রজব ১৪৩৪   ||   মে ২০১৩

আমাদের রাজ্যশাসন-৮

মাওলানা আবদুস সালাম কিদওয়ায়ী

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

বিদায় হজ্ব (১০ম হিজরী)

মক্কা বিজয়ের সুবাদে ইসলামের বড় বাধা দূর হয়ে গেল। ফলে অতি অল্প সময়েই আরবের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইসলামের আলো ছড়িয়ে পড়ল।

দশম হিজরীতে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজ্বের ইচ্ছা করলেন। ইতিহাসে এটি হাজ্জাতুল বিদা তথা বিদায় হজ্ব নামে পরিচিত। কেননা এটিই ছিল নবীজীর শেষ হজ্ব। নবীজীর হজ্বের খবর ছড়িয়ে পড়লে চারদিক থেকে লোকজন আসতে শুরু করেন এবং লক্ষাধিক সাহাবী নবীজীর নিকট একত্র হন। হজ্ব পালন শেষে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন। তাতে তিনি ইরশাদ করেন-

হে লোকসকল!

মন দিয়ে শোনো এবং মনে রেখো। তোমাদের সাথে হয়তো আর সাক্ষাতের সুযোগ হবে না। আজকের দিন, এই মাস এই শহরের মতো একজন মুসলিমের রক্ত, তার ধন-সম্পদ সম্মান-মর্যাদা অপর মুসলিমের জন্য হারাম।

আল্লাহ তাআলা তোমাদের সকল কাজের হিসাব নিবেন। সাবধান, আমার পরে তোমরা পথভ্রষ্ট হয়ো না। একে অন্যকে হত্যা করো না। নারীর উপর যেমন তোমাদের অধিকার আছে তেমনি তোমাদের উপরও রয়েছে নারীর অধিকার। তাদের প্রতি কোমলতা মহানুভবতা প্রদর্শন করো। আল্লাহর ভয়ে তাদের অধিকারের প্রতি যত্নবান হও। ভৃত্যদের সাথে উত্তম আচরণ করো। নিজে যা খাও তাকেও তা খাওয়াবে, নিজে যা পরিধান কর তাকেও তা পরিধান করাবে। তাদের কোনো ত্রুটি পেলে ক্ষমা করে দিবে নতুবা পৃথক করে দিবে। তারাও আল্লাহর বান্দা। তাদের প্রতি কঠোরতা সমীচীন নয়।

আরবীর যেমন আজমী তথা অনারবীর উপর কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই তেমনি আরবীর উপরও অনারবীর শ্রেষ্ঠত্ব নেই। সকল মুসলমান পরস্পর ভাই ভাই। কারো সন্তুষ্টি ছাড়া তার কোনো জিনিস গ্রহণ করা তোমাদের জন্য হালাল নয়।

লক্ষ্য রেখো, বে ইনসাফী করো না। আমি তোমাদের মাঝে এমন জিনিস রেখে যাচ্ছি, যতক্ষণ তোমরা তা দৃঢ়ভাবে আকঁড়ে ধরবে পথভ্রষ্ট হবে না। আর তা হল আলকুরআন।

মনে রেখো, কাজকর্মে নিষ্ঠা, মুসলিম ভাইয়ের কল্যাণকামিতা পারস্পরিক সম্প্রীতি-এই তিনটি জিনিস অন্তরকে পবিত্র রাখে।

যারা এখানে উপস্থিত নেই তাদের কাছে আমার কথাগুলো পৌঁছে দিও। কারণ অনেক মানুষ আছে, যারা নিজ কানে শোনা-লোকদের চেয়েও বেশি স্মরণ রাখতে পারে।

ভাষণ শেষ করার পর তিনি উপস্থিত লোকদের উদ্দেশে বললেন, কিয়ামতের দিন তোমাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবে যে, আমি আল্লাহর বিধান তোমাদের নিকট পৌঁছিয়েছি কি না-তখন তোমরা কী জবাব দিবে? কথা শুনে সকল মানুষ সমস্বরে বলে উঠল-আমরা সাক্ষী যে, আপনি আল্লাহর বিধান আমাদের নিকট পৌঁছে দিয়েছেন এবং আপনার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছেন।

কথা শুনে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আকাশের দিকে আঙ্গুল তুললেন এবং তিনবার বললেন, হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকুন, হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকুন, হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকুন।

এরপর আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখান থেকে মদীনায় চলে এলেন।

 

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওফাত

হাজ্জাতুল বিদা তথা বিদায় হজ্বের সময়ই কুরআন মজীদের শেষ আয়াত-(তরজমা) আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম। আর ইসলামকে তোমাদের দ্বীন মনোনীত করলাম। (সূরা মায়েদা () : ) অবতীর্ণ হয়েছিল। এতে এই ইঙ্গিত ছিল যে, এখন আল্লাহর রাসূলের আর দুনিয়ায় থাকার প্রয়োজন নেই। কেননা তিনি যে কাজের জন্য আগমন করেছিলেন তা সুসম্পন্ন করেছেন। দুই মাস পর-সফরের শেষ দিনগুলিতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। দিন দিন অসুস্থতা বেড়েই চলল। অবশেষে ১২ রবিউল আউয়াল, সোমবার (অনেক সীরাত গবেষকের মতে রবিউল আউয়াল সবচেয়ে সহীহ) ৬৩ বছর বয়সে তিনি ইন্তিকাল করেন।

ইন্তিকালের খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে মদীনার সর্বত্র কান্নার রোল পড়ে গেল। অনেক শক্ত মনের মানুষও অচেতন হয়ে পড়ল। হযরত আলী রা. নিজ স্থানেই বসে পড়লেন। হযরত উসমান রা. সম্মোহিত হয়ে গেলেন। শোকের আতিশয্যে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উনাইস রা.-এর ইন্তিকাল হয়ে গেল। হযরত উমর রা. তো প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। যখন বিশ্বাস হল তখন বেহুঁশ হয়ে গেলেন।

মানুষ যখন একটু শান্ত হল তখন কাফন-দাফনের ব্যবস্থা করা হল।

পরের দিন মঙ্গলবার হযরত আয়েশা রা.-এর গৃহেই আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সমাহিত

করা হল।           

    (চলবে ইনশাআল্লাহ)

অনুবাদ : আবদুল্লাহ ফাহাদ

 

 

advertisement