রজব ১৪৪৫   ||   জানুয়ারি ২০২৪

ফিলিস্তিন ও উম্মাহ ॥
‘ইতিহাসের সেই সময়টুকু এসেছে, যখন সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়’

হযরত মাওলানা মুফতি তকী উছমানী

[ফিলিস্তিনের চলমান সংকটে বিশ্বের প্রতিটি মুসলিমের হৃদয়ে গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। ইসরাইলী হায়েনাদের পাশবিকতায় মুসলিম অমুসলিম তথা গোটা ইনাসানী দুনিয়াহতবিহ্বল হয়ে পড়েছে। অবিরাম নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশের পরও ইসরাইল ও মিত্রগোষ্ঠীর মাঝে মানবতার ছিটেফোঁটাও জাগ্রত হয়নি। বরং মানবাধিকার ধ্বংসের  বীভৎস ইতিহাস রচিত হচ্ছে গাজা উপত্যকায়।

এমন পরিস্থিতিতে প্রয়োজন কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ। শাসক ও শাসিত, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সকল পরিমণ্ডল থেকেই।

পাশাপাশি আরো বেশি প্রয়োজন, হামাস-ইসরাইল যুদ্ধের ব্যাপারে স্বচ্ছ ও সঠিক ধারণা রাখা। এ ব্যাপারে কোনোরূপ বিভ্রান্তি কিংবা ভুল বোঝাবুঝি ডেকে আনতে পারে ভয়ংকর বিপদ, এমনকি অস্তিত্বের হুমকি; পার্থিব ও পরকালীন উভয় বিবেচনায়।

এ নিয়েই জাতিকে জাগিয়ে তুলেছেন উম্মাহর দরদী রাহবার শাইখুল ইসলাম মুফতী মুহাম্মাদ তাকী উসমানী দা. বা.। গত ৬ ডিসেম্বর ২০২৩ ঈ.-এ ইসলামাবাদের জিন্নাহ কনভেনশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয়ে যায় হুরমতে আকসা কনফারেন্স। রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক  সকল দল ও মতের আলেম ও জাতীয় নেতৃবর্গ সমবেত হন। তাঁরা এই জিহাদে ফিলিস্তিনী মুজাহিদীনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন। হযরতও তাতে ঐতিহাসিক নির্দেশনা প্রদান করেন।

ঈমানী হারারাত, রূহানী কাইফিয়ত এবং জখম দিলের জোশ ও জযবায় উদ্বেলিত হযরতের সেই বক্তব্যটির অনুবাদ করেছেন মাওলানা মুহাম্মাদ আশিক বিল্লাহ তানভীর সম্পাদক]

الحمد لله رب العالمين، والصلاة والسلام على سيدنا ونبينا، وشفيعنا وحبيبنا، ومولانا محمد، خاتم النبيين وإمام المرسلين، وعلى آله وأصحابه أجمعين، وعلى كل من تبعهم بإحسان إلى يوم الدين!

হযরত উলামায়ে কেরাম, জাতীয় নেতৃবৃন্দ ও সম্মানিত সুুধী! আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি তাআলা ওয়াবারাকাতুহ।

আলহামদু লিল্লাহ, আমরা এই মুহূর্তে এমন একটি বিষয়ে আলোচনা করতে ও শুনতে একত্র হয়েছি, আমি এভাবে বললে বাড়িয়ে বলা হবে না যে, বিষয়টি পাকিস্তানের বাইশ কোটি জনতার ইস্যু এবং প্রত্যেকের হৃদয়ের স্পন্দন। আর তা হচ্ছে ফিলিস্তিন ইস্যু। আমার পূর্বে আলহামদু লিল্লাহ অত্যন্ত উদ্দীপনাপূর্ণ বক্তব্য এসেছে। অনেক বিষয়ে মতামত এসেছে। বহু প্রস্তাবনাও এসেছে। আমি সেগুলো পুনর্ব্যক্ত করার পরিবর্তে সংক্ষিপ্তভাবে কয়েকটি বিষয়ের দিকে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাচ্ছি।

