শাবান-রমযান-১৪৩৩   ||   জুলাই-আগস্ট-২০১২

বাইতুল্লাহর ছায়ায়-২৫

মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

মসজিদে খায়ফ পার হয়ে কিছু দূর আসার পর ভাই কামরুল ইসলামের অবস্থা আবার গুরুতর হয়ে পড়লো। শরীর যে কাঁপছে দেখেই বোঝা যায়। তাড়াতাড়ি ধরে পথের পাশে বসালাম। তিনি নিস্তেজ আওয়াযে বললেন, হুযূর, এ্যাম্বুলেন্স আনেন। মিনায় আরাফায় এ্যাম্বুলেন্স নামক বস্ত্তটি যে দেখিনি তা নয়, কিন্তু কোথায় পাওয়া যায়, জানা নেই। সরকারী হাসপাতালটা তো ফেলে এসেছি অনেক পিছনে। চারদিকে ছোটাছুটি করা, আর একে ওকে জিজ্ঞাসা করাই সার হলো, একটা এ্যাম্বুলেন্স পাওয়া তো গেলোই না, দেখা পর্যন্ত গেলো না।

মানুষ যখন একান্ত অসহায় অবস্থায় আল্লাহকে ডাকে তখন সেই ডাকে এমন একটি মিনতি থাকে যে, আল্লাহর রহমত সাড়া না দিয়ে পারে না। আমার ডাকে তখন সেই রকম একটি মিনতি ছিলো এবং সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর রহমত নেমে এলো।

ফিরে এসে দেখি ভাই কামরুল উঠে বসেছেন। কথা বলছেন হাসিমুখে। অসুস্থতার বা কষ্টের কোন ছাপ নেই চেহারায়। তার পাশে দুজন বাঙ্গালী যুবক। চাকুরী করেন কোন সউদী কোম্পানীতে। মিনায় আনা হয়েছে খন্ডকালের জন্য। তারা যথেষ্ট আন্তরিকতার পরিচয় দিলেন এবং কামরুলকে কাঁধ দিয়ে হাঁটতে সাহায্য করলেন।

কিছু দূর যাওয়ার পর একটা স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র পাওয়া গেলো। সেখানে এক ঘণ্টার মত শুশ্রূষা ও বিশ্রাম পাওয়া গেলো। ভাই কামরুলও মোটামুটি সুস্থবোধ করলেন। আবার শুরু হলো আমাদের পথচলা।

***

ভাই কামরুল তার বাচ্চা দুটিকে অসম্ভব রকম ভালোবাসেন। এটা আবার উল্লেখ করার মত বিষয় হলো কীভাবে? বাবা তার সন্তানকে ভালোবাসবে, এটা তো সংসারের স্বাভাবিক একটি সত্য; সে ভালোবাসা যদি হয়, অসম্ভব রকমের সেটাও তো অস্বাভাবিক কিছু নয়! তাহলে?!

তাহলে মনে হয় কথাটা আমি বুঝিয়ে বলতে পারিনি। আসল কথা হলো, সব বাবাই সন্তানকে ভালোবাসেন। তাতে মাত্রারও তারতম্য থাকে; কেউ অল্প, কেউ বেশী, কেউ বা অনেক। তবে সন্তানের প্রতি বাবার ভালোবাসা যখন বাবার মত হয় তখন সেটা হয় স্বাভাবিক। কিন্তু বাবার ভালোবাসা মায়ের মত হওয়া! এ বস্ত্ত সংসারে সত্যি বড় দুর্লভ। রিশ্তে নামে একটি হিন্দী বই পড়েছিলাম, তাতে ছিলো তেমনি এক বাবার কাহিনী, সন্তানের প্রতি যার ভালোবাসা ছিলো শুধু মায়ের মত নয়, মায়ের চেয়ে গভীর। সে বড় দীর্ঘ ও চমকপ্রদ কাহিনী। তবে সেটা ছিলো গল্প। আর গল্প তো গল্পই। আমার ধারণা ছিলো বাস্তবে এটা সম্ভব নয়।

