একই দিনে ঈদের বিষয় দায়িত্বশীলদের উপর ছাড়ুন-৩
মুসলমানদের মাঝে ঈমান ও ইসলামী ভ্রাতৃত্বের ঐক্য সৃষ্টির চেষ্টা করুন
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
তাবেয়ী-যুগ
কিছু আগে ইমাম ইবনে আবদুল বার রাহ.-এর বরাতে বলা হয়েছে, তাবেয়ীদের মাঝে ইকরিমা, কাসিম ও সালিম রাহ.-এর মাযহাব তা-ই ছিল, যা ছিল সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা.-এর মাযহাব। ‘আততামহীদ’ ছাড়া মুয়াত্তার দ্বিতীয় শরহ (ভাষ্যগ্রন্থ) ‘আলইসতিযকারে’ও তিনি ঐ তাবেয়ীগণের মাযহাব উল্লেখ করেছেন। তাঁর বক্তব্যের আরবী পাঠ এই-
وبه قال عكرمة، والقاسم بن محمد، وسالم بن عبد الله، وإليه ذهب ابن المبارك، وإسحاق بن راهوية، وطائفة.
‘‘এটিই ইকরিমা, কাসিম ইবনে মুহাম্মাদ ও সালিম ইবনে আবদুল্লাহর বক্তব্য। ইবনুল মুবারক ও ইসহাক ইবনে রাহূয়াহসহ একটি জামাতের মাযহাবও এটিই।’’ (আলইসতিযকার ১০/২৯)
ইকরিমা (২৫-১০৫ হি.) তো আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা.-এর খাস শাগরিদ, বড় মুহাদ্দিস ও ফকীহ।
কাসিম ইবনে মুহাম্মাদ (৩৭-১০৭ হি.) আবু বকর সিদ্দীক রা.-এর পৌত্র। আর সালিম ইবনে আবদুল্লাহ (১০৬ হি.) ওমর ইবনুল খাত্তাব রা.-এর পৌত্র। কাসিম ও সালিম এই দুইজন তাবেয়ী-যুগের ঐ সরতাজ সাত ফকীহগণের অন্যতম, যাদের ‘‘আলফুকাহাউস সাবআ’’ বলে স্মরণ করা হয়।
কাসিম রাহ. যে ‘সাত ফকীহ’র একজন এ বিষয়ে তো সবাই একমত। আর সালিম রাহ.ও তাঁদের অন্তর্ভুক্ত ইবনুল মুবারক রাহ.-এর মতে। ফিকহ-ফতোয়ায় ‘‘সাত ফকীহ’’র মতামতের যে বিশেষ মর্যাদা ও বিশেষত্ব সে সম্পর্কে উসূলে ফিকহ ও তারীখে ফিকহের পারদর্শী ব্যক্তিগণ অবগত।
তো এই দুই মনীষীর মাযহাবও এটাই ছিল যে, প্রত্যেক অঞ্চলের অধিবাসীগণ নিজ নিজ চাঁদ দেখা অনুসারে আমল করবে, দূরবর্তী অঞ্চলের চাঁদ দেখা তাদের জন্য আবশ্যকীয় নয়। এঁদের সাথে তৃতীয় তাবেয়ী ইকরিমা রাহ.-এরও মাযহাব এটাই ছিল।
এই তিন তাবেয়ীর মাযহাব সম্পর্কে একথা আরো অনেক আগে বলেছেন ইবনুল মুনযির রাহ. (৩১৮ হি.) ‘‘ইশরাফ’’ গ্রন্থে (৩/১১২) এবং খাত্তাবী (৩৮৮ হি.) ও বাগাভী (৫১৬ হি.) সহ অন্যান্য গ্রন্থকারগণ।
(দ্র. মাআলিমুস সুনান ২/৮৪, শরহুস সুন্নাহ ৪/১৪৫, আরো দেখা যেতে পারে : আলমুসান্নাফ, ইবনে আবী শাইবা ৬/২৮০ আছার : ৯৬৫৮
في القوم يرون الإهلال ولا يرونه الآخرون)
আমাদের জানা মতে তাবেয়ী-যুগের এই তিন বিশিষ্ট মনীষীর বিপরীতে অন্য কোনো তাবেয়ীর ফতোয়া বিদ্যমান নেই। শুধু হাসান বসরী (২১ হি.-১১০ হি.) রাহ. থেকে এমন একটি রেওয়ায়েত পাওয়া যায়, যা এই মাযহাবের বিপরীত ধারণা করা হতে পারে। সুনানে আবু দাউদের কোনো কোনো নুসখায় (আবুল হাসান ইবনুল আবদ ও ইবনে দাছার বর্ণনাকৃত মাখতূতায়) আছরটি আছে-
عن الحسن، في رجل كان بمصر من الأمصار، فصام يوم الإثنين، وشهد رجلان أنهما رأيا الهلالَ ليلة الأحد، فقال : لا يقضي ذلك اليومَ الرجل ولا أهلُ مصره، إلا أن يعلموا أن أهل مصر من أمصار المسلمين قد صاموا يوم الأحد فيقضوه.
