জুমাদাল উখরাাহ ১৪৩৪   ||   এপ্রিল ২০১৩

হাফেয মাওলানা ওমর আহমদ রাহ.

জহির উদ্দিন বাবর

চলে গেলেন ‘ছদর সাহেব হুজুর’ মুজাহিদে আযম আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী রাহ.-এর বড় ছেলে হাফেজ মাওলানা ওমর আহমদ রাহ.। দক্ষিণাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী দীনি প্রতিষ্ঠান  গওহরডাঙ্গা মাদরাসার ভাইস প্রিন্সিপাল ছিলেন তিনি। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে তিনি ‘পীর সাহেব হুজুর’ হিসেবে সর্বমহলে পরিচিত ছিলেন।  দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তিনি ওয়াজ নসীহত করতেন, দীনের আলো ছড়াতেন। শায়খুল হাদীস রাহ. প্রতিষ্ঠিত ঢাকার জামিয়া রাহমানিয়ার পরিচালনা পর্ষদের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করতেন। ঢাকায় অবস্থানকালে তিনি রাহমানিয়াতে থাকতেন প্রায়ই। মাদরাসা কর্তৃপক্ষ তাঁকে মুরবিব হিসেবে মানতেন। এছাড়াও বিভিন্ন দীনি প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন হাফেজ ওমর রাহ.।

হযরত মাওলানা হাফেজ ওমর আহমদ রাহ. শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন গত ২৬ ডিসেম্বর ২০১২ বুধবার সকাল পৌনে নয়টার দিকে। এর আগে দু’দিন তিনি রাজধানীর একটি হাসপাতালের আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। রাজধানীর পোস্তগোলায় একটি মাহফিল শেষে তিনি ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬২ বছর। তিনি স্ত্রী, দুই মেয়ে, এক ভাই, তিন বোন এবং অসংখ্য ভক্তবৃন্দ ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। ২৭ ডিসেম্বর গওহরডাঙ্গা মাদরাসা ময়দানে নামাযে জানাযা শেষে ছদর সাহেব রাহ.-এর পাশে তাঁকে দাফন করা হয়। তাঁর জানাযা ও দাফনে লাখো মানুষ অংশ নেন। তাঁর ইন্তেকালে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ঘরে ঘরে শোকের ছায়া নেমে আসে। জানাযায় অংশ নেয়া মুসল্লিদের মধ্যে চাপা কান্না ও শোক লক্ষ্য করা গেছে। তার ইন্তেকালের খবর শোনার পর রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক এবং দীনদার মুসলমানরা ছুটে আসেন জামিয়া রাহমানিয়া প্রাঙ্গণে। সেখানে জানাযা না হলেও ঢাকাবাসীদের জন্য শেষবারের মতো তাকে দেখার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। দেশের বিভিন্ন মাদরাসা-মসজিদে তাঁর মাগফিরাতের জন্য বিশেষ দুআ ও মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়েছে।

তার জন্ম ১৯৫০ সালে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার গওহরডাঙ্গা গ্রামে। গওহরডাঙ্গা মাদরাসায় তিনি হিফজুল কোরআন সম্পন্ন করেন। এরপর বাবার কাছে প্রাথমিক উর্দু-আরবি কিতাবাদি পড়েন। নড়াইলের নড়াগাতীর বামুডাঙ্গা হাইস্কুল থেকে ১৯৬৯ সালে তিনি এসএসসি পাস করেন। এরপর লালবাগ মাদরাসায় ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। ১৯৭৭ সালে তিনি পাকিস্তানের করাচিতে যান। সেখানে বিভিন্ন মাদরাসায় পড়াশুনার পর জামেয়া সিদ্দিকিয়া থেকে দাওরায়ে হাদীস সম্পন্ন করেন। ১৯৮৩ সালে তিনি দেশে ফিরে এসে তাঁর পিতার প্রতিষ্ঠিত গওহরডাঙ্গা মাদরাসা এবং খাদেমুল ইসলাম জামাতে  খেদমত শুরু করেন। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত তিনি এ খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যান। উপমহাদেশের প্রখ্যাত বুযুর্গ হযরত মাওলানা হাকীম মুহাম্মদ আখতার দা.বা-এর সঙ্গে তাঁর আধ্যাত্মিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং তাঁর কাছ থেকে তিনি খেলাফত লাভ করেন।

দুই.

আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী রাহ. ছিলেন এদেশের আলেমদের শিরোমনি। তাঁর ব্যক্তিত্বের উচ্চতা অনুভব করা আমাদের পক্ষে কঠিন। তবে বই-পুস্তকে পড়েছি, প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা থেকে তাঁর সম্পর্কে বহু আলোচনা শুনেছি। আর কাছ থেকে দেখেছি হাফেয মাওলানা ওমর আহমদ রহ.কে। আমার মনে হয়েছে, ছেলে হিসেবে তার জীবনে পিতার কিছু ছায়া অবশ্যই ছিল। বাবার একান্ত সান্নিধ্যে গড়ে ওঠার কারণে তাঁর মধ্যেও ছিল দূরদর্শী চিন্তা, সারল্য ও দ্বীনের কাজ করার উদ্যম। ‘আববাজি’ বলে তিনি যখন ছদর সাহেব রাহ.-এর প্রসঙ্গ উল্লেখ করতেন তখন উপস্থিত লোকেরা আবেগে আপ্লুত হয়ে যেতেন। তাঁর সান্নিধ্যে গেলে ছদর সাহেবের উঞ্চতা অনুভব করা যেতো।

হাজার হাজার মানুষের আধ্যাত্মিক রাহবার ছিলেন তিনি। লাখো মানুষ তার বয়ান ও নসীহতে আলোর দিশা পেয়েছেন। গওহরডাঙ্গার বার্ষিক মাহফিলের কথা পুরো দক্ষিণবঙ্গে ব্যাপক আলোচিত। ওই মাহফিলে হাফেজ ওমর সাহেব রাহ. যখন বয়ান করতেন মনে হতো প্রাণ ফিরে পেয়েছে মাহফিল। পিনপতন নীরবতা দেখা দিত চারদিকে। লোকজন কেনাকাটা ফেলে মনোযোগী হতেন তার হৃদয়ভেজা কথাগুলোর দিকে। দেশের যে প্রান্তেই তিনি বয়ান করতেন এভাবেই শ্রোতারা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। হৃদয় থেকে আবেগ নিয়ে কথা বলতেন তিনি। এজন্য তার কথা প্রভাব বিস্তার করতো প্রতিটি অন্তরে। হিদায়াতের আলো ছড়াতে তিনি বিরামহীনভাবে ছুটে বেড়িয়েছেন দেশের আনাচে-কানাচে।

শামছুল হক ফরিদপুরী রাহ.-এর

চিন্তাধারা বিস্তারে তিনি নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। তার বয়ান-বক্তৃতার উল্লেখযোগ্য অংশজুড়েই থাকত ছদর সাহেবের আলোচনা। পিতার রেখে যাওয়া বিশাল লেখনি ভান্ডার সংরক্ষণ এবং এর প্রচার-প্রসারেও ছিল তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। হীরার চেয়ে মূল্যবান ছদর সাহেবের লেখনিগুলো যখন অযতনে-অবহেলায় নিঃশেষ হতে চলেছিল তখন তিনি এগুলোর সংরক্ষণ ও প্রচার-প্রসারে মনোযোগী হন। ছদর সাহেবের লেখনি ও চিন্তাধারা নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে তিনি নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন।

দ্বীনের নানা শাখায় কর্মরতদের উদ্বুদ্ধ করা এবং সাহস যোগানো ছিল হাফেজ ওমর সাহেব রাহ.-এর বিশেষ কাজ। পিতার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি এই গুণটি লাভ করেছিলেন। বিশেষত তরুণদের প্রতি তার মনোযোগ ছিল সবচেয়ে বেশি। যে কেউ তার কাছে গিয়ে আশ্রয়-প্রশ্রয় পেতেন। তরুণদের সামনে তিনি শামছুল হক ফরিদপুরী রাহ.-এর ব্যক্তিত্ব এবং অনুসরণযোগ্য গুণগুলো সুন্দরভাবে তুলে ধরতেন। শুধু ছদর সাহেবই নন, আমাদের আকাবিরকে নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা ছিল তার। তিনি চাইতেন ছোটখাটো বিরোধ-বিভেদ ছেড়ে ঐক্যবদ্ধ কোনো প্লাটফর্ম গঠিত হোক। এজন্য তিনি নিজের সাধ্যমতো কাজও করে গেছেন। তার স্বপ্ন ছিল তরুণদের নিয়ে কিছু করার। এ লক্ষ্যে তিনি কিছু কাজ শুরুও করেছিলেন। নিজের মনের আকুলতাগুলো তিনি নানা সময় তুলে ধরেছেন ঘনিষ্ঠ লোকদের কাছে।

 

ব্যক্তিদুর্ভিক্ষের এই সময়ে হাফেজ মাওলানা ওমর আহমদ রাহ. ছিলেন আকাবিরের রেখে যাওয়া একজন যোগ্য উত্তরসূরি। যারা চলে যান তারা আর ফিরে আসেন না। তাদের চলে যাওয়ায় যে শূন্যতার সৃষ্টি হয় তা আর কখনোই পূরণ হয় না। সর্বজনস্বীকৃত এসব ওলামায়ে কেরামের বিদায় জাতির জন্য বিপদের ঘনঘটা। অভিভাবকতুল্য আলেমদের ছায়া যেভাবে দ্রুত এ জাতির ওপর থেকে সরে যাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে বিপদটা খুব কাছে। আমরা দুআ করি, আল্লাহ যেন বিগত আলেমদের রূহানী ফয়েজ থেকে আমাদের কখনো বঞ্চিত না করেন। আর যারা আজও এ জাতির ওপর ছায়া হয়ে আছেন সেইসব ওলামায়ে কেরামের ছায়া আমাদের ওপর আরো দীর্ঘ করে দিন। আমীন। 

 

 

 

advertisement