وحدة الأمة واتباع السنة উম্মাহর ঐক্য : পথ ও পন্থা মতভিন্নতার মাঝেও সম্প্রীতি রক্ষা, সুন্নাহসম্মত পন্থায় সুন্নাহর প্রতি আহবান
গত ২৩ রবিউস সানী ১৪৩৩ হিজরী, মোতাবেক ১৭ মার্চ ২০১২ ঈ. শনিবার কাকরাইল ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়ার উদ্যোগে ‘উম্মাহর ঐক্য : পথ ও পন্থা’ শিরোনামে একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সেমিনারে আলকাউসারের তত্ত্বাবধায়কের পক্ষ থেকে যে প্রবন্ধটি উপস্থাপিত হয়েছিল তা হুবহু বা তার সারসংক্ষেপ আলকাউসারে প্রকাশের জন্য অনেক বন্ধু/পাঠক জোর আবেদন জানিয়েছেন। উক্ত সেমিনারে উপস্থিত বন্ধুরা প্রবন্ধটি পুস্তক আকারে পেলেও আলকাউসারের অধিকাংশ পাঠকের কাছে তা পৌঁছেনি। এজন্য সামান্য পরিবর্তন-পরিমার্জনের পর প্রবন্ধটির সারসংক্ষেপ আলকাউসারে প্রকাশ করা হচ্ছে। এটি প্রবন্ধের দ্বিতীয় কিস্তি। যাদের কাছে মূল প্রবন্ধটি রয়েছে তাদের জন্যও তা উপকারী হবে বলে আশা রাখি।-সম্পাদক
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
হাদীসের শরণাপন্ন হলে কি মতপার্থক্য দূর হয়, না বিবাদ?
কারো কারো ধারণা, সবাই যদি কুরআন ও হাদীসের অনুসরণের ব্যাপারে সম্মত হয়ে যায় তাহলে ইখতিলাফ দূর হয়ে যাবে। ইখতিলাফ শুধু এ জন্যই হয় যে, এক পক্ষ কুরআন-হাদীস অনুসরণ করে, অপর পক্ষ কুরআন-হাদীস অনুসরণ করে না। এ প্রসঙ্গে তারা নিমেণাক্ত আয়াতটিও উল্লেখ করে থাকে-
فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا
(তরজমা) যদি তোমরা কোনো বিষয়ে বিবাদে লিপ্ত হও তাহলে তা আল্লাহ ও রাসূলের নিকট পেশ কর। যদি তোমরা আল্লাহ ও শেষ দিবসের উপর ঈমান রাখ। এটা উত্তম ও এর পরিণাম সুন্দর।-সূরা নিসা (৫) : ৫৯
অথচ উপরোক্ত আয়াতে এ কথা বলা হয়নি যে, ‘কুরআন-হাদীসের শরণাপন্ন হলে ইখতিলাফ দূর হয়ে যাবে।’ বরং বলা হয়েছে, ‘বিবাদের ক্ষেত্রসমূহে কুরআন-হাদীসের শরণাপন্ন হও।’ এর অর্থ হল তাহলে বিবাদ মিটে যাবে। এরা বিবাদ মিটে যাওয়াকে ইখতিলাফ মিটে যাওয়ার সমার্থক ধরে নিয়েছে এবং এখানেই ভ্রান্তিতে নিপতিত হয়েছে। কেননা বিবাদ মিটে যাওয়া ও ইখতিলাফ মিটে যাওয়া এককথা নয়। অনেক ক্ষেত্রে ইখতিলাফ বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও বিবাদ মিটে যায়। পক্ষান্তরে অনেক ক্ষেত্রে ইখতিলাফ ও বিবাদ দু’টোই মিটে যায়।
যেমন বিবাদরতদের মাঝে এক পক্ষ জালিম, অপর পক্ষ মাজলূম। এক পক্ষ হকের উপর, অন্য পক্ষ বাতিলের উপর। তারা যদি কিতাব-সুন্নাহর শরণাপন্ন হয় এবং কুরআন-সুন্নাহর ফয়সালা মেনে নেয় তাহলে বিবাদও দূর হবে, মতভেদও থাকবে না। পক্ষান্তরে যেখানে শরীয়তের দলীলের ভিত্তিতে একাধিক মত হয়েছে কিংবা সুন্নাহর বিভিন্নতার ক্ষেত্রে একজন এক সুন্নাহ অন্যজন অন্য সুন্নাহ অনুসরণ করছে-এ ধরনের ক্ষেত্রে যদি পরস্পর বিবাদ সৃষ্টি হয় এবং উপরোক্ত আয়াতের নির্দেশনা অনুযায়ী তারা কিতাব-সুন্নাহর শরণাপন্ন হয় তাহলে কিতাব-সুন্নাহ তাদেরকে এই নির্দেশনাই দিবে যে, বিবাদ করো না। কারণ তোমরা উভয়ে সঠিক পথে আছ। কারো অধিকার নেই অন্যের উপর আক্রমণ করার। তো এখানে মতপার্থক্য বহাল থাকা সত্ত্বেও বিবাদ দূর হবে।