হাসান বসরী রাহ. থেকে বর্ণিত, কোনো ব্যক্তি কোনো শহরে ছিল এবং (সেই শহরবাসীদের সাথে) সোমবার রোযা শুরু করল। এরপর দুই ব্যক্তি এসে সাক্ষ্য দিল যে, তারা দুজন রবিবার রাতে (শনিবার দিবাগত রাতে) চাঁদ দেখেছে। (সুতরাং রবিবার থেকেই রোযা শুরু হওয়া উচিত ছিল) এ ক্ষেত্রে হাসান রাহ. বলেছেন, শুধু এটুকুর ভিত্তিতে ঐ ব্যক্তি ও শহরবাসী একটি রোযা কাযা করবে না। তবে তারা যদি জানতে পারে যে, কোনো মুসলিম শহরের অধিবাসীগণ বাস্তবেই রবিবার রোযা রেখেছে তাহলে তারা ঐ দিনের রোযা কাযা করবে। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ২৩৩৩; তুহফাতুল আশরাফ, হাদীস : ১৮৪৯২)
শব্দের ব্যাপকতা থেকে হাসান বসরী রাহ.-এর ফতোয়ার যদি এ অর্থ করা হয় যে, দূর-দূরান্তের কোনো শহরের অধিবাসীদের বিষয়েও তারা একদিন আগে রোযা রেখেছিল বলে প্রমাণিত হলে এ শহরের অধিবাসীগণকে এক দিনের রোযা কাযা করতে হবে, তাহলে বলা যায়, হাসান বসরী রাহ.-এর মাযহাব ছিল, এক অঞ্চলের চাঁদ দেখা অন্য অঞ্চলের জন্য (যদি প্রমাণিত হয়) অবশ্যগ্রহণীয়।
সারসংক্ষেপ
এ পর্যন্ত আলোচনার সারসংক্ষেপ এই যে, দূর-দূরান্তের অঞ্চলের চাঁদ দেখা ওয়াজিবুল আমল (অবশ্যগ্রহণীয়) না হওয়ার বিষয়ে সাহাবা-যুগে আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা.-এর মাযহাব পাওয়া গেল, এর বিপরীত কিছু কারো থেকে পাওয়া যায়নি। তাবেয়ী-যুগে তিন বড় মনীষী ইকরিমা রাহ., কাসিম রাহ. ও সালিম রাহ. থেকেও এই মাযহাবই পাওয়া গেল। এর বিপরীত বিবরণ শুধু এক হাসান বসরী রাহ. থেকে পাওয়া যায় যদি তাঁর ফতোয়াকে শব্দের ব্যাপকতার উপর রাখা হয়। নতুবা শক্তিশালী সম্ভাবনা আছে, তাঁর উদ্দেশ্য, নিকটবর্তী কোনো শহরে চাঁদ দেখা ও রোযা রাখা প্রমাণিত হলে কাযা আসবে, অন্যথায় নয়।
চার মাযহাবের মুজতাহিদ ও অন্যান্য ফকীহগণের সিদ্ধান্ত
ইমাম তিরমিযী রাহ. (২৭৯ হি.) তার ‘জামি’ গ্রন্থে কিতাবুস সিয়াম (সিয়াম-অধ্যায়)-এর নবম বাব (পরিচ্ছেদের) শিরোনাম দিয়েছেন-
باب ما جاء لكل أهل بلد رؤيتهم
(প্রত্যেক শহরবাসীর জন্য নিজ নিজ চাঁদ দেখা অনুসরণীয় সংক্রান্ত হাদীস) এই শিরোনামের অধীনে তিনি আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা.-এর ঐ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন, যা ‘সাহাবা-যুগ’ শীর্ষক আলোচনায় উল্লেখিত হয়েছে। এই হাদীস বর্ণনার পর ইমাম তিরমিযী রাহ. লেখেন-
حديث ابن عباس حديث حسن صحيح غريب. والعمل على هذا الحديث عند أهل العلم، أن لكل أهل بلد رؤيتهم.
