রজব-১৪৩৩   ||   জুন-২০১২

দূ র্নী তি : কেবল স্বীকার নয়, দরকার পদক্ষেপ

ওয়ারিস রব্বানী

বাংলাদেশের সব জায়গাতেই দুর্নীতি। পুলিশ প্রশাসন সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত। এর পরই ভূমিপ্রশাসন, স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও বিচার প্রশাসনে দুর্নীতি বেশি। দুর্নীতি ও আইনের সঠিক প্রয়োগ না হওয়াই বাংলাদেশে সুশাসনের প্রধান অন্তরায়।

উপরের কথাগুলো বিরোধীদলীয় কোনো নেতার নয়। কোনো কূটনীতিক বা বিচারপতিরও নয়। নয় টিআইবি-র কোনো কর্মকর্তার। এমনকি দুর্নীতির কারণে পদ্মাসেতুর তহবিল আটকে দেওয়া সংস্থা-বিশ্বব্যাংকের কোনো প্রতিনিধিও অভিযোগগুলো তুলেননি। নির্লিপ্ত ভাষায় কথাগুলো বলেছেন বর্তমান সরকারের প্রচন্ড ক্ষমতাধর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। গত ১৯ মে রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে সুশাসন বিষয়ক গোলটেবিল আলোচনার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। পরের দিনের পত্রপত্রিকায় তার এ বক্তব্যকে স্বীকারোক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী যখন প্রশাসনের বিভিন্ন শাখায় রমরমা দুর্নীতির কথা ভরা মজলিসে বলতে থাকেন গণমাধ্যম তখন সেটিকে স্বীকারোক্তি হিসেবেই চিহ্নিত করবে। একদিক থেকে এতে নতুন কিছু নেই। কিন্তু মন্ত্রীর এই দুর্নীতি-বয়ানকে স্বীকারোক্তি হিসেবে চিহ্নিত করার অন্য একটি কারণও বোঝা যায়। লক্ষ্য করা গেছে, পদ্মাসেতু প্রকল্পে দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর (সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী) দুর্নীতির কথা বলে তহবিল না দেওয়ার কথা বলায় সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হয়েছে। এমনকি বিশ্বব্যাংক কর্তৃপক্ষকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলা হয়েছে দুর্নীতির বিষয়টি প্রমাণ করে দেখাতে। সরকারের বিভিন্ন কলকব্জায় যে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে-সেটা মুখ পুছে অস্বীকার করা হয়েছে। গত এপ্রিলে টাকার বস্তা নিয়ে কেলেংকারিতে পড়ে যাওয়ার পরও কালো বিড়াল খ্যাত এক মন্ত্রীর মন্ত্রিত্ব বহাল রাখা হয়েছে। তারপর তার সাধুতা প্রমাণের জন্য শোনানো হয়েছে বড় বড় বাণী। উপরে-নিচে নানা কায়দায় দুর্নীতি যে হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে তা স্বীকারই করা হয়নি। দুর্নীতির পথ বন্ধ করার কোনো উদ্যোগ নেওয়ার খবরও জানা যায়নি। এ পরিস্থিতিতে অর্থমন্ত্রী স্বীকার করেছেন দেশের সব জায়গায় দুর্নীতি চলছে। যদিও তিনি দুর্নীতির আলোচিত অনেক প্রসঙ্গ ও খাতের দিকে যাননি, তারপরও  তার এ স্বীকারোক্তির তাৎপর্য অনেক।

