রজব ১৪৩৫   ||   মে-২০১৪

আমার আববাজান

হযরত মাওলানা আব্দুল হাই পাহাড়পুরী

নেককার বান্দাদের একটি আলামত হল ইত্তেবায়ে সুন্নাত। ঘরে ও বাইরে উভয় যিন্দেগীতে তাঁরা সুন্নতের পূর্ণ পাবন্দ হয়ে থাকেন। আলহামদুলিল্লাহ আমার আববাজান এমনই একজন মানুষ ছিলেন। আববাজান ছিলেন সুন্নতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যিন্দা নমুনা। পাহাড়পুর মাদরাসায় যাওয়ার সুযোগ যাদের হয়েছে তারা দেখেছেন, মাঠের উত্তর পশ্চিম কোণে ছোট্ট একটি কামরা। কামরার দক্ষিণ দেয়াল ঘেঁষে একটি ছোট খাট। খাটের মাথার কাছে দক্ষিণমুখী জানালা। কামরার মধ্যখানে গাম দিয়ে মলাটের কাগজ লাগানো  

মুলিবাশের বেড়া। ঘরের ভিতর আবছা আলো। পুরনো স্যাঁতস্যাঁতে দেয়াল। এখানে সেখানে আস্তর খসে পড়েছে। এখানে এই ছোট্ট কামরাটায় থাকতেন আমার আববাজান। জীবনের কয়েকটি যুগ তিনি এই ঘরেই কাটিয়েছেন।

এই ঘর আমার আববাজানের অসংখ্য নির্ঘুম রাতের নিরব সাক্ষী। আমার আববাজান আল্লাহর প্রিয় বান্দা ছিলেন। এ ঘরের শক্ত মেঝে একজন আল্লাহওয়ালার চোখের পানিতে অসংখ্যবার সিক্ত হয়েছে। রাতের শেষ প্রহরে আববা ঘুমিয়ে আছেন- জানি না আসমানের ফেরেস্তারা এমন দৃশ্য কোনোদিন দেখেছে কি না। এখানে উজ্জ্বল আলো ছিল না। শীতল বাতাস ছিল না। কিন্তু আমাদের যখনই আলোর প্রয়োজন হয়েছে আমরা এখানেই ছুটে এসেছি। জীবনের নির্মম বাস্তবতায় যখনই মনটা অস্থির হয়ে উঠেছে সবকিছু বাদ দিয়ে সবকিছু ভুলে গিয়ে এখানেই আশ্রয় খুঁজেছি। আববার সামনে হাটু গেড়ে বসেছি। আববা মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছেন। পরম প্রশান্তির স্পর্শ। আহা কী ছিল সেই হাতের স্পর্শে। হৃদয়ের গভীরে তখন অনুভূত হত এক অভূতপূর্ব স্বাদ। আববা যেন হাতের স্পর্শে আমাকে দান করতেন হৃদয় থেকে উঠে আসা আলো। যে আলোয় আলোকিত হতাম আমি এবং আমার চারপাশের আরো কতজন।

আজীবন আববা আমাকে আপন সেণহ ছায়ায় আগলে রেখেছেন। আমাকে কখনো চোখের আড়াল হতে দিতেন না। আববা কোথাও গেলে আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। পাহাড়পুর মাদরাসার কাজে আববাকে মাঝেমধ্যে ঢাকা আসতে হত। আমাকেও সঙ্গে নিয়ে আসতেন। আববার সঙ্গে থাকার সুবাদে সেই ছোটকালেই অনেক বড় বড় ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যের সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।

আমার মনে পড়ে, একবার আববা আমাকে নিয়ে ঢাকা এলেন। সারাদিন তাঁকে বিভিন্ন জায়গায় ছুটাছুটি করতে হবে। আমাকে নিয়ে এত জায়গায় যাওয়া মুশকিল। আমাকে কোথায় রাখবেন, কার কাছে রাখবেন চিন্তায় পড়ে গেলেন। অবশেষে মনে পড়ল হযরত মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরি রাহ. (সদর ছাহেব হুজুর)-এর কথা। আববা আমাকে নিয়ে সদর ছাহেব হুযুরের কাছে এলেন। বললেন, হযরত, আমি মাদরাসার কাজে বিভিন্ন জায়গায় যাব। আমার ছেলেটাকে আপনার কাছে রেখে যেতে চাই। সদর ছাহেব সানন্দে রাজি হলেন এবং একজন খাঁটি আল্লাহওয়ালাকে এত কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য সেই ছোটকালেই আমার অর্জিত হয়ে গেল।

সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সারাদিন সদর ছাহেব হুযুরের কামরায় হুযুরের সামনেই বসে থাকলাম। অবুঝ বয়স। সবকিছু স্পষ্ট মনে নেই। যতটুকু মনে পড়ে, হযরতের দরবারে চুপচাপ ভালো মানুষের মত বসে ছিলাম না। কখনো হযরতের কলম ধরি, কখনো খাতা ধরি। সারাদিন হযরতের সামনে বসে বসে এই কাজ করতে থাকলাম। আর সদর ছাহেব হুযুর কী করতে থাকলেন? আমাকে একবারও ধমক দিলেন না। যখনই হযরতের জরুরি কিছু ধরতে যাই হযরত আমার দিকে অন্য কিছু বাড়িয়ে দিয়ে মোলায়েম কন্ঠে বলেন, বাবা, এটা না, এটা নাও। কী অপূর্ব সবর! কী অসাধারণ সেণহ বাৎসল্য!

