শাওয়াল ১৪৩৩   ||   সেপ্টেম্বর ২০১২

সালাফের প্রতিচ্ছবি : শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আইয়ুব রাহ.

মাওলানা মুহাম্মাদ ত্বহা হুসাইন

উস্তাযে মুহতারামের ইন্তেকাল আকস্মিক ছিল না। বেশ কমাস ধরে তাঁর চিকিৎসা চলছিল। তারও আগে প্রায় আঠার বছর ধরে তিনি ছিলেন পক্ষাঘাতগ্রস্ত। ইন্তেকালের সপ্তাহখানেক আগেও তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতির কথা শুনেছি। তবুও গত ১৫ মে ২০১২ সৌদি আরব সময় প্রায় তিনটার দিকে যখন তাঁর  ইন্তেকালের খবর শুনি, মুহূর্তেই বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। তখন আমি পবিত্র ও প্রাণের নগরী মক্কার মসজিদে হারামের সন্নিকটে উস্তাযে মুহতারাম হযরত মাওলানা আব্দুল মালেক ছাহেবের খেদমতে ছিলাম। খবরটি শোনামাত্রই দুচোখে বাঁধভাঙ্গা অশ্রু নেমে এল। আসরের নামাযের আগে ও পরে মাতাফে নেমে বায়তুল্লাহর দিকে যতবার তাকিয়েছি, দুচোখে অশ্রুর ধারা প্রবাহিত হয়েছে। মনে হচ্ছিল, পিতৃত্বের ছায়া থেকে বঞ্চিত হয়ে আমি যেন চিরদিনের জন্য এতিম হয়ে গেলাম।

তাওয়াফ করতে গেলাম। কোনো দুআই মনে আসছে না। অশ্রু ঝরছে, শুধুই অশ্রু। জানি না, আল্লাহর ঘরের চারপাশে ঘুরে বেড়ানো একজন নাদান শাগরিদের নীরব অশ্রুপাত পরপারে তাঁর কোনো উপকারে আসবে কি না?

আকস্মিক নয় তবুও হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আইয়ুব রাহ.-এর ইন্তেকালের দুঃসংবাদের এই বোঝা কেউই যেন বহন করতে পারছে না। এই তিরোধান লাখো প্রাণে নাড়া দিয়েছে, হাজারো চোখের অশ্রু ঝরিয়েছে। মানুষ গড়ার কারিগর এই ক্ষণজন্মা মনীষীর

ইন্তেকালে সত্যি এ জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল।

তিনি ছিলেন একজন বর্ষীয়ান আলেমে দ্বীন, বিখ্যাত শায়খুল হাদীস, প্রখ্যাত ওয়ায়েজ, দক্ষ শিক্ষাবিদ ও আকাবির সালাফের প্রোজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি।

দরসে নিযামীর পঠন-পাঠন ও ছাত্র গঠনে তাঁর অনন্য দৃঢ়তা এবং শিক্ষা পরিচালন ও প্রশাসনে তারা সাহসিকতা তাঁর ব্যক্তিত্বকে বর্ণাঢ্য করে তুলেছিল। বহুমাত্রিক প্রতিভা, জ্ঞান ও প্রশাসনিক দক্ষতা ছিল তাঁর অনন্য বৈশিষ্ট্য।

আনুমানিক ১৩৫৮ হিজরী মোতাবেক ১৯৩৯ঈ. সনে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া থানার রাজানগর খন্ডলিয়া পাড়ায় তাঁর জন্ম। তার পিতা মাওলানা ফজলুর রহমান রাহ. ছিলেন এলাকার বয়োবৃদ্ধ একজন আলেমে দ্বীন। হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আইয়ুব রাহ. অত্যন্ত ছোট থাকতেই তিনি ইন্তেকাল করেন। হযরত হয়ে পড়েন পিতৃহীন, এতিম। এতিমির ফলে তাঁর পড়াশোনাও শুরু হয়েছিল বেশ দেরীতে।

তিনি তার গ্রামে রুকনুল ইসলাম মাদরাসায় জামাতে শাশুম পর্যন্ত পড়াশোনার পর পাড়ি জমান বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ায়। সেখানে পাঞ্জুম হতে দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত অত্যন্ত সুনামের সাথে পড়াশোনা করেন। জামেয়া পটিয়ার বর্তমান সুযোগ্য মহাপরিচালক হযরত মাওলানা মুফতী আব্দুল হালীম বোখারী দা. বা. ছিলেন তাঁর সহপাঠী।