প্রথম কথা হচ্ছেআলহামদু লিল্লাহ, সকলে এই বিষয়ে একমত, ইসরাইল নিরীহ গাজাবাসীর ওপর যে লোমহর্ষক নারকীয় ও নির্মম গণহত্যা চালাচ্ছে ন্যূনতম মানবিক মূল্যবোধও তাতে পদপিষ্ট হচ্ছে। এতে এ বিষয়টি পরিস্ফুট হয়েছে, অপবিত্র সেই শত্রুরা অন্তরে মানবতার ছিটেফোঁটাও খুইয়ে বসেছে। সকলেই এর নিন্দা জানিয়েছে। কিন্তু কিছু বিষয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে। সেগুলো দূর করতে আমি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা পেশ করতে চাচ্ছি।

একটি বিষয় হচ্ছেপুরো বিশ্ব থেকে, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠন থেকে, এমনকি মুসলিম দেশগুলোর সংগঠন ওআইসির পক্ষ থেকেও যে প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে, তা হল যুদ্ধ বিরতি প্রস্তাব। যুদ্ধ বিরতি মানে হচ্ছে, ইসরাইলকেও যুদ্ধ থেকে বারণ করা হবে এবং হামাসকেও নিবৃত্ত রাখা হবে। যুদ্ধ বিরতি প্রস্তাবের সাধারণ অর্থ এটাই। কিন্তু বাস্তব কথা হচ্ছে, আমাদের দাবি শুধু এতটুকুগাজা শহরে বোমা বর্ষণ বন্ধ করতে হবে। যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব নয়। হামাসের জানবায মুজাহিদগণ ইসলামের নামে এবং জন্মগত অধিকারসূত্রে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডকে ইসরাইলের কব্জা থেকে স্বাধীন করার সংগ্রাম করে যাচ্ছে। স্বাধীনতাকামী মুজাহিদীনের এ লড়াই কখনো দমে যাওয়ার নয়। এ যুদ্ধ শেষ হবার নয়। এ প্রতিরোধ সংগ্রাম ততদিন অব্যাহত থাকবে এবং থাকতে হবে, যতদিন না পুরো ফিলিস্তিন ভূখণ্ড থেকে ইসরাইলের দখল উৎখাত হয়। কাজেই আমাদের দাবি যুদ্ধ বিরতির নয়। যদি ইসরাইল নিরীহ বেসামরিক গাজাবাসীর ওপর আক্রমণ করার পরিবর্তে সম্মুখ সমরে হামাসকে প্রতিহত করতে চায়, আসুক মোকাবেলা করতে। যুদ্ধ চলমান থাকবে। তাদের ট্যাঙ্কগুলো, সামরিক সাজ সরঞ্জামাদি সবকিছু লণ্ডভণ্ড করা পর্যন্ত হামাস প্রতিহত করে যাবে, ইনশাআল্লাহ।

অতএব যেকোনো সচেতন মুসলিমের মুখে যুদ্ধ বিরতির পরিবর্তে এই নৃশংস বোমা বর্ষণ বন্ধ করার দাবি উচ্চকিত হওয়া চাই। ইসরাইল নিজের পরাজয় ঢাকতে এবং নিজেদের ক্ষয়ক্ষতির বদলা নিতে নিষ্পাপ শিশু, অসহায় নারী এবং নিরীহ জনগণকে হত্যা করে যাচ্ছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হওয়া চাই। এটা যুদ্ধাপরাধ। এই যুদ্ধাপরাধ বন্ধ করার দাবি আমরা জানাচ্ছি। যুদ্ধ বন্ধ করার প্রস্তাব নয়। যুদ্ধ চলমান থাকবে, ইনশাআল্লাহ। বিজয় অর্জন পর্যন্ত এ যুদ্ধ চলতেই থাকবে।