ভাই কামরুলকে দেখে, তার মুখে বাচ্চাদের গল্প শুনে আমার ধারণায় কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। এখন মনে হয় বাস্তবেও হয়ত সম্ভব বাবার ভালোবাসা মায়ের মত হওয়া।

এ প্রসঙ্গ এখানে কেন? কারণ ভাবছিলাম, কীভাবে ভাই কামরুলকে এ অবস্থায় একটু সতেজ করে তোলা যায়। ডেলকার্নেগির পরামর্শ হলো, এমনকি শয্যাশায়ী রোগীকেও যদি তুমি সজীব স্বতঃস্ফূর্ত করে তুলতে চাও তাহলে তার সবচে প্রিয় ও ভালোবাসার বিষয়টি সন্তর্পণে তার সামনে উত্থাপন করো।

ব্যবস্থাপত্রটা প্রয়োগ করলাম এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ফল পেলাম। তিনি অনর্গল বলতে শুরু করলেন। আর সে কী আবেগ, উচ্ছ্বাস! যে কথা পাঁচবার শুনেছি তা আবার বললেন, যে কথা তিনবার শুনেছি তাও বললেন, যে কথা একবার শুনেছি তাও বাদ গেলো না। তবে এমন কথা একটাও পাওয়া গেলো না যা আগে বলেননি। আহা, এই জগত সংসারে তার বাচ্চা দুটির মত দুষ্ট এবং মিষ্ট বাচ্চা যেন আর নেই! ওরা যখন হাসে তখন দেখতে খুব সুন্দর, যখন কাঁদে তখন আরো সুন্দর, আর যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন তো একেবারে পরীর বাচ্চা!

এতক্ষণ তো তিনি হাঁটছিলেন সঙ্গের যুবকটির কাঁধে হাত রেখে, কাহিল পদক্ষেপে। একসময় লক্ষ্য করলাম কাঁধ থেকে হাতটা নেমে এসেছে, তারপর দেখি, পদক্ষেপও যথেষ্ট সবল হয়ে উঠেছে! মানুষ বড় আশ্চর্য প্রাণী!

***

বিপদে পেরেশানিতে এতক্ষণ বোধ হয় হুঁশ ছিলো না। তাই দেখতেও পাইনি, শুনতেও পাইনি; এখন পেলাম। টিনশেডের পাশ দিয়ে আমরা যাচ্ছি মিনার শেষ প্রান্তের দিকে, আর টিনশেডের ভিতর দিয়ে হাজার হাজার মানুষ তখনো চলেছে জামারা-অভিমুখে। তখনো মুখে তাদের লাববাইক আল্লাহুম্মা লাববাইক-এর সুমধুর ধ্বনি। হঠাৎ করে যেন হৃদয়ের মধ্যে প্রশান্তির একটি শীতল পরশ অনুভূত হলো। হজ্বের ধ্বনি এখন আমার মুখে নেই, আমার ভাইয়ের মুখে তো আছে! এ ধ্বনি বলতে যেমন মধুর লাগে, শুনতেও তেমনি মধুর লাগে।

ভাই কামরুল যেন আমার মনের কথাটাই বললেন, হুযূর, লাববাইক শুনে আমার দেহের মনের সব অবসাদ যেন দূর হয়ে গেছে। নিজেকে এখন পূর্ণ সতেজ মনে হচ্ছে। আহ, যদি বুঝতে পারতাম, কী আছে লাববাইক ধ্বনির মধ্যে! হয়ত জান্নাতের দুধের নহর, মধুর নহর বেয়ে বেয়ে আসে এ ধ্বনি!

