আলিমদের ব্যবসা-বাণিজ্যে অংশগ্রহণ : কিছু সমস্যা ও তার সমাধান
এবার মাসিক মুহাযারার শিরোনাম নির্ধারণ করা হয়েছে-‘বর্তমান প্রেক্ষাপটে আলিমদের ব্যবসা-বাণিজ্যে অংশগ্রহণ : সমস্যা ও সমাধান।’ শিরোনামে ‘বর্তমান প্রেক্ষাপটে’ শব্দ দুটি না থাকলেও অসুবিধা নেই। কারণ উপার্জনের বিষয়টি নতুন নয়, পুরনো। সব যুগেই আলিম-ওলামা ছিলেন। তাঁরা দ্বীনী কাজের সাথে নিজেদের ও পরিবার পরিজনের জীবিকাও উপার্জন করেছেন। আপনারা হয়তো বলবেন, আগের যুগের অনেক আলিম তো বিয়ে শাদি করেননি, সংসারের ঝামেলা তাদের ছিল না। শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রাহ. (১৪১৭ হি.) তাঁদের সম্পর্কে একটি কিতাবও লিখেছেন-
العلماء العزاب الذين آثروا العلم على الزواج
কিন্তু তাঁদের সংখ্যা খুব বেশি নয়।
বিভিন্ন শতাব্দীর অসংখ্য আলিমের মধ্য থেকে তাঁদেরকে খুঁজে খুঁজে বের করতে হয়েছে।
তাছাড়া সংসারজীবনে প্রবেশ না করলেও তাদের অর্থোপার্জনের প্রয়োজন হয়নি তা তো নয়। তাহলে বোঝা গেল, আর্থিক কর্মকান্ডে আলিমদের সম্পৃক্ত হওয়া নতুন কিছু নয়।
আজকে যে বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলা যায় তা হল : ১. উপার্জন এবং অর্থ-সম্পদের বিষয়ে শরীয়তের দৃষ্টিভঙ্গি।
২. উপার্জনের পদ্ধতি এবং পরামর্শমূলক কথা।
৩. কিছু সমস্যা ও তা থেকে উত্তরণের উপায়?
৪. কিছু সংখ্যক আলিম ও দ্বীনদার মানুষ যারা ব্যবসা করছেন তাদের অধিকাংশ কোন পথ অবলম্বন করছেন, আসলে কোন পথ অবলম্বন করা দরকার ছিল। তারা যে পথ বেছে নিয়েছেন এতে শরঈ খারাবি কী এবং অর্থনৈতিক খারাবি কী? এর বিকল্প পন্থা কী হতে পারত এবং সেটি এর চেয়ে ভালো কেন।
এই দু’ চারটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে ইনশাআল্লাহ।
প্রথম কথা তো হচ্ছে, জীবিকা নির্বাহের রাস্তা বের করা শরীয়তের নির্দেশ, তবে সবসময় তা শর্তযুক্ত রাখা হয়েছে। সূরা জুমআর আয়াতটি দেখুন-
فاذا قضيت الصلوة فانتشروا فى الارض وابتغوا من فضل الله واذكروا الله كثيرا لعلكم تفلحون
সালাত শেষ হলে তোমরা ভূ-পৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (রিযিক) সন্ধান করবে ও আল্লাহকে অধিক স্মরণ করবে। যেন তোমরা সফলকাম হও।-সূরা জুমুআ (৬২) : ১০
শুধু এতটুকু নয়, শরীয়ত সদাকার আদেশ করেছে। আত্মীয়-স্বজনদের হক আদায় করতে বলেছে। তেমনি সামাজিক বিভিন্ন কাজকর্মে অর্থব্যয়ের যে নির্দেশ শরীয়তে আছে তা ইঙ্গিত করে একদল মানুষ এমন থাকুক, যারা নিজের ও পরিবারের প্রয়োজনীয় জীবিকা উপার্জনের পাশাপাশি আরো বেশি কিছু উপার্জন করবে। সবাই নয় এবং সবাই তা পারবে না।
সারকথা এই যে, নিজের ও নিজের পরিবার-পরিজনের প্রয়োজন পূরণের জন্য উপার্জন করা এবং বিশেষ ক্ষেত্রে আরো বেশি উপার্জন করা শরীয়তের দৃষ্টিতে প্রশংসনীয়। তবে শর্ত আছে। কুরআন-হাদীস পাঠ করলেই শর্তগুলো জানা যাবে। যেমন দেখুন এই হাদীসটি-
التاجر الصدوق الأمين