ইবনে আববাস রা.-এর উপরোক্ত হাদীস ‘সহীহ’। (ইমাম তিরমিযীর বিশেষ পরিভাষায় ‘‘হাসানুন সহীহুন গরীবুন’’) এবং আহলে ইলমের (ফকীহ ও মুহাদ্দিসগণের) আমলও এটাই যে, প্রত্যেক শহরবাসীর জন্য নিজেদের দেখাই গ্রহণযোগ্য। (জামে তিরমিযী ২/২৩২, হাদীস : ৭০২-এর অধীনে)।
ইমাম তিরমিযী রাহ. বিধান সংক্রান্ত হাদীসের অধীনে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে হাদীসের ইমাম ও মুজতাহিদ ফকীহগণের মাযহাব বর্ণনা করে থাকেন। সাহাবা, তাবেয়ীনের মাযহাবের সাথে চার ইমাম, সুফিয়ান ছাওরী ও ইসহাক ইবনে রাহূয়াহ রাহ.-এর মাযহাব বিশেষভাবে বর্ণনা করেন। অথচ আলোচ্য বিষয়ে তিনি কোনো ইখতিলাফই বর্ণনা করেননি। সাধারণভাবে ‘আহলে ইলমে’র মাযহাব বর্ণনা করেছেন যে, ‘প্রত্যেকে নিজ অঞ্চলের চাঁদ দেখা অনুসারে আমল করবে।’ (অর্থাৎ দূর-দূরান্তের শহর-নগরের চাঁদ দেখা অবশ্যগ্রহণীয় নয়) বোঝা গেল, ইমাম তিরমিযী রাহ.-এর দৃষ্টিতে অধিকাংশ ফকীহ ও মুহাদ্দিসের মাসলাক সেটাই, যা তিনি উল্লেখ করেছেন। সম্ভবত এ কারণেই এ বিষয়ে কোনো ইখতিলাফ বর্ণনার প্রয়োজন বোধ করেননি।
ইমাম ইবনে আবদুল বার রাহ. সাহাবা-তাবেয়ীনের মাযহাব বর্ণনার পর পরবর্তী ফকীহগণের মধ্যে আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক (১১৮-১৮১ হি.) ও ইমাম ইসহাক ইবনে রাহূয়াহ রহা. (১৬১-২৩৮ হি.) এর নাম উচ্চারণ করে বলেছেন যে, এঁদেরও মাসলাক এটাই ছিল। (অর্থাৎ প্রত্যেক অঞ্চলের জন্য নিজ নিজ চাঁদ দেখাই ধর্তব্য) (আলইসতিযকার ১০/২৯)
ইসহাক ইবনে রাহূয়াহ রাহ.-এর মাসলাক সম্পর্কে আরো দেখুন : আলইশরাফ, ইবনুল মুনযির ৩/১১২; মাআলিমুস সুনান, খাত্তাবী ২/৮৪; শরহুস সুন্নাহ, বাগাভী ৪/১৪৫
এবার চার মাযহাবের ইমাম ও তাঁদের অনুসারী ফকীহগণের মাযহাব সম্পর্কে প্রয়োজনীয় আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ।
হানাফী মাযহাব
হানাফী মাযহাব সম্পর্কে মশহূর হয়েছে যে, এই মাযহাবের ‘‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’’ হল, ‘ইখতিলাফুল মাতালি’ (চাঁদের উদয়স্থলের বিভিন্নতা) ধর্তব্য নয়। অর্থাৎ যেকোনো জায়গার চাঁদ দেখা সব জায়গার জন্য ‘ওয়াজিবুল আমল’ অবশ্যপ্রযোজ্য। এমনকি পৃথিবীর পশ্চিম প্রান্তে চাঁদ দেখা গেলেও পূবের লোকদের জন্য তা অবশ্যগ্রহণীয়।
‘‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’’ শব্দবন্ধ থেকে মনে করা হয়েছে, এ মাসআলা সরাসরি ইমাম আবু হানীফা রা. থেকে বর্ণিত। অতপর এ ধারণাও করা হয়েছে যে, এটি যখন ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’ তখন এর বিপরীতে মাযহাবের অন্যান্য ফকীহ ও মাশাইখের কথা গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত নয়। কারণ ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’ তো সব কিছুর উপরে!!
পর্যালোচনা :
এ কথা স্বীকৃত যে, হানাফী মাযহাবের একাধিক কিতাবে চাঁদের উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য না হওয়াকেই মুফতা বিহী বলা হয়েছে। কেউ কেউ আরো বলেছেন যে, এটিই মাযহাবের অধিকাংশ মাশাইখের মাসলাক। কিন্তু ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’ কথাটির বিষয়ে বিনীত নিবেদন এই যে, হানাফী মাযহাবে ঐ সিদ্ধান্ত ‘জাহিরুর রিওয়াহ’ হওয়ার বিষয়টি সঠিক নয় এবং এ কথাও ঠিক নয় যে, এ মাসআলা (উদয়স্থলের বিভিন্নতা ধর্তব্য নয় এবং পশ্চিমের চাঁদ পূবের জন্যও অবশ্যগ্রহণীয়) ইমাম আবু হানীফা রাহ. থেকে সরাসরি বর্ণিত। তদ্রূপ এ ধারণাও ঠিক নয় যে, হানাফী মাযহাবে যায়লায়ী বা আলাউদ্দীন কাসানী ছাড়া এ সিদ্ধান্তের বিরোধী কেউ নেই। বরং হানাফী মাযহাবের অনেক ফকীহ, যারা মাযহাবের মনীষী ব্যক্তিত্ব এবং ফিকহ ও হাদীসে যাঁদের মাকাম যথেষ্ট উঁচু তাঁরা যায়লায়ী ও কাসানীর আগেই ঐ সিদ্ধান্তের বিপরীতে ফতোয়া দিয়েছেন।
