শাওয়াল ১৪৩৪   ||   আগস্ট ২০১৩

হযরত মাদানী রাহ. কক্ষনো ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী ছিলেন না

- হযরত মাওলানা কাজী মু’তাসিম বিল্লাহ রাহ.

ইন্তেকালের প্রায় সাড়ে তিন মাস আগে বর্ষীয়ান আলেমে দ্বীন মাওলানা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ রাহ.-এর একটি একান্ত সাক্ষাৎকার মাসিক আলকাউসার-এর জন্য গ্রহণ করেন বিশিষ্ট লেখক-আলেম মাওলানা আবু সাবের আবদুল্লাহ।

অনুলিখন তৈরি ও অন্যান্য প্রস্ত্ততি শেষে সাক্ষাৎকারটি যখন প্রকাশের জন্য প্রস্ত্তত ছিল, আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা, তখনই তিনি মাওলার ডাকে সাড়া দিয়ে এই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন। সে সাক্ষাৎকারটি এ সংখ্যায় প্রকাশ করা হলো।

বিভিন্ন প্রসঙ্গ ও ইস্যু নিয়ে কয়েক দফায় একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার গ্রহণের প্রক্রিয়ায় বক্ষমান সাক্ষাৎকারটি ছিল প্রাথমিক ও একটি মাত্র প্রসঙ্গ কেন্দ্রিক। সেজন্য এতে কেবল ধর্মনিরপেক্ষতাইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কিত প্রশ্নোত্তরগুলো স্থান পেয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে এতে গুরুত্বপূর্ণ বহু দিকনির্দেশনা রয়েছে।

পরবর্তীকালে হযরত মরহুমের অসুস্থতা ও সময়ের সমন্বয়ের অভাবে সাক্ষাৎকারটিকে আর দীর্ঘ করা যায়নি। আমরা হযরত মরহুমের জন্য দুআর দরখাস্ত করছি এবং এ সাক্ষাৎকারটি গ্রহণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে মুবারকবাদ জানাচ্ছি।-সম্পাদক

আবু সাবের : আসসলামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ

কাজী সাহেব : ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।

আবু সাবের : আজ আমরা হুজুরের খেদমতে হাজির হয়েছি বিশেষ কিছু প্রশ্নের সমাধান জানার জন্য। বর্তমান প্রেক্ষাপটে তা জানা এবং অন্যদেরকে জানানো একান্ত জরুরী। আশা করি হুজুর আমাদের আরজি পূরণ করবেন।

কাজী সাহেব : এখন শরীরও ভালো না। দুনিয়াতে থেকেও আছি কবরে। তবু ইলমের আমানত আপনজনদের হাওয়ালা করার নিয়তে কিছু বলার চেষ্টা করবো, ইনশাআল্লাহ।

আবু সাবের : আল্লাহ তাআলা আমাদের মজলিসকে কবুল করুন, উম্মতের জন্য ফায়দামন্দ বানান। আমীন।

হুজুরের কাছে আমাদের প্রথম জানতে চাওয়া হলো, ইসলাম পূর্ণাঙ্গ দ্বীন-একথার মতলব কী?

কাজী সাহেব : জিন্দেগীর সকল স্তরে যদি কেউ ইসলামের বিধান অনুসরণ করতে চায়, তাহলে সে ইসলামের বিধান উপস্থিত পাবে। ইসলামের প্রশস্ততা এতই ব্যাপক। এই হলো ইসলাম পূর্ণাঙ্গ দ্বীন হওয়ার অর্থ।

আবু সাবের : ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র সকল স্তরেই সে ইসলামের বিধান উপস্থিত পাবে?

