জুমাদাল আখিরাহ ১৪৩০   ||   জুন ২০০৯

বাইতুল্লাহর মুসাফির-২২

মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

পরদিন তথ্যমন্ত্রণালয় থেকে কর্মসূচী দেয়া হলো মাদায়েন পরিদর্শনের। হযরত অস্থির হয়ে বললেন, তাহলে কি ছদরের সাথে মুলাকাত হবে না? আমি সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, আশা করি, দুএকদিনের মধ্যেই হবে।

হযরত শুধু বললেন, আচ্ছা দেখা যাক।

মাদায়েনে ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় বস্ত্ত হলো কাখে কিসরা। তাছাড়া রয়েছে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয় ছাহাবী হযরত সালমান ফারসী (রা) এবং আরো দুজন ছাহাবীর মাযার। এছাড়া  মাদায়েনের মাটিতে আছে নাম না  জানা আরো অসংখ্য ছাহাবী ও মুজাহিদীনের কবর। কারণ কাদেসিয়ার যুদ্ধ তো ছিলো শুধু রক্তের স্রোত! মাদায়েনে, ইরাকে, ইরানে, ইস্পাহানে এবং মুসলিম জাহানের সবখানে রক্তের স্রোত পার হয়েই তো আমরা পৌঁছেছিলাম ।

এখন মাদায়েন একটি ছোট শহর। কিন্তু সুদূর অতীতে তা ছিলো পারস্যের রাজধানী। পারস্যসম্রাট কিসরা এখানেই বাস করতেন। পারস্যের রাজপ্রাসাদের ভগ্নাবশেষই এখন কাখে কিসরা

মাদায়েনের আবহাওয়া, পরিবেশ ও ভৌগলিক অবস্থান ছিলো খুবই উপযোগী। দজলানদী তখন  শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ছিলো। দজলার পূর্ব-পশ্চিম উভয় তীরে শহরের জনপদ ছিলো। তবে শুধু পূর্ব অংশকে মাদায়েন বলা হতো। অর্থাৎ শহরের মূল জনপদ ছিলো পূর্বতীরে। এখন অবশ্য নদী শহর থেকে বেশ দূরে।

মাদায়েন ছিলো এত সুরক্ষিত যে, এর দুর্গকে মনে করা হতো অপরাজেয়। কেননা দুর্গের নিকট দিয়ে প্রবাহিত দজলা ছিলো একটি অলঙ্ঘনীয় প্রাকৃতিক পরিখা। তাই কাদেসিয়ার চূড়ান্ত যুদ্ধে পরাজিত পারসিকরা মাদায়েনে আশ্রয় নেয়ার পর কল্পনাও করেনি যে, মুসলিম বাহিনী দজলা পার হয়ে দুর্গে চড়াও হতে পারে! কিন্তু আল্লাহর গায়বী মদদ যাদের সঙ্গী, প্রকৃতির কোন বাঁধা কি পারে তাদের গতি রোধ করতে! পাহাড়, নদী, মরুভূমি!

ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে মাদায়েনজয়ের অবিশ্বাস্য ঘটনা। মুসলিম বাহিনী যখন দজলার তীরে এসে দাঁড়ালো, দজলা তখন সমুদ্রের মত উত্তাল। কিন্তু মুসলিম সিপাহসালারের ঈমানী জোশে ভরপুর বয়ান মুজাহিদীনের দিলের দজলাতেও পয়দা করলো বিরাট মউজ! ঘোড়ার পিঠে বসে আল্লাহু আকবার বলে তারা ঝাঁপ দিলো দজলার পানিতে! মউজের সাথে খেলা করে ছেলেখেলার মতই তারা পার হয়ে গেলো দজলানদী! অপর তীরে দাঁড়িয়ে এ অভাবনীয় দৃশ্য দেখে পারসিক বাহিনী উদ্ভ্রান্তের মত পালাতে লাগলো। তাদের ধারণা হলো, এরা মানুষ নয়, দেওদানো! আল্লাহর নবীর ছাহাবাদের হাতে সেই যে মাদায়েনের পতন হলো, আজো মাদায়েন মুসলিম ভূখন্ড রূপে মুসলিম উম্মাহর হাতে রয়েছে। পার্থক্য শুধু এই, মুসলিম ভূখন্ড  রয়ে গেছে, কিন্তু সেই মুসলিম বাহিনী আর নেই। তাই সেদিন তারা ভয় করতো, আজ আমরা ভয় করি! সেদিন আমরা মেরেছি, আজ নিজেরা মারামারি করে মরছি!

সকালে নাস্তার পর আমরা হোটেল থেকে রওয়ানা হলাম। বাগদাদের রাস্তা মানেই সবুজ গাছের ছায়া! ছায়ায় ছায়ায় চলে যাওয়া যায় যত দূর মন চায়!

পঞ্চাশ কিলোমিটার দীর্ঘ বাগদাদ-মাদায়েন সড়কের উভয় পার্শ্বে শুধু খেজুরবাগান, আর খেজুরবাগান। ইরাক খেজুরের দেশ জানতাম; এখানে এসে জানলাম, মানুষের জনসংখ্যার চেয়ে খেজুরের জনসংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশী!

দুপাশের খেজুরবাগানের শোভা দেখতে দেখতে পথ ফুরিয়ে গেলো। মাদায়েন ইরানের সীমান্তবর্তী এলাকা। কিন্তু যুদ্ধের কোন চিহ্ন ছিলো না কিছু সৈন্যের চলাচল এবং দুএকটি সেনা চৌকি ছাড়া।

মূল শহরের আগেই মাদায়েনের হালকা জনবসতি শুরু হলো এবং অল্প পরেই আমরা শহরে প্রবেশ করলাম। প্রথমেই দেখা যায় সালমানপাক, অর্থাৎ হযরত সালমান ফারসী (রা)-এর মাযার ও মসজিদ। কিন্তু এখানে না থেমে গাড়ী এগিয়ে গেলো শহরের অপর প্রান্তে, কিসরার রাজপ্রাসাদের ভগ্নাবশেষ যেখানে।

ইতিহাসের বর্ণনায় বলা হয়, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাবকালে এ রাজপ্রাসাদেরই চৌদ্দটি মিনার ধ্বসে পড়েছিলো। দুর্গ-প্রাসাদ কিছুই এখন নেই, ধ্বংসস্তূপ ছাড়া। শুধু একটি দীর্ঘ ও সুউচ্চ প্রাচীর দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী এবং শিক্ষার উপকরণ হয়ে। সে যুগে এত উঁচু প্রাচীর তৈরী হয়েছে, ভাবতে অবাক লাগে! প্রাচীর -গাত্রের ফাটল সম্পর্কে আমাদের বলা হলো, সেটা গম্বুজ ধ্বসে পড়ার সময়র সৃষ্টি। বিভিন্ন সময় বিদেশী বিশেষজ্ঞ এবং উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে ফাটল সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হলেও  সব উদ্যোগ-প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। এই ভগ্নপ্রাচীরের সামনে কিছুক্ষণের জন্য আমি

স্তব্ধ হয়ে ছিলাম। এটা যেন চৌদ্দশ বছরের ঝড়ঝাপটা সহ্য করে এখনো দাঁড়িয়ে আছে শুধু আমারই শিক্ষার জন্য। এ প্রাচীর যেন নীরব ভাষায়  বলছে, হকের মোকাবেলায় এভাবেই গুঁড়িয়ে যায় বাতিলের মজবূত কেল্লা। কোরআনের (তরজমা) বাণী-

আপনি বলুন, সত্য এসেছে এবং মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে। মিথ্যা তো বিলুপ্ত হবেই।

ভগ্নপ্রাচীর যেন বলছে, যদি বুঝতে চাও, আমাকে দেখো। আমার ভগ্ন ইটগুলো থেকে শিক্ষা গ্রহণ করো।

প্রাসাদের এ প্রাচীরটিও হয়ত গুঁড়িয়ে যেতো, কিন্তু আল্লাহ তাঁর কুদরতের নিদর্শনরূপে এখনো তা বাকি রেখেছেন। যত দিন আল্লাহর ইচ্ছা, তা বাকি থাকবে পরবর্তীদের শিক্ষার জন্য। ফিরআউন সম্পর্কে যেমন আল্লাহ বলেছেন- (তরজমা)

আজ তোমাকে নাজাত দেবো, তোমার দেহযোগে, যাতে তুমি হতে পারো তোমার পরবর্তীদের জন্য নিদর্শন।

আমরা ঘুরে ঘুরে দেখছি, কিন্তু আমাদের হযরতের যেন এখানে দেখার কিছু নেই। হয়ত তাঁর দেখার বিষয় আরো ঊর্ধ্বের কিছু এবং তাঁর শিক্ষা গ্রহণের বিষয়  অন্যকিছু! তাই কিছুক্ষণ হেঁটে, কিছু কিছু দেখে তিনি একপাশে মুছল্লা বিছিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন নামাযে। এই সব ধ্বংসাবশেষ যার কুদরতের নিদর্শন তাঁর সমীপে আত্মনিবেদন করাই তো তাঁর প্রিয় বান্দাদের শান! হযরত নামায পড়লেন, আমরা ধীরে ধীরে ঘুরে ঘুরে সব দেখলাম। প্রাচীরের সংলগ্ন কিছু কক্ষ এখনো অক্ষত রয়েছে, আর মাঝখানে রয়েছে সুউচ্চ তোরণ; সম্ভবত প্রাসাদের প্রধান তোরণ। সেটা অতিক্রম করে সামান্য এগুলেই  একটি সুপ্রশস্ত কক্ষের কিছু চিহ্ন। সম্ভবত কিসরার দরবার কক্ষ। ভগ্নাবশেষের যে প্রতাপ তাতে সহজেই বোঝা যায়, যৌবনে কেমন ছিলো রাজপ্রাসাদ ও তার সম্রাটদের প্রতাপ-পরাক্রম!

কে জানে, এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইটপাথরের মাঝে লুকিয়ে আছে মানুষের ভাগ্যের ভাঙ্গা-গড়ার কত করুণ ইতিহাস! ধ্বংসাবশেষের ইটপাথর যদি কথা বলতে পারতো, তাহলে জানা যেতো ইতিহাসের কত অজানা কাহিনী! শোনা যেতো কত অট্টহাসি, কত আর্তনাদ! শোনা যেতো কখনো নুপুরের ঝংকার, কখনো জল্লাদের হুঙ্কার!