এখানে যে দুটো বিশেষণ উল্লেখ করা হয়েছে-সত্যবাদিতা ও আমানতদারি-এ দুটোর দ্বারা ব্যবসার ক্ষেত্রে যত ধরনের অন্যায় ও গর্হিত কর্মের আশ্রয় নেওয়া হয় সবগুলোকে বাতিল করা হয়েছে। আলোচনার শেষের দিকে এ বিষয়ে কিছু কথা বলার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।
অর্থনীতির বিষয়ে যেসব কিতাব লেখা হয়েছে, এ উপমহাদেশের আলিমদের বা আরবের আলিমদের, তাতে দু ধরনের দৃষ্টিভঙ্গিই আছে। বিশেষত এ উপমহাদেশের আলিমদের অর্থনীতির উপর লেখা কিতাবপত্রে দু ধরনের চিন্তা পাওয়া যায়-কিছু কিতাব আছে, যেগুলো অর্থনীতি বিষয়ে লেখা হলেও দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে অর্থবিমুখ। অর্থাৎ অর্থোপার্জনে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। আবার কিছু কিতাব আছে, যেগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা।
মানাযের আহসান গিলানী, আমীন আহসান ইসলাহী, আবদুল বারী নদভী, হিফযুর রহমান সিউহারভী-রাহিমাহুমুল্লাহ-প্রমুখ আলিমদের কিতাব পড়লে দুটো দৃষ্টিভঙ্গিই পাওয়া যাবে। পড়ার সময় মনে হবে, একটা আরেকটা থেকে আলাদা। আসলে আগে থেকেই দুটো ধারা চলে আসছে।
আমাদের হাদীসের কিতাবগুলোতে একটি মাসআলা আলোচনায় আসে যে, সবরকারী দরিদ্র উত্তম, না শোকরকারী ধনী? এ বিষয়ে দুদিকেই যুক্তি আছে, দলিল আছে। সাহাবায়ে কেরামের যুগেও এ দুটি ধারা ছিল। অর্থ-সম্পদ বিষয়ে আবু যর গিফারী রা.-এর সিদ্ধান্ত ও অবস্থানও আপনারা জানেন। আবুদ দারদা রা.-এর কথাও অনেকে জানেন। তিনি বলেছিলেন, ইসলাম আসার পর আমি ইবাদত ও তিজারতকে একত্র করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পারিনি। পরে শুধু ইবাদতকে গ্রহণ করেছি।
তবে জুমহুর সাহাবা দুটোর মাঝে সমন্বয় করেছেন। খোদ খলীফারাও করেছেন। আবু বকর রা. খেলাফতের দায়িত্ব নেওয়ার আগে ব্যবসা করতেন।
যাইহোক, দুটি ধারা আগে থেকেই চলে আসছে। তাছাড়া এটি একটি ফিতরী ও স্বাভাবিক বিষয় যে, কেউ ধনী হবে, কেউ সে তুলনায় গরীব হবে। প্রত্যেকের অবস্থা অনুসারে কর্তব্য নির্ধারিত হবে।
দ্বিতীয় কথা এই যে, উপার্জনের ক্ষেত্রে কী কী সমস্যা আসতে পারে এবং সেগুলো থেকে উত্তরণের উপায় কী? সমস্যা সম্পর্কে কথা বলতে গেলে প্রথমে বলতে হবে, কী পরিমাণ সম্পদ থাকা দরকার। একেক পরিমাণ সম্পদের সমস্যা একেক রকম। সম্পদের পরিমাণের শেষ নেই। তবে আমি মনে করি, আল্লাহ তাআলা ছাড়া অন্যের মুখাপেক্ষী না হয়ে সহজেই জীবন অতিবাহিত করা যায়, অন্তত এতটুকু সম্পদ থাকা দরকার। এ পরিমাণ সম্পদ উপার্জনের চেষ্টা করা জরুরি। এবং আল্লাহ চাহে তো এ পরিমাণ সম্পদ উপার্জন করা অসম্ভব নয়।
মুমিন হিসেবে এ বিশ্বাস থাকতে হবে যে, যতদিন দুনিয়াতে মুসলমান থাকবে ততদিন হালাল রোজগারের পথ খোলা থাকবে। কারণ কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা হালাল রিযিকের আদেশ করেছেন। তবে কখনো তা অপেক্ষাকৃত কঠিন হতে পারে, কিন্তু এ তো শুধু উপার্জনের ক্ষেত্রে নয়, দ্বীনের অন্য সকল ক্ষেত্রেই একই কথা। আপনারা যে এখানে এসেছেন গাড়িতে আপনার লেবাসের কয়জনকে দেখেছেন?