কাজী সাহেব : হাঁ, শাহ ওয়ালী উল্লাহ রাহ. এভাবে বলেছেন, তাহযীবে আখলাক, তাদবীরে মানযিল, সিয়াসতে মুদুন ইত্যাদি।

আবু সাবের : ইসলাম একটি অসাম্প্রদায়িক ধর্ম-একথার তাৎপর্য সম্পর্কে একটু বলুন।

কাজী সাহেব : ধর্মের নামে কারো উপর অপঘাত করার সুযোগ নেই। লা-ইকরাহা ফিদ্দীন। ইসলাম গ্রহণে জবরদস্তি নেই।

আবু সাবের : জিহাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমাদের কিছু বলুন।

কাজী সাহেব : লি তাকূনা কালিমাতুল্লাহি হিয়াল উলইয়া। যেন আল্লাহর কালিমা বুলন্দ হয়। রাষ্ট্রীয় কর্তর্ৃত্ব যেন হয় ইসলামের, আল্লাহর দ্বীনের।

আবু সাবের : সত্য ধর্ম হিসেবে ইসলামের বিজয় ও কর্তৃত্বের গুরুত্ব কতটুকু?

কাজী সাহেব : অবশ্যই মাতলুব। অবশ্যই কাম্য।

আনোয়ার শাহ : জিহাদ ও যুদ্ধের মাঝে পার্থক্য-রেখা টানা যায় কীভাবে?

কাজী সাহেব : জিহাদ হলো দাওয়াত ও তাবলীগের চূড়ান্ত রূপ। আর যুদ্ধ নিছক স্বার্থগত আধিপত্য বিস্তারের একটি প্রক্রিয়া।

আনোয়ার শাহ : বর্তমানে যে জিহাদকে সন্ত্রাস বলা হচ্ছে?

কাজী সাহেব : এটা একদম গলত্ কথা। অবশ্য যারা জিহাদ করার দাবী করছে, তারা ইসলামের নীতি অণুসরণ করছে কি না তা ভাবার বিষয়। যেমন জিহাদের জন্য আমীর প্রয়োজন। কুওয়াতে কাহেরা প্রয়োজন। অনেক ক্ষেত্রে এগুলি থাকে না। ফলে বিচ্ছিন্ন শক্তি প্রয়োগ ব্যর্থ হয় এবং বিশৃঙ্খলার রূপ পরিগ্রহ করে। সমস্যা আরও প্রকট হয়।

আবু সাবের : ইসলামী খেলাফত বা ইসলামী সিয়াসত ও কাযা-এগুলো ইসলামী শরীয়তের অংশ, এ ব্যাপারে আপনার মতামত বলুন?

কাজী সাহেব : অবশ্যই এগুলো শরীয়তের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এতে কোনো সন্দেহ নেই।

আবু সাবের : তাহলে এখন খেলাফত ও কাযা প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের দ্বীনী ফরীজা কী? ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা করা, খেলাফত আলা মিনহাজিন নবুওয়াহ কায়েমের চেষ্টা করা, ইসলামের আইন ও বিচার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা, যেন আমাদের আদালতগুলো ইসলাম অনুসারে চলে, তার জন্য সামর্থ্য অনুযায়ী চেষ্টা করা সকলের দায়িত্ব বলে মনে করেন কি?

কাজী সাহেব : মাওলানা মাহমুদ মাদানী মাদ্দা যিল্লুহুল আলীর সাথে এক হিন্দু পন্ডিতের বিতর্ক হয়েছিল। হিন্দু পন্ডিত প্রশ্ন করলো, তোমরা যখন সংখ্যালঘু থাক, তখন সেক্যুলারিজামের খুব বড় প্রবক্তা হয়ে যাও। দুর্বল অবস্থায় এই মতবাদের পক্ষ নাও। কিন্তু তোমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলে ইসলামী খেলাফতের দাবী তোলো, কারণ কী? উত্তরে মাওলানা জিহাদ কাকে বলে বুঝাতে গিয়ে বললেন, আমি যে জিনিসকে হক মনে করছি সেটার দাওয়াত ও তাবলীগ আমি করে যাবো। আল্লাহও আমাকে এর হুকুম করেছেন। আমরা এর দাওয়াতকে উম্মতের খায়েরখাহী মনে করি এবং প্রতিবেশী ভাই ও বোনকে তাতে শরিক করে নেওয়া কল্যাণকর বলে বিশ্বাস করি। এখন এই করতে গেলে কেউ যদি আমার গলা টিপে ধরে, তাহলে আমিও শক্তি প্রয়োগ করে ঐ হাত সরিয়ে দিতে বাধ্য হবো। এমনি আমি কারো উপর হস্তোত্তলন করতে চাই না। আমি শান্তিপূর্ণভাবে দাওয়াতে ইসলামের কাজ করতে চাই। তুমি এসে আমার গলা টিপে ধরবে, তাহলে আমি শক্তি প্রয়োগ করে ঐ হাত সরিয়ে দিবো। সরাতে গিয়ে তোমার হাত ভাঙলে ভাঙ্গুক, থাকলে থাকুক। এটা এক প্রকার জিহাদ। এভাবে দাওয়াতের মাধ্যমে যদি মুসলমান মেজরিটি হয়ে যায়, তাহলে তো বর্তমান যুগের গণতন্ত্র অনুসারেই ইসলামের পক্ষে ভোট এসে যাবে। তখন স্বাভাবিকভাবে ইসলামের আইন ও কাযা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। এভাবে আমরা খেলাফতের দাবি তুলে থাকি।