প্রবেশদ্বারের ঝুলন্ত পর্দায় স্বর্ণের কারুকাজের পরিমাণই নাকি ছিলো দশলক্ষ ভরি! তাহলে রাজপ্রাসাদে সম্পদের পরিমাণ ছিলো কত? এই যে বিশাল ভগ্নপ্রাচীর, এটা যেন ইতিহাসের চলমান স্ক্রীন, যাতে একের পর এক ভেসে উঠছে ঘটনার জীবন্ত ছবি। আমি যেন দেখতে পেলাম সেই নরাধম সম্রাটকে, ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে যে ছিঁড়ে ফেলছে দরবারে নবুয়তের প্রেরিত পত্র। বস্ত্তত সেদিনই হয়ে গিয়েছিলো বিশাল বিস্তৃত পারস্যসাম্রাজ্যের ভাগ্যের ফায়ছালা। কেননা আল্লাহর নবী এই বলে তাদের অভিশাপ দিয়েছিলেন-

আমার পত্র সে ছিঁড়ে ফেলেছে! আল্লাহ যেন তার রাজ্যকে টুকরো টুকরো করে ফেলেন।

আমি যেন দেখতে পেলাম, অহঙ্কারী সম্রাটের উদ্ধত মস্তক থেকে লুটিয়ে পড়া রাজমুকুট গড়াগড়ি খাচ্ছে মুসলিম সেনাপতির পদপ্রান্তে!

আবার দেখতে পেলাম, পারস্যের সেনাপতি মহাবীর রুস্তমের সুসজ্জিত দরবারে প্রবেশ করছেন মুসলিম দূত ছাহাবী হযরত রিবয়ী ইবনে আমির! ঠিক সেই জীর্ণ পোশাক, শীর্ণ বাহন ও সাধারণ ঢাল-তলোয়ার, যা পড়েছি ইতিহাসের পাতায়! ঘোড়ার পিঠে চড়েই তিনি এলেন ভরা দরবারে! ঘোড়া থেকে নামলেন এবং ঘোড়াসহ মূল্যবান গালিচা মাড়িয়ে এগিয়ে গেলেন। একটি তাকিয়ার সাথে ঘোড়া বাঁধলেন ...।

ঐ তো বজ্রদৃপ্ত কণ্ঠে তিনি বলছেন, আমি নিজে আসিনি, এসেছি তোমাদের ডাকে। আমার পোশাক, আমার পদক্ষেপ তোমাদের পসন্দ হয় তো ভালো, নচেৎ আমি ফিরে যাই।

সেনাপতি রুস্তম কিছুটা ক্রোধের ভান করে ভীত কম্পিত কণ্ঠে বললেন, কী জন্য এসেছো তোমরা?

হযরত রিবয়ী বিন আমিরের ঠেঁটে যেন নূরের হাসি! তিনি বললেন, আল্লাহ আমাদের পাঠিয়েছেন যেন তোমাদের বের করে আনি মানবের দাসত্ব থেকে এক আল্লাহর দাসত্বের দিকে এবং জাগতিক সংকীর্ণতা থেকে পরকালীন প্রশস্ততার দিকে এবং সকল ধর্মের অনাচার থেকে ইসলামের সুবিচারের দিকে।

এভাবে ভগ্নপ্রাচীরের বিশাল স্ক্রীনে ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহ ভেসে চলেছে, আর আমি দেখে চলেছি; কিন্তু হঠাৎ থেমে গেলো সবকিছু! একি, ঝাঁকে ঝাঁকে বিমান উড়ছে! টেংক-কামানের গোলার আওয়ায আসছে! কেন, কার বিরুদ্ধে! দাউ দাউ আগুন জ্বলছে এ কোন্ শহর! অপরিসীম বেদনায় মনটা আমার সত্যি ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো।

***

এখানে সরকারী খেজুরবাগান ছিলো। গাছে গাছে বড় বড় পাকা খেজুর ঝুলছে। তাতে অতি বড় নির্লোভের জিভেও পানি আসে! মাটিতেও পড়ে আছে অনেক। এভাবেই পড়ে থাকে। কুড়িয়ে নেয়ার কেউ নেই। আমি এবং মাওলানা হাবীবুল্লাহ মেছবাহ কিছুক্ষণ দ্বিধা-সংকোচের পর একটা দুটো খেজুর মুখে দিলাম। অপূর্ব! সত্যি অপূর্ব এর স্বাদ ও গন্ধ! মুহসিনের সঙ্গে বন্ধুত্বের বন্ধন এমন ছিলো যে, দেশে ফেরার সময় তিনি আমাদেরকে এক ছড়া করে খেজুর উপহার দিয়েছিলেন। ঢাকা বিমানবন্দরে এক ভদ্রলোক প্রথমে আইনের কী একটা ফ্যাকড়া তুললেন, তারপর বড় পীরের বরকত বলে অর্ধেকটা রেখে বাকি অর্ধেকটা দয়া করে ছেড়ে দিলেন। আমিও অনেক কষ্টে কৃতার্থের হাসি হাসলাম। আমাদের দেশে আইন যেমন অদ্ভুত তেমনি অদ্ভুত সে আইনের প্রয়োগ! অদ্ভুত হবে নাই বা কেন! ভৌগলিক জাতীয়তার বর্তমান পৃথিবীতে আমরাই যে একমাত্র জাতি, যাদের পরিচয়সত্তা এখনো অনির্ধারিত। তাই অর্ধেক ভোটার বাঙ্গালী, অর্ধেক ভোটার বাংলাদেশী। সত্যি অদ্ভুত! এদেশের সবকিছু বড় অদ্ভুত! নেতা, জনতা, নদী-নারী, মৃত্তিকা, বৃক্ষলতা! চাকুরিজীবী এবং বুদ্ধিজীবী!

যাক, আবার ফিরে যাই মাদায়েনের সরকারী খেজুরবাগানে। একটা দুটো খেজুর খেয়ে ভিতরের সেই চিরবাঙ্গালীটা বোধ হয় জেগে উঠলো। ভাবলাম, কয়েকটা পকেটে পুরে নেই; হোটেলে বসে খাবো। হাবীবুল্লাহ মেছবাহ বাঁধা দিলেন, তাও একেবারে বনী ইসরাইলের মান্না-সালওয়ার হাওয়ালা দিয়ে। আমি শরমিন্দা হয়ে সে ইচ্ছা ত্যাগ করলাম। হজ্বের সফরটুকুই ছিলো হাবীবুল্লাহ মেছবাহ ছাহেবের সঙ্গে আমার সঙ্গ। সফরের আগে বা পরে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় ছিলো, দেখা ছিলো, সঙ্গ ছিলো না। জীবনের ব্যস্ততার স্রোতে আমরা এমনই ভেসে যাই যে, মন চায়, তবু প্রিয় মানুষদের সঙ্গ আর লাভ করা হয় না। তিনি আজ জীবনের অন্য পারে। এমনকি তাঁর জানাযারও সঙ্গ আমি গ্রহণ করতে পারিনি। তবে সফরের ঐ পবিত্র সময়ের সঙ্গটুকু এখনো আমি মনে রেখেছি। আল্লাহ তো সত্যবাদীদের সঙ্গ গ্রহণ করতে বলেছেন। আমার অভিজ্ঞতায় তিনি ছিলেন তেমনই একজন সত্যবাদী। আল্লাহ তাঁকে জান্নাত নছীব করুন।

খেজুরবাগানে হযরত নামাযের স্বাদ গ্রহণ করছেন, আমরা গ্রহণ করছি খেজুরের স্বাদ। এদিকে আখতার ফারূক ছাহেব করে বসলেন আরেক কান্ড! খেজুরকা  বেয়ে তর তর করে  উঠে গেলেন উপরে। শুধু খেজুর উদ্দেশ্য হলে প্রয়োজন ছিলো না। গাছের গোড়ায় মাটিতেই পড়ে ছিলো দেদার। ইরানসীমান্ত অবশ্য খুব কাছে। ভাবতে পারতাম, প্রিয় ইরানকে আরেকবার দেখতে চান, কিন্তু ঐটুকু উচ্চতা থেকে তো ইরানের মাটি দেখা যাওয়ার কথা নয়! তাহলে কেন গাছ বাওয়া! তিনি কি ভুলে গিয়েছিলেন যে, ইরাক-ইরান যুদ্ধবন্ধের গুরুত্বপূর্ণ মিশনের তিনি সদস্য! অনেক সময় আমরা অনেক কিছু ভুলে যাই। যেমন খেজুর পকেটে পোরার সময় আমিও ভুলে গিয়েছিলাম। অনেক সময় অকারণেই আমরা শৈশবে ফিরে যেতে চাই। তখন সেটা হয়ে পড়ে দৃষ্টিকটু। কারণ শৈশবের যে পবিত্র সত্তা সেটা তো আমরা বলি দিয়ে ফেলি অনেক আগেই যৌবনের বেদিতে, থেকে যায় শুধু শৈশবের খোলসটুকু। আর এত বড় মানুষ কি ঐ ছোট্ট খোলসে ফিরে যেতে পারে!

আমার পাশে দাঁড়িয়ে মুহসিন দৃশ্যটি দেখে মিটিমিটি হাসছিলেন। সে হাসির তরজমাটি আমার কাছে মনে হলো এরকম, আমার দেখা হলো তোমাদেরকে এবং তোমাদের শায়খকে। মুখে শুধু বললেন, বাগদাদভ্রমণ তোমরা উপভোগ করছো দেখে আমার ভালো লাগছে।

আমার খটকা লাগলো। মুহসিনের ভাবনায় আমাদের ইরাকসফর কি তাহলে নিছক ভ্রমণ! এবং সে ভ্রমণ আমরা উপভোগ করছি! মুহূর্তের আচরণ অনেক সময় দীর্ঘদিনের ভাবচিত্র মুছে ফেলে।

আমাদের ঘুরে বেড়ানো, কাখে কিসরা দেখা, খেজুর খাওয়া এবং হযরতের জায়নামাযের স্বাদগ্রহণ  করা সমাপ্ত হলো। আমরা গাড়ীতে করে ফিরে এলাম শহরের প্রবেশ  পথের কাছে সালমানপাকে। 

বোঝাই যায়, ফারসী নাম। আববাসী আমলে পারস্যবংশদ্ভূতদের প্রাধান্য ছিলো, সম্ভবত তখন থেকেই এ নামের প্রচলন। শিয়ারা আহলে বাইত ছাড়া যে অল্পকজন ছাহাবীর সঙ্গে তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে ভক্তির আচরণ করে তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন হযরত সালমান ফারসী (রা)। একারণেই মাযারের নাম  সালমান পাকসালমান শরীফ হতে পারতো, যেমন ওরা বলে মাযার শরীফ, নজফ শরীফ, ইত্যাদি।