বাসে নামাযের সময় হয়েছে আপনি হয়তো বাস থামানোর অনুরোধ করেছেন, কিন্তু অন্যরা বিরক্ত হচ্ছে। কেউ কেউ তো এমনও বলে থাকে যে, পরে কাযা পড়ে নিয়েন!
মাদরাসায় পড়ছেন, তো অন্য অনেকে করুণার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। তাহলে প্রতিকুলতা শুধু উপার্জনের ক্ষেত্রে নয়, দ্বীনের সকল ক্ষেত্রেই। তবে মুমিন হিসেবে এই বিশ্বাসটুকু আপনার থাকতে হবে আর তা বাস্তবও বটে যে, কিয়ামত পর্যন্ত হালাল পথে চলার রাস্তা খোলা থাকবে, এখনও খোলা আছে।
তৃতীয় কথা : অর্থ কীভাবে উপার্জন করা হবে। আমরা দেখতে পাই যে, আলিমদের জীবিকা নির্বাহের রাস্তা দুভাবে হয়ে থাকে।
১. দ্বীনী খিদমতকে মূল পেশা বানিয়ে আরেকটু স্বাচ্ছন্দ্য আনার জন্য কিছু অর্থনৈতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করা।
২. দ্বীনী ইলম অর্জনের পর মূল পেশা হিসেবে কোনো ‘হিরফা’ পেশাদারী কাজ বা ‘তিজারাহ’ ব্যবসা অবলম্বন করা।
দুটোই হতে পারে। কোনোটিই দোষনীয় নয়, তবে শরীয়তের বিধি-বিধান অনুযায়ী হওয়া আবশ্যক।
প্রথম পথ
আলিমদের মধ্যে এই পন্থাটিই বেশি এবং আমাদের এ অঞ্চলে ঐতিহ্যগতভাবেই আলিমগণ দ্বীন শেখার পর দ্বীনী খিদমতের সাথে জড়িত হন, যা অবশ্যই প্রশংসনীয় এবং এটি প্রয়োজনীয়ও ছিল। দ্বিতীয় পথে কেউ গেলে আমরা তারও বিরোধী নই। তবে অধিকাংশ আলেমের দ্বীনী খিদমতে লেগে থাকাটাই ভালো। এটি শুধু ফযীলতের বিষয়ই নয়, প্রয়োজনেরও বিষয়। আপনি যদি এ অঞ্চলের সাধারণ শিক্ষিতদের সাথে আলিমদের অনুপাত বের করেন তাহলে দেখবেন, আলিমদের সংখ্যা কত কম। তাই যেটা ঐতিহ্যগতভাবে এখানে হয়ে আছে সেটা দরকারিও বটে।
এখন কারো যদি মূল পেশা হয় দ্বীনী খিদমত আর সেখান থেকে তিনি কোনো বেতন-ভাতা গ্রহণ না করেন তাহলে সেটা আলাদা বিষয়। জরুরি কিছু নয়। পিছনের দিকে তাকালে দেখা যায়, সালাফ থেকে দু ধরনের অবস্থানই আছে কেউ এটাকে উৎসাহিত করেছেন, কেউ নিরুৎসাহিত করেছেন। অনেকেই বলেছেন, যাদের মূল পেশা দ্বীনী খিদমত তাদের জীবিকার পুরোটা বা মূল অংশ ওখান থেকেই আসা উচিত। তাহলে তাদের পক্ষে ঐ খিদমতে পুরো সময় দেওয়া সম্ভব হবে।
আর এটাও তো সত্য যে, আগের তুলনায় এখনকার দ্বীনী অবস্থা দুর্বল। তাই যদি খেদমতের জায়গা থেকে অর্থ গ্রহণের বিষয় থাকে তাহলে দায়দায়িত্বও বেশি থাকবে। এদিক থেকে অনেকে এটাকে উৎসাহিত করেছেন। আল্লাহ তাআলা ছাড়া অন্য কারো মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজের ও পরিবারের জীবন চলে যায় এ পরিমাণ জীবিকা যদি এ পেশা থেকে এসে যায় তাহলে ভালো, কিন্তু বাস্তব অবস্থা হল, অনেক ক্ষেত্রে তা হয় না। যে যে ক্ষেত্রে হয় না, ফলে করজ করতে হচ্ছে বা বেশি কষ্ট করতে হচ্ছে সেসব ক্ষেত্রে আর কী করা যেতে পারে এটা চিন্তা করা যায়।
এ বিষয়ে দু ধরনের উদ্যোগ হতে পারে : ১. একক বা ব্যক্তিগত উদ্যোগ। ২. সম্মিলিত বা যৌথ উদ্যোগ।