আর বাস্তবে হানাফী মাযহাবের অনুসারীদের আমলও তাঁদেরই ফতোয়ার উপর, ঐ প্রসিদ্ধ মাসলাকের উপর নয়, যাকে ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’ মনে করা হয়েছে।
কেন এটি ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’ নয়
ফিকহ-ফতোয়ার সাথে সামান্য সম্পর্ক রাখে এমন তালিবে ইলমেরও জানা আছে যে, কোনো মাসআলাকে ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’ বলার অর্থ হয়, মাসআলাটি ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান রাহ.-এর ছয় কিতাবের এক কিতাবে আছে। কিতাবুল আসল (যার আরেক নাম ‘আলমাবসূত) আলজামিউস সগীর, আলজামিউল কাবীর, আসসিয়ারুস সগীর, আসসিয়ারুল কাবীর ও আযযিয়াদাত-এই ছয় কিতাবের কোনো কিতাবে আছে। যেহেতু এই কিতাবগুলো ইমাম মুহাম্মদ রাহ. থেকে ‘শুহরাত’ ও ‘ইস্তিফাযা’ সূত্রে বর্ণিত এবং মাযহাবের সকল ফকীহ্র কাছে ‘মুতালাক্কা বিলকবুল’ এবং সাদরে বরণীয় তাই এই কিতাবের মাসআলাসমূহের নাম ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’। অর্থাৎ এই সকল মাসআলা যে বর্ণনা-ধারায় এসেছে, তা শক্তিশালী ও প্রতিষ্ঠিত এবং ইমাম মুহাম্মাদ (হানাফী মাযহাবের মাসাইলের সংকলক ও আবু হানীফা -আবু ইউসুফের শাগরিদ) থেকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত।
পক্ষান্তরে নাদির রেওয়ায়েত (বহুবচন : নাওয়াদির) বলা হয়, যে মাসআলাগুলো এক দুই সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। সেই সূত্রগুলো বর্ণনাকারীর বিচারে সহীহ হলেও তা মাশহুরের পর্যায়ে পৌঁছেনি এবং জাহিরুর রিওয়ায়াহ’র মতো ‘মুতালাক্কা বিল কবুল’ও হয়নি। এ ধরনের মাসআলাগুলো সাধারণত ‘‘নাওয়াদির’’ এবং ‘‘আমালী’’ শিরোণামের কিতাবসমূহে পাওয়া যায়।
যাই হোক এখন আমাদের দেখার বিষয় এই যে, আলোচিত মাসআলা (চাঁদের উদয়স্থলের বিভিন্নতা ধর্তব্য নয়, পশ্চিমের চাঁদ পূবের লোকদের নিকট প্রমাণিত হলে তা অবশ্যগ্রহণীয়) উপরোক্ত ছয় কিতাবে আছে কি না।
আলহামদুলিল্লাহ ‘কিতাবুল আসল’ তো এখন বারো খন্ডে ছাপা হয়েছে। ‘আলজামিউস সগীর’ ও ‘আলজামিউল কাবীর’ আগে থেকেই ছাপা আছে। ‘আসসিয়ারুল কাবীর’, যা জিহাদের মাসাইল বিষয়ে, আলাদাভাবে আমাদের সামনে নেই, তবে ইমাম সারাখসী রাহ.-এর শরহের মধ্যে একীভূত হয়ে ‘শরহুস সিয়ালি কাবীর’ নামে মুদ্রিত হয়েছে। তেমনি আযযিয়াদাত’ কাযী খানের শরহের মধ্যে একীভূত হয়ে ‘শরহু যিয়াদাত’ নামে ছেপেছে। থাকল ‘আসসিয়ারুস সগীর’ (জিহাদের মাসাইলের উপর ছোট কিতাবটি) তো এ কিতাবের মাসাইল ‘কিতাবুল আসল’ ইমাম মুহাম্মাদ রাহ., ও ‘আররাদ্দু আলা সিয়ারিল আওযায়ী’, ইমাম আবু ইউসুফ এ বিদ্যমান আছে। সুতরাং এখন যে কোনো আলিম এ মাসআলা উপরোক্ত কিতাবসমূহে তালাশ করতে পারেন। আমরা সবগুলোতেই তালাশ করেছি, কোনো কিতাবে এমন কেনো মাসআলা পাইনি। কোনো ভাই যদি ঐ কিতাবসমূহ থেকে এ মাসআলা বের করে দেন তবে আমরা তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব।