খতীবে আজম হযরত মাওলানা সিদ্দিক আহমদ রাহ., জামেয়া পটিয়ার প্রতিষ্ঠাতা মুফতী আযীযুল হক রাহ., ইমাম আহমদ রাহ., মুফতী ইব্রাহীম রাহ. ও আমীর হুসাইন রাহ. প্রমুখ ছিলেন তাঁর উল্লেখযোগ্য উস্তাদ।

জামেয়া ইসলামিয়া পটিয়া তার ৭৪ বছরের সমৃদ্ধ ইতিহাসে যে সব সৃজনশীল মনীষী, তীক্ষ্ম মেধাবী, প্রজ্ঞাবান আলিম ও প্রভাবশালী দায়ী ইলাল্লাহ তৈরী করতে সক্ষম হয়েছে হযরত মাওলানা ছিলেন তাঁদের অন্যতম।

তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় মিরসরাইর জামালপুর মাদরাসায় শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে। তাছাড়া তিনি বগুড়ার জামিল ও রাঙ্গুনিয়ার কোদালা আজিজিয়া প্রভৃতি মাদরাসায় দ্বীনি খেদমত আঞ্জাম দেন। পরিশেষে স্বীয় মাদারে ইলমী জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ায় শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে তার জীবনে নবযুগের সূচনা ঘটে।

শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন সফল। যে কোনো জটিল ও কঠিন কিতাব তার অনন্য ও ব্যতিক্রমধর্মী পাঠদানের ফলে মনে হতো খুবই সহজ। তিনি কোনো শরাহ বা ব্যাখ্যাগ্রন্থে নিজেকে সীমাবদ্ধ না রেখে নিজস্ব ভঙ্গিতে অনন্য শৈলী ও আকর্ষণীয় উচ্চারণের মাধ্যমে দরস দিতেন। তাঁর হৃদয়গ্রাহী পাঠদান পদ্ধতির ফলে অতি মেধাবী ও কম মেধাবী সব ছাত্রই সমান উপকৃত হত। তাঁর দরস ছিল বাস্তব দৃষ্টান্ত, প্রাত্যহিক জীবনের উদাহরণ ও চোখের সামনে ঘটা বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা সম্বলিত অতি সহজ ও সাবলীল।

ইলমে দ্বীনের আহরণ ও বিতরণে ব্যয়িত তার বর্ণাঢ্য জীবনে তিনি বিপুল সংখ্যক ছাত্র গড়ে তুলতে সক্ষম হন, যারা দেশে-বিদেশে দ্বীনের নানা খেদমতে নিয়োজিত আছেন। এটা তাঁর জীবনের বিশাল সফলতা।

তাঁর ছাত্রদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কজন হলেন মাওলানা রাহমাতুল্লাহ কাওসার নিযামী, মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ, মুফতী শামসুদ্দীন জিয়া, মাওলানা নোমান আহমদ, মাওলানা আবদুল হক হক্কানী ও মাওলানা মাহমুদুল হাসান প্রমুখ। আল্লাহ তাআলা তাঁদের সকলকে সুস্থ ও নিরাপদ রাখুন। আমীন।

ছাত্রদের সাথে হযরতের সম্পর্ক ছিল খুবই ঘরোয়া ও ঘনিষ্ঠ। পিতৃত্ব নয়, সম্পর্কে মাতৃত্বের আকর্ষণ অনুভূত হত। এই সহজ মানুষটি শাসনের প্রয়োজনে এমন কঠোর আচরণ করতেন যেন হঠাৎ করেই কালবৈশাখী ঝড় নেমে এল। তবে তার চোখ রাঙানি, তীর্যক মন্তব্য ও কঠোর শাসনের মাঝেও তালিবে ইলমের এই অনুভূতি বিদ্যমান থাকত যে, হযরতের হৃদয়টা তখনও তার প্রতি ভালবাসায় পূর্ণ। তাঁর ব্যক্তিত্বে শফকত ও মমতার যেমন কমতি ছিল না তেমনি আযমত ও গাম্ভীর্যেরও অভাব ছিল না। তাই প্রত্যেক তালিবে ইলম তাঁকে একদিকে যেমন যমের মতো ভয় করত, অন্যদিকে তার কাছেই পেত মাতৃত্বের মমতা।

জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার দীর্ঘদিনের সফল শিক্ষা পরিচালক হিসেবে তিনি বহু কৃতিত্ব রেখেছেন। প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনে তার দক্ষতা, নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা, দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতা ছিল লক্ষণীয়। এই দীর্ঘ শিক্ষা-পরিচালনার জীবনে তিনি তালিবে ইলম ও আসাতিযায়ে কেরামের কাছে ছিলেন সমানভাবে সমাদৃত ও জনপ্রিয়। তাঁর আমলেই শিক্ষা-দীক্ষার ক্ষেত্রে দেশে-বিদেশে জামিয়ার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। শেষ জীবনে প্রায় আঠার বছর পর্যন্ত পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়েও তিনি অত্যন্ত দতার সাথে এই খেদমত আঞ্জাম দিতে সক্ষম হন।

একজন খ্যাতনামা ওয়ায়েয হিসেবে সাধারণ মানুষের কাছে তিনি ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয়। হাসি-কান্নায়, টক-ঝাল-মিষ্টির অপূর্ব মিশেলে সুন্দর উপস্থাপনায় তার বয়ান শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখত। হুববে ইলাহী, ইশকে রাসূল, শিরক-বিদআতের প্রতিরোধ ও সমাজসংস্কার ইত্যাদি বিষয়ে তার বয়ানগুলো ছিল দাওয়াত ইলাল্লাহর অপূর্ব নজির।

বয়ানে হোক বা দরসে, যুক্তি ও উপমা প্রয়োগে কঠিন কথাকে সহজ ভাষায় উপস্থাপন করার দক্ষতা ছিল তার সহজাত। তাৎক্ষণিক ও যুৎসই উপমা উপস্থাপণে তার জুড়ি পাওয়া যাবে কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এই কারণেই তার উস্তায সমতুল্য অগ্রজ হযরত মাওলানা সুলতান যওক নদভী তাঁকে সুলতানুল আমছাল উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।

ছাত্রজীবন থেকেই তিনি কাব্য রচনায় পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন। আরবী ও উর্দূভাষী অনেক বিজ্ঞজনের  মন্তব্য, তার রচিত আরবী ও উর্দূ কবিতাগুলো সাহিত্য মানেও উত্তীর্ণ।

অধ্যাত্মিক সাধনায় তিনি চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী আজিজুল উলুম বাবুনগরের প্রতিষ্ঠাতা হযরত মাওলানা হারুন বাবুনগরী রাহ. থেকে খেলাফত লাভ করেছিলেন।

তার নিরহংকার জীবনযাপন, মার্জিত ব্যবহার ও অসীম খোদাভীতির বৈশিষ্ট্য যুগ যুগ ধরে নতুন প্রজন্মের জীবনে প্রেরণা যোগাবে। তাঁর বহুমুখী খেদমত আল্লাহর কাছে কবুল হওয়ার আলামতই হয়তো, তাঁর ইন্তেকালের পর হতে পটিয়া মাদরাসা মসজিদ সংলগ্ন মাকবারায়ে আযীযীতে অপূর্ব ও অপার্থিব এক খোশবু ছড়িয়ে গিয়েছিল। ইন্তেকালের প্রায় তিন সপ্তাহ পর যিয়ারত করতে এসে আমিও এই অন্যরকম সৌরভে মোহিত হয়েছিলাম।

ধবধবে সাদা পাঞ্জাবী-টুপি-লুঙ্গি পরিহিত, শুভ্র-শ্মশ্রূমালা ও রৌদ্রোজ্জ্বল ফর্সা চেহারার অধিকারী বৈশিষ্ট্যমন্ডিত মুরুববীর তিরোধানের মাধ্যমে জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়া আরেকবার বড় ধরনের ধাক্কা খেল। অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে এই বৃহৎ দ্বীনী শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান আল্লামা মুহাম্মাদ হারুন ইসলামাবাদী, শায়খুল হাদীস ইসহাক আল-গাজী, হযরত আলী আহমদ বোয়ালভী, মাওলানা নুরুল ইসলাম, হযরত মাওলানা আনোয়ারুল আজীম ও হযরত মাওলানা সিদ্দিকুল্লাহ রাহ.-এর মতো বিশাল বিশাল ইলমী মহীরূহের ছায়া থেকে বঞ্চিত হয়ে গেল।

খোদাভীতির বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল এই পূর্বসূরীদের জীবন উত্তরসূরীদেরকে যুগ যুগ ধরে পথ দেখাবে, আলো ছড়াবে অন্ধকারাচ্ছন্ন যাত্রাপথে। তারা হবেন  আমাদের জীবন-পথের আলোকবর্তিক। আমীন। ষ

 

 

advertisement