একক উদ্যোগ-এর অর্থ হল, নিজের বুদ্ধি ও অল্প অর্থ কাজে লাগিয়ে কিছু অতিরিক্ত উপার্জনের চেষ্টা করা। এটা কোথাও কোথাও আছে। যেমন কোনো শিক্ষকের কাছ থেকে ছাত্ররা খাতা-কলম কিনে থাকে। কেউ কেউ ছাত্রদের নাস্তা বা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করে থাকেন। এতে দোষের কিছু নেই। এক প্রতিষ্ঠানের সবাই হয়তো তা করতে পারবেন না, কিন্তু কেউ করলে তা দোষনীয় নয়। প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে উৎসাহও দেওয়া উচিত। যাতে ছাত্ররাও মানসম্মত জিনিস সহজে পেতে পারে।
এ রকম আরেকটি উপায় হতে পারে
হস্তশিল্প, কুটির শিল্প। এখন সাধারণ শিক্ষিতদের অনেকেই এ ধরনের কাজ করছে। আলিমদের পরিবারেও তা হতে পারে। এতে দোষের কিছু নেই। হালাল জীবিকা উপার্জনের প্রচেষ্টায় লজ্জারও কিছু নেই।
আরেকটি উদাহরণ দিই। এখানে মানসিক বাধাটা সরিয়ে ফেলতে পারলেই আর সমস্যা নেই।
অনেক ছাত্র বাহির থেকে তরকারি এনে খায়। কোনো উস্তাদের বাসা থেকে যদি তা আসে তাহলে একদিকে
উস্তাদেরও কিছু আয় হল, ছাত্রও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন খাবার পেল। এগুলোতে আসলে দোষ নেই। অনেক ছেলের প্রয়োজন থাকে, অনেকে অসুস্থ থাকে, সব খাবার খেতে পারে না। তো এ ধরনের রীতি গড়ে উঠলে উস্তাদেরও উপকার, ছাত্রেরও উপকার।
আরেকটি উদাহরণ, মৌসুমী কাজ। যেমন ঈদের সময় নতুন কাপড় সরবরাহ করা। এভাবে আয়ের পথগুলো সম্পর্কে যদি একটু ব্যাপকভাবে চিন্তা করা হয়, দু একটি উপায়কে নির্দিষ্ট না করা হয় তাহলে দেখা যাবে, অনেক পথ বের হবে।
আরেকটা আয়ের উৎস বলি, মূল উদ্দেশ্য আয় নয়, তবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে হয়ে যাবে। তা হল লেখালেখি। অনেকে বলে, ইন্ডিয়া, পাকিস্তানের সব আলেম ব্যবসা করেন। আসলে এটা গলত মশহুর। সবাই ওখানে ব্যবসা করেন না। তবে অনেকে এমন আছেন, যারা কিছু কিছু লেখালেখি করেন। এরপর নিজস্ব একটি মাকতাবার মতো হয়ে যায়। হয়তো নিজে গড়ে তোলেন কিংবা নিজের কিতাবগুলো কোনো মাকতাবাকে দেন। ওখান থেকে তার কিছু আয় আসে।
দেখুন, কিতাবপত্র লেখাও পড়ানোর মতোই। পড়ানো যেমন আল্লাহর জন্য হয় তেমনি কিতাব লেখাও আল্লাহর জন্য। তবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আয়ও আসবে।
আরো কিছু রাস্তা আছে, এগুলোকে উৎসাহিত করব না। যেমন তাবীজ-তদবীর ও আমলের কাজ। একে পেশা হিসেবে নেওয়া শরঈ দৃষ্টিকোণ থেকে পছন্দনীয় নয়। শরীয়তের গন্ডির ভিতর থেকে কারো কোনো উপকার করলে যদি কিছু পেয়ে যায় তাহলে দোষের কিছু নেই। কিন্তু পেশা বানানো পছন্দনীয় নয়।
তো এই হল ব্যক্তিগতভাবে ছোট ছোট কাজকে আয়ের উৎস বানানোর কিছু দৃষ্টান্ত।
ম্মিলিত বা যৌথ উদ্যোগ