শুধু এই নয় যে, ঐ সকল কিতাবে এ মাসআলা আমরা পাইনি। শুধু এটুকু হলে নিশ্চিতভাবে বলতাম না যে, এ মাসআলা ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’ নয়। কারণ হতে পারে, উপরোক্ত কিতাবসমূহের কোনো মাখতূতা (হস্তলিখিত পান্ডুলিপিতে) এ মাসআলা আছে, যা মুদ্রিত নুসখাসমূহে আসেনি। হতে পারে সেই নির্ভরযোগ্য মাখতূতার ভিত্তিতেই আমাদের পরবর্তী কোনো কোনো ফকীহ এ মাসআলাকে ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’ বলেছেন।
এই সম্ভাবনার উপর অনেক চিন্তা-ভাবনা করা হয়েছে। এ কারণে এ মাসআলা ফিকহে হানাফীর প্রাচীন সূত্রগুলোতে তালাশ করা হয়েছে, বিশেষভাবে ঐ কিতাবগুলো বারবার মুতালাআ করা হয়েছে, যা জাহিরুর রিওয়ায়াহর মাসাইল গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করে কিংবা মূলত যা ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’-এর মাসাইল সংকলনের জন্য লেখা হয়েছে। কিন্তু ঐ সকল কিতাবেও এ মাসআলা পাওয়া যায়নি। এবং আবু হানীফা রাহ. আবু ইউসুফ রাহ. মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান রাহ. কারো যবানীতেই এমন কোনো কথা আমরা পাইনি যে
لا عبرة لاختلاف المطالع
(উদয়স্থলের বিভিন্নতা ধর্তব্য নয়)।
আর না তাঁদের কারো উদ্ধৃতিতে এ কথা পেয়েছি যে-
لو رأى أهل المغرب هلال رمضان يجب الصوم على أهل المشرق
(পশ্চিম প্রান্তে চাঁদ দেখা গেলে পুবের লোকদের উপরও রোযা ফরয হয়ে যাবে।) এ ধরনের কোনো কিছুই এসব কিতাবে মাযহাবের মূল ইমামদের বা পূর্ববর্তী কোনো ফকীহর উদ্ধৃতিতে পাওয়া যায়নি।
উদাহরণস্বরূপ : ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’-এর মাসাইলের জন্য সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য কিতাব হাকিম শহীদ রাহ. (৩৩৪ হি.)-এর ‘মুখতাসারুল কাফী’ যার ভাষ্য লিখেছেন ইমাম সারাখসী রাহ. ‘আলমাবসূতে’ যা ত্রিশ খন্ডে প্রকাশিত। আমরা এ মাসআলা সারাখসীর আলমাবসূতেও পাইনি।
‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’র মাসাইলের এক নির্ভরযোগ্য সংকলন ইমাম বুরহানুদ্দীন মাহমুদ বিন সদরুস শরীয়া (৫৫১-৬১৬ হি.)-এর ‘আলমুহীতুল বুরহানী’’। যা কয়েক বছর আগে বৈরুত থেকে ইদারাতুল কুরআন করাচীর পক্ষ থেকে ২৫ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে। এ কিতাবের প্রত্যেক পরিচ্ছেদে লেখক প্রথমে ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’-এর মাসাইল উল্লেখ করেছেন, এরপর ‘নাদির রিওয়ায়াত’ ও ‘ফাতাওয়া মাশাইখ’ উল্লেখ করেছেন। ভূমিকায় তিনি বলেছেন-
وجمعت مسائل المبسوط، والجامعين والسير، والزيادات، وألحقت مسائل النوادر والفتاوى والواقعات ... .
আমি এতে মাবসূত (কিতাবুল আসল) দুই জামি (অর্থৎ আলজামিউল কাবীর আলজামিউস সগীর), সিয়ার ও যিয়াদাতের মাসআলাসমূহ একত্র করেছি। এরপর এর সাথে নাওয়াদির, ফাতাওয়া ও ওয়াকিয়াত (ঐ সময়ের নতুন মাসাইল) শ্রেনীর মাসাইল যোগ করেছি ...।’ (আলমুহীতুল বুরহানী ১/১৫৯)
তো এ কিতাবেও ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’র বরাতে এ মাসআলা উল্লেখিত হয়নি; বরং এ কিতাবের তৃতীয় খন্ডে (পৃষ্ঠা : ৩৪১) এ বিষয়ের আলোচনাই শুরু হয়েছে এভাবে-
أهل بلدة إذا رأوا الهلال هل يلزم ذلك في حق أهل بلدة أخرى؟ اختلف المشايخ فيه.
কোনো শহরের অধিবাসীরা যখন চাঁদ দেখবে তখন কি তাদের চাঁদ দেখা অন্য শহরের অধিবাসীদের জন্যও অবশ্যগ্রহণীয় হবে? এ বিষয়ে মাশাইখের ইখতিলাফ আছে ...।’ তো কথা শুরুই হচ্ছে মাশাইখের বরাতে। এরপর তিনি ইখতিলাফ উল্লেখ করেন, যা সামনে তাঁরই ভাষায় উল্লেখ করা হবে ইনশাআল্লাহ।
