য হিম্মত কাজে লাগানোর কোনো বিকল্প নেই। হিম্মতের মধ্যে দুআও শামিল থাকে। এরপর ভিন্নভাবে আরো দুআ করে যেতে থাকলে ইনশাআল্লাহ খুব সহজেই ইসলাহ সম্ভব। তো সেই ছেলেকে বললাম, তুমি তোমার হিম্মতকে কাজে লাগাও। এরপরও যদি কখনো জাওয়াল হাতে নাও তাহলে প্রথমেই আমাকে ফোন করবে।

যাহোক, বলছিলাম ইনহিমাক ছাড়া তাফাক্কুহ অর্জন করা সম্ভব নয়। একটু আগে দফতরে মাওলানা আবুল বাশার ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম একটা লেখা পড়ছিলেন। আমরা সেই লেখারই একটি বাক্য নিয়ে কথা বলছিলাম। কিছুক্ষণ পর তিনি পড়া শেষ করে সেই বাক্যটি সম্পর্কেই আবার কথা উঠালেন। আমরা বললাম, এইমাত্র তো এ বিষয়েই কথা হল। কিন্তু তিনি কিছুই বলতে পারেন না। হিদায়ার মতো কোনো কিতাব নয়, সাধারণ একটি লেখা পড়তে যদি এই পরিমাণ ইনহিমাক থাকে তাহলে চিন্তা কর কিতাব পড়াশোনার সময় কেমন ইনহিমাক মনোযোগ থাকে! তালিবুল ইলমের জন্য এই ইনহিমাকই জরুরি। ইনহিমাক ছাড়া কোনো রকমের তাফাক্কুহ বা পান্ডিত্য ও পরিপক্কতা অর্জন করা সম্ভব নয়। এই রকমের তালিবুল ইলম মাঝে মধ্যে পাওয়া যায়। তবে ব্যাপকভাবে অবস্থা এর বিপরীত। তো চোখ কানের খুব হেফাযত করি। এগুলোর ব্যাপারে যেন কোনো অবহেলা না হয়।

لحظة يا صاحبي إن تغفل +ألف ميل زاد بعد المنزل

এক মুহূর্তের উদাসীনতা আমাকে হাজার বছরের পথ পিছিয়ে দিতে পারে। সেজন্যে সতর্কতা সব সময় জরুরি। এক মুহূর্তের গাফলতি আমার বরবাদি বা বিচ্যুতির কারণ হয়ে যেতে পারে।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে হেফাযত করুন এবং তাকওয়া-তাহারাত ও তাফাক্কুহ নসীব করুন। আমীন।

 [মুসাজ্জিলা থেকে পত্রস্থ করেছেন : আসআদুদ্দীন মাহদী ও তাওহীদুল ইসলাম তায়্যিব]    

 

 

advertisement