জুমাদাল উলা-১৪৩২   ||   এপ্রিল-২০১১

আড়াই মিনিট

মাওলানা হাবীবুর রহমান খান

শাকোশামা ছিল মিয়াগি শহরের সর্বোচ্চ ধনীদের একজন। তার একটি ছোট ফাইভ স্টার শিপ ছিল। যে শিপে ছিল ছয়টি কিংসাইজ বেডরুম, দুটি সুইমিং পুল, একটি টেনিস কোর্ট, একটি ড্যান্সিংফ্লোর, দুটি বড় সাইজের বার, একটি জিম এবং ছোট একটি লন। বারো সিটের একটি জেট বিমানও তার ছিল। সে এই বিমান নিয়ে প্রায়ই টোকিও, ওসাকা চলে যেত। কখনো কখনো চীন বা থাইল্যান্ডও যেত। তার আরো ছিল লিমোজিন, ফেরারীসহ নামিদামি ব্রান্ডের ডজনখানেক গাড়ি। কিন্তু তার সকল সম্পত্তির মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান ছিল তার বাড়িটি। জাপানের স্যান্ডাই সমুদ্র উপকূলে বিস্তৃত জায়গাজুড়ে সে এ বাড়ি নির্মাণ করেছিল। এটি আসলে ছিল বাগান ও লন পরিবেষ্টিত একটি শ্বেতপ্রাসাদ। এ বাড়ির প্রতিটি জানালা দিয়েই দেখা যেত সাগরের নীল জলরাশি। আর বৃষ্টির সময় প্রতিটি কক্ষ থেকেই শোনা যেত বৃষ্টির সূর-মূর্ছনা।  

জাপান ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ। প্রায় প্রতিদিনই এখানে কয়েকবার স্বল্পমাত্রার ভূমিকম্প হয়ে থাকে। এজন্য জাপানের অধিবাসীরা ভূমিকম্পে অভ্যস্ত। এদেশের লোকেরা কম্পমান ছাদের নিচে, দোদুল্যমান মেঝেতে বসেও কাজকর্ম করতে থাকে। কিন্তু ভূমিকম্প তো ভূমিকম্পই। এ বিপদ যখন যেখানে দেখা দেয় সেখানের বাসিন্দাদের হৃদকম্প শুরু হয়ে যায়। এজন্য জাপানের ধনাঢ্য ব্যক্তিরা ভূমিকম্পপ্রুফ বিল্ডিং নির্মাণ করে। জাপানের স্থপতি ও প্রকৌশলীরা এক্ষেত্রে অনেক অগ্রসর। তারা পঞ্চাশ তলাবিশিষ্ট ভবনের ভিত্তিমূলেও সকপ্রুফ প্রযুক্তি ব্যবহার করে থাকে। ফলে ভূমিকম্পের সময় এ সকল ভবন পাঁচ ছয় মিটার পর্যন্ত ডান বামে কাঁত হয়ে পড়লেও ভাঙ্গে না, এমনকি ফাটলও ধরে না। জাপানে এমন প্রযুক্তিও আছে, যার মাধ্যমে আপনি আপনার বহুতল ভবনটি ভিত্তিমূলসহ উত্তোলন করে অন্য জায়গায় এমনকি অন্য কোনো শহরে নিয়েও প্রতিস্থাপন করতে পারবেন। আপনি আগ্রহ প্রকাশ করলে ঠিকাদার কোম্পানি তাদের দৈত্যাকৃতির ক্রেন নিয়ে আসবে, যা আপনার বহুতল ভবনকে মাটি থেকে তুলে নিবে এবং বিশাল ট্রলিতে করে আপনার নির্দেশিত নতুন জায়গায় এনে এমনভাবে বসিয়ে দিবে যে, আপনার ডাইনিং টেবিলে রাখা চায়ের কাপটি পর্যন্ত স্থানচ্যুত হবে না। অন্তত জাপানী প্রকৌশলীগণ এমনটাই দাবি করে থাকেন। জাপানে এখন নির্মাণ শিল্পে এত উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে যে, রিখটার স্কেলে নয়মাত্রার ভূমিকম্প হলেও আপনি টের পাবেন না। জাপানের ধনিক শ্রেণী ভবন নির্মাণে সর্বদাই এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে থাকেন।