সহীহ বুখারীর ঐ হাদীস কারো অজানা নয়, যাতে হযরত উমর রা. ও হযরত হিশাম ইবনে হাকীম রা.-এর মধ্যকার বিরোধের কথা বর্ণিত হয়েছে। যা সাময়িক ঝগড়ার রূপ ধারণ করেছিল। মতবিরোধটি হয়েছিল কুরআনের কিরাত নিয়ে। হযরত উমর রা. হযরত হিশাম রা.কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট হাজির করে তার বিরুদ্ধে নালিশ করেছিলেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেকের পড়া শুনলেন। এরপর প্রত্যেককেই বললেন-
هكذا أنزلت
অর্থাৎ এভাবে কুরআন নাযিল হয়েছে।-সহীহ বুখারী ৮/৬৩৯-৬৪০ (ফাতহুল বারী)
এ ধরনের আরেকটি ঘটনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে বলেছেন-
كلاكما محسن، فاقرآ
তোমাদের দুজনই ঠিক পড়েছ। তাই পড়তে থাক।-সহীহ বুখারী ৮/৭২০ (ফাতহুল বারী)
বনু কুরাইজার ঘটনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণীর মর্ম বোঝার ক্ষেত্রে সাহাবায়ে কেরামের মাঝে মতভেদ হয়েছিল। উভয় দল হাদীসের মর্ম যা বুঝেছেন সে অনুযায়ী আমল করেছেন। এরপর সরাসরি আল্লাহর রাসূলের শরণাপন্ন হয়েছেন। কিন্তু তিনি কোনো দলকে তিরস্কার করেননি। বিস্তারিত ঘটনা উদ্ধৃতিসহ সামনে আসছে।
তো দেখুন, প্রথম ঘটনা ছিল কিরাআতের পার্থক্য সংক্রান্ত, যা সুন্নাহর বিভিন্নতার মধ্যে শামিল। এই মতভেদের ক্ষেত্রে যখন আল্লাহর রাসূলের শরণ নেওয়া হল তিনি বিবাদ মিটিয়ে দিলেন, কিন্তু ইখতিলাফ বহাল রাখলেন এবং বললেন, উভয় পদ্ধতি সঠিক।
দ্বিতীয় ঘটনাটি ছিল রায় ও ইজতিহাদের মতপার্থক্য। এখানে প্রত্যেক পক্ষ হাদীস থেকে যা বুঝেছেন সে অনুযায়ী আমল করেছেন। এখানে তাদের মাঝে কোনো বিবাদ হয়নি। এরপরও তাঁরা বোধ হয় এজন্যই আল্লাহর রাসূলকে জিজ্ঞাসা করেছেন যে, তাঁর আদেশের সঠিক অর্থ জানবে না। কিন্তু হাদীসের বর্ণনা অনুযায়ী, আল্লাহর রাসূল তা বলেননি। শুধু এটুকু করেছেন যে, কোনো পক্ষকেই তিরস্কার করেননি। তাহলে এখানে তিনি ইজতিহাদ এবং সঠিক প্রেরণা তথা হাদীস অনুসুরণের প্রেরণা থেকে প্রকাশিত সিদ্ধান্তকে বহাল রেখেছেন। এই শ্রেণীর মতভেদকে তিনি বাতিল করেননি। তাহলে ইখতিলাফে মাহমূদ বা ইখতিলাফে মাশরূ, যে নামই দেওয়া হোক, কুরআন-সুন্নাহর সামনে উপস্থাপন করা হলে বিলুপ্ত হবে না। কারণ এ তো কুরআন-সুন্নাহর দলিলের ভিত্তিতেই হয়েছে। হ্যাঁ, এসব বিষয়ে কেউ যদি বিবাদে লিপ্ত হয় সে কুরআন-সুন্নাহর শরণাপন্ন হলে বিবাদ থেকে ফিরে আসবে। কারণ কুরআন তাকে বলবে-
وكلا آتينا حكما وعلما
অর্থ : আর তাদের প্রত্যেককে দিয়েছি প্রজ্ঞা ও জ্ঞান।
এবং হাদীস তাকে বলবে-
كلاكما محسن فاقرءا এবং فما عنف واحدا من الفريقين
হ্যাঁ, ইখতিলাফে মাযমুম বা নিন্দিত মতভেদের ভিত্তি যেহেতু দলিল-প্রমাণের বিরোধিতা অথবা মূর্খতা ও হঠকারিতা কিংবা প্রবৃত্তি ও দুর্বল ধারণার অনুসরণ তাই এ ধরনের ইখতিলাফ কুরআন-হাদীসের দিকে প্রত্যাবর্তন ও অনুসরণের দ্বারা মিটে যায়।
