জুমাদাল আখিরাহ ১৪৩০   ||   জুন ২০০৯

মুফতী আবদুল ওয়াহহাব রাহ.

মনসুর আহমদ

মুফতী আবদুল ওয়াহহাব রাহ. আনুমানিক ১৩৪১হি. সনে চাঁদপুর জেলার সদর থানাধীন বড়লক্ষীপুর গ্রামের বিখ্যাত শেখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মাওলানা আবদুর রহমান রাহ. ছিলেন দারুল উলূম দেওবন্দের ছাত্র এবং শাইখুল ইসলাম আল্লামা শাববীর আহমদ উছমানী রাহ.-এর মুরীদ। শৈশব থেকেই মুফতী ছাহেব রাহ. ছিলেন অত্যন্ত কোমল নম্র স্বভাবের। দুরন্তপনা ক্রীড়ামত্ততা তার স্বভাবে ছিল না। তিনি যেমন ছিলেন মেধাবী তেমনি ছিলেন পড়াশোনায় মনোযোগী অধ্যাবসায়ী। ছাত্রজীবনের শুরু থেকেই উস্তাযদের সুনজর লাভ করেছিলেন। সবচেবেশি স্নেহ-ভালবাসা পেয়েছেন বাংলার প্রথম শাইখুল হাদীস আল্লামা সাঈদ আহমদ সন্দিপী রাহ.-এর। যিনি হযরত শাইখুল হিন্দ রাহ.-এর অন্যতম প্রিয় ছাত্র তাঁর বিশিষ্ট খলীফা এবং দারুল উলূম দেওবন্দের মজলিসে শুরার সদস্য ছিলেন। এই সৌভাগ্য আল্লাহ পাক বাঙালীদের মধ্যে শুধু তাঁকেই দান করেছিলেন।

আল্লামা সাঈদ আহমদ রাহ. ছিলেন মুফতী ছাহেব রাহ.-এর ইলমী মুরববী শায়খ। তাঁর কাছেই তিনি প্রথমবার দাওরায়ে হাদীস সমাপ্ত করেন। দ্বিতীয়বার দাওরায়ে হাদীস পড়েন দারুল উলূম দেওবন্দে। সেখানে যাদের কাছে হাদীস পড়েছেন তাঁরা হলেন আওলাদে রাসূল আল্লামা সায়্যিদ হোসাইন আহমদ মাদানী রাহ., আল্লামা ইবরাহীম বলীয়াবী রাহ., শাইখুল আদব আল্লামা এজাজ আলী রাহ., হাকীমুল ইসলাম ক্বারী তাইয়্যেব রাহ., আল্লামা ফখরুল হাসান মুরাদাবাদী রাহ. প্রমুখ। দাওরায়ে হাদীসের পর দাওরায়ে তাফসীর সমাপ্ত করে দেশে ফিরে আসেন।

দেওবন্দে থাকা কালেই বরিশালের একটি মাদরাসা থেকে বার বার খিদমতের প্রস্তাব আসতে থাকে। তিনি কিছুটা সম্মতি প্রকাশ করলেও দেশে ফিরে কালবিলম্ব না করে ছুটে গেলেন চট্টগ্রামে, মুহাদ্দিস ছাহেব রাহ.-এর কাছে। সব শুনে মুহাদ্দিস ছাহেব রাহ. বললেন, বরিশালের মাদরাসাটিকে আমি তোমার ইলমী-আমলী তারাক্কীর জন্য উপযোগী বলে মনে করছি না। আমি তো তোমার জন্য দুটি মাদরাসা ঠিক করে রেখেছি। তুমি যে কোনো একটি পছন্দ কর। বরুড়া মাদরাসা উজানী মাদরাসা। অতঃপর মাদরাসাদ্বয়ের অবস্থা সম্পর্কে কিছু কথা বললেন। কথাগুলো শুনে মুফতী ছাহেব রাহ. বুঝে নিলেন, মুহাদ্দিস রাহ.-এর মনের টান বরুড়া মাদরাসার দিকে। হযরত সেদিন মনে মনে বেশ লজ্জিত হয়েছিলেন। মুরববীকে না জানিয়ে তাদের প্রস্তাবে সম্মতি দেওয়ার জন্য তিনি হযরতের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলেন।

মুফতী ছাহেব রাহ. ১৩৭১ হিজরীতে কুমিল্লার সুপ্রাচীন বৃহত্তম দ্বীনী বিদ্যাপীঠ, আলজামেয়াতুল ইসলামিয়া দারুল উলূম বরুড়াতে, মুহাদ্দিস পদে যোগদান করেন। অল্পদিনের মধ্যেই হযরতের অসাধারণ ইলমী আমলী যোগ্যতা দক্ষতার কথা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। হযরতের প্রশংসা তখন মাদরাসার ভিতরে বাইরে সকলের মুখে মুখে। একসময় মাদরাসার তৎকালীন মুরববীগণ ফতোয়া প্রদানের গুরুভারও তাঁর উপর ন্যস্ত করেন। তখন থেকেই তিনিমুফতী  ছাহেব হুজুরনামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন।