আবু সাবের : আমাদের বাংলাদেশে তো মুসলিম মেজরিটি আছে। কাজেই আমাদের জন্য, আমাদের উলামায়ে কেরাম ও সাধারণ মুসলমানদের জন্য একথা বলা বা চেষ্টা করা একান্ত কর্তব্য যে, এদেশে আমরা খেলাফত কায়েম করতে চাই। আইন যেন ইসলামের কাযা অনুসারে হয় এজন্য আমরা আওয়াজ তুলতে চাই। আপনি বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এটাকে শরঈ দায়িত্ব বলে মনে করেন কি?

কাজী সাহেব : আসল সমস্যাটা হলো  মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটি বিভিন্নভাবে এই মতের প্রসার ঘটিয়ে ফেলেছে যে, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা হয়েছে  ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার উপর। সেক্যুলারিজমের উপর।

আবু সাবের : স্বাধীনতা সংগ্রাম তো হয়েছে জুলুমের বিরুদ্ধে। জালিমের বিরুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার জন্য। তখন ওরা জালিম ছিল। আমরা মাজলুম ছিলাম।

আনোয়ার শাহ : মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে আমরা বুঝি যে, দেশটা পরাধীনতা থেকে স্বাধীন হোক। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা এজন্য লড়েছেন যে, এদেশে একটি শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা কায়েম হবে। এটাইতো ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।

কারণ, মুক্তিযুদ্ধের কোনো শ্লোগানেই ধর্মনিরপেক্ষতার কথা ছিল না। এটা এসেছে স্বাধীনতার পর এবং তা রাশিয়ার প্রভাবে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও আওয়ামী লীগ উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য, সাবেক প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী বলেছেন, বামপন্থীরা শেখ সাহেবের উপর সওয়ার হয়ে আমাদের উপর ধর্মনিরপেক্ষতা চাপিয়ে দিয়েছে। তারা বুঝিয়েছে, রাশিয়ার সমর্থন না থাকলে আমাদের দেশ স্বাধীন হওয়া কঠিন ছিল। এজন্য  ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা এবং ধর্মহীন রাশিয়ার শক্তিশালী সমর্থনের কারণে যেহেতু দেশ স্বাধীন হয়েছে, তাই রুশপন্থী বামেরা ধর্মনিরপেক্ষতা আমদানী করতে পেরেছে। এবং তারা শেখ সাহেবকে মানিয়ে নিতেও সমর্থ হয়েছে। এ কারণে ঐ সময় আলেমগণ এর প্রতিবাদ করেছিলেন। তাছাড়া যে ছয়দফা দাবীর প্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে তাতেও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা নেই।

আহমদ মায়মূন : সংবিধান তৈরি হয়েছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর। সেখানেই এই বিষয়টা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

আবু সাবের : পাকিস্তানের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মুফতি মাহমুদ রহিমাহুল্লাহু বলেছেন, বাঙ্গালী মাজলুম হ্যায়। তার এই কথার মাঝেই মুক্তিযুদ্ধের কার্যকারণ নিহিত আছে। আমাদের যুদ্ধ ছিল জুলুমমুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য। ধর্মহীনতার জন্য নয়। তাছাড়া আওয়ামী লীগের সত্তরের নির্বাচনী ইশতেহারে ইসলাম বিরোধী কোন আইন করা হবে না - এ ধারাটির কারণেই তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করেছিল। আর ইসলামের পক্ষের এ জনমত উপেক্ষা করার কারণে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। 