পক্ষান্তরে ইখতিলাফে মাহমুদ বা ইখতিলাফে মাশরূ হয়েই থাকে কুরআন ও হাদীসের উপর অটল থাকার কারণে। তাই কুরআন-হাদীসের দিকে প্রত্যাবর্তনের কারণে এ ইখতিলাফ মিটে যাওয়ার কোনো অবকাশ নেই। এজন্য এ ধরনের ইখতিলাফ সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীন ও আইম্মায়ে দ্বীনের মাঝেও হয়েছে এবং পরবর্তীতে আহলে হাদীস ও সালাফী উলামায়ে কেরামের মাঝেও হয়েছে।
যারা ‘আসবাবে ইখতিলাফে ফুকাহা’ এবং ‘ফিকহে মুকারান’-এর কিতাবসমূহের সঠিক ধারণা রাখেন তাদের নিকট বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্ট ও বাস্তব সত্য, তবে কিছু কিছু মানুষ নিজের অজ্ঞতার কারণে এ ধরনের ইখতিলাফকে হাদীস মানা বা না মানার ইখতিলাফ বলে মানুষকে বিশ্বাস করাতে চায়।
ইজতিহাদী বিষয় ও একাধিক সুন্নাহ সম্বলিত বিষয়ে সুন্নাহর প্রতি আহবানের সুন্নাহসম্মত পদ্ধতি
আলহামদুলিল্লাহ এ শিরোনামের বেশ কিছু জরুরি কথা বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন শিরোনামের আলোচনায় এসে গেছে। কিছু কথা সামনের শিরোনামগুলোতেও আসবে। তবে গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতার কারণে কিছু কথা আলাদা শিরোনামেও নিবেদন করছি।
ইখতিলাফুত তানাওউ বা একাধিক সুন্নাহ সম্বলিত বিষয়ে আহবানের বিধান
প্রথমে ‘ইখতিলাফুত তানাওউ’ সম্পর্কে আলোচনা করছি। যেহেতু এখানে মতপার্থক্যের ক্ষেত্র এমন বিষয়, যাতে একাধিক সুন্নাহ রয়েছে, তাই এক্ষেত্রে নিমেণাক্ত নীতিমালা অনুসরণ করা কর্তব্য।
১. যেহেতু সুন্নাহ মোতাবিক আমল হওয়াই উদ্দেশ্য তাই যে এলাকায় যে সুন্নাহর উপর আমল হচ্ছে এবং যে মসজিদে যে সুন্নাহর অনুসরণ হচ্ছে সেখানে তা-ই বহাল থাকতে দেওয়া উচিত। ঐ এলাকায়, ঐ মসজিদে সাধারণ মানুষকে দ্বিতীয় সুন্নাহর দিকে দাওয়াত দেওয়া মোটেই উচিত নয়। এ দাওয়াত খাইরুল কুরূন তথা সাহাবা-তাবেয়ীনের যুগে ছিল না। যেসব ক্ষেত্রে সুন্নাহ একটি সেখানে সেই সুন্নাহর বিষয়ে অবহেলা করা হলে সুন্নাহর দিকে দাওয়াত দিতে হবে। তদ্রূপ কেউ সুন্নাহ ছেড়ে বিদআতে লিপ্ত হলে তাকে বাধা দিতে হবে এবং সুন্নাহর দিকে আসার দাওয়াত দিতে হবে। এ দাওয়াত সালাফের যুগে ছিল।
সুন্নাহর বিভিন্নতার ক্ষেত্রগুলোতে বেশির চেয়ে বেশি এই তো হবে যে, আপনার বা আপনার উস্তাদের গবেষণা অনুযায়ী, কিংবা আপনার প্রিয় মুহাদ্দিস বা প্রিয় ইমামের গবেষণা অনুযায়ী যে সুন্নাহ মোতাবেক আপনি আমল করছেন তা অপর সুন্নাহ থেকে অগ্রগণ্য বা সুন্নত হওয়ার দিকটি তাতে বেশি স্পষ্ট। তো এটুকু অগ্রগণ্যতা সাধারণ মানুষকে সেদিকে আহবান করার জন্য যথেষ্ট নয়। নতুবা একই কথা অন্য পক্ষেরও বলার অবকাশ থাকবে। তো উভয় পক্ষ যখন নিজেদের দিকে আহবান করতে থাকবে তখন ফলাফল কী হবে? সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে সাধারণ মানুষের মাঝে অস্থিরতা ছড়ানো হবে না কি?
এ শ্রেণীর মতভেদকে তো ইসলাম ও কুফর কিংবা সুন্নাহ ও বিদআর মতো বিভেদ-বিচ্ছিন্নতার মতভেদ সাব্যস্ত করা যায় না। এখানে অন্য পক্ষের মতামতের দালিলিক ভিত্তি স্বীকার করতে হবে (যদি ইনসাফ ও ন্যায়নিষ্ঠা থাকে)। তাহলে একের দৃষ্টিতে যে প্রাধান্য ও অগ্রগণ্যতা তা অন্যের উপর কেন আরোপ করা হবে?