দ্বিতীয়ত যে বিষয়টি আমি উল্লেখ করতে চাচ্ছি তা হচ্ছেপ্রশাসনের দায়িত্বশীলদের পক্ষ থেকে বারংবার, এবং কখনো কখনো ভুল বোঝাবুঝির কারণে শান্তিপ্রিয় ব্যক্তিবর্গের মুখেও শোনা যায়, ‘দ্বিরাষ্ট্র নীতির ভিত্তিতে ফিলিস্তিন সংকটের সমাধান’-এর কথা। অর্থাৎ ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে। একটি ইসরাইল নামক রাষ্ট্র, অপরটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র। এটা সম্পূর্ণ ধূর্ততাপূর্ণ একটি দাবি। আমরা তীব্রভাবে তা প্রত্যাখ্যান করছি। সেই প্রথম দিন থেকেই আমরা ইসরাইল প্রতিষ্ঠার বিরোধী। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা সেই প্রথম দিন থেকেই ইসরাইলের অস্তিত্বকে পশ্চিমা শক্তির অবৈধ সন্তানআখ্যা দিয়েছিলেন। আজও আমরা সেই চেতনায় বলীয়ান রয়েছি। কাজেই ইসরাইল যে অঞ্চলগুলো দখল করে নিয়েছে, সেগুলো তারই থাকুক আর গাজা ও পশ্চীম তীর ফিলিস্তিনীদের থাকুকএমন কোনো সিদ্ধান্ত আমরা কখনোই মেনে নিতে পারি না। অতএব দ্বিরাষ্ট্র নীতির আলোকে যে সমাধান প্রস্তাব পেশ করা হয় তা বন্ধ করা উচিত।

তৃতীয় বিষয়পুরো বিশ্বে এমনকি পশ্চিমা মিডিয়ার অপপ্রচারে প্রভাবিত মুসলিম দায়িত্বশীলদের মাঝেও একটি ভয়াবহ বিভ্রান্তি লক্ষ করা যায়। এটা পশ্চিমা দুনিয়ার মিশনের অংশও বটে, বিশেষ করে আমেরিকার। তাদের নীতি হচ্ছেযখন কোনো জাতি দখলদার থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সংগ্রামে অবতীর্ণ হয় তখন টেররিস্ট ট্যাগ দিয়ে তাদেরকে বিশ্ব দরবারে কলঙ্কিত করা হয়। এ নীতি আমাদের কাশ্মীরী ভাইদের ওপর প্রয়োগ করা হয়েছে। কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামী জনতাকে সন্ত্রাসী আখ্যা দেওয়া হয়েছে এবং এখনো দেওয়া হচ্ছে। আফগানিস্তানের তালেবানদেরকে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত সন্ত্রাসী বলা হয়েছে। অবশেষে নতজানু হয়ে তাদের সাথে টেবিলে বসে সমঝোতা করতে বাধ্য হয়েছে। আলহামদু লিল্লাহ, আল্লাহ তাআলা তাদের বিজয় দান করেছেন।

এই নীতিই প্রয়োগ করা হচ্ছে ফিলিস্তীনে। আলহামদু লিল্লাহ, হামাস একটি রাজনৈতিক শক্তির নাম। তারা কেবল যুদ্ধবাজ কোনো গোষ্ঠী নয়। আফসোস হয়, কোনো কোনো গণমাধ্যমে তাদের মুজাহিদদেরকে যোদ্ধা বা লড়াকু এ ধরনের নাম দেওয়া হয়। বাস্তবিক পক্ষে তারা একেকজন আল্লাহর রাস্তার মুজাহিদ। জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ করছে। মাত্রই জনাব হানিয়া সাহেব বললেন, এদের মাঝে বিপুল সংখ্যক পূর্ণ কুরআনের হাফেয রয়েছেন। এছাড়া আংশিক হাফেযও কম নয়। তিনি এও বলেছেন, এদেরকে বিশেষভাবে দ্বীনী তরবিয়তে দীক্ষিত করা হয়। হামাসের কাজে যুক্ত হওয়ার পূর্বে তাদেরকে বিশেষভাবে দ্বীনী ও ইসলাহী তরবিয়ত করা হয়। প্রকৃতপক্ষে এরা আল্লাহর রাস্তার মুজাহিদ। প্রতিরোধ সংগ্রামে তারা লড়ে যাচ্ছে। যেহেতু তারা আত্মরক্ষার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে, এজন্য তাদেরকে টেররিস্ট আখ্যায়িত করছে। অথচ সন্ত্রাসী হল ইসরাইল। যারা দীর্ঘ পঁচাত্তর বছর অবধি ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে নৃশংস গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে।