এখানে মসজিদটি তেমন বড় নয়, জাঁকজমকপূর্ণও নয়। অতি সাধারণ, তবে অত্যন্ত ভাবগম্ভীর। মসজিদে প্রবেশ করার পর নিজের অজান্তেই কেমন একটি ভাবতন্ময়তা হৃদয়কে আচ্ছন্ন করে। মসজিদের সীমানার ভিতরেই মাযার। এ মহান ছাহাবীর কবরের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের ভিতরে আমি অন্যরকম একটি পরিবর্তন অনুভব করলাম। ভক্তি ও মুহববতের অপূর্ব এক তরঙ্গ যেন আমার সমগ্র সত্তাকে দোলা দিতে লাগলো। কবরের শিয়রে প্রস্তর- ফলকে যখন দেখলাম নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সেই বিখ্যাত উক্তি, সালমানু মিন্-না আহলাল বাইত (সালমান তো আমাদের আহলে বাইতের একজন) তখন মুহববতের তরঙ্গ- দোলা হৃদয়ে যেন আরো গভীর হলো।

সম্ভবত গাযওয়াতুল আহযাবের সময় ঘটেছিলো সেই মধুর ঘটনাটি। ছাহাবা কেরামের মাঝে সালমান ছিলেন সালমানেরই মত। আল্লাহর নবী তাঁকে এত ভালোবাসেন, তাই সবাই তাঁকে আলাদা করে ভালোবাসেন।  পরিখার খননকাজ চলছে, তখন কোন প্রসঙ্গে আনছার বলে উঠলেন, সালমান আমাদের (কারণ হিজরতের পূর্ব থেকেই তিনি মদীনায় বাস করেন।)

মুহাজির বলে উঠলেন, সালমান আমাদের (কারণ তিনিও দ্বীনের জন্য স্বদেশ-স্বজন ত্যাগ করে এসেছেন)

এরপর এলো সালমানের জীবনে মহাসৌভাগ্যের সেই দুর্লভ মুহূর্তটি। আল্লাহর নবী ভালোবাসার এই অপূর্ব প্রতিযোগিতার কথা শুনে মৃদু হেসে বললেন, সালমান তো আমাদের আহলে বাইতের একজন।

আমি কল্পনায় অনেকবার দেখতে চেয়েছি, নবীর যবানে খোশখবর শুনে হযরত সালমান (রা) পবিত্র মুখমন্ডল পুলকে, আনন্দে, শিহরণে কেমন উদ্ভাসিত হয়েছিলো! কল্পনায় আমি কিছু দেখতে পাইনি। হয়ত তাঁর আনন্দ-উদ্ভাস ছিলো অকল্পনীয় এবং সেটাই তো স্বাভাবিক। যদি তাঁর দেশের সম্রাট বলতো,  এর বিনিময়ে তোমাকে দেবো পারস্যের সিংহাসন ও রাজমুকুট, তিনি কী বলতেন! কিছুই বলতেন না, ফিরেও তাকাতেন না। এর বিনিময়ে তো পৃথিবীর সব সিংহাসন এবং সকল রাজমুকুটও ফিরে তাকাবার যোগ্য নয়!

তাঁকে পারস্যের প্রশাসক নিয়োগ করা হয়েছিলো। তৃতীয় খলীফা হযরত উছমান (রা)-এর যামানায় তিনি ইন্তিকাল করেন এবং এখানে মাদফূন হন। তাঁর জীবন-ইতিহাস যেমন মর্মস্পর্শী তেমনি শিক্ষণীয়। পারস্য থেকে এসেছেন, তাই তিনি সালমান ফারসী। জীবনের শুরুতেই সত্যের সন্ধানে বের হয়েছিলেন পারস্য থেকে মাটি ও মায়ের বন্ধন ছিন্ন করে। ঘরে শিকল-বাঁধা করেও তাঁকে আটকে রাখা যায়নি। তারপর শামদেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সাধু-রাহিবের সংস্পর্শে ধর্মচর্চা ও সাধু-চরিত্র পর্যবেক্ষণ করে অতিবাহিত হলো  জীবনের দীর্ঘ সময়। একজনের মৃত্যুর পর তার উপদেশ মত হাযির হতেন অন্যজনের কাছে। প্রথমজন সাধুর বেশে অসাধু হলেও পরবর্তীরা ছিলেন পবিত্র মানুষ। তারা সালমানের সত্য-পিপাসায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে ভালোবেসেছিলেন। শেষ রাহিবের কাছে তিনি জানতে পারেন, শেষনবীর আগমন আসন্ন এবং তিনি আসবেন হিজাযের ভূমিতে, খেজুরের দেশে। সালমান হিজাযে এলেন এবং অগ্নিপরীক্ষায় পতিত হলেন। আমরা যারা আযান শুনে মায়ের কোলে এসেছি, আমরা বুঝতে পারবো না, কীভাবে সত্যের সন্ধান করতে হয় এবং সত্যের জন্য কতকিছু ভোগ করতে হয়। স্বাধীন সালমান হিজাযে এসে হলেন এক ইহুদীর ক্রীতদাস! তিনি হাসিমুখেই মেনে নিলেন  ক্রীতদাসের জীবন, তবু যদি দেখা পাওয়া যায় সেই মহা- মানবের, যিনি আসবেন সত্যের আলো নিয়ে তাঁকে পথ দেখাতে!

সালমান ইয়াছরিবের উপকণ্ঠে ইহুদী মনিবের খেজুর বাগানে কাজ করেন, আর ব্যাকুল প্রতীক্ষায় জীবনের দিন পার করেন। একসময় তাঁর জীবনব্যাপী সত্যসন্ধান পরিণতি লাভ করলো এবং সত্যমানবের জন্য তাঁর ব্যাকুল প্রতীক্ষার অবসান হলো। আল্লাহর নবী ইয়াছরিবে এলেন এবং তিনি তাঁর দীদার লাভ করলেন। তাঁর নতুন পরিচয় হলো, আল্লাহর নবীর ছাহাবী এবং .. এবং সালমানু মিন্না  আহলাল বাইত!

মদীনা শরীফে হযরত সালমান ফারসী (রা)-এর সেই খেজুর- বাগান দেখরও সৌভাগ্য আল্লাহ দান করেছেন, যেখানে আল্লাহর নবী নিজ হাতে খেজুর-চারা রোপণ করে তাঁর দাসমুক্তি ত্বরান্বিত করেছিলেন।

কবরের সামনে দাঁড়িয়ে সত্যের  এই মহান সাধকের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা অন্তরের পর্দায় জীবন্ত ছবির মত ভাসমান হলো।

সত্যের সন্ধানে তাঁর জীবনব্যাপী  ত্যাগ যেমন অতুলনীয় তেমনি আল্লাহর নবীর কাছ থেকে পাওয়া  পুরস্কারও ছিলো তুলনাহীন।

সালমানু মিন্না, এই মহাসম্মাননা দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণ করে যে, ইসলামের জাতীয়তা ভৌগলিক সীমারেখার ভিত্তিতে যেমন নয়, তেমনি নয় ভাষা ও বর্ণের ভিত্তিতে। ঈমান এবং একমাত্র ঈমানই হলো ইসলামের জাতীয়তার ভিত্তি। আফসোস, যে ইরাকের মাটিতে শুয়ে আছেন পারস্যের সালমান, যার কবরের প্রস্তরফলকে এখনো জ্বলজ্বল করছে সালমানু মিন্না-এর আলোকরশ্মি, সেই ইরাকে আজ ধ্বনিত হয় আরব জাতীয়তাবাদের শ্লোগান! ইরাক-ইরান যুদ্ধকে বলা হয় পারসিকদের বিরুদ্ধে আরবদের যুদ্ধ। এই মাদায়েনে ইতিহাসের কাদেসিয়ায় ছাহাবী হযরত সাদ বিন আবী ওয়াক্কাছ (রা) যে জিহাদ পরিচালনা করেছেন ইসলামের ঝান্ডা উঁচিয়ে, সেটাকে এখন বলা হয় সিয়াদাতুল আরব আলাল ফুরস (পারসিকদের উপর আরব- বিজয়)। সাদ্দাম কি জানেন নিজের অজ্ঞাতে কত বড় অপরাধ তিনি করছেন এবং কী সর্বনাশ ডেকে আনছেন নিজের ও মুসলিম উম্মাহর। সম্প্রদায়প্রীতিকে আল্লাহর নবী বলেছেন, জাহেলিয়াতের দুর্গন্ধ; তো কী ভয়ঙ্কর হতে পারে এই দুর্গন্ধ গায়ে মাখার পরিণতি!

কবর যিয়ারাত হয়ে গেছে, কিন্তু সরতে মন চাইছে না। কারণ, হতে পারে হযরত সালমান ফারসী (রা)-এর কবরে এটা আমার প্রথম সালাম এবং এটাই আমার শেষ সালাম।

শৈশব থেকেই সালমান আমার হৃদয়ের ভালোবাসা, এখনো সালমান আমার কলবের মুহববত। তাঁর নূরানী চেহারার একটি উদ্ভাসিত ছবি ছিলো আমার শিশুহৃদয়ে, এখনো আছে। এখানে দাঁড়িয়েও আমি দেখতে পাই সেই নূরানী ছবি। আল্লাহর নবী যাকে এত ভালোবেসেছেন তাঁকে ভালোবাসবে না কোন্ সে মানুষ?! তাকে শ্রদ্ধা করবে না কোন্ সে হৃদয়?! তবে ইসলামের ভালোবাসা হলো আদর্শের এবং আদর্শের প্রতি আনুগত্যের ভালোবাসা।

হযরত ওমর (রা)-এর যামানায় পারস্যের সালমান ছিলেন আরবের সিপাহসালার। দুশমনের কেল্লায় হামলা চালাতে গিয়ে তিনি বলতেন, দেখো, ইসলাম আমাকে কত মর্যাদা দিয়েছে! পারস্যের আমি আজ আরবের আমীর!

এটাই ইসলাম ও ইসলামী চেতনা।

তাই হে ইরাক, শোনো মুসাফির ভাইয়ের ডাক। ফিরে এসো তোমার কোলে শুয়ে থাকা সালমানের কাছে এবং আরব-পরিচয় ভুলে গ্রহণ করো ইসলামের পরিচয় ।

হে সালমান, জানি না, ইরাক এ আওয়ায শোনবে কি না! ইরাকের সাদ্দাম তোমার কাছে আসবে কি না! কিন্তু আমি হে পেয়ারা সালমান, চৌদ্দশ বছর দূর থেকে তোমার কবরে দাঁড়িয়ে দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করছি, ইসলাম ছাড়া অন্য কোন পরিচয় আমি স্বীকার করি না! ইসলাম ছাড়া অন্য কোন বন্ধন আমি মানি না!

মানুষ এখান থেকে মাটি নেয়, আমি তোমার কবরের মাটি চাই না হে সালমান, শুধু চাই ইসলামের পরিচয়-বন্ধনের শিক্ষাটুকু নিয়ে যেতে। আমার দেশ যেন গ্রহণ করে তোমার কবরের শিক্ষা!