অপূর্ব এক তন্ময়তার মধ্যে খুব অল্প সময়ে যেন টিনশেডের শেষ মাথায় এসে পড়লাম।

***

বাংলাদেশী দুই যুবক তখনো আমাদের সঙ্গে। কিছুটা যেন কৃতজ্ঞতা নিবেদনের উদ্দেশ্যে তাদের খোঁজখবর নিলাম। দুজনেই মোমেনশাহীর ছেলে। তাদের চাকুরী খুব সুখের নয়, মজুরিও বলার মত নয়। তবু তারা সুখী। কারণ তারা নবীর দেশে আইতে পারছে! বাংলাদেশে সাধারণ সমাজে যারা ধার্মিক নয়, তারাও এমন ধর্মপ্রাণ! নবীর দেশে শুধু আসতে পারাটাই তাদের কাছে এত আনন্দের, এত গর্বের, গৌরবের! আগুনঝরা রোদ, হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম, অতিসামান্য পারিশ্রমিক, এসব তাদের কাছে তুচ্ছ। কষ্ট শুধু একটাই, এত দূর এসে, এত কাছে থেকেও প্রাণভরে আল্লাহর ঘর দেখা হয় না। মাসে দুমাসে একবার সুযোগ হয়। তবু আল্লাহর শোকর! আমরার মত মানুষ, আর আল্লাহর ঘরের তাওয়াফ!

আপনেরার মত হজ্ব আমরা পায়াম কই! এই কামের মধ্যে দিয়াও তিনডা হজ্ব আল্লায় দিছে। যে দিছে হেয় কবুল করনের মালিক।

নিজের সামান্যতার কী সরল আন্তরিক প্রকাশ! এভাবেই তো মানুষ সামান্য থেকে অসামান্য হয়! আবার এ জিনিসটার অভাবেই অসামান্য মানুষ হয়ে যায় অতি সামান্য।

আমার খুব ভালো লাগলো সরল সাধারণ বাংলাদেশী যুবক দুটিকে।

তিনবছর আগে ওরা এসেছে সউদী আরবে। একজন আসার দুদিন আগে অসুস্থ মাকে হাসপাতালে ভর্তি করেছিলো। হাসপাতালে রেখেই তাকে বিমানে উঠতে হয়েছে। জীবনের নির্মম প্রয়োজনের কাছে হৃদয়ের মিনতি এবং চোখের জল কত মূল্যহীন!

কয়েক দিন পর ছেলেটি খবর পেলো, মাকে হাসপাতাল থেকে বাড়ীতে আনা হয়েছে, আর সেখান থেকে নেয়া হয়েছে কবরস্তানে! 

চোখে জল, মুখে হাসির উদ্ভাস, এর মধ্যে ছেলেটি বললো, তার মনে কোন দুঃখ নেই, কারণ মৃত্যুর সময় মা কলমা পড়েছে।

এখানে কার কাছ থেকে যেন শিখে নিয়েছে আল্লাহর শেখানো দুআ-

رب رب ارحمهما كما ربياني صغيرا

এখন এটাই তার একমাত্র সম্বল মায়ের বুকের ফোঁটা ফোঁটা দুধের প্রতিদান দেয়ার।

আমি নীরবে ছেলেটির কাঁধে হাত রাখলাম এবং নীরবেই তাকে মোবারকবাদ জানালাম। আমি এমন মায়ের কথা শুনেছি যিনি নিজে শিক্ষার আলো পেয়েছেন এবং বৈধব্য বরণের পর জীবনের সবকিছু বিসর্জন দিয়ে একমাত্র ছেলেকে উচ্চ শিক্ষা দান করেছেন। তারপর?! ছেলে সংসার পেতেছে আমেরিকায়, আর বিধবা মায়ের জীবনের শেষ কটা দিন কেটেছে আমেরিকায়, তবে ছেলের সংসারে নয়, একটি বৃদ্ধাশ্রমে! কত দুর্ভাগা এই মা! না, না, আমি ভুল বলেছি।  যেমনই হোক মা কখনো দুর্ভাগা হয় না, দুর্ভাগা হয় মায়ের মমতার অাঁচলের কথা ভুলে যাওয়া সন্তান।

আমার পাশে এই যে ছেলেটি, যার কাঁধে হাত রেখে আমি মিনার পথ অতিক্রম করছি, যার সঙ্গে মিনার পবিত্র ভূমিতে আমার প্রথম দেখা এবং হয়ত জীবনের শেষ দেখা, তার মা শিক্ষার আলো পাননি, ছেলেকেও শিক্ষার আলো দিতে পারেননি, কিন্তু কত ভাগ্যবতী মা! কত ভাগ্যবান তার সন্তান! কারণ মৃত্যুর পরো তাদের মধ্যে  রয়েছে رب ارحمهما  এর সেতুবন্ধন!