এক্ষেত্রে যে উপায়টি বলব তা ব্যবসা নয়; বরং নিজের পেশায় থেকে ব্যবসায় অর্থায়ন করা। কারণ আপনার যদি একটি নিয়মিত পেশা থাকে আবার পুরা ব্যবসায়ীও হতে চান তাহলে কোনোটিই ভালোভাবে হবে না।
অনেক ছাত্রকে দেখা যায়, বিভিন্ন জায়গায় পরীক্ষা দিতে চায়। ঐসব দিকে যাওয়া উচিত কি অনুচিত-সে বিতর্কে না গিয়েও যে কথা বলা যায় তা হচ্ছে, তুমি যে বছর মাদরাসায় ভর্তি হয়েছ ঐ বছর অন্য কোথাও পরীক্ষা দিতে পারবে না। কারণ অন্য কোথাও পরীক্ষা দিতে গেলে তুমি এ মাদরাসার নিয়ম ভঙ্গ করবে, নিসাবের পড়া ঠিক মতো পড়বে না, অনুপস্থিত থাকবে। এখানেও বিষয়টি এ রকম। খিদমতের পুরো যিম্মাদারী আদায়ের সাথে সাথে যদি প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীও হতে চাই তাহলে কোনোটাই হবে না। কোনোটা যদি ভালো হয় তাহলে বুঝতে হবে অন্যটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ব্যবসার জন্যও মেধা ও সময় লাগে, তেমনি আদর্শ শিক্ষকতার জন্যও মেধা ও সময় লাগে। ভালো দরসের জন্য যথেষ্ট প্রস্ত্ততি নিতে হয়। এরপর মনোযোগের সাথে দরস দিতে হয়। সুতরাং দুটোই যখন সময় ও মেধাকে দাবি করে তখন দুটো কীভাবে হবে। এটা সম্ভব কেবল সরকারী চাকরির ক্ষেত্রে। যেখানে চাকরিটা সময়ের সাথে সীমাবদ্ধ। সুতরাং কেউ ঐ সময়ের পর ব্যবসায় অংশগ্রহণ করতে পারে এবং প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীও হতে পারে। কিন্তু মাদরাসার যিম্মাদারির সাথে এটা সম্ভব নয়। এখানে যেটা সম্ভব তা হচ্ছে ব্যবসায় অর্থায়ন। কয়েকজনের অর্থ একত্র হয়ে ব্যবসা দাঁড়িয়ে যেতে পারে। তবে তা পরিচালনা করবেন তারা, যাদের মূল পেশা ব্যবসা, অন্য কিছু নয়। তো সারকথা এই যে, বড় ব্যবসা পরিচালনা করাও সম্ভব যদি এটাই মূল পেশা হয়। অন্যথায় বহু সমস্যার সৃষ্টি হবে।
বড় ব্যবসা কীভাবে করবে
ব্যবসা যত ছোট সমস্যা তত কম।
পক্ষান্তরে ব্যবসা যত বড় সমস্যাও তত বেশি। এটা শুধু আলিমদের জন্য নয়, সাধারণ ব্যবসায়ীদের জন্যও। তবে আলিমদের প্রতি আমাদের দুর্বলতা বেশি। আমরা তাদের কথা বলছি না, যাদের চিন্তাধারা এই যে, ব্যবসা করতে যাচ্ছি, অন্যরা যেভাবে করে আমরাও সেভাবেই করব। তাদের সম্পর্কে এখানে কিছু বলার নেই।
কোনো কোনো ‘ইসলামী’ ব্যাংকার এমনও বলে থাকেন যে, ব্যাংকগুলো তো আন্তর্জাতিক স্বীকৃত নীতির আওতায় চলে। এখানে বাস্তবে বড় পরিবর্তন করা প্রায় অসম্ভব। তাই যদি গবেষণা করে ব্যাংকের সুদের ব্যাপারে একটা কিছু করা যেত তাহলে পুরোপুরি ইসলামী ব্যাংকিং সম্ভব হত!
তাকে বেশি দোষ দেই না। কারণ তিনি সাধারণ শিক্ষিত মানুষ। ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রেও শুধু পোশাক পরিবর্তন করেছেন, কিন্তু আশ্চর্য হতে হয় কোনো কোনো ‘ইসলামী’ ব্যক্তির কথা শুনে। এ রকম একজন বললেন, আলিমরা এতদিন পর্যন্ত কী গবেষণা করল! এই আধুনিক যুগে এসেও সুদটাকে বৈধ করতে পারল না!
