শাওয়াল ১৪৩৩   ||   সেপ্টেম্বর ২০১২

লা ল ফি তা : বিধি মোতাবেক ব্যবস্থার নমুনা

আবু তাশরীফ

কথায় আছে-দশে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ। কাজটি দশজনে মিলেই করেছিল। টেঁকের পয়সা খরচ করে খানাখন্দেভরা সরকারি রাস্তা মেরামতের কাজ। এতে লাজ-লজ্জার কিছু ঘটেওনি। কিন্তু সরকারি কর্তারা এখন মামলা-মোকদ্দমায় ফাঁসানোর উদ্যোগ নিয়েছেন তাদের। দশে মিলে কাজ করেও তারা বাঁচতে পারছেন না। বিড়ম্বনা আর লজ্জা কোনোটাই ঢাকতে পারছেন না। তারা শুধু জন দুর্ভোগ কমাতে চেষ্টা করেছিলেন। নিজেদের প্রয়োজনে সরকারি রাস্তা ইট-সুড়কি ফেলে মেরামত করেছিলেন। কিন্তু সরকারি কর্তা-ব্যক্তিদের খুশি করতে পারেননি। বহুদিন বহু ধর্না দিয়েও যে ভাঙ্গা রাস্তা মেরামতে কর্তাদের সুনজর কাড়া সম্ভব হয়নি, সে রাস্তা নিজেরা ঠিক করার পর এখন কর্তাদের কু-নজর থেকে তারা বাঁচতে পারছেন না।

একদিকে স্ব-উদ্যোগ, আরেকদিকে ভোগান্তির এ অদ্ভুৎ খবরটি ছাপা হয়েছে গত ২৯ জুলাইয়ের একটি দৈনিক পত্রিকার ১০-এর পাতায়। শিরোনাম দেওয়া হয়েছে- খানাখন্দে ভরা সড়ক মেরামত করে বিপাকে এলাকাবাসী। বগুড়ার শেরপুর উপজেলা সদরের জিরো পয়েন্ট থেকে দ্বিতীয় কিলোমিটারের দুবলাগাড়ী-চকপোতা সড়কের মেরামত নিয়ে এ ঘটনা ঘটেছে। জানা গেছে, কয়েকযুগ ধরে এ সড়কটির কোনো উন্নয়ন হয়নি। ছোট-বড় অসংখ্য খানাখন্দে সড়কটি ভরে গেছে। সড়ক ও জনপথ বিভাগের কোনো কর্মকর্তার চোখে এ সমস্যাটা ধরাই পড়েনি। এ বর্ষার সময় ভোগান্তি অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায়। এতে উদ্যোগী কিছু মানুষ স্থানীয় সবার সহযোগিতা নিয়ে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে প্রায় লাখ খানেক টাকা খরচ করে সড়কটি মেরামত করেন। আর এর পরপরই মেরামত কাজের ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরে সড়ক বিভাগের পক্ষ থেকে তাদের কাছে চিঠি আসে। ত্রুটি-বিচ্যুতি ঠিক না করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দেয়া হয় ওই চিঠিতে। এতে উদ্যোগী সাধারণ মানুষ হতবাক হয়ে যান।

সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ)-এর উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী স্বারিত চিঠিটিতে অভিযোগ করা হয়েছে, এভাবে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে মেরামত করায় সড়কের দু পাশের অংশ উঁচু হয়ে গেছে। এতে সড়কে পানি জমে সড়কটি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ১১ জুলাই স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে আরো বলা হয়েছে, ৭ দিনের মধ্যে নিজ খরচে রাস্থা সমতল করা না হলে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে অনুরোধ করা হবে।

অসহনীয় ভোগন্তি থেকে মানুষকে বাঁচাতে এবং নিজেরা বাঁচতে যারা উদ্যোগ নিয়ে রাস্তাটি মেরামত করেছেন তারা তো কোনো উপায় না পেয়েই কাজটি করেছেন। সরকারি খাতে নিজেরা অর্থ ও শ্রম দিয়েছেন। হতে পারে তাদের মেরামত কর্মে কিছু ভুলচুক হয়ে গেছে। ব্যাকরণ মেনে

রাস্তাটি তারা সংস্কার করতে পারেননি। কিন্তু রাস্তা মেরামত ও সংস্কারের দায়িত্ব যে সরকারি বিভাগটির ছিল তারাও তো এতদিন কিছু করেনি। এমনকি জনগণের স্বেচ্ছাশ্রমের সময়ও তো সহযোগিতা করতে বিধি মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে এগিয়ে আসেনি। সড়কের মেরামত কর্ম সারার পর তাদের কানে পানি গেছে। এবং এরপর তারা ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দিয়েছে। এ দেশের সরকারি কাজকর্মের লালফিতার দৌরাত্ম এখন কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠেছে-এ ঘটনা তারই প্রমাণ। খবরে জানা গেছে, রিপোর্টারের প্রশ্নের উত্তরে ব্যবস্থা গ্রহণ বিষয়ক পত্রদাতা উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী বলেছেন, বরাদ্দ না থাকায় সড়কটি  সংস্কার করা যাচ্ছে না। কবে নাগাদ বরাদ্দ আসবে তা-ও বলা যাচ্ছে না। তার মানে হচ্ছে যারা সড়কটি মেরামত করেছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এত উতলা হলেও ওই সড়ক মেরামতে সরকারি উদ্যোগের আশু কোনো সম্ভাবনাই নেই। এটি কেবলই ভোগান্তি থেকে বাঁচতে চাওয়া ভুক্তভোগীদের টুটি চেপে ধরার পদক্ষেপ। সড়ক বিভাগ নিজেরা সড়ক মেরামতের কিছুই করবে না। তাদের অবহেলায় ভুক্তভোগীরা চলনসই কিছু নিজ উদ্যোগে করলেও বিপদে পড়বে।

এ ঘটনা হতাশা ও উদ্বেগজনক। সন্দেহ নেই সারা দেশের সব উদ্যোগী নাগরিকদের কাছে এ ধরনের ঘটনা একটি ভুল বার্তা পৌঁছে দেবে। বগুড়ার শেরপুর এখানে বড় কথা নয়, দেশজুড়েই খানাখন্দ, অব্যবস্থা ও সংকটের ছড়াছড়ি। আর সেটা কেবল সড়ক বিভাগে নয়। জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট সব বিভাগেই অব্যবস্থাপনা ও দায়িত্বহীনতার পাহাড় জমে আছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সরকারি প্রতিষ্ঠান থাকে হাত গুটিয়ে। সেই গুটানো হাতের দিকে  তাকিয়ে থেকে মানুষ কি কেবল ভোগান্তির পাঁকেই ডুবতে থাকবে? কিছু লোক উদ্যোগ নিয়ে কিছু করে সবাইকে ভোগান্তি থেকে বাঁচাতে চাইলে তাদেরকে উল্টো চেপে ধরা হবে? এভাবে কি দেশ চলবে-মানুষ বাঁচবে? ছোট কর্তাদের যারা বড় কর্তা-দয়া করে তারা এসব বিষয়ে একটু মনোযোগ দিন। 

 

 

advertisement