২. এ ধরনের বিষয়ে সর্বোচ্চ যা হতে পারে তা এই যে, আলিমগণ নিজেদের মাঝে আলোচনা করতে পারেন এবং পারস্পরিক মতবিনিময় ও চিন্তার আদান-প্রদান হতে পারে। এ জাতীয় বিষয়ে সালাফের ফকীহ ও ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তিদের থেকে এটুকুই পাওয়া যায়।
৩. এই বিষয়গুলোকে ‘নাহি আনিল মুনকারে’র আওতায় নিয়ে আসা এবং কোনো একটি পন্থার উপর মুনকার কাজের মতো প্রতিবাদ করা, সেই পন্থার অনুসারীদের নিন্দা-সমালোচনা করা, তাদেরকে সুন্নাহবিরোধী ও হাদীসবিরোধী আখ্যা দেওয়া সম্পূর্ণ নাজায়েয ও সুন্নাহ পরিপন্থী কাজ।
এই কথাগুলোর দলিল এই-
ক. যেহেতু দুটো পন্থাই নির্ভরযোগ্য হাদীস বা আছার দ্বারা প্রমাণিত তাই কোনো একটি পন্থার উপর যদি ‘আমর বিল মারুফ ও নাহি আনিল মুনকারে’র বিধান প্রয়োগ করা হয় তাহলে দ্বিতীয় পন্থাটিকে, যা শরীয়তের দলিল দ্বারা প্রমাণিত, প্রত্যাখ্যান করা হয়, যা ভুল।
খ. এর দ্বারা ‘ইবতালুস সুন্নাহ বিল হাদীস’ বা ‘ইবতালুস সুন্নাহ বিস সুন্নাহ’ অর্থাৎ হাদীসের দ্বারা সুন্নাহকে বাতিল করা, কিংবা এক সুন্নাহ দ্বারা অন্য সুন্নাহকে বাতিল করা হয়। এ তো ঐ ক্ষেত্রেও বৈধ নয়, যেখানে দলিলসমূহের মাঝে বিরোধ পরিলক্ষিত হয়। ঐ ক্ষেত্রেও তো একটি দলিলকে প্রাধান্য দেওয়া হয়, অন্য দলিলকে বাতিল করা হয় না। তাহলে যে ক্ষেত্রে বিরোধ নয়, সুন্নাহর বিভিন্নতা, সেক্ষেত্রে কীভাবে তা বৈধ হতে পারে?
গ. আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যামানায় একটি ঘটনায় যখন তাঁর আদেশের মর্ম বোঝার ক্ষেত্রে সাহাবীদের মাঝে মতপার্থক্য হল, আর তা হল ফরয নামায কাযা করার মতো কঠিন বিষয়ে, এরপর এ মতপার্থক্য আল্লাহর রাসূলের দরবারে পেশ করা হল তখন তিনি কোনো পক্ষকেই কিছু বলেননি। সুন্নাহর বিরোধিতার অভিযোগ তো দূরের কথা। অথচ আদেশটি (হাদীসটি) তাঁরই ছিল। সুতরাং আদেশের উদ্দেশ্যও তাঁর নিশ্চিতভাবেই জানা ছিল। এরপরও কোনো পক্ষকে আদেশ পালনে ব্যর্থ ঘোষণা করেননি। আল্লাহর রাসূল কি উম্মতের জন্য আদর্শ নন? তাহলে উম্মত কীভাবে সুন্নাহর বিভিন্নতার ক্ষেত্রে এ ঘোষণা দিয়ে দেয়?
ঘ. উম্মাহর সালাফ-খালাফ তথা আগের পরের মনীষীগণের ইজমা এই যে-‘লা ইনকারা ফী মাসাইলিল ইজতিহাদ’ অর্থাৎ ‘ইজতিহাদী বিষয়ে প্রতিবাদ নয়’। তাহলে যেসব ক্ষেত্রে সুন্নাহর বিভিন্নতামূলক মতপার্থক্য সেখানে প্রতিবাদ করা কীভাবে বৈধ হয়?
ঙ. আর বিশেষভাবে একাধিক সুন্নাহ সম্বলিত ক্ষেত্রগুলোতে সাহাবা-যুগ থেকে সালাফের নীতি ও অবস্থান ‘তাওয়াতুর’ তথা উম্মাহর অবিচ্ছিন্ন কর্মধারার মাধ্যমে প্রমাণিত। তাঁরা এ জাতীয় বিষয়ে একে অন্যের প্রতিবাদ করতেন না। আলিমগণ নিজেদের মাঝে আলোচনা করতেন।
উল্লেখিত দলিল-প্রমাণের আলোকে যে কথাগুলো নিবেদন করা হল বড় বড় আলিম ও মনীষীগণও তা বলেছেন। তাদের কিছু উদ্ধৃতি সামনে আসছে। আপাতত আমি দুটি কিতাবের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
১. রিসালাতুল উলফা বাইনাল মুসলিমীন (শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহ.-এর কিছু পুস্তিকা ও ফতোয়ার সমষ্টি)।
সংকলনটি হালাবের মাকতাবুল মাতবূআতিল ইসলামিয়া থেকে শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রাহ.-এর সম্পাদনায় ও তাঁর টীকা সহকারে প্রকাশিত হয়েছে। এর প্রচ্ছদে লেখা আছে-
وفيها أمر الإسلام بالتوحد والائتلاف وحظره التنازع والتفرق عند الاختلاف.