***

টিনশেড পার হয়েই বাম দিকে যে পথটা গেছে সেদিকে আমাদের যেতে হবে, এইটুকু জানি। পরবর্তী পথটা মনে নেই। যুবক দুটি পথের পাশের মানচিত্র দেখে আমাদের পৌঁছে দিলো তাঁবুর দোরগোড়ায়। তারপর চলে গেলো। যতক্ষণ দেখা যায়, আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের চলে যাওয়া দেখলাম। নিজের

অজান্তেই চোখদুটি ঝাপসা হয়ে এলো। চশমা খুলে চোখ মুছলাম, তারপর চশমা পরলাম, কিন্তু ছেলেদুটিকে আর দেখতে পেলাম না!

মানুষের ভিড়ে মাঝে মাঝে এমন মানুষেরও দেখা পাই বলেই জীবন এখনো আছে এবং আছে জীবনের কিছু সজীবতা।

***

ফজরের জামাত হলো। ভাই কামরুল রাতের ঘুমটা ঠিকমত পেয়ে এখন মাশাআল্লাহ যথেষ্ট সতেজ সজীব। ইমাম ছাহেবকে ঘিরে চিড়া-গুড়ের মজলিস হলো, যেমন সবসময় হয়। আমি তো এই মজলিসের নিয়মিত হাজিরান, ভাই কামরুলও খুব উৎসাহের সঙ্গে শরীক হলেন। হজ্বের আগে কী প্রসঙ্গে যেন ইমাম ছাহেবের সঙ্গে কথা হচ্ছিলো, একটি সমৃদ্ধ কুতুবখানা বা গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে; এমন একটি কুতুবখানা যা অন্তত পাকভারত উপমহাদেশে হবে শ্রেষ্ঠ কুতুবখানা, যেখানে দেশের এবং বিদেশের গবেষকরা আসবেন, যত দিন প্রয়োজন থাকবেন এবং গবেষণাকর্মে উপকৃত হবেন। অনেক কথাই হয়েছিলো। এটা সেই ছাত্রজীবন থেকে আমার বুকের লালিত স্বপ্ন।

ব্যবসার জগতের মানুষ ভাই কামরুলের কানে সে আলোচনা কীভাবে গেল জানি না, চিড়া আর গুড় মুখে দিয়ে আয়েশী ভঙ্গিতে চিবুতে চিবুতে হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, হুযূর, আপনার কুতুবখানাটা গড়ে তুলতে কত খরচ হবে?!

ভালো তো! ভাই কামরুল এবং কুতুবখানা! আসলে কার মধ্যে কী লুকিয়ে আছে কেউ জানে না। কার দ্বারা কী কাজ হবে কেউ বলতে পারে না।

ভাই কামরুলের জিজ্ঞাসায় কেন জানি ভিতর থেকে একটি প্রেরণা বোধ করলাম এবং সেই প্রেরণা থেকে অনেক কথা বললাম। ভাই কামরুল তখন খুব দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গেই বললেন, হুযূর, যদি বেঁচে থাকি, আর আল্লাহ তাওফীক দেন, আমি আপনার কুতুবখানার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করবো।

হজ্ব থেকে ফেরার পর আল্লাহর রহমতে ভাই কামরুলের জীবনে আমূল পরিবর্তন এসেছে। তখন দাড়ি ছিলো না, এখন শুনেছি মুখে সুন্নতি দাড়ি এসেছে। ছেলেরা পড়তো তার পছন্দের স্কুলে, এখন তারা মাদরাসায় পড়ে। এখন তার স্বপ্ন বাচ্চাদের তিনি আমলদার আলেম বানাবেন। আল্লাহ তাকে তাওফীক দান করুন, আমীন। মাঝে মধ্যে ভাবি, মিনার তাঁবুতে সেই সুন্দর ফজরের দিনটির কথা তাকে স্মরণ করিয়ে দিই, আবার ভাবি, চলুক না সবকিছু নিজের গতিতে!