শাকোশামাও স্যান্ডাই সাগর তীরে এ ধরনের সুরম্য ও সুরক্ষিত প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন। তার ধারণা ছিল ভূমিকম্পে যদি গোটা স্যান্ডাইও ধ্বংস হয়ে যায় তাহলেও তার প্রাসাদের কিছুই হবে না। কিন্তু ১১ মার্চের সেই ভয়াবহ ভূমিকম্পে তার সকল স্বপ্ন-সাধ ধুলিস্মাত হয়ে গেল।

এটা ছিল জুমআর দিন। শাকোশামা তার বেডরুমে বসে কাজ করছিল। খোলা জানালার ওপারে ছিল সমুদ্রের অবারিত নীল। আর বাগানের ওপর দিয়ে বসে আসছিল সাগরের ঝিরঝির বাতাস। এই মনমুগ্ধকর সুন্দর পরিবেশে শাকাশোমা ল্যাপটপ নিয়ে কাজে ডুবে ছিল।

দুটা চৌদ্দ মিনিটে বাড়িটি হঠাৎ দোল খেতে লাগল। তার মনে হল সে যেন দোলনায় বসে আছে। এ কম্পন কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী হল। ঘরের জানালা দিয়ে তাকিয়ে শাকোশামা দেখল পাশের রাস্তায় লোকজন ছুটাছুটি করছে। তার বিলাসবহুল জাহাজটি বাড়ির সামনে নোঙ্গর করা ছিল। সর্বাধুনিক গাড়িগুলো ড্রাইভওয়েতে প্রস্ত্তত ছিল। তার স্ত্রী ও সন্তানরা নিজ নিজ কক্ষে বিশ্রাম করছিল। সে চেয়ার থেকে উঠে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরের দৃশ্য দেখার চেষ্টা করল। ঠিক ঐ সময় ভূমিকম্প দ্বিতীয়বার আঘাত হানে এবং সে জানালা থেকে দূরে নিক্ষিপ্ত হয়। বাড়িটি মারাত্মকভাবে কাঁপতে থাকে। দূরে সমুদ্রে দেখা দেয় একটি পর্বতপ্রমাণ ঢেউ, যা বিদ্যুতবেগে তীরের দিকে ছুটে আসতে থাকল। বাড়িটি ডান বামে দুলছে আর দৈত্যাকৃতির ঢেউটির দূরত্ব দ্রুত কমে আসছে। এতক্ষণে শাকাশোমার মনে হল সে তার বাড়িতে বন্দী। এই প্রথম তার মন বলল, সে ও তার পরিবার কেউ এ বাড়িতে নিরাপদ নয়। কিন্তু বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগেই ঢেউটি প্রচন্ড বেগে তীরে আছরে পড়ল। তার স্বপ্নের জাহাজখানা কাগজের নৌকার মতো হাওয়ায় উড়তে লাগল। গাড়িগুলো হাওয়ায় উড়ে বাড়ির প্রাচীরের সাথে ধাক্কা খেয়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। রাস্তায় ছুটতে থাকা মানুষগুলো ঝড়ের আঘাতে দুই তিনশত ফুট ওপরে উঠে বিভিন্ন ভবনের সাথে টক্কর খেতে লাগল এবং বড় বড় গাছের ডালে লটকে থাকল। পরমুহূর্তেই পর্বতপ্রমাণ ঢেউ তার বাড়ির উপর আছড়ে পড়ল এবং ভয়ঙ্কর একটি বিস্ফোরণের মতো বাড়িটি ধ্বংসস্ত্তপে পরিণত হল। সে নিজেকে আবিষ্কার করল খোলা আকাশের নিচে পানির প্রবল স্রোতে। সে স্রোতের সাথে সাথে ভেসে চলছিল। তার শরীরে ধাতব পদার্থের টুকরো, গাছ, মাছ, কচ্ছপ, কাকড়ার ধাক্কা লাগছিল। অনিবার্য মৃত্যু থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য হাত পা সঞ্চালিত করছিল। এ অবস্থায় সে একটি গাছ পেয়ে গেল এবং সর্বশক্তি দিয়ে গাছটি আকড়ে ধরল। ঢেউয়ের আঘাত, পানির স্রোত তাকে ছিনিয়ে নিতে চাইছিল, কিন্তু সে সর্বশক্তিতে গাছটিকে আকড়ে থাকল। এ সময় সে দুই পাশ দিয়ে ভেসে যেতে দেখল শত শত মানুষ, হাজার হাজার গাড়ি, ঘরের ফার্নিচার ও আসবাবপত্র।