অর্থাৎ এ পুস্তিকায় আলোচনা করা হয়েছে যে, ইসলাম তার অনুসারীদেরকে ঐক্য ও সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ থাকার আদেশ করে এবং মতপার্থক্যের ক্ষেত্রে বিভেদ-বিচ্ছিন্নতার শিকার হতে নিষেধ করে।
সংকলনটিতে তানাওউয়ে সুন্নাহ বা সুন্নাহর বিভিন্নতা সম্পর্কেও শায়খ ইবনে তাইমিয়া রাহ.-এর একটি পুস্তিকা আছে। তাতে তিনি ইজমা ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণ করেছেন যে, একাধিক সুন্নাহর ক্ষেত্রে যে মতপার্থক্য তাতে উপরোক্ত কর্মপন্থাই অনুসরণীয়।
তিনি লেখেন, ‘প্রথমত সালাফের ইজমা আছে যে, এ ধরনের একাধিক সুন্নাহ সম্বলিত ক্ষেত্রগুলোতে হাদীস-সুন্নাহয় বর্ণিত প্রতিটি পন্থাই জায়েয ও বৈধ। দ্বিতীয়ত এসব বিষয়ের হাদীস ও আছার থেকেও এই প্রশস্ততা প্রমাণিত হয়।’
দ্বিতীয় পুস্তিকাটি শায়খ আবদুল্লাহ ইবনে জইফুল্লাহ আররুহাইলী লিখিত। হিজাযের ভালো আলিমদের মাঝে তাঁকে গণ্য করা হয়। তিনি ফকীহও এবং মুহাদ্দিসও। তাঁর এই সারগর্ভ ও দলিল সম্বলিত পুস্তিকাটির নাম- دعوة إلى السنة في تطبيق السنة منهجا وأسلوبا
অত্যন্ত দরদের সাথে পুস্তিকাটি লেখা হয়েছে। তাই সেরকম দরদের সাথেই তা পাঠ করা উচিত। আমার সামনে এ পুস্তিকার প্রথম সংস্করণ রয়েছে, যা দারুল কলম বৈরুত থেকে ১৪১০ হিজরীতে প্রকাশিত হয়েছে।
এতে তিনি উলামা-তালাবা ও দায়ীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন, ‘আমরা সুন্নাহর অনুসরণ করতে চাই, সুন্নাহর দিকে আহবান করতে চাই, কিন্তু আমাদের এ কাজও তো সুন্নাহ অনুসারেই হতে হবে। সুন্নাহর অনুসরণ করতে গিয়ে, সুন্নাহর দিকে দাওয়াত দিতে গিয়ে কোনো কাজ যদি সুন্নাহবিরোধী হয়ে যায় তাহলে কেমন হবে?’
পুস্তিকার শুরুতে তেরোটি আয়াত ও হাদীস উল্লেখ করেছেন এবং তার আলোকে সর্বমোট ২৪টি বিষয়ে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এরপর بعض مظاهر المخالفة للسنة ‘সুন্নাহ-বিরোধিতার কিছু দৃষ্টান্ত’ শিরোনামে এমন কিছু সুন্নাহ-বিরোধী কাজ চিহ্নিত করেছেন, যেগুলো সুন্নাহ অনুযায়ী আমল করতে গিয়ে এবং সুন্নাহর দিকে দাওয়াত দিতে গিয়ে করা হয়। এরপর বিভিন্ন শিরোনামে বিস্তারিত ও দালিলিক আলোচনা করেছেন। দীর্ঘ আলোচনা করেছেন একাধিক সুন্নাহর ক্ষেত্রগুলোতে নিজের কাছে অগ্রগণ্য পন্থার দিকে দাওয়াত দেওয়ার বিধান সম্পর্কে। এ পুস্তিকাটিও আদ্যোপান্ত পড়ার মতো। আমি শুধু প্রাসঙ্গিক কিছু কথা তুলে দিচ্ছি।
الإشارة إلى خطأ في مفهومنا لمعنى الالتزام بالكتاب والسنة
وخطأ آخر من أخطائنا في هذا العصر، ارتكبناه في سبيل الدعوة إلى السنة وإلى الاحتكام إلى الكتاب والسنة، وهذا الخطأ هو الجمود باسم الاتباع. لا شك في أن الاتباع للكتاب والسنة واجب، وأن الخضوع والتسليم لهما لازم لكل مسلم، ولا خيرة للمسلم أمام حكم الله وحكم رسوله، كما أنه لا يصْلُحُ أن يتقدم بين يدي الله ورسوله بالقول أو التشريع والحكم، هذا أمر لا جدال فيه، ولكن الخطأ والجناية على الكتاب والسنة هما في الحرص على الجمود، وعدم الفقه وسعة البصيرة في فهم الكتاب والسنة في ضوء نصوصهما ومقاصدهما الشرعية.
فترى فينا :
_ من يتسرع إلى القول بالتحريم
_ ومن يميل إلى التشديد في فهم الأحكام
_ من يتجه إلى القول الواحد دائما في المسائل، وإبطال ما عداه.