মাদরাসার তদানন্তীন মুহতামিম ছিলেন মাওলানা ইয়াসীন ছাহেব রাহ. তাঁর ইন্তেকালের পর গুরু দায়িত্বের জন্য মুফতী ছাহেব রাহ. উপযুক্ত বলে বিবেচিত হন। অথচ হযরত সব সময়ই পদের বিষয়ে সম্পূর্ণ নির্মোহ ছিলেন। কিন্তু দায়িত্ব আসার পর তিনি তৎপর হয়ে উঠলেন এবং অসাধারণ প্রজ্ঞা দক্ষতার সাথে কাজ শুরু করে দিলেন। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, ‘আতফালুল মুসলিমীন আমওয়ালুল মুসলিমীন’ (মুসলমানদের সন্তান সম্পদ) দুটি আমানতের সমন্বয়েই মাদরাসা। তিনি বলতেন, মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক সংশ্লিষ্টদের মাঝে পূর্ণমাত্রায় দায়িত্বশীলতা আমানতদারি এসে গেলে আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকেগায়েবী নুসরতআসতে থাকবে।

হযরতের আমানতদারির কিছু দৃষ্টান্ত নিম্নে তুলে ধরছি।

৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রতিটি মানুষ যখন প্রাণভয়ে সতর্কভাবে রাত কাটাত, সাবধানে পথ চলত, সভয়ে কথা বলত অন্যান্য অনেক প্রতিষ্ঠানের মতো দারুল উলূম বরুড়াও তখন জনশূন্য হয়ে পড়ে। ছাত্র নেই, শিক্ষক নেই, সাধারণ মানুষের আনাগোনা নেই, কিন্তু হযরত মাদরাসাতেই অবস্থান করতেন। সেই ভয়ানক রাতগুলোতে একা মাদরাসা পাহারা দিতেন। কেননা, তিনি মুহতামিম; মাদরাসা তাঁর হাতে আমানত। মাস-শেষে শিক্ষকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বেতন পৌঁছে দিতেন। এমনই ছিল হযরতের দায়িত্বশীলতা এবং অধীনস্ত শিক্ষকদের প্রতি সদাচার মহানুভবতা।

স্বাধীনতার পর রব উঠল, দারুল উলূম বরুড়াকে কলেজ বানিয়ে ফেলা হবে। লক্ষ্যে একদিন স্থানীয় সাংসদ প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিরা মাদরাসায় এলেন। হযরত তাদের মুখোমুখি হলেন। বলতে গেলে হযরত সেদিন তোপের মুখে পড়েছিলেন। কিন্তু সভয়ে নয়, বাঘের মতো তিনি সেদিন তাদের মোকাবেলা করেছিলেন। সেদিনকার সেইউত্তপ্ত বৈঠকেএই অকুতোভয় মর্দে খোদা যে সাহসিকতা দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছিলেন নিঃসন্দেহে তা ছিল গৌরবজনক অধ্যায়।

আমানতদারিতে হযরত নিজের দৃষ্টান্ত নিজেই ছিলেন। একবার মাদরাসার গাছের একটি লেবু পেকে যাওয়ার উপক্রম হল। কেনার মতো কেউ নেই। মাদরাসার একটি লেবু নষ্ট হয়ে যাবেহযরত বাজারে লোক পাঠিয়ে লেবুর দাম জানলেন। পঁচিশ পয়সায় এক হালি বিক্রি হয়। কিন্তু হযরত একটিই পঁচিশ পয়সা দিয়ে কিনে নিলেন। মৃত্যুশয্যা গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত হযরতের এই অভ্যাস ছিল যে, মাদরাসায় অবস্থানকালে কেউ যদি তাঁকে টাকা-পয়সা হাদিয়া হিসেবে প্রদান করত তা তিনি মাদরাসার তহবিলে জমা করে দিতেন। অথচ অনেকের উদ্দেশ্য থাকত হযরতকেই প্রদান করা। তবে কেউ যদি এভাবে বলত-হুজুর! মাদরাসায় দিয়ে এসেছি বা দিচ্ছি, এগুলো আপনার জন্য, তাহলে নিজে রাখতেন।

ছাত্রদের আমলের পাবন্দির প্রসঙ্গে শিক্ষকদেরকে আমলের প্রতি যত্নবান হতে বলতেন। এতে ছাত্ররা প্রভাবিত হত। কেননা, শুধু মৌখিক নসীহত সুফল দান করে না।

ছাত্র-শিক্ষকদের প্রতি তাঁর আচরণ ছিল অতিশয় কোমল। ছোট্ট তালিবে ইলমটিকেও তিনি আপনি বলে সম্বোধন করতেন। শিক্ষকদের বৈঠকে অনেক সময় শাসনের স্বরে, উচ্চ-কণ্ঠে কথা বলতেন, কিন্তু তাঁর সঙ্গে উপরের-নিচের সকল শিক্ষকের ব্যক্তিগত সম্পর্ক এমন ছিল যে, প্রত্যেকেই বুঝতেন এবং বলতেন, হুজুর আমাকে খুব মুহাববত করেন।