যিয়ারাতের পুরো সময় হযরতের পাশে ছিলাম। মোরাকাবায় তাঁর সেই শান্ত-সমাহিত রূপ এখনো আমার চোখে ভাসে, এখনো আমার বুকে জাগে। মোরাকাবার রহস্য তখনো বুঝিনি, এখনো না; শুধু ভাবি, কিছু একটা আছে! মক্কা শরীফে জান্নাতুল মুআল্লায় ইচ্ছা হয়েছিলো, জিজ্ঞাসা করি, মোরাকাবার হাকীকত কী? মোরাকাবায় কী দেখা যায়? কী পাওয়া যায়? জিজ্ঞাসা করা হয়নি। কারণ হযরতের কাছে আমার কখনো ছিলো সাহস, কখনো ভয়।

তখন ভয় ছিলো, জিজ্ঞাসা করিনি; এখন সাহস হলো, জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি আলতো করে আমার মাথাটা বুকে টেনে নিলেন। আবার শুনতে পেলাম তাঁর কলবের ধড়কন এবং হৃদয়ের স্পন্দন!

তিনি বললেন, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মসঊদ (রা) বলেছেন,

فإن الحي لا تؤمن عليه الفتنة

আখের সেইটার কিছু হাকীকত তো আছে! আসলে অনুসরণের জন্য জীবিতদের চেয়ে মৃতরাই নিরাপদ। তো আল্লাহর নেক বান্দাদের রূহানী ফয়য তাদের মৃত্যুর পরও জারি থাকে। সেখানেও রয়েছে ফয়যের সিলসিলা। মোরাকাবায় কিছু দেখা যায় কি না, জানি না, তবে কিছু পাওয়া যায়। রূহানী ফায়যের সিলসিলা থেকে কিছু ফায়য পাওয়া যায়, যদি বিদআতের যুলমাত থেকে কলবকে পাক রাখা যায়।

আমার প্রিয় হযরত এখন দুনিয়াতে নেই। এখন আমি তাঁর কবরের সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয়, কিছু যেন দেখা যায়! কিছু যেন পাওয়া যায়! আলোর কোন বন্ধন যেন সৃষ্টি হয়! আত্মা থেকে আত্মায় আত্মিকতার কোন প্রবাহ যেন তরঙ্গায়িত হয়! তবে এ বিশ্বাস অন্তরে অবিচল থাকে যে, এ প্রবাহ এখান থেকে নয়, সেখান থেকে, কলবের সিলসিলা শুরু হয়েছে যেখান থেকে।

***

একটু দূরে রয়েছে দুই ছাহাবীর আরো দুটি কবর। একটি হযরত হোযায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রা)-এর, অন্যটি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে জাবির (রা)-এর।

হযরত হোযায়ফা (রা) হলেন অতি উচ্চ মর্যাদার ছাহাবী। আল্লাহর নবী তাঁকে এত ভালোবাসতেন যে, অনেক গোপন কথা তিনি তাঁর কাছে আমানত রেখে গেছেন। বিশেষত মুনাফিকদের নাম ও পরিচয়। তাই তাঁকে বলা হতো ছাহিবুস্-সির (আল্লাহর নবীর ভেদের ধারক)

প্রিয় পাঠক, আমি, তুমি- আমরা তো সাচ্চা মুসলমান এবং  সেজন্য আমরা খুব পুলকিত। এটা অবশ্য ভালো। ঈমানের গৌরব করা অবশ্যই ভালো। তবে একটা কথা বলো; হযরত ওমর (রা), যার ভয়ে শয়তান পথ এড়িয়ে চলতো, তিনি একবার এই হোযায়ফা ইবনুল ইয়ামানের কাছে ভয়ে ভয়ে জানতে চাইলেন, মুনাফিকদের যে তালিকা তোমার কাছে রয়েছে, আল্লাহর কসম করে বলো, তাতে আমার নাম তো নেই!

বলো তো, ওমরের দিলে কেন এত ভয়! আমি, তুমি কেন এত নির্ভয়!

হযরত হোযায়ফা (রা)-এর কবরের সামনে দাঁড়িয়ে আমি প্রার্থনা করলাম, হে আল্লাহ, ঈামনের সঙ্গে যেন মৃত্যু হয়, আমার এবং আমার প্রিয় সকলের। মুনাফিকের দফতরে যেন নাম না থাকে, আমার এবং আমার প্রিয় সকলের।

হযরত ওমর (রা)-এর যামানায় তিনি মাদায়েনের প্রশাসক নিযুক্ত হন। তিনি এসেছিলেন গাধার পিঠে সওয়ার হয়ে। মাদায়েনেই হয়েছে তাঁর মৃত্যু ও কবর।

তাঁর পবিত্র হাতে ইসলাম গ্রহণ করে কত অগ্নিপূজক আগুনের অন্ধকার থেকে নূরের আলোতে প্রবেশ করেছে তার সংখ্যা ইতিহাসের পাতায় নেই, রয়েছে তাঁর আমলনামায়। এভাবে ছাহাবা কেরাম যদি দেশে দেশে ছড়িয়ে না পড়তেন; ইস্তাম্বুলের নগরপ্রাচীর, আর চীনের মহাপ্রাচীরের কাছে যদি তাঁদের কবর না হতো তাহলে হে বন্ধু, ইসলামের আলো হিজাযভূমির বাইরে কীভাবে ছড়াতো! এমন কষ্টহীন ইসলাম কীভাবে আমরা পেতাম! সুতরাং কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কিছু কি দায় নেই আমাদের!

পাশের কবরটি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে জাবির (রা)-এর। ইনি বিখ্যাত আনছারী ছাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে জাবির নন। তাঁর কবর মদীনায়, জান্নাতুল বাকীতে। ইনি অন্য কোন ছাহাবী।

আজ থেকে বায়ান্ন বছর আগে এ দুই ছাহাবীর কবরকে কেন্দ্র করে এক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছিলো, যা তখন বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো। এঘটনা আমি প্রথম পড়েছিলাম ঢাকার একটি জাতীয় দৈনিকে। তাতে তথ্যসূত্রের

বিস্তারিত উল্লেখ ছিলো।

আমাদের গাইড মুহসিন বললেন, ইরাকের তথ্যমন্ত্রণালয়ের যোগাযোগ বিভাগে প্রয়োজনীয় তথ্য এবং পত্র-পত্রিকার বেশকিছু কাটিং সংরক্ষিত রয়েছে।

কবরদুটি তখন এখানে সালমান-পাকে ছিলো না; ছিলো বেশ কিছু দূরে দজলা নদীর কাছে। ইরাকের তৎকালীন শাসক একদিন স্বপ্নে দেখেন, ছাহাবীদ্বয় বলছেন, আমাদের কবরে পানি আসছে, তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা গ্রহণ করো। সরকারীভাবে কবরের আশেপাশে খনন করে দেখা গেলো, মাটিতে আর্দ্রতা থাকলেও পানি নেই। নিছক স্বপ্ন ভেবে শাসক বিষয়টি এড়িয়ে গেলেন। কিন্তু পরপর দুবার তিনি একই স্বপ্নে একই আদেশ পেলেন। তখন বিচলিত হয়ে বিশিষ্ট আলিমদের মতামত চাইলেন। তারা সম্মিলিত ফতোয়া দিলেন যে, কবর খনন করা হোক এবং (স্বপ্নের সত্যতা পাওয়া গেলে) কবর স্থানান্তরের ব্যবস্থা করা হোক।

ইসলামের ইতিহাসে অনন্যসাধারণ ঘটনা হিসাবে ইরাকসরকার ব্যাপক প্রচার করেছিলো এবং হজ্বের মৌসুম বলে মক্কা-মদীনায়ও ঘোষণা করা হয়েছিলো। নির্দিষ্ট তারিখে বহু দেশ থেকে এত বেশী মানুষ এসেছিলো যে, দৃশ্য প্রচারের জন্য বিভিন্ন স্থানে বড় বড় বিশেষ স্ক্রীন স্থাপন করতে হয়েছিলো। বহু অমুসলিমও ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে ছুটে এসেছিলেন।

কবর খনন করে দেখা গেলো মাটি খুব বেশী আর্দ্র, একেবারে কাদা-কাদা।

আলিমদের তত্ত্বাবধানে দুই ছাহাবীকে কবর থেকে উত্তোলন করার পর দেখা গেলো, হাজার বছরের ব্যবধানেও তাদের পবিত্র দেহ অক্ষত  ও জীবন্ত রয়েছে। মানুষের আবেগ তখন যেন অশান্ত এক সমুদ্র। আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে আকাশ প্রকম্পিত হলো।

এ দৃশ্য দেখে জার্মানির এক চক্ষু- চিকিৎসক কালিমা উচ্চারণ করে তাওহীদের উম্মায় শামিল হয়ে গেলেন। তাঁর মন্তব্য ছিলো, তাঁদের চোখের দৃষ্টিতে জীবিত মানুষের জ্যোতি বিদ্যমান রয়েছে, যা মৃত্যুর অল্প পরেই নষ্ট হয়ে যায়।

আল্লাহর কী শান! সারা জীবন যিনি মানুষের চোখে আলো দিয়েছেন, তার অন্তর্চক্ষু ছিলো আলোহীন। বহু শতাব্দীর কবর-শয্যা থেকে উঠে আসা দুই ছাহাবীর জ্যোতির্ময় চক্ষু থেকে আজ তিনি লাভ করলেন

অন্তর্চক্ষুর জ্যোতি!

জানাযার খাটিয়ার সাথে যুক্ত লম্বা হাতলের সাহায্যে বহু মানুষ পবিত্র জানাযা বহন করার সৌভাগ্য অর্জন করলো এবং অবশেষে তাঁদেরকে এখানে সালমানপাকে দাফন করা হলো। অনেকে স্বচক্ষে, আর অনেকে বড় স্ক্রীনে এ দৃশ্য প্রত্যক্ষ  করেছিলো।

কিন্তু আশ্চর্য! নিকট অতীতের এমন বিস্ময়কর ও ঈমানোদ্দীপক ঘটনা যেমন ব্যাপক প্রচার পাওয়ার কথা, পায়নি। প্রচারমাধ্যমের শক্তি ইসলামী উম্মাহর হাতে এখনো নেই, তখনো ছিলো না। এখন তো এর গুরুত্ব কিছুটা হলেও অনুভব করা হয়, তখন তাও করা হতো না। লালকেল্লায় যখন শরাব ও শাবাবের মাহফিল জমতো ইউরোপে তখন পত্রিকার যুগ শুরু হয়ে গেছে। আজো বিশ্বের প্রচারমাধ্যমের প্রায় সবটুকু ইহুদীদের দখলে। মুসলিম জাতি এখনো টিকে আছে কীভাবে! শুধু আল্লাহর রহমত ও কুদরতে।  শেষদিকে মুসলমানরা জ্ঞানসাধনা করেছে বিজ্ঞানসাধনা ছেড়ে দিয়ে এবং যুক্তিচর্চা করেছে প্রযুক্তির চর্চা ছেড়ে দিয়ে। এই এক ভুলেরই মাশুল দিতে হচ্ছে যুগ যুগ ধরে। জানি না, এ দুর্গতির শেষ কোথায়?