কাজী সাহেব : হাঁ, এরকমই হওয়ার কথা।

আবু সাবের : সে যাই হোক  এই দেশের মেজরিটি হলো মুসলমান। কাজেই মুসলিম মেজরিটির দেশে এখন ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠার দাবি করা এবংখেলাফতের জন্য চেষ্টা করা অসঙ্গত হবে না। এটা যে আমাদের ঈমানী দায়িত্ব সেতো আপনি আগেই বলেছেন। এখন সেটা কীভাবে হবে, সে সম্পর্কে বলুন।

কাজী সাহেব : সেটা দাওয়াত ও তাবলীগের মাধ্যমে হবে।

আবু সাবের : দাওয়াত ও তাবলীগের মাধ্যমে তো নামায-রোযাই শুধু হবে। প্রচলিত দাওয়াতে তো দ্বীন প্রতিষ্ঠার সামগ্রিক রূপরেখা নেই। প্রচলিত পন্থায় পূর্ণাঙ্গ দ্বীনের দাওয়াত দেওয়াও হয় না।

কাজী সাহেব : কেন? শুধু নামায ও রোযার হবে কেন? দাওয়াত পূর্ণাঙ্গ দ্বীনের হবে। সবটার দাওয়াত দিতে হবে। যাদের দাওয়াত অতটুকুতে সীমাবদ্ধ এবং ঐভাবেই যারা দাওয়াতের কাজ করে তারাই তাবলীগী, অন্যরা নয়, এটা কে বললো? অবশ্য এতটুকু যারা করছে তারাও কম করছে না। এটাও আমাদের কাজ। আমরা একে খাটো করে দেখতে চাই না।

আবু সাবের : তার মানে হুজুর কি বুঝাতে চাচ্ছেন যে, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য জনমত গঠন করা, ইসলামের পক্ষে ভোট চাওয়া এটাও এক প্রকার দাওয়াত? এই যে বিভিন্ন ইসলামী সংগঠন দাওয়াতী সপ্তাহ পালন করে। কর্মী সংগ্রহ করে। জনগণকে ইসলামী খেলাফতের গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টা করে। ইসলামী রাষ্ট্র এবং কাযা প্রতিষ্ঠার এই দাওয়াতকে হুজুর তাহলে আমাদের জন্য ফরীজা বলে মনে করেন?

কাজী সাহেব : হ্যাঁ, তাই। তবে বাংলাদেশে দাওয়াতরতদের অনেকের কর্মধারা আমার পছন্দ নয়।

আবু সাবের : সে থাক। আপনি তো বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আগে জমিয়তের ব্যানারে এই দাওয়াতের অগ্রপথিক ছিলেন। মুফতী মাহমুদ রহিমাহুল্লাহর সঙ্গে আপনি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছেন। তৎকালীন সরকারকে আপনারা প্রেসার দিয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশ হওয়ার পর দাওয়াতের এই ময়দানে আপনি কাজ করা এক রকম ছেড়েই দিয়েছেন। আপনি কি বাংলাদেশ হওয়ার আগের ও পরের অবস্থার মাঝে কোনো পার্থক্য অনুভব করেন?

কাজী সাহেব  : হ্যাঁ, এখন আপনি যাদের জন্য করবেন, যাদের নিয়ে করবেন, সেই অভাগারাই সেটা চায় না। আফসোস এখানে!

আবু সাবের : চায় না তো না জানার কারণে। আগের চেয়ে এখন মানুষের মাঝে দ্বীনী চেতনা কমে যাচ্ছে বলে।

কাজী সাহেব : মুসলমানদেরকে চাওয়াইতে হবে। একজন মসুলমানকে আমি বলবো না যে, তুমি ইসলামী আইন-কানুনের অনুসরণ করো, তা কি করে হয়!