ছাত্রদেরকে যথাসম্ভব ভালো খাবার প্রদান করা ঋণ করে হলেও শিক্ষকদের বেতন নিয়মিত পরিশোধ করা পছন্দ করতেন। তামীরের চেয়ে তালীমকেই অধিক গুরুত্ব দিতেন। ধনাঢ্যদের তোষামোদ, ফাসিকের তারিফ কখনোই করতেন না। স্থানীয় সাধারণ মুসলমানদের ইখলাসপূর্ণ সামান্য দানকে সম্মান করতেন।  আর শিক্ষকদেরকে শেষরাত্রে আল্লাহর কাছে চাওয়ার পরামর্শ দিতেন। হযরত ষাট বছর দারুল উলূম বরুড়ার খিদমত করেছেন। মুহতামিম ছিলেন চল্লিশ বছর। তিনি যতদিন প্রত্যক্ষভাবে মাদরাসা পরিচালনা করেছেন ততদিন মাদরাসা সর্বাঙ্গসুন্দর ছিল।

মাদরাসায় অবস্থানকালে তাঁর সম্মুখে লোকদের ভিড় লেগে থাকত। কেউ আসত দুআ চাইতে, কেউ তদবীর নিতে। হযরত তাদের প্রয়োজন পূরণ করার আগে হযরত ইউসুফ .-এর হিকমত অবলম্বনে কিছু নছীহত করতেন। খানিকটা জোরালোভাবেই তিনি সেই নছীহত করতেন। হযরত ইউসুফ . জেলে থাকাকালে স্বপ্নের ব্যাখ্যা জিজ্ঞাসাকারীদেরকে ব্যাখ্যা বলার আগে সুকৌশলে তাওহীদের দাওয়াত প্রদান করেছিলেন। হযরতের নছীহতে মানুষের উপকার হত। অনেকের মধ্যে পরিবর্তন এসে যেত।

সময়ানুবর্তিতা ছিল হযরতের জীবনের অনন্য বৈশিষ্ট্য। প্রত্যেক কাজে-কর্মে কঠোরভাবে সময়ের পাবন্দি করতেন। মাদরাসায় আসা-যাওয়া, সকাল-সন্ধ্যায় ঘন্টাদুয়েক আযকার-ওযায়েফের নিমিত্তে নির্জনে অবস্থান, এশার নামাযান্তে অনতিবিলম্বে শয্যাগ্রহণ এসব বিষয়ে সাধারণত নিয়মের ব্যতিক্রম হত না।

মুফতী ছাহেব রাহ. ছিলেন সুন্নতে-নববীর জীবন্ত নমুনা। ইবাদত-বন্দেগী, আযকার-ওযায়েফ, আচার-অভ্যাস সবক্ষেত্রেই তিনি সুন্নতের পূর্ণ অনুসারী ছিলেন।

সব সময়ই স্বল্পাহারী ছিলেন। সামনে যা আসত, তা থেকেই রুচিমাফিক খেয়ে নিতেন। খাবার-দাবারে অনাড়ম্বরতা পছন্দ করতেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নতের অনুকরণে খাবারের দোষ না ধরা ছিল তাঁর সারা জীবনের অভ্যাস। বাইরে তো দূরের কথা, নিজের ঘরেও তিনি খাবারের দোষ বর্ণনা করতেন না।

বিবাহ-শাদিসহ সামাজিক নানাবিধ বিষয়ে প্রচলিত সকল অমূলক রীতি-নীতির বিরুদ্ধে সুন্নতের উপর দৃঢ় অবস্থান ছিল তাঁর অসাধারণ বৈশিষ্ট্য।

গীবত-শেকায়েতের ব্যাপকতার এযুগেও তিনি তা থেকে সম্পূর্ণরূপে আত্মরক্ষা করে চলতেন। কেউ তাঁর সামনে গীবত করতে চাইলে তাকে থামিয়ে দিতেন। বলতেন, ভাই আমার নিজের ভিতরেই তো কত  দোষ! পরের দোষ দেখে লাভ কী? এমনকি শত্রুদের গীবত শোনা থেকেও কঠোরভাবে বেঁচে থাকতেন। অবশ্য হযরতের ব্যক্তিগত কোনো শত্রু ছিল না। মাদরাসা সংক্রান্ত বিষয়ে বিভিন্ন সময় অনেকেই তাঁর সঙ্গে শত্রুতা করেছে। কিন্তু তারাও ব্যক্তিগতভাবে হযরতের গুণমুগ্ধ ছিল। তিনি প্রতিশোধপরায়ণ ছিলেন না। ছোট-বড় কোনো বিষয়েই জীবনে কোনো দিন প্রতিশোধ নেননি। অথচ প্রতিশোধ নেওয়ার ক্ষমতা তাঁর ছিল। তাঁর জন্য জীবন উৎসর্গকারীর অভাব ছিল না। কিন্তু মন্দের জবাবে ভালো ব্যবহার করা- ছিল তাঁর চরিত্র।