_ ومن ينظر إلى المستحبات النظر إلى الواجبات.
_ ومن يتوهم أن السنة في كل الأمور ليست إلا شيئا واحدا. فيحجر المرء بهذا واسعا. في حين أن السنة في مسألة ما قد تكون على وجهين. وليست وجها واحدا، أو يكون الأصل في بعض الأمور أن السنة فيه الإطلاق، وليس التقييد والتحديد.
সংক্ষিপ্ত তরজমা
কিতাব-সুন্নাহর অনুসরণের অর্থ বোঝার ক্ষেত্রে আমাদের একটি ভুল
এ যুগের একটি ভুল, যা কিতাব ও সুন্নাহর দিকে দাওয়াত দিতে গিয়ে আমরা করে থাকি তা হচ্ছে ইত্তিবার নামে স্থবিরতা। কিতাব ও সুন্নাহ যে অবশ্যঅনুসরণীয় এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এর জন্য তো জ্ঞান ও প্রজ্ঞা লাগবে এবং কিতাব ও সুন্নাহ সঠিকভাবে বুঝতে হবে। আজ আমাদের ভুল এখানেই যে, আমরা ইত্তিবা ও অনুসরণের নামে জুমুদ ও স্থবিরতার আশ্রয় নিয়েছি। সঠিকভাবে বোঝা ছাড়াই নিজের বুঝের দিকে দাওয়াত দিচ্ছি।
- কারো কারো প্রবণতা এই যে, কোনো কিছুকে হারাম বলার আগে পর্যাপ্ত চিন্তা-ভাবনা করে না।
- কেউ শরীয়তের বিধান বোঝার ক্ষেত্রে কাঠিন্য ও কড়াকড়ির দিককে প্রাধান্য দিয়ে থাকে।
- কেউ ইখতিলাফী মাসায়েলের ক্ষেত্রে সর্বদা একটি মতই স্বীকার করে এবং অন্যসব মত প্রত্যাখ্যান করে।
- কেউ মুস্তাহাব বিষয়ের সাথে ওয়াজিবের মতো আচরণ করে
- কেউ মনে করে, সকল বিষয়ে সুন্নাহ ও পদ্ধতি কেবল একটিই হয়। এভাবে একটি প্রশস্ত ক্ষেত্রকে তারা সংকীর্ণ বানিয়ে ফেলে। অথচ কোনো কোনো বিষয়ে সুন্নাহর দুটি পন্থা থাকে (অর্থাৎ উভয় পন্থা সুন্নাহসম্মত হয়)। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শুধু মূল বিষয়টি সুন্নাহ হয়ে থাকে, বিশেষ কেনো পন্থা নয়। (পৃ. ৫০-৫১)
তিনি আরো বলেছেন-
الإشارة إلى مسلك خاطئ في فهمنا لمسائل الخلاف الفرعية وطريقة دعوتنا إلى الراجح فيها
لقد ابتليت الأمة الإسلامية في هذا العصر بظهور شيء من الروح الجدلية لدى كثير من المسلمين الصالحين مع نزعة إلى الشدة والغِلظة والفظاظة في طريقة الدعوة وفي الحوار الموقف حتى في المسائل الفقهية الخلافية.
وقد ترتب على هذه الطريقة كثير من المفاسد التي لا يقرها الإسلام، ومن ذلك :
_ تفرق الصف الإسلامي على مسائل فرعية، ففي سبيل الحماس لها والأخذ بالصواب فيها نسِيَتْ بعض الأصول في كثير من الأحيان في سبيل التمسك بالصواب في المسائل الخلافية في تلك الفروع!
_ وترتب على ذلك ظهور التعصبات والتحيّزات التي يرافقها الجهل والظلم، بدعوى الحرص على الحق والصواب في تلك الأمور الخلافية من المسائل الفرعية والأساليب والوسائل!!.
_وترتب على ذلك تجرؤ كثير من صغار الطلاب على الاجتهاد والفتيا وآداب العلم و"المشيخة" أو "الزعامة" العلمية أو الدعوية من قِبَل هؤلاء الصغار، الذين لم يأتوا بجديد سوى الخلاف والفُرْقة والابتعاد عن الجادة، وكان يسعهم الحرص على الخير في منهج وسط يبعدهم عن كل هذه الأنواع من الشر!.
_ لقد نَتَجَ عن هذه المسالك الخاطئة في الدعوة وفي طلب العلم والتفقه في الدين والتعامل مع المخالفين تضخيم بعض الأحكام الفرعية والغلوّ في السنن والمستحبات، وذلك أمر لا يقره الدين، لأن السنن والمستحبات هي من الدين وينبغي أن تؤخذ على أنها كذلك، ولا يجوز أن يتجاوز بها قدرها، كما أنه لا يجوز أن تنقص عن قدرها الذي وضعها الله فيه، والدين بين الغالي والجافي والمُفْرِط والمفرّط، ونتج عن هذا الخلل _ كما قلت _ الوقوع فيما نهى الله تعالى عنه من التفرق في الدين والتفرق في الصف، وآيات الله تعالى أعظم شاهد في نهي الله تعالى أشد النهي عن الأمرين كليهما، وكذا سيرة الرسول صلى الله عليه وسلم وسيرة فقهاء هذه الأمة : أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم ومن تبعهم بإحسان من أئمة السلف، فمن تأمل ذلك كله أدرك الحق في هذه المسألة.