উপরোক্ত ঘটনাটি হল জাপানে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক কালের ভয়াবহ সুনামির একটি খন্ডচিত্র। যা শুক্রবার ১১ মার্চ দুপুর সোয়া দু টায় আঘাত হানা ৮.৯ মাত্রার ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্টি হয়েছিল এবং মাত্র আড়াই মিনিটে পৃথিবীর একটি উন্নত রাষ্ট্রকে তছনছ করে দিয়েছে। নিহত হয়েছে জাপানের ষোল হাজার মানুষ এবং নিখোঁজ রয়েছে এর কয়েক গুণ। আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি দুই হাজার বিলিয়নেরও অধিক। জাপানের এই ভয়াবহ ঘটনা প্রমাণ করে যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে আত্মরক্ষার হাজারো উপায় উদ্ভাবন করলেও আল্লাহর কুদরতের সামনে মানুষ নিতান্তই অসহায়। কুদরত যখন শাস্তি দেওয়ার ইচ্ছে করে তখন উন্নত থেকে উন্নততর প্রযুক্তিও ব্যর্থ হয়ে যায়।

হায়! আমরা যদি বুলেটপ্রুফ গাড়ি, সুরক্ষিত বাড়ি ও প্রশিক্ষিত বডিগার্ড নিয়োগ করার আগে ও পরে এই সত্যকে স্মরণ করতাম। হায়! আমরা যদি কুদরতের শাস্তি ও প্রতিশোধ থেকে বাঁচার সত্যিকার উপায় অবলম্বন করতাম। প্রযুক্তির স্বর্গরাজ্য জাপানের যদি হয় এই অবস্থা তাহলে আমরা কীভাবে প্রযুক্তির বড়াই করি? কুদরত তো আড়াই মিনিটেই সকল দর্প চূর্ণ করে দিতে পারে।

মানুষ যদি কুদরতের হাত থেকে বাঁচতে পারত তাহলে পৃথিবীর কোনো সম্রাট ও রাজাবাদশাহদের মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হত না। আর আমরাও ইউরোপ আমেরিকার নব্য ফেরাউন ও নমরূদের পরিবর্তে মিসরের সেই পুরাতন ফেরাউন নমরুদের গোলামিই করতাম। আমরা আত্মরক্ষার জন্য নতুন পুরাতন সকল প্রযুক্তির সমাবেশ ঘটাতে পারি, কিন্তু কুদরতের আড়াই মিনিট থেকে বাঁচার ক্ষমতা আমাদের নেই।

(পাকিস্তানের বিখ্যাত কলামিস্ট জনাব জাভেদ চৌধুরীর কলাম জিরো পয়েন্ট থেকে অনুদিত)

বিপদে পড়লে কেউ কেউ আল্লাহকে স্মরণ করি ঠিকই কিন্তু পরক্ষণেই আল্লাহকে ভুলে যাই এবং এমন ঔদ্ধত আচরণ করি যে, মনেই হয় না আমরা এক অসহায় জাতি। এই দু মুখো চরিত্রের চিত্রায়নই আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদে এভাবে করেছেন, (তরজমা) তারা যখন নৌকায় চড়ে, তখন আল্লাহকে এভাবে ডাকে যে, তাদের সম্পূর্ণ বিশ্বাস একনিষ্ঠভাবে তাঁরই উপর থাকে। তারপর তাদেরকে উদ্ধার করে যখন স্থলে নিয়ে আসেন অমনি তারা শিরকে লিপ্ত হয়ে পড়ে। -সূরা আনকাবুত : ৬৫