সঞ্চয়ের প্রবণতা হযরতের মধ্যে ছিল না। প্রতিদিন যা হাতে আসত তা ঐদিনই খরচ করে ফেলতেন। কিছু স্ত্রী-সন্তানদেরকে দিতেন, কিছু আত্মীয়-স্বজন গরীবদের মাঝে বিলাতেন। হযরতের দানের হাত খুবই প্রসারিত ছিল। প্রকাশ্যে যেমন দান করতেন তেমনি গোপনেও করতেন। তাঁর ইন্তিকালের কিছুদিন পরে জনৈকা মহিলা তাঁর বাড়িতে গিয়ে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে। একপর্যায়ে কান্না কিছুটা সংবরণ হলে বলতে থাকে, মুফতী ছাহেব হুজুর আমাকে প্রতি শনিবার মঙ্গলবার দুই শত টাকা করে নিয়মিত প্রদান করতেন। তিনি টাকাটা মাদরাসায় বসেই দিতেন, কিন্তু কাউকে জানতে দেননি।

কারো সাথে সাক্ষাতে বা আলাপকালে তাঁর  মুখমন্ডলে স্নিগ্ধ হাসি লেগে থাকত। তাঁর মুখে অট্টহাসি কখনো শোনা যেত না। ঘনিষ্টজনদের বর্ণনা হল, হযরতকে আমরা কোনোদিন মিথ্যা বলতে শুনিনি। তিনি রসিকতার ছলেও মিথ্যা বলতেন না। অবশ্য তিনি রসিকতা করতেন। তবে যতটুকু সুন্নত ততটুকু এবং যেভাবে সুন্নত ঠিক সেভাবে।

অন্তরে যে কথা নেই, তা মুখে আনতেন না। কাউকে খুশি করার জন্য কিছু একটা বলা; মেহমানের সামনে কৃত্রিম আন্তরিকতা প্রকাশ করা-এসব তাঁর স্বভাবে ছিল না। অকৃত্রিম আচরণই তাঁর প্রতি সকলের শ্রদ্ধাবোধকে বাড়িয়ে তুলত।

সবার প্রতি হযরতের দৃষ্টি ছিল সমান উদার। একজনকে পরম বন্ধু বানিয়ে অন্যজনকে চরম শত্রু জ্ঞান করা তাঁর চরিত্রে ছিল না। নিম্নোক্ত বাণীটি তাঁর জীবনে সুন্দরভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল।

বন্ধুর প্রতি ভালবাসা পোষণে ধীরতা অবলম্বন কর। সত্বর কোনো দিন সে তোমার শত্রুতে পরিণত হতে পারে। আবার শত্রুর প্রতি শত্রুতা পোষণেও ধীরতা অবলম্বন কর। শীঘ্র কোনো দিন সে তোমার বন্ধুতে পরিণত হতে পারে।জামে তিরমিযী, রেওয়ায়েত : ১৯৯৭

তিনি কাউকে অবজ্ঞা করতেন না। এক রিকশাচালকও তাঁর আন্তরিক আচরণ উচ্চারণ থেকে বঞ্চিত হত না। আবার কারো প্রতি অতিরিক্ত সম্মানও প্রদর্শন করতেন না। যে যতটুকু সম্মান পাওয়ার যোগ্য তাকে তা করতেন।

হযরত ছিলেন প্রচারবিমুখ। তাঁর মাঝে নম্রতা আত্মবিলুপ্তি এত প্রবল ছিল যে, নিজেকে একজন সাধারণ মানুষের চেয়েও সাধারণ বলে মনে করতেন। তাঁর কোনো কথা কাজে আত্মগরিমা আত্মতুষ্টির লেশমাত্রও ছিল না। যারা বয়সে-যোগ্যতায় তাঁর চেয়ে অনেক ছোট; তাদের মুখ থেকেও তিনি দ্বীনের কথা মন দিয়ে শুনতেন। হযরতের সিন্ধুসম ব্যক্তিত্বের সামনে নিজের অবস্থাকে বিন্দুসম কল্পনা করতেও লজ্জাবোধ করে। তা সত্ত্বেও বিগত তিন-তিনটি রমযানে অধমের দরসে তাফসীরে (?) হযরত নিয়মিতই বসতেন। যা কিছু বলার তাওফীক হত তিনি তন্ময় হয়ে শুনতেন। মাঝে মাঝে তাঁর চোখ থেকে অশ্রু ঝরত। এতে তাঁর অসাধারণ বিনয়ের পরিচয় পাওয়া যায় এবং দ্বীন ইলমের প্রতি তাঁর অদম্য আগ্রহের কথা স্পষ্ট হয়ে উঠে।