আমি আমার শৈশবকাল পুরোটাই আববার ছায়া হয়ে ছিলাম। চোখের আড়াল হওয়া আমার জন্য নিষিদ্ধ ছিল। আববা এভাবেই আমাকে চোখে চোখে রাখতেন আর মাঝেমাঝে বলতেন, আমি যে আমার ছেলের চৌকিদারি করছি, আল্লাহ জানেন, আমার এই চৌকিদারি কাজে লাগে কি না।

শামছুল হক ফরিদপুরী রাহ.-এর দরবারে সেই যে বসে থাকা, এরপর আমার যিন্দেগীর অর্ধশত বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু সেই দৃশ্য আমার চোখে এখনো জ্বলজ্বল করে। আমার এখন মনে হয়, আববা পরিকল্পনা করেই এসেছিলেন, একজন আল্লাহওয়ালার সোহবতে যেন আমি ধন্য হই। আমার কচি হৃদয়ে একজন আল্লাহওয়ালার ছবি অংকিত হয়ে থাকুক। আল্লাহওয়ালাদের সোহবতের তাসীর অসীম। তাদের সামনে কিছুক্ষণ বসে থাকা, কোনো কথা হোক না হোক, এর মধ্যেও সীমাহীন লাভ। আমার এখন মনে হয় আববার মনে হয়ত এই চিন্তাটাই কাজ করেছিল।

আমি দেখেছি আববার বেশির ভাগ কাজ হত শিরোনামবিহীন। বিশেষ করে আমাদের এসলাহ ও তরবিয়তের ক্ষেত্রে আববা এই বিষয়টির খুব রেয়ায়েত করতেন। তোমাকে সদর ছাহেব হুযুরের কাছে নিয়ে যাব, বুযুর্গানে দ্বীনের মজলিসে আসা যাওয়ার অনেক ফায়দা, আমি চাই তুমিও সদর ছাহেব হুযুরের মত একজন হও- এ জাতীয় কোনো শিরোনাম ব্যবহার না করে আববা আমাকে সরাসরি সদর ছাহেব হুযুরের দরবারে নিয়ে এলেন।  শিরোনাম অনেক সময় কাজের রূহ ও প্রাণশক্তি নষ্ট করে দেয়।

আববার এই চৌকিদারির আরেকটা ঘটনা আমার মনে পড়ে। আমার বয়স তখন ছয় কি সাত। ধামতি আমাদের নানার বাড়ি।  পাহাড়পুর থেকে ধামতি প্রায় পাঁচ ছয় মাইল পথ। মাটির রাস্তা। আববার একটা সাইকেল ছিল। নড়বড়ে। কোনোমতে চলে। এটা নিয়েই আববা চলতেন। জোড়াতালি দিয়ে কোনো রকমে। একদিন ধামতির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন। সাইকেলের চালক আববা। আরোহী আমি। সাইকেলের সামনের অংশে গামছা পেচিয়ে  আববা আমাকে বসালেন। পিতা ও পুত্রের সাইকেল যাত্রা চলতে থাকল। অর্ধেক পথ এসেছি এমন সময় বাঁধল বিপত্তি। কট করে একটা শব্দ হল। অর্থাৎ সাইকেল ভেঙে গেল। কিন্তু আববা ভাঙলেন না। মোটেও বিচলিত হলেন না। এতদূর পথ এখনো বাকি। পায়ে হেঁটে যাওয়া দুরূহ ব্যাপার। সাথে ভাঙা সাইকেল। আমি ভেঙে পড়লাম। ভয় পেয়ে গেলাম। আববা আমাকে অভয় দিলেন। কাছেই ছিল বটগাছ। আববা বললেন, বাবা, তুমি এখানটায় বটগাছের ছায়ায় বস। আমি দেখি কী করা যায়।

সফরসঙ্গী হিসেবে আববার কাছে টুকটাক কিছু জিনিস থাকত। আববা ছোট একটা ছুরি বের করলেন। বটগাছের ডাল ভেঙে আনলেন। শক্ত এবং সরু। ছুরি দিয়ে চেঁছে ডালটা সমান করলেন। সাইকেলের ভাঙা বাঁটের দু্ই দিকে ডালের দুই প্রান্ত ঢুকিয়ে শক্ত করে বাঁধলেন। কাজটা করতে আববার কতক্ষণ লাগল? বড়জোর পনের কি বিশ মিনিট। তারপর সেই জোড়া লাগানো সাইকেলে আমাকে বসিয়ে আবার প্যাডেল চাপলেন।

আমি আমার ছেলের চৌকিদারি করি আববার একথা যতবার আমার মনে পড়ে, ভাঙা সাইকেল জোড়া লাগানোর এ ঘটনাও আমার মনে পড়ে যায়। চৌকিদারি শব্দের সাথে সাইকেলের ঘটনার কী একটা যোগসূত্র যেন আছে। সেই প্রচ্ছন্ন যোগসূত্রের সূত্র ধরেই আমি আমার জীবনের এতগুলো বছর কাটিয়েছি। বটগাছের ডাল দিয়ে আববা দুটি বিচ্ছিন্ন চাকা এক করেছেন এবং আমাকে শিখিয়ে দিয়েছেন, মঞ্জিলে মাকসুদের পথে তোমার এই পথচলা যদি কখনো স্থবির হয়ে পড়ে, তুমি নিরাশ হয়ো না। কোনো বটবৃক্ষের ছায়ায় আশ্রয় নাও। বটবৃক্ষের সাহায্য নাও এবং নিজেকে আঁটসাঁট করে বেধে নাও।