আবু সাবের : হ্যাঁ, ঠিকই।

কাজী সাহেব : কিন্তু এই না যে, এটা করতে গিয়ে মারামারি-হানাহানি করতে হবে। গণবিচ্ছিন্নভাবে কেউ দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে।

আবু সাবের : না না, তা না। দায়িত্ব হলো শান্তিপূর্ণভাবে গণমুখী উপায়ে খেলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা। এটা আমাদের দ্বীনী দায়িত্ব ও ফরীজা।

কাজী সাহেব : আমার একটা অস্পষ্টতা আছে। খেলাফত আলা মিনহাজিন নবুওয়াহ প্রতিষ্ঠা করা আমাদের দায়িত্ব। এতো বুঝলাম। কিন্তু উমাইয়াদের যুগ থেকে এই পর্যন্ত যত আলেম-উলামা গত হয়েছেন, তারা কি এই ফরীজা থেকে গাফেল ছিলেন? তাদেরকে তো এই ফরীজা আদায়ে তেমন হরকত করতে দেখা যায়নি!

আবু সাবের : তখন তো হুজুর ইসলামী কাযা প্রতিষ্ঠিতই ছিলো। কোনো কোনো খলীফা তার ব্যক্তি জীবনে ফাসেক ছিলেন। খামখেয়ালি করতেন। কিন্তু তার আইন ও আদালত চলতো ইসলাম অনুসারে। এবং তখন ইসলামেরই প্রতিপত্তি  ও গালাবা ছিল। এমন কি মুঘলদের আদালতও ইসলামী আইনের অনুসারী ছিল। ফলে দেখা যায় মুঘল ভারতে হাদীস চর্চার চেয়ে ফিকহ চর্চাকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হতো। কারণ ফিকহ চর্চা করলে প্রশাসনে ও বিচার বিভাগে চাকরী হতো। বিচারক হওয়া যেত।

আনোয়ার শাহ : রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য ইসলাম যে নেযাম দান করেছে সেটা ইনসাফপূর্ণ ও ন্যায়ভিত্তিক। এগুলো প্রতিষ্ঠা করা আমদের ঈমানী দায়িত্ব। এই দায়িত্ব আঞ্জাম দিতে হলে আমাদের প্রথম কর্তব্য হবে একজন আমীর নির্বাচন করা। একটি শুরা গঠন করা। ঐ আমীরের নেতৃত্বে শুরার কর্মসূচি অনুসারে কাজ করা।

কাজী সাহেব : আমীর হতে হবে। বাকি আমীরুল মুমিনীন বানাতে গেলে বর্তমানে সেটা আবার রাষ্ট্রদ্রোহমূলক আচরণ হয়ে যায় কি না তা ভাবার বিষয়।

আবু সাবের : মোটকথা, দীর্ঘ আলোচনা থেকে আমাদের সামনে স্পষ্ট হলো যে, এদেশেও খেলাফত ও কাযা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা আমাদের দ্বীনী ফরীজা। সকলেরই শরঈ দায়িত্ব।

কাজী সাহেব : কিন্তু দরজাবন্দী আছে; স্তর বিন্যাস আছে। ইবাদতের স্তর সবার উপরে। বাকি, কাজ করে যেতে হবে।

আবু সাবের : একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে যাচ্ছি। মুসলিম সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগরিষ্ঠ সব দেশেই বর্তমানে একটি শব্দ নিয়ে দারুন বিতর্ক হতে দেখা যায়। সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতা। কেউ এর অর্থ করেন অসাম্প্রদায়িকতা বলে। আর যারা রাখঢাক না করে বলে ফেলেন, তারা বলেন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ধর্মীয় আইনের স্থান নেই। আইন ও আদালতে ধর্মীয় আইন হবে না। ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার। সাধারণ রাজনৈতিক নেতারাও এ ধরনের শ্লোগান দিয়ে থাকে। প্রতিবেশী ভারত ধর্মনিরপেক্ষ নামে পরিচিত। আমাদের দেশেরও কয়েকটি রাজনৈতিক দল এ মতে বিশ্বাসী। তারা কি অসাম্প্রদায়িকতা বোঝায়, না রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ধর্মীয় আইনের অনুপস্থিতি বোঝায়? এ সম্পর্কে কিছু বলুন।

কাজী সাহেব : ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থটা ভারত থেকে নেওয়া যেতে পারে। ওখানে ধর্ম নিরপেক্ষতার আদর্শ অতটা ঘোলাটে নয়।

আবু সাবের : তার মানে হুজুরের মতে ধর্মনিরপেক্ষতার মূল অর্থ এবং আমলী অর্থ এটা যে, রাষ্ট্র বিশেষ কোনো ধর্মের আইন অনুসরণ করবে না। ধর্মীয় আইনগুলি রাষ্ট্রীয় পরিমন্ডলে স্থান পাবে না, তাইতো?