এখন শুধু এটুকু বলা উদ্দেশ্য যে, এ কিতাবে ইমাম মুহাম্মাদের ছয় কিতাবের বরাতে বা ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’ শিরোণামে ঐ মাসআলার নাম-নিশানাও নেই, যা হানাফী মাযহাবের ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’ বলে মশহূর হয়ে গেছে।
মুখতাসারুত তহাবী (৩২১ হি.), মুখতাসারুল কারখী (৩৪০ হি.) মুখতাসারুল কুদুরী (৪২৮ হি.), বিদায়াতুল মুবতাদী (৫৯৩ হি.) (হেদায়া যার শরহ-ভাষ্যগ্রন্থ), তুহফাতুল ফুকাহা, আলাউদ্দীন সমরকন্দী (৫০৮ হি.)-এ কিতাবগুলোও জাহিরুর রিওয়ায়াহর মাসাইলের বিশেষ সূত্র হিসেবে গণ্য। কিন্তু এসব কিতাবেও এ মাসআলা আমরা পাইনি।
আলমুহীতুল বুরহানীর মতো জাহির রেওয়ায়েতের মাসআলার জন্য রযীউদ্দীন সারাখসী রাহ. (৫৪৪ হি.)-এর কিতাব ‘আলমুহীতুর রাযাভী’ এবং ইউসুফ ইবনে আলী আল জুরজানী রাহ.-এর কিতাব ‘খিযানাতুল আকমাল’ও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের জানামতে, এই দুই কিতাব এখনো ছাপেনি। তবে আল্লাহর শোকর, এগুলোর মাখতূতা থেকে এই মাসআলা তাহকীক করার তাওফীক আল্লাহ তাআলা দিয়েছেন। তাহকীক দ্বারা জানা গেছে যে, এগুলোতেও এই মাসআলা জাহির রেওয়ায়েতের শিরোণামে বা ইমাম মুহাম্মাদের ঐ ছয় কিতাবের বরাতে নেই।
‘খিযানাতুল আকমাল’ ফিকহে হানাফীর মাসাইলের গুরুত্বপূর্ণ সংকলন। এর ‘মাখতূতা’ (হস্তলিখিত পান্ডুলিপি) ইস্তাম্বুলের ‘মাকতাবায়ে ফয়যুল্লাহ’য় সংরক্ষিত আছে। ফটোকপি আছে জামেয়া উম্মুল কুরা মক্কা মুকাররমার কুতুবখানায়। আমাকে এ নুসখা সম্পর্কে জানিয়েছেন আমার শাগরিদ মাওলানা তাহমীদুল মাওলা। এরপর আমি শায়খ ত্বহা হোসাইন ইবনে দানিশকে (মুকীম, মক্কা মুকাররমা) অনুরোধ করি, তিনি যেন এ নুসখা থেকে অন্তত কিতাবুস সওমের অংশ কপি করে পাঠান। আল্লাহ তাআলা তাঁকে জাযায়ে খায়ের দান করুন, তিনি তা পাঠিয়েছেন।
খিযানাতুল আকমালের ভূমিকায় লেখক নিজে এর ধারাবাহিক বিন্যাস উল্লেখ করেছেন যে, প্রথমে তিনি মুখতাসারুল হাকিম শহীদ এর মাসাইল (যা মূলত ইমাম মুহাম্মাদ রহ.-এর ‘কিতাবুল আসলে’র মাসাইলের সংকলন) উল্লেখ করবেন। অতপর ‘আলজামিউল কাবীর’ ও ‘আল জামিউস সগীর’-এর মাসাইল উল্লেখ করবেন। এরপর হাসান বিন যিয়াদ এর ‘আল মুজাররাদ’, ‘আল মুনতাকা’, ‘আল কারখী’ ‘শরহুত তহাবী’, উয়ূনুল মাসাইল, আবুল লাইছের ‘মুখতালিফ’ আল খাস্সাফের ‘আদাবুল কাযী’ আন নাতিফির ‘আল আজনাস’, ‘আররওযা’ ও ‘আল ফাতাওয়া’, ফাতাওয়াল বাক্কালী, ফাতাওয়া আবিল লাইছ ও ফাতাওয়াল কাযী সায়িদ-এর মাসাইল উল্লেখ করবেন।
ভূমিকার শেষে এ-ও লিখেছেন যে, এ কিতাব লেখা শুরু হয়েছে ৫২২ হি. ঈদুল আযহার দিন।
এই সমৃদ্ধ ও বরকতপূর্ণ কিতাব থেকে সাওমের অংশ পাঠ করলাম কিন্তু এতে ঐ দুটি কথা (উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য নয় বা পশ্চিমের চাঁদ দেখা পূর্বের অধিবাসীদের জন্য অবশ্য অনুসরণীয়) না জাহিরুর রিওয়ায়াহর কোনো কিতাবের উদ্ধৃতিতে, না নাদির রেওয়ায়েতের কোনো কিতাবের উদ্ধৃতিতে আছে, না উল্লেখিত অন্য কোনো কিতাবের বরাতে।
এই বাস্তবতা সামনে রেখে চিন্তা করলে খুব সহজেই উপলব্ধি করা যায় যে, ‘উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য নয়’ বা ‘পশ্চিমের চাঁদ দেখা পূর্বের অধিবাসীদের জন্য অবশ্যঅনুসরণীয়’ এই দুই কথার কোনোটি না জাহির রেওয়ায়েতের কিতাবসমূহে আছে, না নাদির রেওয়ায়েতের কিতবাসমূহে,আর না খিযানাতুল আকমালের ভূমিকায় উল্লেখিত বুনিয়াদী কিতাবসমূহে। তদ্রূপ না তা আছে তহাবীর আলমুখতাসার’ বা তার শরাহ-গ্রন্থে,আর না কারখীর কিতাবে।