***

দুপুরে মিনার তাঁবুতে ঘুমিয়ে আছি এবং সুন্দর একটি স্বপ্ন দেখছি। ঘুম এবং স্বপ্ন দুটোই ভেঙ্গে গেলো একটি দরাজ হাসির পরিচিত আওয়াযে। ইনি ভাই মুহিউদ্দীন। তার কথা সম্ভবত আগে বলেছি।

দোষ নেই, কিংবা গুণ নেই এমন মানুষ পৃথিবীতে নেই। তবে যার দোষ কম, গুণ বেশী তাকেই আমরা বলি ভালো মানুষ। তো পরিচয়ের প্রথম দিন থেকে এখন পর্যন্ত তাকে আমি ভালো মানুষরূপেই পেয়েছি। দ্বীনকে উদ্দেশ্য করে সন্তানের শিক্ষা-দীক্ষার জন্য এমন নিবেদিতপ্রাণ মানুষ আমি কম দেখেছি। শুধু এই যে, তার সঙ্গে চলতে হয় একটু সাবধানে।

ঘুম ভেঙ্গেছো, মাফ করে দিলাম; কিন্তু স্বপ্ন ভাঙ্গার অপরাধ! তাও মাফ করতে হলো। কারণ মক্কা শরীফ থেকে আমার জন্য তিনি (পাঁচ লিটার) যমযম এনেছেন, পায়ে হেঁটে এবং হাতে বহন করে।

বহু বছর তিনি আছেন মক্কায় জিদ্দায় এবং প্রতিবছর হজ্ব করেন এবারও করছেন। যোহরের পর তার সঙ্গে রামী করতে গেলাম। আসতে এবং যেতে বেশ কিছু অভিজ্ঞতা হলো।

মিনায় সবচে বড় সমস্যা মানুষের হারিয়ে যাওয়া। একবার হারালে আর উপায় নেই। বিশাল তাঁবুর রাজ্যে নিজের তাঁবুটি খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব। শিক্ষিত, সতর্ক, অভিজ্ঞ ও শক্তসমর্থ যারা তাদের জন্যও বেশ কঠিন। কাফেলা থেকে বিচ্ছিন্ন এই সব তাঁবুহারা মানুষগুলোর অবস্থা যে কী করুণ হয় তা নিজের চোখে না দেখলে বোঝা যাবে না। হজ্বের ব্যবস্থাপনায় যারা আছেন, মনে হয় বিষয়টার যথাযথ গুরুত্ব তাদের মাথায় আসছে না। তারা সম্ভবত শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত দফতরে বসে সমস্যা ও সমাধান চিন্তা করেন। এবার দেখলাম পুরো মিনাকে বিভিন্ন ইউনিটে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিটি ইউনিটের মাথায় রয়েছে ইউনিট নম্বর, রোড নম্বর এবং তাঁবু নম্বর। কিন্তু ব্যবস্থাটা এত জটিল যে, আমাদের পক্ষেই বুঝে ওঠা সম্ভব হয়নি। রাস্তার মোড়গুলোতে পুরো মিনার মানচিত্র স্থাপন করা হয়েছে, যাতে হারিয়ে যাওয়া মানুষ নিজের অবস্থান এবং সেখান থেকে তাঁবুর অবস্থান বুঝে সঠিক পথে যেতে পারে। অতি উত্তম ব্যবস্থা। তবে কিনা ভদ্রলোকদের মাথায় এ কথাটা আসেনি যে, বিভিন্ন দেশ থেকে যারা হজ্ব করতে আসেন তাদের বিপুল সংখ্যা এ মানচিত্র বোঝারই যোগ্যতা রাখে না। প্রতিটি মানচিত্রের পাশে অন্তত একজন অভিজ্ঞ সাহায্যকারী যদি থাকতেন যিনি অন্তত হাতের ইশারায় বুঝিয়ে দিতে পারেন যে, উদ্দিষ্ট স্থানে পৌঁছতে হলে তাকে কোন দিকে যেতে হবে, তাহলে পথের পাশের এই সুন্দর আলোঝলমল মানচিত্র হতো অর্থবহ।