সরকার বা প্রশাসনের বিভিন্ন বিভাগে দুর্নীতির মানেই হলো রাষ্ট্রের সম্পদ ও অর্থের অপচয়।  দুর্নীতি একটি মস্তবড় গুনাহরও কাজ। এভাবে দুর্নীতি একটি বড় আকারের অভিশাপে পরিণত হয়। দুর্নীতির এই সর্বব্যাপি অভিশাপ থেকে বাঁচার অধিকার ও আকুতি নাগরিকদের মাঝে প্রবল। কিন্তু উপায় নেই। সাধারণ নাগরিকরা প্রশাসন-যন্ত্রের বাইরে বসে পেরেশানি ভোগ  ও আফসোস করা ছাড়া কিছুই করতে পারেন না। ক্ষমতার মসনদে যারা থাকেন ইচ্ছা থাকলে দুর্নীতির টুটি চেপে ধরার সুযোগ তারাই পান। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে, এ বিষয়টিতে তাদের আন্তরিকতার নমুনা বিশেষ দেখা যায় না। অনেকে বলেন, দুর্নীতির সুবিধা ভোগের যে স্বাদ তা থেকে ক্ষমতাসীনরাও বিরত থাকার মতো বৈরাগী হতে পারেন না। এতেই প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি বানের পানির মতো প্রবাহিত হওয়ার পথ পেয়ে যায়। বঞ্চনার অভিযোগ ও আক্ষেপ দেশব্যাপি ছড়িয়ে পড়ে। অর্থমন্ত্রী মহোদয়ের বক্তব্যে বোঝা যাচ্ছে, বর্তমানে দেশে সে অবস্থাই চলছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, প্রশাসনিক দুর্নীতির অস্তিত্ব কেবল বর্তমান সরকারের সঙ্গে নির্দিষ্ট বা সীমাবদ্ধ কোনো বিষয় বলে আমরা মনে করি না। এটি অতীতেও ছিল। বলা যায়, সব সরকারের আমলে প্রশাসনের একটি অবধারিত চিত্র দুর্নীতি। তবে কখনো এটি কম, কখনো বেশি হয়েছে। কখনো এর অস্তিত্বের কথা স্বীকার করা হয়েছে, কখনো স্বীকারই করা হয়নি। কখনো কিছু কিছু শুদ্ধি আনা হয়েছে, কখনো আরও আশকারা দেওয়া হয়েছে। এ সরকারের আমলে দুর্নীতির তথ্য এতদিন দায়িত্বশীল কোনো কণ্ঠে উচ্চারিতই হয়নি। এই প্রথম হলো। বিরোধীদলগুলো, গণমাধ্যম এবং আন্তর্জাতিক তহবিল সংস্থা ও কুটনীতিকরা দুর্নীতির কথা বার বার বললেও এতদিন সেসব অভিযোগ ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এবারই ব্যতিক্রম ঘটল। গণতান্ত্রিক সরকারে প্রধানমন্ত্রীর পরের স্থানটি দেওয়া হয় অর্থমন্ত্রীকে। সেই অর্থমন্ত্রীই এবার বললেন দুর্নীতির কথা। রাখঢাক না করেই বললেন, দেশের সব জায়গায় দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে। তাই সরকারের প্রভাবশালী এক সদস্যের স্বীকারোক্তি হিসেবে এ বক্তব্যকে গণ্য করা যেতেই পারে এবং তাতে আস্থাও রাখা যেতে পারে।

আমরা সাধারণ জনগণ। দুর্নীতি ঘটিত বঞ্চনা থেকে বাঁচার অধিকার ও আকাঙ্খা আমাদের রয়েছে। এখন আমরা এই স্বীকারোক্তির কারণে যে দায় চলে আসে সে দায়টি পূরণে সরকার কী পদক্ষেপ নেয়-তা দেখার অপেক্ষায় আছি। আমরা দেখতে চাই-এটা বাজার মাত করার জন্য কোনো বাত কি বাত নয়। অর্থমন্ত্রীর এ স্বীকারোক্তি বা উপলব্ধির জন্য দুর্নীতি বিরোধী যে সাঁড়াশি অভিযান চালানো দরকার সেটাই এখন মুখ্য। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের দেশে দুর্নীতির কালো বিড়াল দেখতে দেখতে চোখ ব্যথা হয়ে গেছে। এবার চোখের একটু সুখ চাই।

 

 

 

advertisement