কাজী সাহেব : হ্যাঁ, তাই। আর আমি এই অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতার কায়েল নই। একজন মুসলমান ধর্মনিরপেক্ষতার কায়েল (প্রবক্তা) হয় কি করে, তা আমার বুঝে আসে না।

আবু সাবের : মুসলমান তো তার ধর্মের পক্ষে হবে। এটা তার ঈমান। ধর্মনিরপেক্ষ মানে কোনো ধর্মের পক্ষে নয়। তা কি করে হয়। প্রত্যেক মুসলমান চবিবশ ঘণ্টার জিন্দেগীতে ধর্ম অনুসরণ করতে বাধ্য। তার ব্যক্তি জীবন ইসলামের পক্ষে। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনও ইসলামের পক্ষে। সুতরাং মুসলমানদের জন্য ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ার সুযোগ নেই। ধর্মনিরপেক্ষতা ইসলামের সাথে এবং ঈমানের সাথে সাংঘর্ষিক।

কাজী সাহেব : হ্যাঁ, শেষোক্ত অর্থে সাংঘর্ষিক, সন্দেহ করার অবকাশ নেই। এটা একদম স্পষ্ট।

আবু সাবের : কিন্তু আপনি যে বলেছেন, ভারতে নীতিগতভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শটা পরিষ্ফূট। এর দ্বারা কি আপনি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম বাংলাদেশেও ধর্মনিরপেক্ষতা অনুসরণযোগ্য বলে বোঝাতে চেয়েছেন। সংখ্যালঘু অমুসলিম রাষ্ট্রে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম রাষ্ট্রে কি ধর্মনিরপেক্ষতা একই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার্য, না ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে?

কাজী সাহেব : না। একই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার্য হতে পারে না। ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতা না মানলে রামরাজ্য কায়েম হবে। শিরক ও মূর্তিপুজার আধিপত্য হবে। তার চেয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা অনেকটা সহনীয়। কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এখানে ধর্মনিরপেক্ষতা মেনে নেওয়ার প্রশ্নই আসে না।

আবু সাবের : শায়খুল ইসলাম মাদানী রহিমাহুল্লাহ-এর রাজনৈতিক দর্শন কী ছিল? কেউ কেউ বলতে চান, হযরত মাদানী ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী?

কাজী সাহেব : আস্তাগফিরুল্লাহ। হযরত শাইখুল ইসলাম মাদানী কাদ্দাসাল্লাহু সিররাহু কক্ষনো ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী ছিলেন না।

আবু সাবের : খেলাফত ও সিয়াসতের সঠিক ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি আর মওদূদী মতবাদের মাঝে পার্থক্য কী?

কাজী সাহেব : অনেক পার্থক্য। মাওলানা মওদূদী সাহেব মনে করেন ইসলাম এসেছে মূলত খেলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য। কিন্তু কুরআন হাদীস অনুযায়ী আমাদের আসলাফ যা বুঝিয়েছেন তা হলো, ইসলাম এসেছে যেন দুনিয়াতে আল্লাহ পাকের হুকুম আহকাম পালিত হয়। সুতরাং স্তরে স্তরে যখন রাষ্ট্রীয় হুকুম আসবে সেটাও পালিত হবে। মাওলানা মওদুদী সাহেবের কথা নিলে দ্বীনের তরতীব ও

স্তরবিন্যাস উলট পালট হয়ে যাবে।

আবু সাবের : তার মানে মাওলানা মওদুদী সাহেব বলতে চাচ্ছেন, নবীগণের আগমনের মূল উদ্দেশ্য  হুকুমত প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু কুরআন হাদীস থেকে যা বোঝা যায় তা হলো হুকুমত নবীগণের প্রথম ও মূল উদ্দেশ্য নয়। এটা দ্বীন প্রতিষ্ঠার যরীআহ বা মাধ্যম।