সুতরাং একথা বলাহামাস একটি বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠী, এমনটি নয়; বরং তারা গোটা ফিলিস্তিনবাসীর প্রতিনিধিত্ব করছে। কাজেই এই বিভ্রান্তি থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা চাই।

চতুর্থ বিষয়আমার পূর্বেও উলামায়ে কেরাম এবং জাতীয় নেতৃবৃন্দ এ বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তা হচ্ছে, মুসলমানদের ওপর এত নিপীড়ন চলছে! শিশুদের দিকে তাকানোর জো নেই! নারীদের অবস্থা উল্লেখ করার মতো নয়! অথচ আমরা এবং আমাদের শাসকবর্গ এর জন্য কেবল মৌখিক কিছু বিবৃতি এবং সর্বোচ্চ কিছু আর্থিক সহযোগিতাতেই ক্ষান্ত থাকছেন। আল্লাহ তাআলা তাদের আরো তাওফীক দান করুন। আমরা এতটুকু প্রচেষ্টার জন্যও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হল, এই মুহূর্তে যে সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত ছিল, আমাদের শাসকশ্রেণি এখনো সে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেননি।

জনাব ইসমাঈল হানিয়া সাহেবও এদিকে ইঙ্গিত করেছেন। তিনি বলেছেন, আমাদের ভূখণ্ডে এসে আপনাদের লড়তে বলছি না। মাত্রই তিনি স্পষ্টভাবে তা জানিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু গাজার সাধারণ মুসলমান এবং মুজাহিদীনের জন্য আপনারা যতটুকু পারেন সাহায্য পৌঁছান। আমরা অনুরোধ জানাচ্ছি, এতে কসুর করবেন না।

আমি শরীয়তের বিধান আপনাদের সামনে উল্লেখ করতে চাই। শরীয়তের বিধান হচ্ছেকোনো মুসলিম ভূখণ্ডে যদি দুশমন কবজা করে বসে অথবা সেখানকার শাসনভার ছিনিয়ে নেয় তখন ওই ভূখণ্ডের মুসলিমদের ওপর জিহাদ ফরয হয়ে যায়। তারা যদি প্রতিহত করতে সক্ষম না হয় তখন পার্শ্ববর্তী মুসলিমদের ওপর জিহাদ ফরয হয়ে যায়। এভাবে ধীরে ধীরে পরিধি ব্যাপৃত হয়ে বিশে^র সকল মুসলিমের ওপর নিজের সাধ্য অনুযায়ী জিহাদ ফরয হয়ে যায়। ইসলামী শরীয়তের একজন ছাত্র হিসেবে আমি আপনাদের সম্মুখে ঘোষণা করছিসাধ্য অনুযায়ী বিশ্বের সকল মুসলমানের ওপর, চাই সে পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক না কেন, সকলের ওপর এই মর্মে জিহাদ ফরয যে, যে যতটুকু সহযোগিতা নিয়ে গাজাবাসীর জন্য এগিয়ে আসতে সক্ষম, ততটুকু সহযোগিতা সে অবশ্যই পেশ করবে।

আমি এখন আপনাদের সম্মুখে কুরআন কারীমের দুটি আয়াত তিলাওয়াত করছি। আমি মনে করি, আয়াতদুটির বার্তা এই কনফারেন্সের সৌজন্যে গোটা মুসলিম উম্মাহর প্রেরণা হওয়া চাই। সূরা নিসায় আল্লাহ বলেন

وَ مَا لَكُمْ لَا تُقَاتِلُوْنَ فِیْ سَبِیْلِ اللهِ وَ الْمُسْتَضْعَفِیْنَ مِنَ الرِّجَالِ وَ النِّسَآءِ وَ الْوِلْدَانِ الَّذِیْنَ یَقُوْلُوْنَ رَبَّنَاۤ اَخْرِجْنَا مِنْ هٰذِهِ الْقَرْیَةِ الظَّالِمِ اَهْلُهَا وَ اجْعَلْ لَّنَا مِنْ لَّدُنْكَ وَلِیًّا وَّ اجْعَلْ لَّنَا مِنْ لَّدُنْكَ نَصِیْرًا.