এ ঘটনার বহু বছর পর আববা নিজেই আমাকে এক বটবৃক্ষের ছায়ায় নিয়ে এসেছিলেন। সেখানে আমার জীবনের চাকায় বিপুল শক্তির সঞ্চার হয়েছিল। সেই গতিতে এখনো চলছি। আলহামদুলিল্লাহ, ছুম্মা আলহামদুলিল্লাহ। হযরত হাফেজ্জী হুযুর রাহ. ছিলেন আমার জীবনের সেই বটবৃক্ষ। আল্লাহ তাআলা আমার আববাকে এবং আমার হাফেজ্জী হুযুরকে জান্নাতুল ফিরদাউসের সুউচ্চ মাকাম নসীব করুন। আমীন।

পাহাড়পুর। কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর থানার অন্তর্গত ছোট্ট একটি গ্রাম। এখানকার গ্রাম্য জীবন বড়ই সাদাসিধা। এখানকার প্রকৃতি অন্যসব গ্রামের মতই নির্মল। এখানকার মানুষের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, সকল অনুভূতি অন্য সবার মতই নিষ্কলুষ। এখানেও আছে সবুজের সমারোহ, পাখিদের কলতান, দিবসের কর্মচাঞ্চল্য, রাতের নিস্তব্ধতা। এখানেও আছে জীবন ও মৃত্যুর চিরকালীন অবয়ব। সবকিছু মিলিয়ে পাহাড়পুর বড়ই সাধারণ একটি গ্রাম। তবু এখানকার আলো বাতাসে কোথায় যেন একটা অনন্যতার নিবিড় স্পর্শ ছিল।

মুন্সি আব্দুল জলীল। জলীল মুন্সি নামেই সমধিক পরিচিত। অনেক সাধারণের মধ্যে একজন অসাধারণ। আল্লাহ তাআলার একটি গুণবাচক নাম জলীল। আল্লাহ তাআলার জলীল নামের বিস্ময়কর প্রভাব পড়েছে মুন্সি আব্দুল জলীলের স্বভাবে ও আচরণে। তিনি ছিলেন প্রচন্ড জালালী তবিয়তের। এই আবদুল জলীল মুন্সিরই দ্বিতীয় সন্তান মাওলানা আখতারুজ্জামান- আমার আববাজান।

আববার মুখে শুনেছি এবং আম্মার মুখেও শুনেছি দাদাজানের জীবনের বিস্ময়কর অনেক ঘটনা। পাহাড়পুর ও আশপাশের দশ গ্রামের মানুষ এক নামে তাঁকে চিনত। পরম শ্রদ্ধাভরে তাঁকে স্মরণ করত। অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ছিলেন।

من رأى منكم منكرا فليغيره بيده

এর জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত ছিলেন। দাদাজানের হাতে সবসময় একটা লাঠি থাকত। যেখানেই কোনো অন্যায় দেখতেন লাঠি হাতে প্রতিরোধ করতেন। দূর থেকে তাঁকে দেখলেই মানুষ সতর্ক হয়ে যেত। প্রখর মেধার অধিকারী চৌকান্না ব্যক্তি ছিলেন। একদিকে যেমন তিনি প্রচন্ড রাগী ও প্রতিবাদী ছিলেন অন্যদিকে তার স্বভাব ও রুচিতে অসাধারণ রসবোধও ছিল। এককথায় জালালে ও জামালে মেশানো একজন অনন্য-সাধারণ ও বিস্ময়কর মানুষ ছিলেন আমার দাদাজান- মুন্সি আবদুল জলীল রাহ.।

আববাজান তো প্রাথমিক পড়াশোনা কুমিল্লা বটগ্রাম মাদরাসায় সম্পন্ন করেছেন। এরপর দাদার কাছে অনুমতি চাইলেন হাটহাজারী মাদরাসায় ভর্তি হওয়ার। দাদা শর্ত দিলেন, তোমার এখানকার সমস্ত উস্তাযের অনুমতি ও দুআ নিয়ে আস। তাঁরা অনুমতি দিলে তারপর যেতে পারবে। এর আগে নয়। আববা সমস্ত উস্তাযের অনুমতি ও দুআ নিয়ে এসে দাদাকে জানালেন। দাদা প্রশ্ন করলেন, কামিনি মাস্টারের কাছে গিয়েছ? কামিনি মাস্টার ছিলেন পাঁচপুকুরিয়া স্কুলের একজন হিন্দু মাস্টার। কামিনি মাস্টার থেকেও বিদায় অনুমতি নিতে হবে, তার কাছেও অনুমতি চাইতে হবে- একথা আববার কল্পনায়ও আসেনি। সেই ছোট্টকালে কামিনি মাস্টারের কাছে পড়েছিলেন, এখন তার কাছেও অনুমতি আনতে হবে! তাও আবার খালেস দ্বীনি শিক্ষা হাসিল করার জন্য! আববা বিস্ময়ভরা কণ্ঠে উত্তর দিলেন, না। দাদা ধমকে উঠলেন, যাও, কামিনি মাস্টার থেকে অনুমতি ও বিদায় নিয়ে এসো।

আববা গেলেন কামিনি মাস্টার থেকে বিদায় নিতে। পাঁচপুকুরিয়া স্কুলে তিনি তখন পড়াচ্ছিলেন। আববা স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকলেন। যাতে ক্লাস শেষ হলেই মাস্টারের সাথে দেখা করতে পারেন। এদিকে কামিনি মাস্টার বারবার দরজার দিকে তাকাচ্ছিলেন আর অবাক হচ্ছিলেন, অনেক্ষণ যাবৎ জুববা পাগড়ি পরিহিত এক তরুণকে দরজার কাছে দাড়িয়ে থাকতে দেখে। কে এই তরুণ?