জীবনের সর্বক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন মাটির মানুষ। আপন-পর সবার সঙ্গেই সহজভাবে মিশতেন, সহজভাবে কথা বলতেন। পরিবারের ছোট-বড় সকলের খোঁজ-খবর নিতেন। আত্মীয়-স্বজনের খবরা-খবর নিতেন। তাঁর মধুময় আচরণে বড়দের মতো ছোটরাও মুগ্ধ ছিল।

হযরতের ইবাদতের সৌন্দর্য বর্ণনা করা  কঠিন বিষয়। হযরতের নামায পড়ার ধরনটা ছিল দেখার মতো এবং দেখে শেখার মতো। কোনো পরিস্থিতিতেই তিনি তড়িঘড়ি করে নামায পড়তেন না। নামাযের সময় তিনি যেন অন্য সবকিছু ভুলে যেতেন।

নফল ইবাদতের মধ্যে কুরআন পাকের তিলাওয়াতই ছিল তাঁর সর্বাধিক প্রিয়। আবেগমথিত হয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে মৃদু আওয়াজে বলিষ্ঠ উচ্চারণে তিনি তিলাওয়াত করে যেতেন। মাহে রমযানে তাঁর তিলাওয়াতের পরিমাণ অনেক বেড়ে যেত। রমযানের শেষ দশকের ইতিকাফে প্রতিদিন এক খতম করতেন।

একদা হযরতের মনে ব্যাকুলতা সৃষ্টি হল যে, আগেকার বুযুর্গদের ব্যাপারে শুনেছি, তাদের অনেকেই দুরাকাত নামাযে পূর্ণ কুরআন শরীফ খতম করে ফেলতেন। আমরাও যদি অন্তত একদিনের জন্য চেষ্টা করে দেখতাম! হযরত তাঁর আগ্রহের কথা হাফেয উবাইদুল্লাহ সাহেবকে জানালেন। তিনি মাদরাসারই শিক্ষক ছিলেন এবং ভালো হাফেয ছিলেন। হাফেয সাহেব রাজি হয়ে গেলেন। রমযানের এক রাতে নামায শুরু হল। অনেকেই শরীক হলেন। হাফেয সাহেব প্রথম রাকাতেই একটানে উনত্রিশ পারা পড়ে ফেললেন। দ্বিতীয় রাকাতে ত্রিশতম পারা পড়ে নামায শেষ করলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পিছনে মুকতাদী টিকল মাত্র দুজন। একজন দাড়িয়ে, অন্যজন বসে। যিনি শেষ পর্যন্ত দাড়িয়ে থাকতে পেরেছিলেন তিনি মুফতী ছাহেব রাহ.

হযরতের দুআ কবুল হত বলে জনশ্রুতি ছিল। নানাবিধ সমস্যা-সংকটে লোকেরা দুআর জন্য তাঁর কাছে ছুটে আসত। হযরতের দুআর শব্দ-বাক্য ছিল নির্বাচিত, সংক্ষিপ্ত, কিন্তু ব্যাপক অর্থবহ।

তিনি অতিশয় কোমল হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন। মুনাজাতে হাত তুলতেই অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়তেন। নিজের শিক্ষকদের নাম শুনলে, আকাবিরে উম্মতের আলোচনা শুনলেও তিনি কেঁদে ফেলতেন। ওয়ায-নছীহতের ক্ষেত্রেও হযরতের ধারা ধরন ছিল ব্যতিক্রম। চাঁদপুরে নিজ এলাকাতে যখন আসা-যাওয়া করতেন তখন জুমার নামায শেষে দ্বীনের মৌলিক বিষয়াদি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করতেন। তাঁর আলোচনা দীর্ঘ হলেও শ্রোতারা অতিষ্ঠ হত না। মাদরাসায় অবস্থানকালে প্রায়ই ফজরের নামায আশপাশের কোনো মহল্লার মসজিদে গিয়ে পড়তেন। অনেক সময় নিজেই আযান দিতেন। হযরতের আযান শুনলে মহল্লাবাসী পরস্পর ডাকাডাকি করে মসজিদে হাজির হয়ে যেত। হযরত নামাযের পর বয়ান করতেন। গতানুগতিক ধারায় কথা বলতেন না। শ্রোতাদেরকে জরুরি কিছু বুঝাতে চাইতেন। তারাও বুঝতে চেষ্টা করত। তাদের মাঝে পরিবর্তন আনতে চাইতেন। অল্প-বিস্তর পরিবর্তনও পরিলক্ষিত হত।

মাহফিলে দাওয়াত হলে ভরা মজলিসে বয়ান করার জন্য অপেক্ষা করতেন না; বরং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মাহফিলের শুরু ভাগে বয়ান করে ফিরে আসতেন এবং নিজের মামুলাতে মশগুল হতেন।