‘‘খিযানাতুল আকমলে’র একটি নুসখা হিন্দুস্তানের মাকতাবায়ে রেযা রামপুরেও আছে। দারুল উলূম দেওবন্দের তালিবে ইলম মাওলানা মোশতাক আহমাদ আমার অনুরোধে রামপুর সফর করে এ মাখতূতা দেখেছেন এবং সংশ্লিষ্ট পৃষ্ঠাগুলো আমার জন্য সংগ্রহ করেছেন। তাতেও এ ধরণের কোনো কথা নেই।
এবার ‘আলমুহীতুর রাযাভী’র কথা শুনুন। এ কিতাবের আরেক নাম ‘মুহীতুস সারাখসী’। এর একটি মাখতূতা করাচীর প্রসিদ্ধ মাদ্রাসা আহসানুল উলূম গুলশান ইকাবলের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক হযরত মাওলানা যারওয়ালী খান ছাহেবের কুতুবখানায় আছে। জামেয়াতুর রশীদ করাচীর উস্তাজ মাওলানা জহীরুদ্দীন বাবর ছাহেব আমার অনুরোধে এ মাখতূতার সংশ্লিষ্ট পৃষ্ঠাগুলোর নকল আমার জন্য পাঠিয়েছেন। এতেও একই অবস্থা। ‘উদয়স্থলের বিভিন্নতা ধর্তব্য না হওয়া’ বা পশ্চিমের চাঁদ পূবের লোকদের জন্যও অবশ্যঅনুসরণীয় হওয়া’ কোনো কথাই না জাহিরুর রিওয়ায়াহর বরাতে আছে, না নাদির রেওয়ায়েতের বরাতে।
সারকথা দাড়াচ্ছে, জাহির রেওয়ায়েতের ছয় কিতাবে বা পরের যে সকল কিতাবে জাহির রেওয়ায়েতের মাসাইল সংকলন হয়েছে, তার কোনোটিতেই আমার জানা মতে ‘উদয়স্থলের বিভিন্নতা ধর্তব্য নয়’, বা পশ্চিমের চাঁদের কারণে পূবের লোকদের উপর রোযা ওয়াজিব হবে, এ ধরণের কোনো কথা নেই।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ কথাগুলোকে ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’-এর মাসআলা কে বলেছেন, কীভাবে বলেছেন -এ বিষয়টিই আগামী শিরোণামগুলোর বিষয়বস্ত্ত।
‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’ প্রসঙ্গ কীভাবে এল
অনুসন্ধানে যদ্দূর জানা গেছে, এ কথা সর্বপ্রথম (আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন) আল্লামা তাহির ইবনে আহমদ ইবনে আবদুর রশীদ আলবুখারী রাহ.-এর কিতাব ‘খুলাসাতুল ফাতাওয়া’ থেকে শুরু হয়েছে। ওখান থেকে আল্লামা হাসান বিন মানসূর কাযী খান রাহ. তাঁর ‘ফাতাওয়া’য় নিয়েছেন (যা খানিয়া নামে প্রসিদ্ধ)। এরপর এ দুজনের উপর নির্ভর করে পরের অনেক মুসান্নিফ এ কথা লিখেছেন। কেউ তাদের বরাত দিয়েছেন, কেউ দেননি। এভাবেই কথাটি মশহূর হয়ে গেছে।
তাহির বিন আহমদ বিন আবদুর রশীদ রাহ.-এর জন্ম ও মৃত্যুসন ‘আততাবাকাতুছ ছানিয়্যা’ এবং এর বরাতে ‘আলজাওয়াহিরুল মুযিয়্যাহর’ (২/২৭৬) হাশিয়ায় উল্লেখিত হয়েছে। তাঁর জন্ম ৪৮১ বা ৪৮২ হিজরীতে আর মৃত্যু ৫৪২ হিজরীতে। কাশফুয যুনূনে (খন্ড : ১, পৃষ্ঠা : ৭০৩) তাঁর কিতাব ‘খিযানাতুল ওয়াকিয়াত’’ এর আলোচনায় তাঁর মৃত্যুসন ৫৪২ হিজরীই লেখা হয়েছে।
কাযী খান রাহ. ছিলেন ছাহিবে হিদায়ার সমসাময়িক। ছাহিবে হিদায়ার জন্ম ৫১১ হিজরীতে, মৃত্যু ৫৯৩ হিজরীতে। কাযী খান রা.-এর মৃত্যুসন তো ঐতিহাসিকগণ ৫৯২ হিজরী লিখেছেন, কিন্তু জন্মসন উল্লেখ করেননি। অনুমান করা যায়, তার জন্মও ৫১০ হি. থেকে ৫২০ হিজরীর মধ্যেই হবে।