ক্লাস শেষ করে মাস্টার বের হলেন এবং অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কে তুমি বাবা? কিজন্য এসেছ?

আববা বললেন, আমার নাম আখতারুজ্জামান। মুন্সি আব্দুল জলীল সাহেবের ছেলে। আমি আপনার ছাত্র। ছোট থাকতে আপনার কাছে এই স্কুলেই পড়েছিলাম। আমি এখন পড়াশোনার জন্য চট্টগ্রাম হাটহাজারী মাদরাসায় ভর্তি হতে চাই। আপনার কাছে বিদায় নিতে এসেছি।

কামিনি মাস্টার কিছুক্ষণ অবাক বিস্ময়ে আববার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তার চোখ ঝাপসা হয়ে এল। একসময় তিনি আবেগে কেঁদে ফেললেন এবং বললেন, কেউ তো আমার কাছে বিদায় নিতে আসে না, তুমি এসেছ! একথা বলে তিনি আববার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন এবং নিজের মত করে অনেক দুআ করে দিলেন।

আববা এমন তারবিয়তই পেয়েছিলেন আমার দাদাজানের কাছ থেকে। কামিনি মাস্টারের কতই তো ছাত্র। কয়জনকে তিনি চেনেন। কয়জনের কথাই বা তাঁর মনে আছে। সেই কবে কত বছর আগে আববা তার কাছে পড়েছেন। এত ছাত্রের ভীড়ে আববাকে তার আলাদা করে চেনার কথা না। এত বছর পর আববার কথা মনে রাখা তো দূরের কথা। এধরনের অবস্থায় মানুষ স্বাভাবিকভাবেই তার সঙ্গে যোগাযোগের প্রয়োজন অনুভব করে না। দ্বিতীয় আরেকটা বিষয় হল, অবচেতনভাবে আরেকটা অনুভূতিও আমাদের মধ্যে কাজ করে। আমি মাদরাসায় পড়ব। দ্বীনি শিক্ষা অর্জন করব। এখানে আমার স্কুলের স্যারদের কাছ থেকে দুআ ও অনুমতি আনার কী আছে। কিন্তু আমার দাদাজান আববাজানকে হাতেকলমে এই সবক শিখিয়ে দিলেন, তোমার বড় হওয়া, তোমার মানুষের মত মানুষ হওয়ার নেপথ্যে যাদের অবদান সবচেয়ে বেশি তারা কিন্তু তোমার শিক্ষক ও উস্তাযগণ। তোমার উস্তাযদের থেকে তুমি যতকিছু শিখেছ এর সবটাই তোমার জীবন বিনির্মাণের একেকটি

প্রস্তর। এর সবটাই দামী। সবটাই মহামূল্যবান। এর কোনো একটার প্রতিও যদি তোমার ন্যূনতম অবহেলা বা গুরুত্বহীনতা চলে আসে, তোমার জীবনের স্তম্ভ সেখানেই কিন্তু ধুলিস্যাত হয়ে গেল। এ জীবন্ত বাস্তবতাটা যারা বুঝে না, তাদের জীবনের ভিত হয়ে যায় চরম নড়বড়ে। সময়ের সামান্য ঝড়ো হাওয়ায় এ ভিত বারবার কেঁপে উঠে। এরপর একসময় তার এ জীবন-প্রাচীর চরমভাবে বিধ্বস্ত হয়। মানুষ তখন পথ হারায়। পথের সন্ধানে হন্যে হয়ে ছুটে ফেরে। কোথাও সে একটুখানি আশ্রয় খুঁজে পায় না। তখন সে অভিযুক্ত করে সময়কে বা কালচক্রকে। অভিযোগ করে তার শিক্ষাব্যবস্থাকে। কিংবা তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে।

এটা আমার দাদাজান  আবদুল জলীল মুন্সি সাহেবের জীবনের কীর্তিময় দিক। তিনি তার সন্তানদের জন্য নিজেকে এক অভাবনীয় নির্মল আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। যাদেরকে আল্লাহ তাআলা কিছু দান করবেন তাদের জন্য বহু গায়েবী

ইন্তেযাম করে রাখেন। একে বলে কুদরতের নেগরানী। রাববুল আলামীনের অদৃশ্য তত্ত্বাবধান। আমার আববাজান এমনই তত্ত্বাবধান পেয়েছিলেন।

এ কথা শুধু আববাজানের বেলায়ই প্রযোজ্য এমনটা নয়। বরং আমার দাদাজান তাঁর সমস্ত সন্তানের প্রতি পরম যত্নবান ছিলেন। প্রত্যেক পিতামাতাই