পাকিস্তানের স্বনামধন্য আলিম মাওলানা তাকী উছমানী তার ইরাকের সফরনামায় লিখেছেন, মাওলানা জাফর আহমদ আনছারী বলেন, ১৯২৯ সালের সে ঘটনা আমার স্পষ্ট মনে আছে, যা ঐ সময়ের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ভারতীয় এক সাহিত্যিক- দম্পতি তখন ইরাকসফরে ছিলেন। তারাও ঐ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। তারা তাদের ভ্রমণকাহীনিতে লিখেছেন, বহু বিদেশী পর্যটক  ক্যামেরায় ঐ দুর্লভ দৃশ্য ধারণ করেছেন। মাওলানা আনছারীর  ব্যক্তিগত সংগ্রহে নাকি, ঐ ভ্রমণ- কাহীনির একটি কপি রয়েছে।

আল্লাহ তাআলা তাঁর কুদরতের প্রকাশ এবং দ্বীনের সত্যতার উদ্ভাস মাঝে মাঝে এভাবে ঘটিয়ে থাকেন। যার কিসমত ভালো সে তো সত্যের আলো পেয়ে যায়; যার কিসমতের দুয়ার বন্ধ সে তা পায় না, যদিও জন্মের পর বাবা তার নাম রাখে মুজাহিদুল ইসলাম!

স্বয়ং আল্লাহর নবীর চাঁদ দুটোকরো করার মুজিযা! মক্কার কোরাইশ কি ইসলাম গ্রহণ করেছিলো? কিংবা আরবের অন্যান্য গোত্র!

প্রসঙ্গ থেকে দূরে সরে পড়ছি, তবু লোভ সম্বরণ করতে পারা গেলো না; এধরনের আরেকটি বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছে দূর অতীতে খলীফা হযরত মুআবিয়া (রা)-এর যামানায়। অহুদযুদ্ধের প্রথম শহীদ ছিলেন হযরত জাবির (রা)-এর আববা হযরত আব্দুল্লাহ। তাঁকে এবং হযরত আমর বিন জামূহকে একই কবরে দাফন করা হয়েছিলো। যাদের ধারণা, অর্থের অভাবই আমাদের মূল সমস্যা, তারা শুনুন, অহুদে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের পর্যাপ্ত কাফন ছিলো না। হযরত আব্দুল্লাহ (রা)-এর কাফন ছিলো একটি মাত্র চাদর। তাতেও শুধু চেহারা ঢাকা হয়েছে, পা ঢাকতে হয়েছে ঘাস দ্বারা।

অহুদের চল্লিশ বছর পর এক বড় পাহাড়ি ঢলে কবরটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাছাড়া সেখানে একটি খাল খননেরও প্রয়োজন দেয়া দেয়। তখন হযরত জাবির (রা)-এর উপস্থিতিতে কবর খনন করা হলো; দেখা গেলো, উভয় ছাহাবীর পবিত্র দেহ সম্পূর্ণ অক্ষত ও জীবন্ত; এমনকি বর্ণিত আছে যে, হযরত আব্দুল্লাহ (রা)-এর চেহারার যখমে তাঁর হাত রাখা ছিলো। হাতটি সোজা করার পর চেহারার যখম থেকে তাজা খুন ঝরতে লাগলো। যখন হাতটি আবার যখমের উপর রাখা হলো তখন খুন ঝরা বন্ধ হলো।

১৯২৯ সালের ঘটনা হযরতের জানা ছিলো না। শুনে খুব অবাক হলেন এবং আমাকে জাযাকাল্লাহ বললেন। তাঁকে আমি আরো বললাম, জিলানীর মাদরাসায় যার সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছে, শায়খ আব্দুল কারীম, তিনি তখন যুবক ছিলেন এবং সেই জানাযা বহন করার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন। এবিষয়ে আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম।

***

তখনো যথেষ্ট সময় ছিলো, কিন্তু হযরত বললেন, তিনি সালমান ফারসী (রা)-এর মসজিদে যোহর আদায় করে বাগদাদ ফিরবেন। পুরো সফরে দেখেছি, হোটেলে জামাত করার চেয়ে তিনি কোন না কোন মসজিদে নামায পড়ার চেষ্টা করতেন এবং তাতে খুব রূহানী সুকূন অনুভব করতেন।

এভাবেই একদিন তিনি পুরোনো বাগদাদে এক মসজিদ দেখে নামায আদায় করার কথা বলেছিলেন। মুহসিন কেন জানি হোটেলে ফিরে নামায পড়ার উপর জোর দিচ্ছিলেন।  শেষে মসজিদেই যাওয়া হলো। ইমাম-মুআয্যিন নেই, মুছল্লীও নেই। দুজন কি তিনজন বুড়ো জামাতে শরীক হলেন। নামাযের পর, বাংলাদেশের শায়খ জানতে পেরে অনেকে জড়ো হলো এবং খেজুর দ্বারা আমাদের আপ্যায়ন করলো। আপ্যায়নের এই স্বভাবসরলতা আরব ছাড়া আর কোথাও তুমি পাবে না। হযরত তাদেরকে অত্যন্ত দরদের সাথে কিছু নছীহত করলেন এবং নামাযের তারগীব দিলেন। মুহসিন নামায পড়েছেন, কিন্তু নছীহতের সময় তার চেহারায় খুব অস্বস্তি লক্ষ্য করলাম। এই চেহারা ও তার অস্বস্তি আমার জন্য ছিলো সাদ্দামের আধুনিক ইরাকের জীবন্ত রাজনৈতিক মানচিত্র। তথ্যমন্ত্রণালয় থেকে প্রচারকৃত নামাযী সাদ্দামের অনেক ছবি ও পোস্টার আমাদের দেখানো হয়েছে। সেগুলোর সঙ্গে এই জীবন্ত মানচিত্রটিও আমার দেখার প্রয়োজন ছিলো। মুহসিন নিজের অজ্ঞাতে তার চেহারার মানচিত্র দ্বারা আমার উপকার করেছিলেন।

প্রসঙ্গত, আমাদের পুরোনো ঢাকায় যেমন মসজিদ, আর মসজিদ, বাগদাদের পুরোনো এলাকায় কিন্তু তা নয়। মসজিদ খুব কম। নতুন বাগদাদে একটা কি দুটো। জনসংখ্যার ব্যবধান একটি কারণ হলেও মূল কারণ সম্ভবত আরো গভীরে। অবশ্য নতুন বাগদাদের মসজিগগুলোর স্থাপত্যসৌকর্য ও অন্যান্য সৌন্দর্য থেকে চোখ ফেরানো যায় না। মাসাজিদুহুম আমিরাহ-এর একেবারে যিন্দা নমুনা। তার চেয়ে মসজিদ যদি হতো খেজুরপাতা ও খেজুরডালের, আর তা আবাদ হতো নামাযে, ইবাদতে ও তিলাওয়াতে!

অনেক দূর চলে গিয়েছি, ফিরে আসি সালমানপাকে। মুহসিনকে জানালাম হযরতের ইচ্ছার কথা। তিনি ছোটাছুটি করে দজলার তীরবর্তী একটি সুন্দর হোটেলে  হযরতের আরাম ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করলেন। দজলা বলতে গেলে হোটেলের তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত। আমরা হোটেলের খোলা চত্বরে কফির পেয়ালা হাতে দজলার বয়ে যাওয়া দেখছিলাম। নদীর স্রোত ছিলো সামনের দিকে, সাগরের পানে, কিন্তু চিন্তার স্রোত আমাকে নিয়ে গেলো পিছনের দিকে, অতীতের মাদায়েনে। ধীরে ধীরে ঝাপসা অতীত সুস্পষ্ট হয়ে উঠলো, ঠিক যেন বর্তমান! ঐ যে দজলানদীর তীরে ছাহাবা কেরামের জামাত! সালারে লশকর একবার দেখেন দজলার ঢেউ, একবার  দেখেন মাদায়েনের দুর্গ, যেখানে পাচিলের উপর তীর-ধনুক হাতে শত শত সিপাহী। ঘোড়া ও সরঞ্জামসহ পুরো বাহিনীর দজলা পার হওয়া একে তো অসম্ভব, তদুপরি তারা হবে পাহারাদারদের বেপরোয়া তীর বর্ষণের শিকার। চিন্তিত সালার যেন আসমানের দিকে তাকালেন এবং দুহাত তুলে মুনাজাত করলেন, আর তাঁর অন্তরে জাগ্রত হলো গায়বী মদদের একীন ও বিশ্বাস। এই বিশ্বাস যখন জাগ্রত হয়, আল্লাহর মদদ তখন অবশ্যই নেমে আসে।

গায়বি মদদের সেই একীন ও বিশ্বাসে বলীয়ান সালারে লশকর ঘোষণা করলেন, শাহাদাতের তামান্না আছে যাদের তারা আল্লাহর নামে দজলার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ো। স্থল যিনি সৃষ্টি করেছেন দজলার ঢেউ তাঁরই সৃষ্টি। স্থলে যিনি রক্ষা করেন, দজলার ঢেউ থেকে তিনিই তোমাদের রক্ষা করবেন।

আমি যেন শুনতে পেলাম আল্লাহু আকবারের বজ্রধ্বনি; আমি যেন দেখতে পেলাম দজলার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ার অচিন্তনীয় সেই দৃশ্য! এমন দৃশ্য দুএকবার যা ঘটেছে মুসলিম উম্মাহর ইতিহাসেই ঘটেছে। আমি যেন দেখতে পেলাম মুজাহিদীনের ভয়-ভাবনাহীন নূরানী চেহারা। নদীর বুকে নৌকা চলে, কিন্তু সেদিন, দজলা নিজেই যেন নৌকা হয়ে পার করে দিলো মুজাহিদ-বাহিনীকে।

ঐ যে আগুন-পূজার সেপাহীরা পানি পার হওয়া তাওহীদের পূজারীদের ভয়ে তীর-ধনুক ফেলে প্রাণহাতে পালাচ্ছে! ঐ যে  মুজাহিদীনের সালার দুর্গের সামনে লুটিয়ে পড়লেন শোকরানার সিজদায়।

কোথায় আজ দজলা পাড়ি দেয়া মুজাহিদীনের উত্তরসূরীরা! যাদের ভয়ে বিশ্ব কেঁপেছে তারা কেন  কাঁপে আজ বিশ্বের ভয়ে! স্পেনজয়ী তারিকের বংশধর কেন স্পেন থেকে বিতাড়িত! ফিলিস্তিন ও বাইতুল মুকাদ্দাস উদ্ধারকারী সালাহুদ্দীনের অনুসারী কেন ফিলিস্তিন থেকে উৎখাত হলো? বাইতুল মুকাদ্দাস কেন হাতছাড়া হলো। মুসলিম বিশ্বের এক ইঞ্চি ভূমিও কি আমরা অর্জন করেছি? এমনকি রক্ষা করতে পেরেছি তাদের রেখে যাওয়া সবটুকু ভূখন্ড? তারপরো তারা পশ্চাদপদ, আমরা প্রাগ্রসর?