হারিয়ে যাওয়া প্রতিটি মানুষের  অভিযোগ হলো, পুলিশের কাছ থেকে কোন রকম সহযোগিতাই পাওয়া যায় না।

আসলে সউদী হুকুমত গোটা হজ্বব্যবস্থা পরিচালনা করে সম্পূর্ণ অদক্ষ ও অশিক্ষিত জনবল দ্বারা। এমন একটি বহুজাতিক বিশ্বসমাবেশ, অথচ মাঠপর্যায়ের পুরো কর্মীবাহিনী আরবী ছাড়া আর কোন ভাষা জানে না এবং  আরবীও যাকে বলে মায়ের মুখের বুলি! ফলে তাদের দ্বারা বিপদগ্রস্ত মানুষের তেমন কোন সাহায্য হয় না, ক্ষেত্রবিশেষে বরং বিড়ম্বনা বাড়ে।

পুরো মিনায় যদি পাঁচহাজার স্বেচ্ছাসেবক শুধু এই কাজে নিয়োজিত থাকতো যে, তারা নিজেরা হারিয়ে যাবে না, বরং হারিয়ে যাওয়া মানুষকে কার্যকর সাহায্য করতে পারবে তাহলে মিনায় হারিয়ে যাওয়া হাজার হাজার মানুষ অবর্ণনীয় দুঃখকষ্ট থেকে রেহাই পেতো।

জাতিসঙ্ঘ তার শান্তিমিশনে বিভিন্ন দেশের সেনাবাহিনী থেকে বিপুল অর্থের বিনিময়ে সাহায্য নেয়। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী তো এক্ষেত্রে অতুলনীয় পেশাদারি দক্ষতা, উন্নত নৈতিকতা ও মানবিকতার পরিচয় দিয়েছে। তো হজ্বের ব্যবস্থাপনায় সউদী হুকুমত কী পারে না বাংলাদেশসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশের সেনাবাহিনী থেকে দক্ষ জনবল সংগ্রহ করতে!

হারিয়ে যাওয়া মানুষদের দুর্গতি ও দুর্দশা সম্পর্কে কয়েক সফরে এত প্রচুর অভিজ্ঞতা জমা হয়েছে যে, ইচ্ছা করলে ছোটখাটো একটি বই হতে পারে। এবারের একটি অভিজ্ঞতার কথাই বলি, আমি ও মুহিউদ্দীন রামী করে ফিরে আসছি। মিনার সীমানা পার হয়ে মুযদালিফায় আমাদের ৮৬ নম্বর তাঁবুর প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছি, এমন সময় হিন্দুস্তানের হারিয়ে যাওয়া একটি পুরো পরিবারের সঙ্গে দেখা। একজন বুড়ো, তার ভাই, ছেলে, ছেলের মা এবং ছেলের বউ। এরা বিহারের বাসিন্দা। বাংলা বোঝেন এবং একটু আধটু বলতেও পারেন। তাদের তখন কী বিপর্যস্ত অবস্থা, মুখে বলার প্রয়োজন ছিলো না, মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো। দুপুরে জামারায় গিয়ে ফেরার পথে পথ হারিয়ে ফেলেছে। এখন মাগরিবের পর। সারা দিন কিছু খাওয়া হয়নি। একফোঁটা পানিও না। সম্ভবত সঙ্গে পয়সা নেই। দূর থেকে দেখেই বুঝতে