সন্তানের জন্য দুআ করেন। সন্তান আল্লাহ তাআলার তরফ থেকে এক অমূল্য আমানত। এ আমানত রক্ষায় নিজের চেষ্টা তদবীর যত জরুরি এর চেয়ে অনেক বেশি জরুরি হল আল্লাহ তাআলার কাছে দুআ ও কান্নাকাটি।

সন্তানের তালীম-তরবিয়ত, আমল আখলাকসহ সর্বদিকে কামিয়াবির জন্য নিয়মিত আল্লাহ তাআলার কাছে দুআ ও মুনাজাতের কোনো বিকল্প নেই।

সন্তানের প্রতি যত্নশীল প্রত্যেক মা-বাবাই এ কাজটি করে থাকেন অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে। কিন্তু আমার দাদাজান ছিলেন এ ব্যাপারে একজন প্রবাদতুল্য আদর্শ পিতা। নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের পর দুআ, বিশেষ সময়গুলোতে দুআ; এগুলো তো ছিলই, উপরন্তু তিনি শুধু তাঁর সন্তানদের জন্য দুআ সম্বলিত একটি সুদীর্ঘ কবিতাও রচনা করেছিলেন। ফার্সী ভাষায় রচিত সেই কবিতা তিনি চলতে ফিরতে পাঠ করতেন। কবিতার পুরোটাই ছিল শুধুই সন্তানদের জন্য দুআ ও মুনাজাত। প্রত্যেক সন্তানের নাম নিয়ে নিয়ে আল্লাহ তাআলার কাছে বড়ই আবেগ ও দরদমাখা ভাষায় দুআ। একজন পিতার জন্য তাঁর যিন্দেগীর সবচেয়ে বড় পাওনা, তাঁর দুনিয়া ও আখেরাতের সবচেয়ে দামী সম্পদ ও মূলধন যে তার সন্তান, সন্তানের কামিয়াবিই যে একজন পিতার সবচেয়ে বড় কামিয়াবি, সন্তানের বিপথগামিতার মধ্যেই যে একজন পিতার সবচেয়ে বড় হতাশা ও ব্যর্থতা - আমার দাদাজানের এই কবিতা পংক্তিগুলো রচিত না হলে হয়ত এ মহাসত্যটি আমার সামনে এতটা সমুজ্জ্বল হয়ে উদ্ভাসিত হতো না। দাদাজানের কবিতার কিছু অংশ আমার মনে আছে। পরে কোনো এক অবসরে কবিতাগুলো ইনশাআল্লাহ কোনো একটি লেখায় লিপিবদ্ধ করার ইচ্ছা আছে।

আবদুল জলীল মুন্সির সাহস ও নির্ভীকতা ছিল মানুষের মুখে মুখে। তাঁর এই নামের জালাল তাঁর মধ্যে এমন প্রবলভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল যে, দূর থেকে তাঁকে দেখে মানুষ তটস্থ হয়ে যেত। সতর্ক হয়ে যেত। অন্যায়কে তিনি এতটাই কঠোর হাতে দমন করতেন যে, তাঁর সামনে দ্বিতীয়বার আর কেউ অন্যায় করার সাহস পেত না। কোনো মেয়ে মানুষ তাঁর সামনে দিয়ে বেপর্দা হাঁটার সাহস পেত না। এক কথায় তিনি ছিলেন من رأى منكم منكرا فليغيره بيده-এর মেসদাক। একেবারে জীবন্ত উদাহরণ। ঈমান ও ইসলামের প্রতি তাঁর নিখাদ প্রেম ও ভালোবাসা এতটাই প্রবল ছিল যে, মাঝেমধ্যে তিনি যেন অন্য কোনো জগতে চলে যেতেন। ইসলামই একমাত্র সত্য ধর্ম এবং ইসলামই থাকবে সবার উপরে الإسلام يعلو ولا يعلى এ আকিদা ও বিশ্বাসের তিনি ছিলেন যিন্দা নমুনা।

কুমিল্লা বটগ্রাম মাদরাসায় পড়াশোনা শেষ করে আববা হাটহাজারী মাদরাসায় ভর্তি হলেন। মাদরাসার মাতবাখে (বোর্ডিংয়ে) খানা খেতেন। লেখাপড়া ও উন্নত আমল আখলাকের কারণে অল্পদিনের মধ্যে মাদরাসার আসাতিযায়ে কেরাম ও বুযুর্গানে দ্বীনের নেক নযর লাভ করতে সক্ষম হলেন।  মুফতিয়ে আযম হযরত মাওলানা মুফতি ফয়যুল্লাহ রাহ.-এর পীর হযরত মাওলানা সাঈদ আহমদ রাহ.। হাটহাজারী মাদরাসায় দীর্ঘ ত্রিশ বছর বুখারী শরীফের দরস প্রদান করেছেন। একদিন হঠাৎ আববা যে জামাতে পড়তেন, সে জামাতে এসে উপস্থিত। আববার জামাতের ছাত্ররা সবাই এক জায়গায় বসা। আববা বসা পিছনের সারিতে। মুহাদ্দিস ছাহেব বললেন, আমি একটা পোয়া (ছেলে) আমার বাড়িতে জায়গীর নেব। মুহাদ্দিস ছাহেবের বাড়িতে মেহমান হওয়ার সৌভাগ্য কে না লাভ করতে চায়। একে একে অনেকে আগ্রহ প্রকাশ করল।