তন্ময় হয়ে দেখছি প্রবাহমান দজলার ঢেউ। মনে হলো, প্রতিটি ঢেউ যেন প্রশ্নবোধক চিহ্ন এবং তা আমারই উদ্দেশ্যে! দজলার অধিকার ছিলো আমাকে প্রশ্ন করার। কেননা মেঘনার দেশে জন্ম হলেও দজলা আমার স্বপ্ন! পদ্মার ঢেউয়ে দোল খেলেও দজলা আমার বুকের তরঙ্গ। দজলা হয়ত ভেবেছে, আমি বোঝবো তার ঢেউয়ের ভাষা এবং তার বুকের ব্যথা! কিন্তু আমার কাছে কোন জবাব ছিলো না এসব প্রশ্নের। আমি শুধু মিনতি জানালাম আমার প্রিয় দজলাকে, তোমার বুকের প্রতিটি ঢেউ যেন প্রার্থনা করে তোমার স্রষ্টার কাছে, মুসলিম উম্মাহর অন্তরে আবার যেন ঢেউ জাগে, জিহাদের, আবার যেন জোশ ওঠে শাহাদাতের! আবার যেন ওড়াতে পারে তারা ঝান্ডা বিজয়ের! তাদের ঘোড়া আবার যেন ঝাঁপিয়ে পড়ে নতুন দেশের নতুন দজলার বুকে! আবার যেন তারা জয় করে নতুন মাদায়েনের নতুন কেল্লা। তাদের পায়ের তলা থেকে আর যেন সরে না যায় নতুন কোন ভূখ !

***

যোহরের সময় হযরতের সঙ্গে আমরা মসজিদে হাযির হলাম। হয়ত এটা সালমানপাক মসজিদে আমার একমাত্র নামায, একথা ভেবে আবেগ আমার আবারো উদ্বেলিত হলো এবং কিয়ামে ও রুকু-সিজদায় হৃদয় আমার আল্লাহর প্রতি পূর্ণ বিগলিত হলো। আমি যেন নামায পড়ছি বাইতুল্লাহর ছায়ায়! সিজদায় আমার কপাল যেন স্পর্শ লাভ করছে হারামের পবিত্র ভূমির।

নামাযের পর আমরা রওয়ানা হলাম। যে পথে দুপাশের খেজুর-বাগান দেখে দেখে মাদায়েন এসেছিলাম, সেই একই পথে একই সৌন্দর্য উপভোগ করে করে আমরা মাদায়েন থেকে বাগদাদে ফিরে এলাম।***

দজলার পূর্বতীরে কারখ অঞ্চলে বাগদাদের প্রাচীন

কবরস্তান। নাম বাবুদ-দায়ের। আত্মিক দিক থেকে বাবুদ-দায়েরের যিয়ারাত আমার জন্য ছিলো খুবই ফলদায়ক। এই প্রাচীন কবরস্তানে যুগে যুগে কত মানব-মহামানব তাদের শেষশয্যা গ্রহণ করেছেন; এই মাটির নীচে লুকিয়ে আছে ইলমের কত বেশ কীমত খাযানা; মারিফাতের কত অমূল্য রত্ন; ইতিহাস তার কতটুকু খবর রাখে! ইতিহাস তো ব্যস্ত শুধু রাজপ্রশস্তি ও বীরবন্দনায়। তারপরো কজন  বেঁচে আছে ইতিহাসের পাতায়!

অথচ আল্লাহর বান্দারা, কবরের চিহ্ন মুছে গেলেও, জীবন্ত আছেন মানুষের ভক্তি-ভালোবাসায় এবং নিজেদের জারিয়ান আমলনামায়।

বাবুদ-দায়েরে কারো কবরের সন্ধান জানার তেমন কোন উপায় নেই, তবে একটি সুন্দর বেষ্টনীর মাঝে সংরক্ষিত রয়েছে তিনটি কবরের মাযার। সেখানে শুয়ে আছেন হযরত মারূফ কারখী, হযরত সারী সাকাতী ও হযরত জোনায়দ বোগদাদী (রহ)। আমরা হযরতের সঙ্গে আল্লাহর এই তিন পেয়ারা বন্দার কবর যিয়ারত করলাম এবং জানা-অজানা অন্যসব কবরবাসীর জন্যও মাগফিরাতের দুআ করলাম।

হযরত মারূফ কারখীর জন্ম এক খৃস্টান পরিবারে, কিন্তু শৈশবেই গায়ব থেকে তাঁর অন্তরে তাওহীদের চেতনা জাগ্রত করে দেয়া  হয়েছিলো। তিনি বলে উঠতেন, আল্লাহু আহাদ, আল্লাহ এক।  পরিবারের সকলেই বিচলিত ছিলো। তাঁর বাবা কখনো শাসন করতেন কখনো করতেন কঠিন তিরস্কার। কারণ এটা ছিলো পারিবারিক সম্মান ও মর্যাদার প্রশ্ন।

হাদীছ বলে, মায়ের হক তিনবার, বাবার হক একবার, মা ও বাবার এ পার্থক্য চিরসত্য। যুগে যুগে তা প্রমাণিত হয়েছে; মারূফ কারখীর জীবনেও প্রমাণিত হলো। পারিবারিক মর্যাদার প্রশ্নে বাবা হলেন পাষাণ, কিন্তু সন্তান হারিয়ে মা হলেন পাগলিনীপ্রায়। সকাল-সন্ধ্যা তিনি কাঁদেন, আর কাঁদেন। রাতে ঘুম থেকে জেগে চিৎকার করে ওঠেন, মারূফ, কোথায় তুমি বাপ! অভাগিনী মায়ের কথা একবারও কি মনে পড়ে না বাপ!

কখনো বলতেন, কাজ নেই আমার তিন খোদায়, মারূফ যদি এক খোদায় খুশী থাকে, আমিও খুশী। শুধু আমার মারূফ ফিরে আসুক আমার বুকে।

মারূফ কারখী একসময় ফিরে এসেছিলেন মায়ের বুকে। তখন তিনি অন্য এক মারূফ, যাকে দেখে সত্যের প্রতি বিশ্বাস জাগে, যাকে পেয়ে সত্যকে পাওয়ার ব্যাকুলতা আসে। মারূফের আম্মা তো বটেই, পরিবারের অন্য সকলেও ইসলাম গ্রহণ করে ধন্য হলেন।

মানুষের প্রতি হযরত মারূফ কারখীর দরদ-ব্যথা ছিলো অন্যরকম। নবীর উম্মতি নাফরমান হলেও তাকে তিনি ভালোবাসতেন এবং তার হিদায়াতের দুআ করতেন। এই দজলা নদীর পারের ঘটনা; ভক্ত-মুরীদান নিয়ে এক সন্ধ্যায় তিনি বসে আছেন। কিছু যুবক নৌকায় গান-বাজনায় মত্ত। একজন বললো, দেখুন হযরত, নদীর বুকেও এরা নাফরমানিতে লিপ্ত; আপনি বদদুআ করুন, আল্লাহ যেন তাদের নৌকা দজলায় ডুবিয়ে দেন। হযরত মারূফ শান্ত কণ্ঠে বললেন, আল্লাহ যদি তাদেরকে রহমতের দরিয়ায় ডুবিয়ে দেন, তোমার আপত্তি আছে? তাতে তোমার কোন ক্ষতি আছে? তিনি দুহাত তুলে দুআ করলেন, হে আল্লাহ, দুনিয়ার আনন্দের পরিবর্তে এদের তুমি আখেরাতের স্বাদ দিয়ে দাও।

দুনিয়ার আনন্দ-বাজনায় মত্ত এই যুবকদল সত্যি একদিন আখেরাতের আনন্দ-সাধনায় মগ্ন হলো কারখীর দরদভরা দুআর বদৌলতে।

দুশ হিজরীতে তিনি যখন ইন্তিকাল করেন, গোটা বাগদাদ ভেঙ্গে পড়েছিলো তাঁর জানাযায়, আর খলীফার তামান্না ছিলো, এর অর্ধেক মানুষও যেন হয় তার জানাযায়!

এখানে এই মাটির নীচে তিনি শুয়ে আছেন; আমি যেন তাঁর সান্নিধ্যের উষ্ণতা অনুভব করছি। একসময় নিজেকে প্রশ্ন করলাম, এখান থেকে কী আমি পেলাম? ভিতর থেকে যেন আওয়ায এলো, এখান থেকে তুমি শিক্ষা পেলে অন্তরে তাওহীদের অবিচল বিশ্বাস লালন করার এবং তাওহীদের জন্য জীবনের সর্বস্ব ত্যাগ করার, আর শিক্ষা পেলে মানুষের জন্য দরদ-ব্যথায় উদ্বেলিত হওয়ার এবং শুধু মানুষের কল্যাণ- কামনায় দুহাত উপরে তোলার।

***

হযরত মারূফ কারখীরই বিশিষ্ট খলীফা হলেন সারী সাকাতী (রহ)। তাঁর মাটির উপরের জীবন কেটেছে মুরশিদ কারখীর আলোকিত সান্নিধ্যে, মাটির নীচের জীবনেও তিনি ধন্য হয়েছেন সেই সান্নিধ্যে। আমি প্রার্থনা করলাম, কবরের সঙ্গী এঁরা জান্নাতেও যেন হন পরস্পরের সঙ্গী; আর তাদের আলোকিত জীবনের পথ ধরে আমরাও যেন পৌঁছে যেতে পারি, জান্নাতের দরজায়, বেহেশ্তের অফুরন্ত নেয়ামতের বাগিচায়।

হযরত সারী সাকাতী বলেন, আমি যা কিছু পেয়েছি মারূফ কারখীর একটি দুআর বরকতেই পেয়েছি। এক ঈদের দিনে দেখি, তিনি ছিন্নমলিন কাপড়ের এক দুঃখী বিষণ্ণ বালককে নিয়ে বাজারে যাচ্ছেন। তিনি বললেন, দেখো, এই এতীম ঈদের আনন্দের দিনে কাঁদছে। আমি এর মলিন মুখে ঈদের হাসি ফোটাতে চাই।