নারী-পুরুষ, বালক-বৃদ্ধ, ধনী-নির্ধন, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সুন্নী-বেদআতী, স্বজাতি-বিজাতি সকলে মত পথের পার্থক্য ভুলে প্রাণভরে ভালবাসতেন মুফতী ছাহেব রাহ.কে। আলিম-ওলামাদের প্রতি সাধারণ মানুষের মনে বীতশ্রদ্ধা ক্রমঃবৃদ্ধির বর্তমান সময়টিতেও হযরত ছিলেন ব্যতিক্রম।

কথাটি স্বতঃসিদ্ধ যে, দূরের মানুষের কাছে মকবুল হওয়া সহজ, কিন্তু কাছের মানুষের প্রিয় হতে পারা নিতান্তই কঠিন। কিন্তু হযরতের বেলায় এরও ব্যতিক্রম ঘটেছে। হযরতের গ্রহণযোগ্যতা দূরের চেয়ে কাছের লোকদের নিকট ছিল বেশি। হযরতের বয়স যখন সত্তরের কোঠায় তখন একটি কঠিন রোগে তাঁর অপারেশনের প্রয়োজন হল। অপারেশনের পর হুঁশ ফিরতে বেশ কয়েক ঘন্টা দেরী হয়। হযরতের জীবনের ব্যাপারে বলতে গেলে সবাই তখন নিরাশ হয়ে পড়ে।

হযরত চল্লিশ দিন ক্লিনিকে ছিলেন। সময়ে চাঁদপুর, বরুড়াসহ বহু দূর-দূরান্ত থেকে শত শত মানুষ হযরতকে দেখার জন্য ছুটে আসে। তাদের বেদনাক্লিষ্ট চেহারা দেখে এবং মুখের আহাজারি শুনে বোঝা যেত, তাদের হৃদয়ের কত গভীরে মুফতী ছাহেব রাহ.-এর স্থান। অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে ক্লিনিকের ডাক্তার কর্মচারীরা অবাক হয়ে যেতেন। এদিকে মাদরাসার আশপাশের গ্রামের মহিলারা নফল নামায পড়ে, নফল রোযা রেখে হযরতের জন্য দুআ করতে থাকেন। হযরতের যে কোনো বিপদে তারা এমনই করত।

প্রেসিডেন্ট এরশাদের শাসনামলের প্রথম দিকে মাদরাসার ক্ষমতার মোহগ্রস্ত কিছু লোক মার্শাল তে হযরতসহ আরো অনেকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। যেদিন হযরত হাজিরা দিতে যাবেন সেদিন শত শত লোক আশপাশের এলাকা খালি করে ছুটে আসে মাদরাসা প্রাঙ্গনে। প্রতিপক্ষের ব্যাপারে হযরতের একটিমাত্র ইঙ্গিতের জন্য তারা একপায়ে দাঁড়িয়ে। কিন্তু হযরত তাদেরকে কিছু বললেন না। প্রতিটি মামলার ব্যাপারেইউপরেতদবীর করার জন্য, ঘনিষ্ঠ লোকদের অভাব ছিল না। কিন্তু হযরত কখনোই এসবের তোয়াক্কা করেননি। উপস্থিত লোকদেরকে সান্ত্বনা দিয়ে, একখানা কুরআন শরীফ হাতে করে তিনি রওয়ানা হয়ে গেলেন। আদালত প্রাঙ্গনে পৌঁছে যোহর আসরের নামায জামাতের সঙ্গে আদায় করলেন। মগরিবের পূর্ব মুহূর্তে হযরতের ডাক পড়ল। তিনি ভিতরে প্রবেশ করলেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল, আপনি কি দোষী? হযরত কিছুটা উত্তেজিত কণ্ঠে জবাব দিলেন, দোষী যদি না- হতাম তাহলে ঠিক নামাযের সময়টাতে কেন আমার ডাক পড়ল? আপনারা তো অফিসার মানুষ, আপনাদের তো আর নামায কালাম লাগে না। আমি এখানে এসেও যোহর-আসর জামাআতের সাথে পড়েছি। আর মাগরিবের সময় আপনারা ডেকে বসলেন। হযরতের অবস্থা থেকে এবং অপ্রত্যাশিত জবাব শুনে সেনা অফিসার রীতিমতো অবাক হলেন। হযরতকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন মনে করলেন না। মামলা সংশ্লিষ্ট বিভাগে সোপর্দ হল। তদন্তকারীরা মাদরাসায় এসে হিসাব-কিতাবের স্বচ্ছতা দেখে সন্তুষ্ট হল এবং একটি পরিচ্ছন্ন রিপোর্ট তৈরি করে দিয়ে বিদায় নিল। যার একটি কপি এখনো মাদরাসায় সংরক্ষিত আছে।