وإن المصلِحَ الحق هو ذلك الذي يسعى في الإصلاح من غير أن يرافق إصلاحه إفساد، أو من غير أن يتلبس إصلاحه بإفساد يعْلَمُهُ أو لا يَعْلَمُهُ!.
তার আলোচনার মূল আরবী পাঠ উল্লেখ করা হয়েছে। শাখাগত বিষয়ে নিজের কাছে অগ্রগণ্য মতের দিকে আহবান করার উপর তিনি কঠিন ভাষায় প্রতিবাদ করেছেন।
তিনি বলেন, এর দ্বারা মুসলিম উম্মাহর মাঝে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে। এ সকল বিষয়ের পিছনে পড়ে উম্মাহর ঐক্য ও সংহতির বিষয়টি ভুলে যাওয়া হয়েছে; বরং শাখাগত মাসাইলের পিছনে পড়ে কিছু মৌলিক বিষয়ও চিন্তা থেকে অন্তর্হিত হয়েছে।
- এসব বিষয়ে বাহাস-বিতর্কের পন্থা অনুসরণ করে সময়ের অপচয় করা হয়েছে। ঈমানী মহববত খতম করা হয়েছে। শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়েছে, যা কোনো মুসলিম তার মুসলিম ভাইয়ের প্রতি পোষণ করতে পারে না।
- (যে মতপার্থক্য শরীয়তসম্মত ছিল তাতে মতপার্থক্যের নীতি ও বিধান ত্যাগ করে ভুল পন্থা অনুসরণ করার ফলে) মানুষের মাঝে অন্যায় পক্ষপাত ও দলীয় চেতনা সৃষ্টি হয়েছে, যার অনিবার্য ফল হচ্ছে, মূর্খতা ও অবিচার।
- এই কর্মপদ্ধতির কারণে ছোট ছোট তালিবুল ইলমও নিদ্বির্ধায় ইজতিহাদ ও ফতোয়ার ময়দানে প্রবেশ করেছে, যা বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতা ছাড়া নতুন কোনো সুফল দিতে সক্ষম হয়নি।
- এই ভুল কর্মপন্থার কারণে শাখাগত বিষয়গুলোকে বড় বানিয়ে পেশ করা, সুন্নত-মুস্তাহাবের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করা এবং এমনসব বিষয় পয়দা হচ্ছে, যা ইসলামে বৈধ নয়। সুন্নত-মুস্তাহাবকে না তার অবস্থান থেকে উপরে তোলা যাবে, না নীচে নামানো যাবে। দ্বীনের মাঝে কোনো প্রকারের প্রান্তিকতাই বৈধ নয়।
কর্মপন্থার ভুলে দ্বীনের বিষয়ে বিভেদ ও উম্মাহর মাঝে বিবাদ সৃষ্টি হয়েছে, যা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আল্লাহ তাআলার আয়াতসমূহই সাক্ষ্য দেয়, কত কঠিনভাবে তিনি তা নিষেধ করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সীরাত, সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীনের সীরাতও এ বিষয়ে সাক্ষী।
সত্যিকারের সংস্কারক তো তিনিই, যার সংস্কার-কর্মে ধ্বংসের উপাদান থাকে না।-পৃ. ৪৮-৪৯
আমার ধারণা, একাধিক সুন্নাহ বিষয়ে যে মতপার্থক্য সে সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনার জন্য এটুকু আলোচনাই যথেষ্ট ইনশাআল্লাহ।
ইজতিহাদী মাসাইল বা ফূরুয়ী মাসাইলে মতভিন্নতার ক্ষেত্রে সঠিক কর্মপন্থা
ইজতিহাদী মাসাইল কাকে বলে তা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি। এর অপর নাম আলফূরু’ বা ফুরূয়ী মাসাইল। এসকল মাসআলায় দলিলের ধরনই এমন যে, আলিম ও গবেষকদের মাঝে মতপার্থক্য হতে পারে এবং হয়েছে। তাই এই মতপার্থক্য বিলুপ্ত করার চেষ্টা কোনো সমাধান নয়; এতে মতভেদ আরো বাড়বে। এখানে করণীয় হচ্ছে, ইখতিলাফের নীতি ও বিধান কার্যকর করে ইখতিলাফকে তার সীমায় আবদ্ধ রাখা; একে কলহ-বিবাদের কারণ হতে না দেওয়া।
আজ মুসলিম উম্মাহর ট্রাজেডি এই যে, শাখাগত বা অপ্রধান বিষয়কে কেন্দ্র করে তারা কলহ-বিবাদে লিপ্ত হচ্ছে এবং নিজেদের শক্তি খর্ব করছে। যেন কুরআন মজীদের নিষেধ-