আমি বললাম, হযরত, আমাকে এর প্রতিপালনের সুযোগ দিন।

তিনি বললেন, সত্যি করবে! তাহলে নিয়ে যাও, আল্লাহ তোমার অন্তরকে ধনী করে দিন।

হযরত সারি সাকাতী বলেন, তারপর থেকে দুনিয়া আমার কাছে তুচ্ছ হয়ে গেছে।

দুশ একান্ন হিজরীতে বাগদাদে এই মহান সাধকের মৃত্যুতে এক

অন্তর্জ্ঞানী মন্তব্য করেছেন, ভালো মানুষের সংখ্যা মাটির উপরে আজ কমে গেলো এবং মাটির নীচে বেড়ে গেলো।

হযরত সারি সাকাতী বলতেন, কেউ যদি শরীয়তের যাহেরী ইলমের খেলাফ কোন বাতেনী ইলমের দাবী করে, তাহলে সে গোমরাহ।

বাগদাদের বাজারে তাঁর দোকান ছিলো। একবার আগুন লেগে  সব দোকান পুড়ে গেলো; শুধু তাঁর দোকানটি বেঁচে গেলো। তিনি আলহামদু লিল্লাহ বলে  শোকর আদায় করলেন। হঠাৎ তাঁর মনে হলো, আমি তো আমার ভাইদের মুছীবতে খুশী হলাম! এবার তিনি ইস্তিগফার করলেন এবং সব সামান ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বিলিয়ে দিলেন, আর বললেন, এখন আমিও তোমাদের মত হয়ে গেলাম।

আসলেই কি তিনি তাদের মত হলেন! তিনি কি তাদের মত হতে পারেন! তারা কি পারতো, যা তিনি করেছেন তা করতে! তিনি তো হয়েছেন তাঁর নিজের মত! সবাই যদি হতে পারতো তাঁর মত তাহলে তো এই দুনিয়া হয়ে যেতো রাশ্কে জান্নাত, জান্নাতেরও ঈর্ষার পাত্র!

আরো কত ঘটনা মনে পড়লো  আজ এই কবরওয়ালার সান্নিধ্যে দাঁড়িয়ে! একসময় নিজেকে আমি প্রশ্ন করলাম, এখান থেকে কী আমি পেলাম? ভিতর থেকে আওয়ায এলো, এখানে তুমি পেয়েছো, এতীমের চোখের পানি মুছে দেয়ার এবং মানুষের বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়াবার শিক্ষা, আর এ শিক্ষা তোমার নবীর শিক্ষা!

 

***

জোনায়দ বিন মুহম্মদ আলবোগদাদী হলেন হযরত সারি সাকাতীর ভাগিনা এবং তাঁর বিশিষ্ট খলীফা। তিনি যেমন ইলমে মারেফাতের শীর্ষ চূড়ায় উপনীত হয়েছিলেন তেমনি আরোহণ করেছিলেন ইলমে যাহিরেরও উচ্চস্তরে। তিনি বলতেন, ইলমে ফিকহর গভীরতায় যে পৌঁছতে পারেনি সে অনুসরণযোগ্য নয়। তিনি আরো বলতেন, যে মনে করে, নিজের চেষ্টায় আল্লাহকে পাবে, আর যে মনে করে, বিনা চেষ্টায় আল্লাহকে পাবে, তারা উভয়ে গোমরাহ। (অর্থাৎ আমল না করে শুধু রহমতের আশায় বসে থেকো না, আবার আমলের কারণে রহমতের উপর ভরসা করা ভুলে যেয়ো না।)

তিনি আরো বলতেন, গোনাহের পর যদি অনুতাপ জাগে তাহলে নিরাশ হয়ো না। (কেননা এটা ঈমানের আলামত এবং তাওবা নছীব হওয়ার উপায়।)

এক হজ্বের সফরে মক্কায় আরেফীনদের জলসায় হযরত সারী সাকাতীর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, শোকর হলো আল্লাহর নেয়ামতকে আল্লাহর নাফরমানির কাজে ব্যবহার না করা।

২৯৮ হিজরীতে শয্যাশায়ী অবস্থায়ও নামাযের হালাতে তিনি ইন্তিকাল করেন। এখানে দাঁড়িয়েও নিজেকে প্রশ্ন করলাম, জোনায়দ বোগদাদীর যিয়ারাতে কী আমি পেলাম? ভিতর থেকে আওয়ায এলো, এখানে তুমি পেয়েছো ইলমে যাহির ও ইলমে বাতিনের মাঝে সমন্বয় সাধনের শিক্ষা, আর পেয়েছো মৃত্যু পর্যন্ত লা-তাকনাতূ-এর রজ্জু ধরে রাখার শিক্ষা।

প্রথম কবরের একান্ন বছর পর দ্বিতীয় কবর এবং দ্বিতীয় কবরের প্রায় পঞ্চাশ বছর পর তৃতীয় কবর। এভাবে একটির পর একটি কবর তৈরী হচ্ছে, হতেই থাকবে। তারপর একদিন খুলে যাবে সব কবরের দরজা। মানুষ পিপিলিকার মত উঠে আসবে কবর থেকে; রওয়ানা হবে হাশরের মাঠে; দাঁড়াবে গিয়ে মীযানের সামনে। হে আল্লাহ, আমার জন্য যে কবরটি তৈরী হবে তাকে তুমি করে দিও জান্নাতের বাগিচা। হে আল্লাহ, এটা প্রাপ্তির দাবী নয়, রহমতের আবদার! হে আল্লাহ, যারা আমীন বলে, তাদেরও।

যিয়ারাত শেষে হযরতের পাশে  দাঁড়ালাম। তাঁর আলোকিত ও পরিতৃপ্ত মুখমন্ডলের দিকে তাকিয়ে নিজেরও অন্তরে আশ্চর্য এক আলোকময়তা এবং তৃপ্তির স্নিগ্ধতা অনুভব করলাম। তিন কবরের তিন শিক্ষার কথা তাঁর কাছে আরয করলাম। তিনি খুব খুশী হলেন এবং কারখী, সাকাতী ও বোগদাদীর পবিত্র মাযারপ্রাঙ্গনে দাঁড়িয়ে তিনি আমার জন্য এমন এক দুআ করলেন, যা আমি মনে করি, আমার জীবনের অনেক বড় সম্পদ।

***

হোটেলে ফিরে হযরত আমাকে তাঁর কামরায় ডাকলেন। গিয়ে দেখি, তিনি অস্থির অবস্থায় পায়চারি করছেন। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে সালাম দিলাম। তিনি তাকালেন। ভিতরের অস্থিরতার ছাপ চেহারায় সুস্পষ্ট। তিনি বললেন, মৌলভী আবু তাহের, তুমি কোশিশ করতে পারো না, ছদরের সাথে জলদি যেন মোলাকাত হয়?

আমি পেরেশান হয়ে ভাবলাম, এখানে তো আমি হযরতের সঙ্গে আসা এক আজনবী মুসাফির, কারো সঙ্গে তো আমার কোন পরিচয় নেই!

হঠাৎ যেন বিজলি চমকের মত মনে পড়লো ইরাকের ধর্মমন্ত্রীর কথা। দুবছর আগে তিনি বাংলাদেশ সফরে গিয়েছিলেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পক্ষ হতে তার সম্মানে নৌবিহারের আয়োজন করা হয়েছিলো। ফাউন্ডেশনের তখনকার মহাপরিচালক জনাব সামসুল আলম সাহেব অনুগ্রহ করে আমাকেও সঙ্গে নিয়েছিলেন  এবং মন্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। তাকে আমার অতি মার্জিত, ভদ্র ও

আন্তরিক মনে হয়েছিলো। ইরাক-ইরান যুদ্ধ তখন শুরু হয়েছে মাত্র।  নৌবিহারের প্রায় পুরোটা সময় তিনি আমার সঙ্গে কথা বলেছেন। আমার আরবী বলা তার ভালো লেগেছিলো। বারবার জিজ্ঞাসা করছিলেন, আরবদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখা-পড়া করেছি; বললাম, এখনো আমি কোন আরবদেশ দেখিনি। তিনি অবাক হয়ে বললেন, কোন আরবদেশ দেখোনি, অথচ এমন বিশুদ্ধ আরবী!

একপর্যায়ে হাসতে হাসতে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কী ধারণা, এ যুদ্ধে কে জয়ী হবে?

যেমন আচমকা প্রশ্ন, আল্লাহর রহমতে তেমনি আচমকা ছিলো আমার জবাব, বললাম, আমার ধারণা এ যুদ্ধে জিতবে আমেরিকা এবং ইসরাইল।

জবাব শুনে মন্ত্রী স্তব্ধ হয়ে  গেলেন এবং দীর্ঘ সময় আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন কোন কথা না বলে।

নৌবিহার শেষে বিদায়কালে তিনি নিজে এগিয়ে এসে আমার সঙ্গে মুছাফাহা করে বললেন, তোমার কথা আমার মনে থাকবে, বিশেষ করে তোমার ঐ জবাবের জন্য, তোমাকে ধন্যবাদ।

এ সব কথা মনে পড়ে একটু আশা হলো যে, হয়ত চেষ্টা করার সুযোগ আছে। অন্তত নিজেকে প্রবোধ দিতে পারবো যে, হযরতের পেরেশানি দূর করার জন্য কিছু একটা করেছি। ফোনে মুহসিনকে পেলাম। বেচারা মাত্র বাসায় পৌঁছেছেন আমাদের হোটেলে রেখে। তাকে বললাম, তুমি কি যে কোন উপায়ে তোমাদের ধর্মমন্ত্রীর সাথে আমার ব্যক্তিগত সাক্ষাতের ব্যবস্থা করতে পারো। বাংলাদেশের সফরে এক নৌবিহারে তার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো। এ সাক্ষাৎ আমার জন্য খুব জরুরী।

মুহসিন বললেন, আমি চেষ্টা করছি, ফলাফল তোমাকে জানাবো

একঘণ্টা পর মুহসিনের ফোন পেলাম। তিনি, আমাকে নিতে আসছেন, বলেই ফোন রেখে দিলেন।

শুনে হযরত খুশী হলেন, আমাকে জাযাকাল্লাহু বললেন, আর বললেন কাউকে জানানোর দরকার নেই।

কয়েকটি প্রশ্ন নিয়ে আমি আগে থেকেই ভাবনার খেই পাচ্ছিলাম না। প্রথমত হযরতের সফরসঙ্গী যারা, সফরের মূল উদ্দেশ্যের প্রতি তারা কতটা নিবেদিত? একজন বাঙ্গালীর জন্য মাযার যিয়ারাত অবশ্যই পুণ্যকর্ম, কিন্তু হযরতের শান্তিমিশন! এ বিষয়টি কি কাউকে অস্থির পেরেশান করছে? অন্তত আমি তো মনে করতে পারছি না।