যাইহোক, যারা ব্যবসায় গিয়ে প্রচলিত ধারার সাথে মিশে যাবে তাদের সম্পর্কে কিছু বলার নেই। কিন্তু যে আলিমরা ব্যবসাকে পেশা হিসেবে নিতে চান, তারা যদি আদর্শ ঠিক রেখে ব্যবসা করেন তাহলে আগেও বলেছি, এতে দোষ নেই; বরং প্রশংসার চোখেই দেখা উচিত।
ভালো ব্যবসায়ীও আমাদের দরকার। এর প্রথম কারণ জীবিকা উপার্জন। দ্বিতীয় কারণ, সমাজের পরিবর্তন। আলিমরা যদি সঠিকভাবে ব্যবসা করেন তাহলে সমাজের একটি উত্তম পরিবর্তনের অসীলা তারা হবেন। এটি হবে সুন্নতে হাসানা বা উত্তম রীতি প্রবর্তনের শামিল।
এখন বিশ্বব্যাপী ব্যবসা চলছে ভুলভাবে। তাই কেউ যদি শরীয়া অনুযায়ী বড় ব্যবসা দাঁড় করায় তাহলে তা একটি মডেল হিসেবে দাঁড়াবে। বর্তমান যুগেও যে শরীয়া মোতাবেক ব্যবসা-বাণিজ্য সম্ভব তার একটি বাস্তব উদাহরণ সৃষ্টি হবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বড় ব্যবসার ক্ষেত্রে কী কী ব্যবসা করা যেতে পারে। দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, কী কী সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে এবং তা থেকে উত্তরণের উপায় কী?
ব্যবসার একটি উপায় হচ্ছে একক প্রচেষ্টা। এটা তার পক্ষেই সম্ভব, যে আগে থেকেই অর্থবিত্তের মালিক। আলিমদের মধ্যে এ ধরনের মানুষ কম।
যাদের অর্থ কম তারা এককভাবে ব্যবসা করতে পারবে না। এখন বড় বড় ব্যবসায়ীরাও এককভাবে ব্যবসা করে না।
এর দৃষ্টান্ত হচ্ছে শেয়ারবাজার ও ব্যাংকগুলো। ব্যাংকে যদিও সব শ্রেণীর মানুষের অর্থ জমা হয় কিন্তু ব্যাংকের টাকা খাটায় দেশের বড় বড় ধনীরা। আরেক জায়গা হচ্ছে শেয়ারবাজার। তারা শেয়ার বাজারে আইপিও ইস্যু করে কোটি কোটি টাকা জনগণ থেকে নেয় এবং সে টাকা দিয়ে ব্যবসা করে। তো শুধু নিজের টাকা দিয়ে শিল্পপতিরাও ব্যবসা করে না।
যাই হোক, আলিমরা যদি বড় ধরনের ব্যবসা করতে চান বা বড় ব্যবসায় অংশীদার হতে চান তাহলে এর পদ্ধতি কী?
ব্যবসার প্রথম বিষয় হচ্ছে মূলধন যোগাড়। সাধারণ ব্যবসায়ীরা সাধারণত দু’ভাবে মূলধন যোগাড় করে। ব্যাংক লোন ও আইপিও-এর মাধ্যমে। কিন্তু আলিমরা কী করবে? আলিমরা পুরোনো পন্থা থেকেই মূলধন যোগাড় করতে পারবেন এবং ব্যবসাও করতে পারবেন। নতুন আবিষ্কৃত ধারাগুলোর বাইরেই এটি সম্ভব। শরীয়তের দৃষ্টিতে একে তুলনা করা যায় শিরকতের সাথে। শক্ত নীতিমালা থাকলে এবং দক্ষ ও সৎ হাতে পরিচালিত হলে এটা সম্ভব। এক্ষেত্রে কিছু কিছু সমস্যা হয়। এটা ছোটখাটো কৌশল অবলম্বন করে সমাধা করা সম্ভব। আপনি নিয়ম রাখতে পারেন যে, মাসের এত তারিখের মধ্যে চাঁদা পৌঁছে দিতে হবে। ঐ তারিখের মধ্যে অফিসে পৌঁছে না দিলে একজন লোক আপনার কাছে যাবে এবং চাঁদা নিয়ে আসবে। সেক্ষেত্রে তার যাতায়াত খরচ আপনাকে বহন করতে হবে। এই নিয়ম চালু হলে দেখবেন, চাঁদা পরিশোধের হার বেড়ে গেছে। আর এখন তো যেকোনো জায়গা থেকেই টাকা পাঠিয়ে দেওয়া সহজ।
এখন শুধু ইতিবাচক কথাই বলছি। এক্ষেত্রেও যেসব ভুল পদ্ধতি আছে, যেমন কেউ চাঁদা এনে দিলে সে এত পার্সেন্ট কমিশন পাবে-এগুলো এখন বলছি না। এ বিষয়ে পরে আসছে।
তো এভাবে অনেকের অল্প অল্প টাকা জমা হলে ব্যবসার অর্থায়ন হবে। এখানে একটি কথা বলি, যা আমি প্রায়ই বলে থাকি, তা এই যে, শর্টকাট পথে বড়লোক হওয়ার উপায় শরীয়তে নাই। সাধারণ ব্যবসা-বাণিজ্যেও নেই। হ্যাঁ, গলদ পথে গেলে আছে। এজন্য ঐ লাইনে কেউ বড় লোক হলে ব্যঙ্গ করে বলা হয়-ভদ্রলোক নিশ্চয়ই আলাদীনের চেরাগ হাতে পেয়েছেন!