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় শাইখুল ইসলাম হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুম লিখেছেন যে, আরব মুশরিকদের রীতি ছিল বড় আজব। যখন তারা সাগরে তরঙ্গ বেষ্টিত হয়ে পড়ত এবং সাক্ষাত মৃত্যুর সম্মুখীন হত তখন তাদের কোনোও মূর্তির কথা স্মরণ হত না, দেব-দেবীর কথাও না, তখন সাহায্যের জন্য কেবল আল্লাহ তাআলাকেই ডাকত। কিন্তু আল্লাহ তাআলার রহমতে যখন প্রাণ নিয়ে তীরে পৌঁছতে সক্ষম হত তখন তাঁকে ছেড়ে আবার সেই প্রতিমাদের পূজায়ই লিপ্ত হত। (আসান তরজমায়ে কুরআন (তাওযীহুল কুরআন) ২/৫৮০)

এ আধুনিক যুগের মানুষ আর আরব মুশরিকদের মাঝে কি তেমন কোনো পার্থক্য আছে? ওরা লিপ্ত ছিল হাতে গড়া মূর্তির পূজায় আর এরা লিপ্ত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পূজায়। সুতরাং ঘোর বিপদে কেউ কেউ আল্লাহকে স্মরণ করলেও পরক্ষণেই তাঁকে ভুলে যাই, বিপদ আপদের বাহ্যিক কার্য-কারণ নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হয়ে নিজেদেরকে আরো বড় বিপদের দিকে ঠেলে দেই।

কুরআন ও হাদীসে প্রায় সকল বিপদেরই মূল কারণ বলা হয়েছে মানুষের পাপাচার। যেমন আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, (তরজমা) স্থলে ও জলে (তথা সারা বিশ্বে) মানুষের কুকর্মের কারণে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। যাতে আল্লাহ তাআলা তাদেরকে তাদের কোনো কোনো কর্মের শাস্তি আস্বাদন করান। যাতে তারা (এ সকল কর্ম থেকে) ফিরে আসে।-সূরা রুম : ৪১)

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, বিপর্যয় বলে এখানে দুর্ভিক্ষ, মহামারি, অগ্নিকান্ড, বন্যা, সাইক্লোন, টর্ণেডো, সুনামি, ভূমিকম্প ইত্যাদি বিপদাপদের আধিক্যকে বোঝানো হয়েছে।

এ সকল বিপদাপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় হল, আল্লাহ তাআলার দিকে প্রত্যাবর্তন করা, তাঁর সাথে সম্পর্ক মজবুত করা। অতীত গুনাহ থেকে তাওবা করে ভবিষ্যতে শুধরে চলা। অথচ আমাদের অভ্যাস হল, কোনো বিপদ এলে আমরা তার মাত্রা ও বাহ্যিক কার্য-কারণ নিয়ে আলোচনা ও বিতর্কে লিপ্ত হই ঠিকই, কিন্তু কুরআন-হাদীসের নির্দেশনার উপর আমল করি না। আবার যারা পাপাচারকেই এ সকল বিপদাপদের কারণ মনে করি, তারাও সকল দায়িত্ব অন্যদের উপর চাপিয়ে দিয়ে নিজেকে সম্পূর্ণ নিষ্পাপ মনে করি। অথচ এ সকল ক্ষেত্রে শরীয়তের শিক্ষা হল, সবার আগে নিজের গুনাহকেই বিপর্যয়ের কারণ মনে করে আল্লাহ তাআলার দরবারে কান্নাকাটি করে তাওবা করা। সাথে সাথে সমাজে যে সকল পাপাচার ব্যাপক হয়ে গেছে সেগুলো থেকে নিজ পরিবার, প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন ও পরিচিতজনসহ সকল মানুষকে বিরত রাখার চেষ্টা করা।

বিপদাপদের বাহ্যিক কার্য-কারণ অবশ্যই আছে। তবে ঐ সকল কার্যকারণের সৃষ্টি ও নিয়ন্ত্রণ আল্লাহ তাআলার হাতে। তাই বিপদ ও বিপর্যয় থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র পথ হল তাঁর ক্রোধ থেকে বেঁচে থাকা এবং তার সন্তুষ্টি অন্বেষণ করা। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাঁর সন্তুষ্টির পথে চলার তাওফীক দান করুন। আমীন।

 

 

 

advertisement