আলফাওয়াইদুল বাহিয়্যা (পৃষ্ঠা : ৮৪) অনুযায়ী কাফাভী রাহ. ‘কাতাইবু আলামিল আখবার’’ গ্রন্থে লিখেছেন যে, তাহির ইবনে আহমদ ইবনে আবদুর রশীদ রাহ. কাযী খান থেকে ইলম হাসিল করেছেন। এটা অসম্ভব নয়। বড় ছোটর থেকে, সমবয়সী সমবয়সী থেকেও ইলম গ্রহণ করে থাকে, কিন্তু উপরোক্ত সন-তারিখ সামনে রাখলে এই ধারণা সমর্থন করা কঠিন হয় যে, কাযী খান ‘খুলাসা’ লেখকের উস্তাজ! ‘খুলাসাতুল ফাতাওয়া’ ও ফাতাওয়া কাযী খান মিলিয়ে পড়লে অনুমিত হয়, কাযী খানের সামনে ‘খুলাসাতুল ফাতাওয়া’ ছিল এবং তিনি ঐ কিতাবের বিন্যাস ও উপস্থাপনা থেকেও ফায়দা হাসিল করেছেন। যাই হোক, তাঁদের মধ্যে যেই-যার থেকে গ্রহণ করে থাকুন, ইখতিলাফে মাতালি (উদয়স্থলের বিভিন্নতা) ধর্তব্য না হওয়াকে যে হানাফী মাযহাবের ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’ বলা হয়েছে সেটা একজন অপরজনের উপর নির্ভর করেই লিখেছেন। আর পরের অনেক লেখক এই দুজনের উপর বা তাদের কোনো একজনের উপর নির্ভর করে লিখেছেন। উপরের কিতাবসমূহ খুলে এবং সরাসরি ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’র ছয় কিতাব দেখে বরাত পরীক্ষা করার সুযোগ হয়নি বা তার প্রয়োজন বোধ করেননি। মোটকথা, এ এক ‘তাসামুহ’ (ভ্রম)। প্রকৃত অবস্থা জানার পর একে বুনিয়াদ বানানো মুনাসিব নয়।
‘খুলাসাতুল ফাতাওয়া’র আরবী পাঠ এই-
ولو صام أهل بلدة ثلثين يوما للرؤية، وأهل بلدة أخرى تسعة وعشرين يوما للرؤية، فعليهم قضاء يوم، ولا عبرة لاختلاف المطالع في ظاهر الرواية، وعليه فتوى الفقيه أبي الليث، وبه كان يفتي شمس الأئمة الحلواني، قال : لو رأى أهل المغرب هلالَ رمضان يجب الصوم على أهل المشرق، وفي التجريد : اعتبر اختلاف المطالع.
কোনো শহরের অধিবাসীগণ যদি চাঁদ দেখে ত্রিশদিন রোযা রাখে আর অপর শহরের অধিবাসীগণ চাঁদ দেখে উনত্রিশ রোযা রাখে তাহলে তাদেরকে একটি রোযা কাযা করতে হবে, আর চাঁদের উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য নয়, জাহিরুর রিওয়ায়াহ অনুসারে। এরই উপর ফকীহ আবুল লাইছের ফতোয়া। আর এরই ফতোয়া দিতেন শামসুল আইম্মা হালওয়ানী। তিনি বলেন, পশ্চিমের অধিবাসীগণ যদি রমযানের চাঁদ দেখে তাহলে পূবের অধিবাসীদের উপর রোযা ওয়াজিব হয়। আর তাজরীদে আছে, উদয়স্থলের বিভিন্নতা ধর্তব্য হবে। (খুলাসাতুল ফাতাওয়া ১/২৪৯)
আর খানিয়ায় এভাবে লেখা
ولو صام أهل بلدة ثلاثين يوما للرؤية، وأهل بدلة أخرى تسعة وعشرين يوما للرؤية، فعلم من صام تسعة وعشرين يوما فعليهم قضاء يوم، ولا عبرة لاختلاف المطالع في ظاهر الرواية، وكذا ذكر شمس الأئمة الحلواني رحمه الله تعالى.
(আলখানিয়া ১/১৯৮, ফাতাওয়া আলমগীরীর সাথে মুদ্রিত নুসখা)
উভয় ইবারতে ভালোভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে:
ক. খুলাসা, খানিয়া দুই কিতাবেই কথা শুরু হয়েছে এই মাসআলা থেকে যে, যে শহরের অধিবাসীরা ২৯ রোযা রেখেছেন তাদের কাছে যদি প্রমাণিত হয় যে, অন্য শহরের অধিবাসীরা চাঁদ দেখার ভিত্তিতে ৩০ রোযা রেখেছেন তাহলে ২৯ রোযাওয়ালাদের উপর এক রোযা কাযা করা জরুরি হবে। যারা ইবারতের অর্থ বোঝার ক্ষেত্রে ত্বরা করেন তারা খুলাসা-খানিয়ার ইবারত থেকে এ ধারণাও করতে পারেন যে, লেখকদ্বয় এ মাসআলাকেও ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’ -এর মাসআলা বলেছেন। অথচ তা নয়। ঐ ইবারতে في ظاهر الرواية কথাটিকে এ মাসআলার সাথে যুক্ত মনে করা ভিত্তিহীন। আর বাস্তবতাও এই যে, মাসআলাটি ‘নাওয়াদির’ (নাদির রেওয়ায়েত)-এর, ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’ -এর নয়। বিষয়টি সামনে বরাতসহ আসছে।
খ. নাদির রেওয়ায়েতের এ মাসআলায় এ কথার উল্লেখ নেই যে, দূরে দূরের দুই শহরের ক্ষেত্রে এই বিধান, না কাছাকাছি দুই শহরের ক্ষেত্রে। ফিকহে হানাফীর একাধিক নির্ভরযোগ্য কিতাবে ও বড় বড় অনেক ফকীহের বক্তব্যে একথার উল্লেখ আছে যে, এ বিধান কাছাকাছি অঞ্চলসমূহের ক্ষেত্রে