কুরআন মুসলমানদের উদ্দেশ্য করে বলছেতোমাদের কী হয়ে গেল! তোমরা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে অবতীর্ণ হও না! সেইসকল অসহায় নারী পুরুষ ও শিশুদের জন্য জিহাদ কর না, যাদেরকে শত্রুরা নিষ্পেষিত করে রেখেছে। তারা দুআ করছেওগো পরওয়ারদেগার, আমাদেরকে এই বসতি থেকে উদ্ধার করুন। তারা আরো দুআ করছে, আয় আল্লাহ আমাদের জন্য কোনো সাহায্যকারী পাঠান। আমাদের কোনো পৃষ্ঠপোষকের ব্যবস্থা করে দিন। [দ্র. সূরা নিসা (৪) : ৭৫]

এইসকল নারী পুরুষ ও শিশুদের দৃশ্য চিত্রায়ণ করে কুরআন গোটা মুসলিম উম্মাহকে লক্ষ করে বলছে, তোমাদের কী হয়ে গেল, তোমরা তাদের উদ্ধার করতে জিহাদে অবতীর্ণ হচ্ছ না!

দ্বিতীয় আয়াতটি শুনুন সূরা তাওবা থেকে

قُلْ اِنْ كَانَ اٰبَآؤُكُمْ وَ اَبْنَآؤُكُمْ وَ اِخْوَانُكُمْ وَ اَزْوَاجُكُمْ وَ عَشِیْرَتُكُمْ وَ اَمْوَالُ اقْتَرَفْتُمُوْهَا وَ تِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَ مَسٰكِنُ تَرْضَوْنَهَاۤ اَحَبَّ اِلَیْكُمْ مِّنَ اللهِ وَ رَسُوْلِهٖ وَ جِهَادٍ فِیْ سَبِیْلِهٖ فَتَرَبَّصُوْا حَتّٰی یَاْتِیَ اللهُ بِاَمْرِهٖ وَ اللهُ لَا یَهْدِی الْقَوْمَ الْفٰسِقِیْنَ.

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে লক্ষ করে আল্লাহ তাআলা বলছেন, আপনি সকলের মাঝে ঘোষণা করে দিনতোমাদের কাছে যদি আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং তাঁর পথে জিহাদ করা অপেক্ষা বেশি প্রিয় হয় তোমাদের পিতা, তোমাদের পুত্র, তোমাদের ভাই, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের খান্দান, তোমাদের সেই সম্পদ, যা তোমরা অর্জন করেছ, তোমাদের সেই ব্যবসা, যার মন্দা পড়ার আশঙ্কা কর এবং বসবাসের সেই ঘর, যা তোমরা ভালবাস, তবে অপেক্ষা কর আমার হুকুম আসার। [দ্র. সূরা তাওবা (৯) : ২৪]

আল্লাহ বলছেন, ‘আমার হুকুমআসার অপেক্ষা কর!!

সর্বশেষ যে কথাটি আমি আপনাদের খেদমতে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে পেশ করতে চাচ্ছিএই কনফারেন্স থেকে মুসলিম শাসকদের সমালোচনা হয়েছে। একটা পর্যায় পর্যন্ত তা যথার্থও বটে। নিঃসন্দেহে সমালোচনা তুলে ধরা আমাদের অধিকার। এটা আমাদের দায়িত্বও বটে, আমরা যা সঠিক মনে করি, সে সম্পর্কে আমাদের শাসকবর্গকেও অভিহিত করব। অতএব এ মুহূর্তে আমরা তাদের সাথে সংঘাতের পরিবেশে নয়; সমঝোতা ও হিতাকাক্সক্ষার ভিত্তিতে বলছি, কারণ আমাদের শরীয়তের শিক্ষা হল, সকলের হিতকামী হও। শাসকবর্গের হিত কামনা করতে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়। আহলে ইলমের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হল, শাসকবর্গকে নসীহত করা। সেই বিবেচনা থেকে বলছি, আমার মন বলছে, আমি আমার সাথে খুব বোঝাপড়া করে এবং আল্লাহর দিকে রুজু করে, আল্লাহর কাছে দুআ করে, আল্লাহ তাবারাকা ওয়াতাআলার কাছে ইস্তেখারা করে বলছিইতিহাসে এমন কিছু মুহূর্ত আসে, তখন যদি সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা না হয়, তাহলে শতাব্দীব্যাপী তার মাশুল গুণতে হয়। কবি যথার্থ বলেছেন