পারলাম, এরা তাঁবুহারা মানুষ। কাছে গিয়ে যখন জিজ্ঞাসা করলাম, একসঙ্গে সবাই ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। মুহিউদ্দীন তাদের সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, কোন ভয় নেই, নিশ্চিন্ত থাকুন; এক ঘণ্টার মধ্যে আপনারা তাঁবুতে পৌঁছে যাবেন। এটা হলো ভাই মুহিউদ্দীনের কথা বলার নিজস্ব আন্দায! একথায় মনে হলো লোকগুলোর কলজেয় কিছুটা পানি এলো।

মুহিউদ্দীনের সঙ্গে ম্যাপ ছিলো। তাদের কাছে যে কার্ড ছিলো তা ম্যাপের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা গেলো, মিনায় টিনশেড বরাবর একেবারে জামারার কাছাকাছি ৩২ নম্বর ইউনিট। মানে তারা প্রায় দুকিলোমিটার দূরে চলে এসেছেন। অর্থাৎ জামারা থেকে ফেরার পথে সোজা হেঁটেছেন এবং তাঁবুর পাশ দিয়েই তাঁবু পার হয়ে চলে এসেছেন। যে পুলিশকেই জিজ্ঞাসা করেন মুখে বলে দেয় কুদ্দাম, আর হাতের ইশারায় দেখিয়ে দেয় সামনে

মুহিউদ্দীন তাদের বুঝিয়ে বলতে চাইলেন এখান থেকে সোজা কীভাবে যেতে হবে, অমনি তারা একসঙ্গে হাউমাউ করে উঠলেন, না বাবা, আল্লাহ তোমাদের ভালো করুন, দয়া করে তাঁবুর সামনে আমাদের পৌঁছে দিয়ে এসো।

মুহিউদ্দীন আমাকে বললেন, আপনি তাঁবুতে যান; আমি এদের পৌঁছে দিয়ে আসি। আমি বললাম, এই নেক কাজে আমিও শরীক থাকতে চাই।

আমাদের হাতে সামান ছিলো। বললাম, আপনারা ঠিক এখানে অপেক্ষা করুন, আমরা সামানগুলো তাঁবুতে রেখে পাঁচ মিনিটের মধ্যে ফিরে আসছি।

তারা ভাবলেন, আমরা সরে পড়তে চাচ্ছি। তাদের দোষ কী; বিপদগ্রস্ত মানুষ এমন ভাবতেই পারে। তখন মুহিউদ্দীন বললেন, আপনি এদের সঙ্গে থাকুন; আমি তাঁবুতে সামানগুলো রেখে আসি।

তিনি গেলেন, আমি তাদের সঙ্গে থাকলাম। তাতে তারা মোটামুটি ভরসা পেলেন। কিছু হালকা খাবার ও ঠান্ডা পানির ব্যবস্থা করা হলো। তারা এতটাই আপ্লুত হলেন যে, চোখগুলো ছলছল করে উঠলো। বিপদের সময় সামান্য একটু সহানুভূতি মানুষকে কতটা বিগলিত করে, অনেকবারের মত এবারও তা অনুভব করলাম।

ভাই মুহিউদ্দীন ফিরে এলেন, আমরা মানচিত্র অনুসরণ করে অগ্রসর হলাম। সারা দিন হেঁটে হেঁটে ক্ষুধায় ক্লান্তিতে তারা একেবারে ভেঙ্গে পড়েছিলেন, বিশেষ করে বুড়োবুড়ি দুজন। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে যখন তাদের তাঁবুর সামনে এসে পৌঁছলাম এবং তারা ভারতীয় পতাকা দেখে তাঁবু চিনতে পারলেন তখন বুড়োবুড়ি আনন্দের আতিশয্যে কেঁদে ফেললেন। তাঁবুর লোকেরাও হারানো মানুষগুলোর জন্য পেরেশান ছিলো। সবাই যে আবেগ উচ্ছ্বাসের সঙ্গে আমাদের জন্য দুআ করলো তা অবশ্যই আমাদের জন্য বিরাট সম্পদ।