মুহাদ্দিস ছাহেব সবাইকে না করতে থাকলেন। একপর্যায়ে তিনি বলে উঠলেন, মৌলভী আখতার কোথায়? আববা পিছনের সারি থেকে দাঁড়িয়ে গেলেন। মুহাদ্দিস ছাহেব তখন মহববত ও সেণহমাখা কণ্ঠে বললেন, হাঁ, আমি এই পোয়াটারে জায়গীর নেব।

মুহাদ্দিস ছাহেবের বাড়িতে আববার জায়গীর ঠিক হল। মাদরাসার সবক শেষ করে আববা মুহাদ্দিস ছাহেবের বাড়িতে চলে যেতেন। হুযুরের ছেলেরা আববার কাছে পড়ত। এভাবেই সময় কাটতে থাকল। একসময় অবস্থা এমন হল যে, মুহাদ্দিস ছাহেব আপন সন্তান থেকেও যেন আববাকে বেশি সেণহ ও মহববত করতে শুরু করলেন। হাটহাজারী মাদরাসার পড়াশোনা শেষ করে আববা যখন বিদায় নিবেন তখনকার ঘটনা। আববা সামানা পত্র সব বাঁধলেন। ভারি বোঝা। আববা কুলি ডাকার জন্য বাইরে যাবেন এমন সময় মুহাদ্দিস ছাহেব আববাকে দেখে বললেন, বাবা কোথায় যাচ্ছ? আববা বললেন, কুলি ডাকতে। মুহাদ্দিস ছাহেব বললেন, কুলি ডাকতে হবে না, আমি আগেই কুলি ঠিক করে রেখেছি।

এর পরের ঘটনা অন্যরকম।

মুহাদ্দিস ছাহেব যে কাজটি করলেন তার জন্য আববা মোটেও প্রস্ত্তত ছিলেন না।

মুহাদ্দিস ছাহেব তাঁর ছেলেদের ডাকলেন এবং আববার বোঝাগুলো স্টেশন পর্যন্ত দিয়ে আসতে বললেন। ছেলেরা তাই করল। মুহাদ্দিস ছাহেবের এ অকৃত্রিম সেণহ ও মহববতের সামনে আববা একদম খামুশ হয়ে গেলেন। আববার কষ্ট হচ্ছিল এ দৃশ্য সহ্য করতে। তবু আপন ইচ্ছা ও অনুভূতির উপর আববা উস্তাযের ইচ্ছা ও অনুভূতিকে প্রাধান্য দিলেন।

হাটহাজারী মাদরাসার পড়াশোনা শেষ করে আববা ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হলেন। কুদরতের বড় সুন্দর ফায়সালা এবং আববার সুপ্রসন্ন ভাগ্য, দারুল উলূম দেওবন্দে যাওয়ার পরও আপন মুহসিন মুশফিক উস্তায সাঈদ আহমাদ রাহ.-এর সাথে দেখা সাক্ষাতের সিলসিলা জারি থাকল।

মুহাদ্দিস সাঈদ আহমাদ রাহ. ছিলেন দারুল উলূম দেওবন্দের মজলিসে শূরার একমাত্র এদেশী রুকন। এই সুবাদে মাঝেমধ্যেই তাঁর দেওবন্দ যাওয়া পড়ত। যতবার দারুল উলূম দেওবন্দ যেতেন ততবার তাঁর প্রিয় শাগরেদের জন্য বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন ধরনের হাদিয়া তোহফা নিয়ে যেতেন। গেঞ্জি, লুঙ্গি, গামছা থেকে শুরু করে তাঁর ঘরে তৈরি বিভিন্ন ধরনের খাবার। বাংলাদেশ থেকে বোঝা বয়ে তিনি এগুলো নিয়ে যেতেন। হযরতের পুরো পরিবারের আববাজানের সাথে এক অদ্ভূত হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। ফলে সবার কিছু কিছু হাদিয়া হযরত আববাজানের জন্য সুদূর দেওবন্দে বয়ে নিয়ে যেতেন। হযরত থলে থেকে  একেকটা হাদিয়া বের করতেন আর বলতেন, এটা তোমার মা দিয়েছে, এটা তোমার ভাই দিয়েছে, এটা তোমার বোন দিয়েছে।