لمحوں نے خطا کی تھی- صدیوں نے سزا پائی

মুহূর্ত করেছে ভুল, শতাব্দী গুণেছে মাশুল।

ইতিহাসে এমন কিছু মুহূর্ত আসে, যখন সাহসিকতা ও অবিচলতার সাথে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। ওই সময় যদি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে শতাব্দীর পর শতাব্দী এর জের টানতে হয়। আমি মনে করি, ইতিহাসের সেই সময়টুকু এখন এসেছে।

এই বাস্তবতা কেউ অস্বীকার করতে পারবে নাগোটা মুসলিম দুনিয়া, মরক্কো থেকে নিয়ে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত, গোটা মুসলিম বিশ্ব এ মুহূর্তে পশ্চিমাদের দাসত্ব বরণ করে নিয়েছে। আমরা যে গোলামীর জীবন যাপন করছি, এটা কে অস্বীকার করতে পারে, বলুন?! অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামরিক এককথায় সার্বিক বিবেচনায় আমরা দাস-জীবন যাপন করছি। এই দাসত্ব আর কতদিন?

অথচ মরক্কো থেকে নিয়ে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত মুসলিম দুনিয়ার অবস্থা হচ্ছেআল্লাহ তাআলা তাদেরকে যে প্রাকৃতিক সম্পদ দান করেছেন অন্য কোনো জাতিকে তা দেননি। পৃথিবীর মধ্যভাগ জুড়ে অবস্থান করছে মুসলিম বিশ্ব। তাদের হাতে এমন প্রাচুর্য রয়েছে, যদ্বারা তারা অন্যদের লাগাম টানতে পারে। তাদের কাছে আছে সুয়েজ খাল। আছে এডেন উপসাগর। বসফরাস ও হরমুজ প্রণালী আছে। এমনকি পৃথিবীর সবচে বেশি তরল সোনা তথা তেল সম্পদ রয়েছে তাদের হাতে। তাদের কাছে প্রাকৃতিক গ্যাস আছে। সহায় সম্পদ সবকিছু আছে। তবুও কেন তারা দাসত্বের জীবন যাপন করছে?

এর কারণ হাদীস শরীফ থেকে জানতে হবে। আর তা হল, মৃত্যুকে ভয় করা, দুনিয়াতে আকৃষ্ট হয়ে পড়া এবং জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ ছেড়ে দেওয়া।

বর্তমানে আমাদের অবস্থা এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু এ মুহূর্তে এসে হামাসের জানবায মুজাহিদগণ আমাদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে পশ্চিমাদের গোলামীর জোয়াল কাঁধ থেকে সরিয়ে স্বাধীনতা ও স্বাধিকারের দীক্ষায় উদ্দীপ্ত হওয়ার। এখন যদি গোটা মুসলিম বিশ্ব এক হয়ে হামাসের সঙ্গ দেয় এবং সমন্বিত প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করে, তাহলে আমি আশ্বস্ত করে বলতে পারি, ব্রিটিশ আমেরিকাসহ গোটা পশ্চিমা দুনিয়া একজোট হয়েও কিছু করতে পারবে না। কেন? প্রভুত্ব আমেরিকার হাতে নেই। আমেরিকা খোদা হয়ে যায়নি। প্রভুত্ব একমাত্র আল্লাহর। ওরা সুপার পাওয়ার নয়; সুপ্রীম পাওয়ার একমাত্র আল্লাহর।

অতএব আমরা যদি একটি বারের জন্য এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে নিইপেটে পাথর বাঁধতে হলে বাঁধব। সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকব। আমরা গুলির সামনে প্রয়োজনে বুক পেতে দেব। বোম্বিংয়ের শিকার হব। তখন আমেরিকা এবং পৃথিবীর কোনো শক্তি আমাদের পরাস্ত করতে পারবে না।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এই হাকীকত বোঝার তাওফীক দান করুন। এই হাকীকত উপলব্ধি করে গোলামীর ইতি টানবার তাওফীক দান করুন।

وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين.

 

 

advertisement