মুফতী ছাহেব রাহ.-এর পারিবারিক জীবনও ছিল আমাদের জন্য আদর্শ। শৈশবে মায়ের গৃহস্থালী কাজে-কর্মে সহায়তা করতেন। পিতার বার্ধক্যে তার সেবার প্রয়োজনে প্রাণপ্রিয় প্রতিষ্ঠান দারুল উলূম বরুড়া থেকে ইস্তফা দিয়ে বাড়ির নিকটে জাফরাবাদ মাদরাসায় গিয়ে যোগদান করেন। হযরত নিয়মিত বাড়িতে আসা-যাওয়া করতেন এবং নিরলসভাবে পিতার খিদমত করতেন। এভাবে চার বছর কেটে গেল। পিতার ইন্তেকালের পর দারুল উলূম বরুড়ার প্রতিনিধি দল তাঁর বাড়িতে গিয়ে তাকে পুনরায় বরুড়ায় ফিরে আসতে অনুরোধ করে। হযরত তাদের অনুরোধ রক্ষা করেন।

ভাইবোনদের মধ্যে হযরতই ছিলেন বড়। পিতার রেখে যাওয়া স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি তিনি শরীয়ত মোতাবেক ভাগ করেন এবং সবাইকে পছন্দমতো অংশ নিতে বলেন। সবার নেওয়ার পর অবশিষ্ট অংশ তিনি প্রসন্নবদনে-সন্তুষ্টচিত্তে গ্রহণ করেন।

স্ত্রীর অধিকার মর্যাদার বিষয়ে হযরত সবসময়ে সচেতন ছিলেন। একদিন হযরতের স্ত্রী বললেন, বাড়িতে জামাই আসছে, আপ্যায়নের তো তেমন কিছুই নেই। হযরত তখন মাদরাসায় রওয়ানা হচ্ছিলেন। মুহূর্তে এমন কিছু শুনতে অপ্রস্ত্তত ছিলেন। খানিকটা বিরক্তি প্রকাশ করে বলে উঠলেন, তা আমাকে বলে লাভ কী? আমি কী করব? প্রত্যাশিত জবাবে স্ত্রী কেঁদে ফেললেন। হযরত মাদরাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলেন। কিন্তু কিছু দূর গিয়ে পুনরায় বাড়ি ফিরে এলেন এবং স্ত্রীর কাছে ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাইলেন। এভাবেই তিনি জীবন সঙ্গীনীর অন্তরকে জয় করে অনেকটা নিজের মতো করে তাকে গড়ে নিয়েছিলেন। ভাগ্যবতী মহিলা আমৃত্যু ইবাদত-বন্দেগী দ্বীন সম্পর্কে বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। জীবনের শেষ অর্ধেকে দিনরাত্রির বেশির ভাগ সময়ই তিনি ইবাদতে কাটিয়েছেন।

হযরত তার দুই ছেলেকে মানুষ করার জন্য শাসন-সোহাগের পাশাপাশি শেষ রাতের মুনাজাতে চোখের পানিতে বুক ভাসাতেন। সেই তপ্ত অশ্রুর প্রতিটি ফোঁটা আল্লাহ পাক নিশ্চয়ই কবুল করেছেন। শেষ বয়সে ছেলেদের প্রসঙ্গ উঠলে তিনি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতেন এবং আনন্দ প্রকাশ করতেন।

মৃত্যু সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘মৃত্যু একটি সেতু, যা বন্ধুকে বন্ধুর কাছে পৌঁছে দেয়।হযরতের কথাবার্তা শুনলে মনে হত, তিনি মৃত্যুর জন্য প্রস্ত্তত হয়ে বসে আছেন। ডাক এলেই চলে যাবেন। বছর দুয়েক আগে থেকে তিনি আরো অধীর হয়ে উঠেন। তাঁর অবস্থা দৃষ্টে বড় ছাহেবজাদা প্রায়ই বলতেন, আববাজান মনে হয় আমাদের মাঝে আর বেশি দিন থাকবেন না। হাদীস শরীফে এসেছে, ‘যে আল্লাহর সাক্ষাত পছন্দ করে আল্লাহ পাকও তার সাক্ষাত পছন্দ করেন।মুসলিম শরীফ হাদীস : ২৬৮৩