আববাজান তাঁর যিন্দেগীর এ কথাগুলো খুব কমই বলতেন। আববাজানের কাছ থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাঁর জীবনের মহামূল্যবান কথাগুলো বের করতে হত। আববাজানের যিন্দেগীটা যদি কেউ পূর্ণাঙ্গ লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করত, ইতিহাসের এক অমূল্য সম্পদ তৈরি হতে পারত। এখন যা লেখা হচ্ছে তাতে নিজেদেরকে একপ্রকার অপরাধী বলেই মনে হচ্ছে। এ মহান সাধকের জীবন থেকে কত কিছুই না নেওয়ার ছিল। জীবন থেকে জীবনের সঞ্চয় করার আছে অনেক। আববা যতদিন বা-হায়াত ছিলেন, বারবার এ উপলব্ধিটা হত। এ সম্পদ, আকাবিরদের রূহানিয়্যাতসিক্ত এ মহান ব্যক্তিত্ব কখন যেন আমাদের ছেড়ে চলে যান। এখনো তো সময় আছে। এখনো তো তাঁর কথা বলার যোগ্যতা আছে। এখনো তো তাঁর কাছে বসে বসে তাঁর জীবনটাকে কাগজের পাতায় তুলে রাখার সুযোগ আছে। আমার মনের এ ভাবনাগুলো আমার মনের ভিতরটাকে অস্থির করে রাখত। আমি মনে মনে ভাবতাম, আল্লাহর কোন বান্দা যদি এই কাজটি করত। এর জন্য নিজের যিন্দেগীর একটি সময়কে অবসর করত। আমি তো আববার হুকুমেই আববার কাছ থেকে একসময় দূরে এসেছি। অন্তত জিসমানী দূরত্ব তো হয়েছিল। আমার ব্যাপারে আববাজানের খেয়ালও এমনটাই ছিল। যে খেয়ালের পিছনে অন্যতম, বরং আমার ধারণায় একমাত্র কারণ ছিলেন হযরত হাফেজ্জী হুযুর রাহ.। আববা আমাকে হাফেজ্জী হযুরের হাতে পুরোপুরি সোপর্দ করে দিয়েছিলেন। যার কারণে হাফেজ্জী হুযুরের ইচ্ছা এমনকি ইশারার বাইরে আববা আমার ব্যাপারে কখনো কোনো সিদ্ধান্ত তো দূরের কথা, কোনো খেয়ালও জাহির করেননি। আববার বিপুল কর্মব্যস্ত যিন্দেগীর তুমুল ব্যস্ততার মধ্যে আববার কাছ থেকে তাঁর যিন্দেগীর ইতিহাস শোনার সুযোগ যদিও খুবই কম ছিল, কিন্তু যিন্দেগীর শেষ সময়টায় যখন মজবুত মনোবলের এই মানুষটি বহুবিধ রোগে আক্রান্ত হয়ে শারীরিক পরিশ্রম, দৌড়ঝাপ থেকে কিছুটা অবসর হলেন, তখন তো তাঁর কাছে বসে তাঁর মুখ থেকে শোনে শোনে তাঁর যিন্দেগীর একটা বিরাট অংশ লিপিবদ্ধ করে রাখা সম্ভব ছিল। তাঁর তো সুযোগ ছিল বলার, তাঁর অনেক কিছুই ছিল আমাদেরকে দেওয়ার, কিন্তু আমরা তার চারপাশের মানুষগুলো নিজেদের নিয়ে এতটাই ব্যস্ত ছিলাম যে, এ মহান মানুষটির যিন্দেগীর একটি চিত্র তাঁরই কাছ থেকে এঁকে রাখার সুযোগ আমাদের হল না। তিনি তাঁর যিন্দেগীর যে অংশগুলো আমাদের কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছিলেন, পরম সযত্নে, কতই না দামী ছিল যিন্দেগীর সেই অংশগুলো। তাঁর যিন্দেগীর কতটুকুই বা তিনি আমাদের কাছে প্রকাশ করেছেন। তাঁর যিন্দেগীর অপ্রকাশিত সেই অধ্যায়ের একটুখানি ঝলকও যদি আমরা পেতাম, আমাদের জীবন কতই না আলোকিত হত। প্রচারবিমুখ এই নিভৃতচারী মহাপুরুষের কাছে আমরা কেবল প্রত্যাশাই করেছি।  সে প্রত্যাশা পূরণে আমরা ন্যূনতম ভূমিকাও তো রাখিনি। রাখতে পারিনি। রাখার চেষ্টাও করিনি। কিতাবের মধ্যে বিদ্যা থাকে। একজন আল্লাহওয়ালার যিন্দেগীর মধ্যে তাঁর অনুশীলনচিত্র থাকে। ইলমের চর্চা তো কম হয় না। কিন্তু ইলমের উদাহরণ খোঁজার সাধনা আমরা কয়জন করি। কিতাবের বিদ্যা- এর উদাহরণ তো আমরা সেই কিতাবের পাতায়ই খুঁজে বেড়াই। কোনো মুবালাগা নয়, আমার দিল ও দেমাগের শাহাদাত এটাই যে, আমার আববা ছিলেন কুরআন ও সুন্নাহর একজন জীবন্ত উদাহরণ। আমার আববার জীবনের মধ্যেই আমরা খুঁজে নিতে পারতাম আমাদের অমীমাংসিত অনেক প্রশ্নের উত্তর।

থাক সেসব কথা। জীবন থেকে যা হারানোর তা তো হারিয়েই গেছে। যা হারিয়েছে তার আফসোসে প্রাপ্তিটুকু থেকেও যেন বঞ্চিত না হই সেই চেষ্টাই করতে হবে। 

মুহাদ্দিস ছাহেব হুযুরের কথা বলছিলাম। মুহাদ্দিস ছাহেবের সাথে  আববাজানের যে তাআল্লুক ও সম্পর্ক, এর গভীরতা উপলব্ধি করার সাধ্য আমার নাই। সুতরাং আমার পক্ষে কি সম্ভব কলমের আঁচড়ে সে সম্পর্কের বিবরণ তুলে ধরা! কিছু ঘটনা হয়ত উল্লেখ করতে পারব। এর থেকেই পাঠককে উদ্ধার করে নিতে হবে উস্তায শাগরেদের মধ্যকার বিস্ময়কর সম্পর্কের একটি নিভৃত উপাখ্যান।