দ্বিতীয়ত এটা যদি হয় শান্তি ও সন্ধির সফর তাহলে সফরসঙ্গী নির্বাচনের এ পদ্ধতি কেন? তোয়াহা বিন হাবীব শুধু ইরানে এবং মুহিউদ্দীন খান শুধু ইরাকে কেন? আমার বিষয়টি অবশ্য আলাদা। আমি মূলত এ সফরের অংশ নই। আমার সফর ইরাকী দূতাবাসের দাওয়াতে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত। আমি নিজের আগ্রহে ও প্রয়োজনে হযরতের সঙ্গ গ্রহণ করেছি।

এত দিন আমার ধারণা ছিলো শান্তিমিশনে হযরত নিঃসঙ্গ। অন্যরা সফরসঙ্গী হলেও মিশনসঙ্গী বোধ হয় নন। আজ হযরতের শেষ কথায় নিশ্চিত হলাম, আমার ধারণা ভুল নয়।

আমাদের গাইড মুহসিন উপরের দিক থেকে আমার কাছাকাছি বয়সের হলেও অত্যন্ত জ্ঞানী ও বিচক্ষণ ব্যক্তি। তিনি আমাকে বলেছিলেন, যদি কিছু মনে না করো তাহলে একটা কথা বলতে চাই। তোমাদের শায়খ শুধু বাংলাদেশের  নন, মুসলিম উম্মাহর সম্পদ, কিন্তু তোমাদের কাছে তিনি অপরিচিত।

মাত্র তিন দিনের পরিচয়ে ইরাকের একজন মুসলিম ভাই হযরত ও তার সফরসঙ্গীদের সম্পর্কে এ মন্তব্য করেছিলেন।  প্রায় একই মন্তব্য করেছিলেন ঢাকা বিমানবন্দরে আমাদের দেশের একজন সুপরিচিত সাংবাদিক।

হযরতের ইরান-ইরাক সফর সম্পর্কে দীর্ঘ পঁচিশ বছর আমি কিছু বলিনি, না মুখে, না কলমে। সফরের পরপর জনাব আখতার ফারূক সাহেব (আল্লাহ তাকে জান্নাত নছীব করুন) যখন কলম ধরলেন, আর দেশব্যাপী ঝড় উঠলো, এমনকি হযরতের ব্যক্তিত্বও মারাত্মক আহত হলো, শিয়া অপবাদ পর্যন্ত দেয়া হলো অতি নিকট থেকে তখন কলম ধরার অদম্য ইচ্ছা জাগ্রত হয়েছিলো। কিন্তু আমার প্রাণপ্রিয় হযরত পাহাড়পুরী হুযূর (আল্লাহ তাঁকে পূর্ণ শিফা দান করুন, আমীন) বললেন, অনুমতি নেই, আর অনুমতি ছাড়া কিছু করা এখনকার সাহসী মানুষদের জন্য সহজ হলেও তখন আমাদের জন্য ছিলো কঠিন। আমরা এটাকে অকল্যাণকর মনে করতাম। আজ পঁচিশ বছর পর ঘটনার একটি অংশের নীরব দর্শক হিসাবে আগামী দিনের জন্য একথাগুলো লিখে রাখলাম। কারণ আমার মনে হয়, হযরতের জীবনের সফলতা ও ব্যর্থতা, সর্বোপরি তাঁর নিঃসঙ্গতার বেদনা উপলব্ধি করার জন্য এর প্রয়োজন রয়েছে। সারা জীবন একই রকম নিঃসঙ্গতার বেদনা বহন করেছেন সত্যের সূর্য নামের আরেকজন মানুষ। সে সূর্য আলো ছড়িয়েছে অস্তহীনভাবে, তবে মেঘের ফাঁকে ফাঁকে; মেঘমুক্ত আকাশ ছিলো না তাঁর জীবনে। আমি মনে করি, এদুজন বড় মানুষ আমাদের মত ছোটদের ব্যর্থ জীবনের জন্য বড় ধরনের সান্ত্বনা।

মুহসিন এলেন এবং আমাকে নিয়ে বের হলেন। আমরা গেলাম মন্ত্রণালয়ে নয়, ধর্মমন্ত্রীর বাসভবনে। মন্ত্রী আমাকে

আন্তরিক অভ্যর্থনা জানালেন, আর বললেন, আমার সেই জবাব এখনো তার মনে আছে এবং সেকারণেই আমাকেও মনে আছে। আমি খুব অবাক হলাম যখন যুদ্ধরত দেশের একজন মন্ত্রী জিজ্ঞাসা করলেন তোমার ইকরা কেমন চলছে? আরো অবাক হলাম যখন দেখি, তার টেবিলে ইকরা পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যার সেই নোসখাটি, যা তাকে নৌবিহারে হাদিয়া দিয়েছিলাম। একজন মেহমানকে সন্তুষ্ট করার এটাই হলো আরবীয় তরীকা।

আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বললাম, আপনি হয়ত জানেন, আমাদের শায়খ ইরাক সফরে এসেছেন শুধু শান্তির অন্বেষণে। এ ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ তাঁর অন্তরে স্থায়ী রক্তক্ষরণের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবিলম্বে এবং যে কোন মূল্যে এ যুদ্ধ বন্ধ হোক, এটা তাঁর আন্তরিক কামনা। এ উদ্দেশ্যে হজ্বের আগে তিনি ইরান সফর করেছেন এবং ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব খোমেনীর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। আমাদের শায়খ যুদ্ধবন্ধের সুনির্দিষ্ট একটি প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন এবং তিনি চান অবিলম্বে প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসাইনের সঙ্গে বৈঠকে বসতে। এ বিষয়ে আমি আপনার সহযোগিতা কামনা করি।

তথ্যমন্ত্রীর মত ধর্মমন্ত্রীরও একই অবস্থা; তিনি যেন আকাশ থেকে পড়লেন। খোমেনী তোমাদের শায়খের সাথে দেখা করেছেন, এটা সত্যি!

আমি মৃদু হেসে বললাম, একটি মিথ্যা বহন করে আমরা জিলানীর দেশে আসবো কেন?

আসলে ইরাকী নেতাদের এমন বিস্ময়বোধের পিছনে যুক্তিসঙ্গত কারণও আছে। খোমেনী এ পর্যন্ত কোন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে পর্যন্ত সাক্ষাৎ প্রদান করেননি। আমাদের দেশের শহীদ প্রেসিডেন্ট যিয়াউর-রহমান যখন শান্তিমিশনে ইরান গিয়েছিলেন তখন তিনি আছরের পর খোমেনীর সঙ্গে শুধু মোছাফাহা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। সেই খোমেনী বাংলাদেশের একজন সাধারণ মানুষের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করবেন এবং যুদ্ধবন্ধের বিষয়ে আলোচনা করবেন তা বিশ্বাস করা কঠিন বৈকি।

যাই হোক, মন্ত্রী আশ্বাস দিলেন, এ বিষয়ে তিনি সম্ভাব্য চেষ্টা করবেন। তবে স্পষ্টভাবে কিছু না বললেও মনে হলো, যুদ্ধ এবং যুদ্ধবন্ধ, উভয় বিষয়েই তার মাঝে হতাশা বিরাজ করছে। অন্তত তথ্যমন্ত্রীর মত তাকে যুদ্ধের প্রতি অতটা উদ্দীপ্ত মনে হয়নি।

হোটেলে ফিরে হযরতকে ধর্মমন্ত্রীর আশ্বাসের কথা শুনালাম। তিনি, মনে হলো কিছুটা স্বস্তি লাভ করলেন, আর আমি তাঁর দিলের দুআ লাভ করলাম।

পরদিন সকালে অন্যরা বের হলেন মাযার যিয়ারাতে। হযরত অসুস্থতার জন্য যিয়ারাতে গেলেন না, আমারও আগ্রহ হলো না হযরতকে ছাড়া মাযার যিয়ারাতে। আমাদের গাইড মুহসিন যখন জানলেন, হযরত যাচ্ছেন না, তখন তিনি তার অধঃস্তন কর্মকর্তাকে যিয়ারাতে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব দিলেন। তিনি বেশ কিছুক্ষণ হযরতের কাছে বসলেন, নছীহত শুনলেন। তারপর আমার কামরায় কিছু সময় কাটিয়ে চলে গেলেন। মুহসিনকে আমার খুব বিষণ্ণ মনে হলো, অথচ গতরাতেও স্বাভাবিক ছিলেন। কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন, গতরাতে গ্রামের বাড়ী থেকে ফোন এসেছে, আমার দুই বন্ধু সীমান্তে যুদ্ধে ছিলো। তারা শহীদ হয়েছে। গ্রামের কবরস্তানে গতকাল তাদের দাফন করা হয়েছে। মুহসিন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, বিশ্বাস করো, তারা খুব সৎ মানুষ ছিলো। আমাদের গ্রামে যুবকদের মধ্যে তারা দুজনই শুধু নামায পড়তো। তারা তো এ যুদ্ধ চায়নি, তবু তাদের প্রাণ দিতে হলো।

আসলে কোন দেশেই সৈনিকরা যুদ্ধ চায় না, যুদ্ধ করেও না। কারণ যুদ্ধে তাদের প্রত্যক্ষ কোন স্বার্থ নেই। যুদ্ধ তো হয় রাজায় রাজায়। ঢাল-তলোয়ার এবং বন্দুক-কামানের মত সৈনিকরাও যুদ্ধের সরঞ্জাম মাত্র। অস্ত্র ছাড়া যেমন যুদ্ধ হয় না, তেমনি সৈনিক ছাড়াও যুদ্ধ চলে না। তাই অস্ত্রের চাহিদা এবং সৈনিকের প্রয়োজন। পার্থক্য এই যে, যুদ্ধে প্রাণহীন অস্ত্রের কোন ক্ষতি নেই, কিন্তু সৈনিকের সমস্যা এই যে, তার প্রাণ আছে, আবেগ-অনুভূতি আছে। সে যখন প্রাণ হারায় তখন তার স্ত্রী বিধবা হয়, সন্তান এতীম হয়। তার মা পুত্রশোকে পাথর হয়। তার মৃত্যুতে একটি পুরো পরিবার বিপর্যস্ত হয়। এভাবে হাজার হাজার সৈনিকের মৃত্যুতে নেমে আসে সামাজিক বিপর্যয়। কিন্তু যুদ্ধের সময়ও দেখা যায়, রাজা বের হয়েছেন শিকারভ্রমণে। কারণ যুদ্ধ পরিচালনা করার জন্য মন প্রফুল্ল রাখার প্রয়োজন আছে!

এমন অর্থহীন যুদ্ধ পৃথিবীর অন্যান্য জাতির মধ্যে হতে পারে এবং হয়, কিন্তু দুটি মুসলিম দেশের মাঝে, ভাইয়ে ভাইয়ে কীভাবে হয়, হতে পারে?!

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

 

advertisement