আববাজানের কাছে এখন সব কিছুই অপ্রিয়। শুধু একটি বিষয়েরই অপেক্ষা-মাওলার সাক্ষাত।

বিগত রমযানের শেষ দশকের এতেকাফ করে বাড়িতে ফিরলেন। ঈদের দিনের সকাল পর্যন্ত কোনো নতুন রোগের আলামত পাওয়া যায়নি। কিন্তু ঈদের নামায শেষে ঘরে ফিরেই তিনি শয্যাগ্রহণ করলেন এবং জানালেন, তাঁর শরীরে জ্বর অনুভূত হচ্ছে। দুয়েক দিনের ব্যবধানে জ্বর সেরে গেলেও শরীরের দুর্বলতা ক্রমশ বাড়তে থাকে। কিন্তু চিকিৎসার জন্য তিনি কোনো চিকিৎসালয়ে যেতে রাজি হচ্ছিলেন না। হয়ত বুঝতে পেরেছিলেন, তিনি আর সুস্থ হবেন না। সুতরাং মৃত্যুটা বাড়ির আমলী পরিবেশে হলেই ভালো হয়। বাড়িতেই ডাক্তার ডেকে চিকিৎসা চালানো হচ্ছিল। এমতাবস্থায়ও তিনি চলতি শিক্ষা বর্ষের প্রথম দিনে মাদরাসায় আসতে উদগ্রীব হয়ে উঠেন। তাঁকে মাদরাসায় আনা হল এবং মাদরাসার মসজিদে জমায়েত ছাত্রদের সামনে নিয়ে বসানো হল। কিন্তু তিনি কিছুই বলতে পারেননি। বেশিক্ষণ বসেও থাকতে পারেননি। এটিই ছিল মাদরাসায় হযরতের শেষ আসা। দিন দিন অবস্থার অবনতি ঘটছিল। এদিনগুলোতে বেশির ভাগ সময় তিনি নীরব হয়ে থাকতেন। অবশেষে হযরতের বহু প্রতিক্ষিত দিন-ক্ষণ ঘনিয়ে এল। তিনি তিন বার আল্লাহু আকবার বলে বলে এপাশ ওপাশ হলেন। অতঃপর কী দেখে জানি একটু হাসলেন। কাছে যারা ছিলেন সবিস্ময়ে তাঁর দিকেই তাকিয়েই ছিলেন। আর তিনি ততক্ষণে মাওলার সান্নিধ্যে পৌঁছে গেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। দিনটি ছিল সোমবার সময় রাত ১১ টা ৩০ মিনিট। ২৬ যিলকাদাহ ১৪২৯ হিজরী মোতাবেক ২৫ নভেম্বর ২০০৮ .

মৃত্যুর পূর্বের সেই হাসি তাঁর ঠোঁটে লেগেই ছিল। হাসি নিয়েই তিনি কবরের শয্যাগ্রহণ করেছেন। মৃত্যুর পর হযরতের চেহারার সৌন্দর্য বহু গুণ বেড়ে গিয়েছিল। তাঁর উন্নত নাসিকায় যুক্ত হওয়া এক অপার্থিব প্রভা যে কাউকে বিস্মিত করেছে।

সেদিন রাত্রে এদেশের প্রবীণতম বরেণ্য আলেম মাওলানা আশরাফ আলী ছাহেব স্বপ্নে দেখলেন, মুফতী ছাহেব রাহ.কে মাদরাসায় এনে পশ্চিম পার্শ্বস্থ ছাত্রাবাসের বারান্দায় রাখা হয়েছে। আর পুরো মাঠ লোকে ভরে গেছে। লাশের পাশে শুভ্র পোশাক পরিহিত অপূর্ব সুন্দর কিছু লোক। একজন অপরজনকে জিজ্ঞাসা করছে, উনি কে? অপরজন জবাবে বলছে, উনি মাহবুবে খোদা। স্বপ্ন ভেঙে গেল। পরদিন জানাযায় এসে দেখলেন, হযরতের লাশটি ঠিক সেখানেই রাখা আছে, যেখানে তিনি স্বপ্নে দেখেছেন।

হযরত মাওলানা আশরাফ আলী দামাত বারাকাতুহুম বলেছেন, আমি অনেক আলেম-উলামার মৃতদেহ দেখেছি। কিন্তু এমন দ্বীপ্তিময় চেহারা কখনো দেখিনি।

হযরতের জানাযায় এত মানুষ উপস্থিত হয়েছিল যা ছিল অকল্পনীয়। স্মরণকালের ইতিহাসে এই অঞ্চলে এমন জানাযা দ্বিতীয়টি হয়নি। মাদরাসার গোটা এলাকা কানায় কানায় ভরে যায়। পুকুরে হাঁটু পানি পর্যন্ত নেমে লোক নামাযে দাঁড়িয়েছে। রাস্তার বহু দূর পর্যন্ত কাতার হয়েছে। যে যেখানে সামান্য জায়গা পেয়েছে সেখানে দাঁড়িয়েই নামাযে শরিক হয়েছে। অনেক হিন্দু অদূরে দাঁড়িয়ে অভূতপূর্ব দৃশ্য অবলোকন করেছে।

সালাফের সময়ে একটি কথা প্রসিদ্ধ ছিল, ‘আমাদের মাঝে এবং তোমাদের মাঝে পার্থক্য নির্ণীত হবে জানাযার দিনে।অর্থাৎ কারা হকপন্থী এবং কারা বাতিলপন্থী জানাযার দিনে তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। কথিত আছে, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ.-এর জানাযা দেখে অনেক অমুসলিম মুসলমান হয়েছে।

আল্লাহ তাআলা তাঁর কবরকে নূর দ্বারা পরিপূর্ণ করে দিন এবং তাঁকে জান্নাতুল ফিরদাউসের সুউচ্চ মাকাম নসীব করুন। আমীন। #

 

 

advertisement