আজ থেকে প্রায় নববই বছর আগে সুদূর হিন্দুস্তানের যমিনে কিছু ভাগ্যবান মানুষ একটি দৃশ্য দেখেছিল। তারা দেখেছিল উস্তাযের প্রতি শাগরেদের হৃদয়মন উজাড় করে দেওয়া শ্রদ্ধা ও ভালবাসা এবং শাগরেদের প্রতি উস্তাযের হৃদয়নিংড়ানো সেণহ ও মহববত। কাঁধে করে বয়ে নিয়ে আসা ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামালেন এবং মুখে পরম প্রশান্তির হাসি নিয়ে ব্যাগ থেকে একটা একটা উপহার বের করতে থাকলেন - এ কাজটা যিনি করছেন তিনি হলেন উস্তায। আর সামনে বসে ঐযে ছেলেটা, চোখে কৃতজ্ঞতার অশ্রু, মুখে নিষ্পাপ পবিত্র হাসি নিয়ে উপহারগুলো যে গ্রহণ করছে- সে তো তাঁরই ছাত্র! যতবার আমার কল্পনায় এ দৃশ্যটি ভেসে ওঠে আমি বিস্ময়াভিভূত হই। আমি এর ব্যখ্যা তালাশ করি, শেষ পর্যন্ত এ ব্যাখ্যাই আমার বুঝে আসে যে, এর কোনো ব্যাখ্যা নেই

আববা দারুল উলূম দেওবন্দে ভর্তি হলেন। দেওবন্দ মাদরাসায় ভর্তি হয়ে আববা  সবার আগে যে কাজটি করলেন, তা হল, আসাতিযায়ে কেরামের সাথে পরিচিত হলেন এবং অল্প দিনের মধ্যেই উন্নত রুচি ও আখলাকের কারণে সবার বিশেষ নেক নযর লাভ করতে সক্ষম হলেন। বিশেষ করে হযরত মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানী রাহ. -এর বিশেষ সেণহের পাত্রে পরিণত হলেন। মাওলানা আসআদ মাদানী তখন দারুল উলূম দেওবন্দের ছাত্র। অল্প বয়স। তাদেরকে প্রতিদিন বাসা থেকে মাদরাসায় আনা নেওয়া করার দায়িত্ব ছিল আববার উপর। আববা প্রতিদিন আসআদ মাদানীকে বাসায় নিয়ে যেতেন আবার বাসা থেকে মাদরাসায় নিয়ে আসতেন। প্রতিদিন মাদরাসায় আনা নেওয়ার পথে আববার সাথে আসআদ মাদানীর একটা অন্যরকম তাআল্লুক তৈরি হয়ে গিয়েছিল। মাদরাসায় আনা নেওয়ার পথে আববার কাছে ছোট্ট আসআদ মাদানী ইলমী ইসতেফাদাও করতেন। সবকের মুযাকারাও করতেন।

এর অনেক বছর পরের কথা। তখনকার ছোট্ট আসআদ মাদানী এখন জগদ্বিখ্যাত আলেমে দ্বীন, আরব-আজমের অবিসংবাদিত ব্যক্তিত্ব ফিদায়ে মিল্লাত হযরত মাওলানা আসআদ মাদানী দামাত বারাকাতুহুমুল আলিয়া। হযরত বাংলাদেশ সফরে এসেছেন। মিরপুরের আরজাবাদ মাদরাসায় অবস্থান করছেন। আমি গেলাম হযরতের সাথে দেখা করার জন্য। আববাজানের পরিচয় হযরতকে দিলাম। দারুল উলুম দেওবন্দে আববাজানের সাথে হযরতের সম্পর্কের কথাও অবহিত করলাম। আমার কথা শোনার সাথে সাথে হযরত যেন জোশের মধ্যে চলে এলেন। আভী মুঝে লে চলো, ম্যায় উনসে মুলাকাত কারো গা। মাওলানা শামছুদ্দীন কাসেমী রাহ. সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি অনেক কিছু বলে কয়ে হযরতকে নিবৃত্ত করলেন। বললেন, হযরত! ওতো গাঁওমে রাহতে হ্যাঁয়, আপ যা নেহী সাকতে। আসআদ মাদানী ছাহেব তখন আমাকে বললেন, উনসে মেরা সালাম আরয কারনা, ম্যায় যরুর আতা, আগার মুমকিন হোতা

আববাজানের ইন্তেকালের কয়েকদিন আগের কথা। আমার ছেলে আশরাফুজ্জামান তার দাদাকে দেখতে পাহাড়পুর গেল। কথায় কথায় হযরত মাওলানা আরশাদ মাদানী ছাহেবের কথা উঠল। নামটা শুনে  আববা কেমন আনমনা হয়ে গেলেন। বিশ্বব্যাপী যার নামডাক, চারিদিকে যার সুনাম সুখ্যাতি, আববা যেন ভাবগম্ভীর এই মানুষটির মাঝে উচ্ছল চঞ্চল একটি শিশুর ছবি দেখতে পেলেন। আববা হঠাৎ হেসে উঠলেন এবং কি এক অদ্ভূত মায়াজড়ানো কণ্ঠে বলে উঠলেন, সে তো এই এতটুকু ছিল, ছোট্ট ছিল। ষ

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

শ্রুতিলিখন : আবরারুয যামান পাহাড়পুরী

 

 

advertisement