আনোয়ার শাহ : এইভাবে বলা যায় যে, নবীগণের আগমনের উদ্দেশ্য আশরাফুল মাখলুকাতকে আল্লাহর সাথে জুড়ে দেওয়া। এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের বিভিন্ন স্তর রয়েছে। একটি হলো সিয়াসত, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে খেলাফত। এটা পূর্ণতার শেষ স্তর। কিন্তু দ্বীনের প্রধান স্তর নয়।

আবু সাবের : মাওলানা মওদুদী সাহেবের দাবীটা হলো, সিয়াসত মূল মাকছাদ। কিন্তু আমাদের আকাবিরগণের তাবীর (অভিব্যক্তি) হলো, এটা যরীআহ। তবে সব যরীআ সমান নয়। সিয়াসত যরীআহ হলেও ফরজিয়ত ও গুরুত্বের বিবেচনায় অতি উচ্চ মর্যাদার দাবী রাখে।

আব্দুস সালাম : হুজুরের কাছে আমার একটা প্রশ্ন। মওদুদীবাদে বিশ্বাসীদেরকে আমরা মুলহিদ বলবো না গোমরাহ বলবো।

কাজী সাহেব : গোমরাহ বলবো। আমাদের আসলাফ মুতাযিলা ও খাওয়ারেজকেও মুলহিদ বলেননি, গোমরাহ বলেছেন।

আবু সাবের : হুজুর! আপনি তো দীর্ঘদিন রাজনীতি করেছেন। আপনার অভিজ্ঞতা থেকে কিছু বলুন। কিছু স্মৃতি ও অবদান বর্ণনা করুন।

কাজী সাহেব : আমি কোনো অবদান রাখিনি। আমি একটা মানুষ, পেঁচাও একটি পাখি!

আবু সাবের : এখন বিনয় অবলম্বন করলে ইতিহাসের একটি অংশ হারিয়ে যাবে। উম্মতের প্রয়োজনে কিছু কথা আজ বলতেই হবে।

কাজী সাহেব : আমার একটা অভিজ্ঞতা, মওদুদীবাদীরা নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে হেন কাজ নেই, যা করতে পারে না। আমার চাক্ষুষ ও বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে এটি বলছি।

আনোয়ার শাহ : সর্বশেষ, হুকুমতে এলাহিয়া প্রতিষ্ঠার  জন্য  আপনি  আপনার শাগরিদ ও মুহিববীনদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।

কাজী সাহেব : আমি উপদেশ দেওয়ার মতো কেউ নই। তবু বলছি, তালীম, তাবলীগ, তাসনীফ ও তাসাওউফ এগুলো মৌলিক কাজ। এগুলি গুরুত্বের সাথে করো। রাজনীতিও পারলে করো। খানকাহী আমলকে নেসাব বানাও।

আনোয়ার শাহ : অর্থাৎ দ্বীনের সকল শোবায় কাজ করতে হবে। কোনো শোবাকে অবহেলা করা যাবে না।

কাজী সাহেব : খবরদার! কেউ কাউকে তুচ্ছ করবে না। তাবলীগীরা আমাদেরকে বেকার ভাববে না। আমরা তাদেরকে জাহেল বলে দূরে ঠেলে দিবো না। পারস্পরিক যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে। পারলে একে অন্যকে সহযোগিতাও করতে হবে।

আবু সাবের : সবার পক্ষ থেকে হুজুরকে জাযাকাল্লাহ। অনেক সময় নিয়েছি। অনেক কষ্ট দিয়েছি।

কাজী সাহেব : আল্লাহ তাআলা সবার খায়ের করুন। আমীন। ষ

 

সাক্ষাৎকার গ্রহণ

মাওলানা আবু সাবের আব্দুল্লাহ

১৬/৩/২০১৩ ঈ. বাদ আসর

 

উপস্থিতি

মাওলানা আনোয়ার শাহ, মাওলানা আহমদ মায়মূন, মাওলানা মুফতী আব্দুস সালাম, মাওলানা মুফতী হাফীযুদ্দীন

অনুলিখন : মাহমুদ হাসান মাসরুর

 

 

 

 

 

advertisement