ولا تنازعوا فتفشلوا
এর বাস্তব দৃষ্টান্ত। বিষয়টা আরব-আজমের সংবেদনশীল উলামা-মাশাইখকে অস্থির করে রেখেছে। তাঁরা এ বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন এবং দিয়ে যাচ্ছেন।
গত শতাব্দীতে আরবের কিছু ব্যক্তি তাকলীদের বিরুদ্ধে এত বলেছেন এবং ফূরূয়ী মাসাইলের ক্ষেত্রে এত কড়াকড়ি করেছেন যে, যুবশ্রেণীর মাঝে দ্বীনের বিষয়ে স্বেচ্ছাচার ও লাগামহীনতার
বিস্তার ঘটেছে, যা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সেখানের বড়দেরকে রীতিমতো পরিশ্রম করতে হয়েছে। তো এখানেও ঐ তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়ার অপেক্ষায় না থেকে আগেভাগেই আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত।
আমি প্রথমে সালাফে সালেহীনের কিছু ঘটনা ও নির্দেশনা উল্লেখ করছি। এরপর ইনশাআল্লাহ বর্তমান যুগের আরব-আজমের কয়েকজন মুরববী আলিমের নির্দেশনা তুলে ধরব।
১. ইমাম দারিমী রাহ. (১৮১-২৫৫ হি.) তাঁর কিতাবুস সুনানে বর্ণনা করেছেন যে, (তাবেয়ী) হুমাইদ আততবীল (আমীরুল মুমিনীন) উমার ইবনে আবদুল আযীয রাহ.কে বললেন, ‘আপনি যদি সকল মানুষকে এক বিষয়ে (এক মাযহাবে) একত্র করতেন তাহলে ভালো হত।’ তিনি বললেন, ‘তাদের মাঝে মতপার্থক্য না হলে আমি খুশি হতাম না।’ এরপর তিনি ইসলামী শহরের গভর্ণরদের উদ্দেশে ফরমান পাঠালেন-
ليقض كل قوم بما اجتمع عليه فقهاءهم
প্রত্যেক কওম যেন ঐ সিদ্ধান্ত মোতাবেক ফায়সালা করে, যে বিষয়ে তাদের ফকীহগণ (আলিমগণ) একমত।-সুনানুদ দারিমী, পৃষ্ঠা : ১৩৪
২. ইমাম ইবনে আবী হাতেম ইমাম মালেক থেকে বর্ণনা করেন যে, খলীফা আবু জাফর মানসুর আগ্রহ প্রকাশ করলেন যে, আমি চাই গোটা মুসলিম সাম্রাজ্যে এক ইলমের (অর্থাৎ মুয়াত্তা মালিকের) অনুসরণ হোক। আমি সকল এলাকার কাযী ও সেনাপ্রধানের নিকট এ ব্যাপারে ফরমান জারি করতে চাই।
ইমাম মালেক রাহ. বললেন, ‘জনাব! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ উম্মতের মাঝে ছিলেন। তিনি বিভিন্ন জনপদে সেনাদল প্রেরণ করেছেন, কিন্তু ইসলামের দিগ্বিজয়ের আগেই তাঁর ওফাত হয়ে গেছে। এরপর আবু বকর খলীফা হয়েছেন। তাঁর আমলেও বেশি কিছু রাজ্য বিস্তার হয়নি। এরপর উমর খলীফা হয়েছেন। তাঁর সময়ে প্রচুর শহর ও জনপদ বিজিত হয়েছে। তিনি সেসব বিজিত এলাকায় শিক্ষা-দীক্ষার জন্য সাহাবীগণকে প্রেরণ করেছেন। সেই সময় থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত (প্রত্যেক জনপদে সাহাবীগণের শিক্ষাই) এক প্রজন্ম থেকে অপর প্রজন্ম পর্যন্ত পৌঁছেছে।
‘অতএব আপনি যদি তাদেরকে তাদের পরিচিত অবস্থান থেকে অপরিচিত কোনো অবস্থানে ফেরাতে চান তবে তারা একে কুফরী মনে করবে। সুতরাং প্রত্যেক জনপদকে তাদের অবস্থার উপর ছেড়ে দিন এবং নিজের জন্য এই ইলমকে (মুয়াত্তা মালেক) গ্রহণ করুন।’
আবু জাফর তাঁর কথা মেনে নিলেন।’-তাকদিমাতুল জারহি ওয়াত তাদীল ২৯
ইবনে সা’দের বর্ণনায় ইমাম মালেকের বক্তব্যে উল্লেখ আছে যে-
يا أمير المؤمنين! لا تفعل هذا، فإن الناس قد سبقت إليهم أقاويل، وسمعوا أحاديث، ورووا روايات، وأخذ كل قوم بما سبق إليهم وعملوا.
ইয়া আমীরাল মুমিনীন! এমনটি করবেন না। কেননা, লোকেরা (সাহাবীগণের) বক্তব্য শুনেছে, হাদীস শুনেছে, রেওয়ায়েত বর্ণনা