এরকম আরেকজন হারিয়ে যাওয়া মহিলা ছিলেন পাবনার মেয়ে শান্তার মা। তিনি মুযদালিফায় হারিয়েছিলেন আরাফা থেকে ফেরার পথে। তাকেও ভাই মুহিউদ্দীন সাহায্য করেছিলেন তাঁবুতে স্বজনদের কাছে পৌঁছে দিতে। সে কাহিনী আরো মর্মন্তুদ ও শিক্ষণীয়।

***

বারো তারিখে জামারায় রামী করে হাজী ছাহেবান সেখান থেকেই মক্কা শরীফ চলে যান। তাতে কোন অসুবিধা নেই; তবে তের তারিখের রাত মিনায় যাপন করে দিনের কোন অংশে রামী করে মক্কায় গমন করা হলো সুন্নত। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তেরো তারিখের রাত মিনায় যাপন করেছেন এবং দিনে রামী করেছেন।

আমাদের আমীর ছাহেব সিদ্ধান্ত দিলেন, পুরো কাফেলা নিয়ে জামারা করে তিনি মক্কা শরীফ চলে যাবেন। আমি আর হুমায়ুন কবীর সাহেব মিনায় রাত যাপন এবং পরদিন সকালে জামারা করে মক্কায় যাবো, যাতে পুরো কাফেলার পক্ষ হতে এই সুন্নতটিও আদায় হয়ে যায়।

দুপুরের পর আমীর ছাহেব কাফেলা নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেলেন, আমি এবং হুমায়ূন কবীর সাহেব তাঁবুতে রয়ে গেলাম। ভাই আব্দুল বাকীর খুব ইচ্ছা ছিলো আমার সঙ্গে থাকার, কিন্তু স্ত্রী সঙ্গে আছেন বলে সম্ভব হলো না। বারবার করে বললেন, তাকে যেন দুআর মধ্যে স্মরণ রাখি।

ভাই মুহীউদ্দীন আমাকে সঙ্গ দেবেন বলে রয়ে গেলেন। অবশ্য তিনি চলে যেতে চাইলেও পারতেন না, আমি যেতে দিতাম না।

পুরো এলাকার তাঁবু প্রায় খালি হয়ে গেলো। অত্যন্ত

প্রশান্তিদায়ক এক নির্জনতা অনুভব করলাম। নির্জনতার প্রশান্তি সবসময় তো ভাগ্যে জোটে না। পেয়েছিলাম একটি নির্জন রাত এবং দিন পঁচিশ বছর আগে তেরো তারিখে এই মিনার মরুভূমিতে, মিনা যখন মরুভূমির মতই ছিলো। সাতাশী সনেও আমি এবং ইমাম ছাহেব তেরো তারিখের রাত মিনায় যাপন করেছিলাম। আশ্চর্য এক নির্জনতা ছিলো এবং অন্তরে ছিলো অপূর্ব এক অনুভূতি।

মাসআলার ভুলে সকালে রামী না করেই আমরা মক্কায় চলে গিয়েছিলাম এবং দুপুরে জামারার উদ্দেশ্যে সুড়ঙ পথে ফিরে এসেছিলাম। বিকালে প্রায় একা একা রামী করেছিলাম এবং একা একা সুড়ঙ পথে মক্কায় ফিরে এসেছিলাম। সম্ভবত সেটাই ছিলো আমাদের দুই বন্ধুর জীবনে শ্রেষ্ঠ দিন। মিনায় সেদিন সন্ধ্যায় প্রচন্ড ঝড় হয়েছিলো। বিরান তাঁবুগুলো সব উড়ে গিয়েছিলো। ধূলোর মেঘে সব অন্ধকার হয়ে গিয়েছিলো। সে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা জীবনে কখনো ভোলার মত নয়। মক্কায় সেদিন প্রচুর বৃষ্টি হয়েছিলো এবং অভাবনীয় ঢল নেমেছিলো। হাঁটু সমান পানি হয়েছিলো রাস্তায়; যদিও সে দৃশ্য দেখার সুযোগ হয়নি আমাদের।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

 

advertisement