তো আপনাকে অল্প থেকেই শুরু করতে হবে। ব্যক্তিগত ব্যবসা করুন বা যৌথ ব্যবসা, শিরকত করুন বা মুযারাবা, সবক্ষেত্রেই এককথা। অল্প থেকেই শুরু হবে। এরপর ধীরে ধীরে বড় হবে। রাতারাতি অনেক টাকা হয়ে যাবে-এটা হবেও না, করাও উচিত না।
করা উচিত না এজন্য বললাম যে, আপনার আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে হয়তো অনেক বড়লোক আছে। তারা আপনাকে একসাথে অনেক টাকা দিতে চায় ব্যবসা করার জন্য। আপনি বুদ্ধিমান হলে এত টাকা একসাথে নিবেন না। কারণ এখানে দায়িত্ব অনেক। প্রথমে মূলধন রক্ষা করা তারপর লাভ করা। কিছু নিজে রাখা, কিছু তাদেরকে দেওয়া। এগুলো অনেক ঝুঁকি ও দায়িত্বের বিষয়। এজন্য ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে হবে।
মূলধন জমা হওয়ার পর কোনো উৎপাদনশীল ব্যবসা হতে পারে আবার কোনো বেচাকেনাও হতে পারে। যারা ব্যবসা পরিচালনা করবেন তারা নিজেদের দক্ষতা অনুযায়ী ব্যবসার ধরন বাছাই করবেন। শরীয়তের বিধান মেনে যে কোনোটাই করা যেতে পারে।
উৎপাদনশীল ব্যবসা এই দিক থেকে ভালো যে, এতে আরো কিছু মানুষের কর্মসংস্থান হয়। তবে পূর্বঅভিজ্ঞতা না থাকলে এতে ঝুঁকিও আছে।
সমিতির মতো আরেকটি হল কোম্পানি। সমিতি ও কোম্পানিতে খুব বেশি পার্থক্য নেই। রাষ্ট্রীয় কিছু আইনে কোম্পানি ও সমিতিতে কিছু পার্থক্য আছে। বাকি শরয়ী দৃষ্টিতে সমিতি ও কোম্পানি দুটোই শিরকত। যদিও আধুনিক আরবীতে লিমিটেড কোম্পানিকে শারিকা বলে। সুতরাং শিরকতের মাসাইলগুলো জেনে নিতে হবে এবং সেগুলো অনুসরণ
করতে হবে।
মূলধন যোগাড়ের দ্বিতীয় পন্থা মুযারাবা। আপনি ছোটখাটো কিছু দাঁড় করান, তাতে প্রতিশ্রুতি থাকুক। আকর্ষণ বোধ করলে একজন দু’জন করে মানুষ আপনার এখানে বিনিয়োগ করতে আসবে। আপনি বলবেন, এখানে বিনিয়োগ করতে পারেন তবে আপনি কোম্পানির অংশীদার হবেন না। আবার অংশীদার হবেন না একথাটা উহ্য রেখে বলতে পারেন যে, এখানে বিনিয়োগ করতে পারেন যদি লাভ হয় তাহলে লাভের এত ভাগ আপনি পাবেন, এত ভাগ আমি। আর লোকসান হলে তা আপনাকে বহন করতে হবে। শেষ বাক্যটি না বললেও মুযারাবা হয়ে যায়। তবে শিরোনাম থাকতে হবে লাভের অংশীদারিভিত্তিক ব্যবসা। এটা মুযারাবার সঠিক তরজমা। কারণ মুযারাবার অংশীদারি তো শুধু লাভের ক্ষেত্রে হয় লোকসান বহন করতে হয় রাববুল মাল বা অর্থদাতাকে।
তো এ উপায়েই মূলধন সংগ্রহ করা সম্ভব। এখানে প্রশ্ন আসতে পারে, এভাবে মনুষ টাকা দিবে কি না। এটা আসলে নির্ভর করে আপনার যোগ্যতা ও বিশ্বস্ততার উপর।
মানুষ প্রথমেই যা চায় তা হচ্ছে সিকিউরিটি, তার অর্থের নিরাপত্তা। মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখে কেন? এখন তো অসংখ্য কোম্পানি আছে, যেগুলোতে বড় বড় লাভের হাতছানি আছে। এরপরও অধিকাংশ মানুষ ব্যাংকেই টাকা রাখে। কেন? কারণ ঐখানে সে নিরাপদ বোধ করে। তো আপনি যদি দক্ষ ও বিশ্বস্ত হন তাহলে অল্প লাভ দিলেও মানুষ আপনার কাছে টাকা রাখবে। মিনতি করে রাখবে। সুতরাং স্বাভাবিক পন্থায় টাকা আসবে না-এই আশঙ্কা সম্পূর্ণ অমূলক। তবে দক্ষতা ও বিশ্বস্ততা প্রমাণ করতে হবে।
এখনও মানুষ নিরাপদ জায়গা তালাশ করে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, মানুষ নিরাপদ মনে করে অর্থ রাখে এরপর প্রতারিত হয়। এ কারণে দিন দিন মানুষের আস্থা কমছে। এদেশের উদাহরণ দিলে অনেকে অসন্তুষ্ট হবে, পাকিস্তানের উদাহরণ নিন। পাকিস্তানে ১টি কোম্পানি ছিল এলায়েন্স মোটর কোম্পানি। তারা টাকা নেওয়ার সময় হালাল উপার্জনের টাকা কি না ইত্যাদি বিচার করে টাকা নিত। পাকিস্তানের বিখ্যাত আলিমদের এবং তাদের সূত্রে অন্য অনেক মানুষের টাকা তাতে খাটত। দেশে আসার পর হঠাৎ শুনলাম, ঐ কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে গেছে। পরিচালকরা পলাতক। পরিচালকরা আলিম ছিল না। কিন্তু
পাকিস্তানের অনেক বড় বড় আলিমের টাকা তাতে খাটছিল। আলিমদের চেয়ে অনেক বেশি ছিল তাদের পরিচিতজনদের টাকা। তো এভাবে আস্থা বিনষ্ট হয়। এজন্য অন্যের অর্থের বিষয়ে দায়িত্বের মানসিকতা নিজের অর্থের চেয়েও বেশি থাকতে হবে। এটা যদি থাকে, দক্ষতা ও বিশ্বস্ততা থাকে তাহলে একসময় মাথাব্যথা হয়ে যাবে যে, এত টাকা কোথায় খাটাব।
তো এটা হচ্ছে অর্থায়ন প্রসঙ্গ। এখানে অন্য কিছু কথাও আছে। তা পরে বলার চেষ্টা করব।
এখন ব্যবসা কোনটা করব-এ নিয়ে দুয়েকটি কথা বলা যাক।
অনেক ধরনের ব্যবসা এখন হচ্ছে। আমার মতে আলিমদের যদি ব্যবসার ক্ষেত্রে বিচরণ করতে হয় তাহলে গণমুখী ব্যবসাকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। তাহলে সমাজ উপকৃত হবে। ঝুঁকির আশঙ্কাও ঐসব ক্ষেত্রে তুলনামূলক
কম থাকে।
গণমুখী ব্যবসা মানে যেখানে ব্যবসা হবেই। যেমন একটু বড় করে ধরলে, সুপার স্টোর। ছোট করে ধরলে ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। এখানে বিক্রি না হয়ে পারে না। এসব দোকানে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র থাকে। সুতরাং কিছু না কিছু বিক্রি হবেই। ফলে লোকসানের ঝুঁকি কমে আসবে। আর অনেক লোকের সাথে মেলামেশা হবে। আপনি বাজারদরেই পণ্য দিবেন, কিন্তু ভালো জিনিস দিবেন। মেয়াদোত্তীর্ণ জিনিস রাখবেন না। নকল জিনিস রাখবেন না। ক্রেতার সাথে সুন্দর আচরণ করবেন। তাহলেই দেখবেন আপনার দোকানে ভীড় লেগে গেছে। আমাদের বাঙালীদের অনেক দুর্বলতা আছে, তবে অনেক গুণও আছে। একটি গুণ হচ্ছে অল্পে সন্তুষ্ট হওয়া। তো ছোটখাটো কিছু বিষয়ে সচেতন থাকলে মানুষ আপনার কাছেই আসবে।
ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের ব্যবসা যদি কেউ করেন তাহলে তার দাঁড়িয়ে যাওয়ার অনেক পথ খোলা আছে। একটা পর্যায়ে গিয়ে আপনি যদি বড় জায়গা নিয়ে