রজব ১৪৪৫   ||   জানুয়ারি ২০২৪

আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের সোহবত মানুষকে আল্লাহর প্রিয় করে তোলে

মাওলানা আবু বকর কাসেমী

يٰۤاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللٰهَ وَ كُوْنُوْا مَعَ الصّٰدِقِيْنَ..

হে মুমিনগণ! তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাকো। সূরা তাওবা (০৯) : ১১৯

আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের সোহবত ও সাহচর্য প্রসঙ্গে আমরা প্রায়ই এই আয়াত তিলাওয়াত করি এবং আলোচনায় শুনে থাকি।

আয়াতে আল্লাহ তাআলা সত্যবাদী তথা আল্লাহওয়ালাদের সঙ্গে থাকার আদেশ করেছেন। আর এটি তাকওয়া লাভ করার সহজতম উপায়। তাছাড়া যেকোনো বিষয়ে কারো কাছ থেকে কোনো কিছু শেখার এবং গ্রহণ করার এটি একরকম স্বীকৃত এবং পরীক্ষিত পদ্ধতি।

তুমি কারো কাছ থেকে কিছু হাসিল করবে তো তার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে থাকো এবং তার খাদেম হয়ে যাও। তবেই তার কাছ থেকে কিছু নিতে পারবে। দ্বীনী ও ইসলামী শিক্ষার ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব অপরিসীম। মহান আল্লাহ মানুষের হেদায়েতের জন্য কিতাব ও রিজাল (আল্লাহর নির্বাচিত ও প্রিয় বান্দাদের) পাঠিয়েছেন। এরই মাধ্যমে যুগে যুগে মুমিনগণ আল্লাহর প্রিয় ও ঘনিষ্ঠ হয়েছেন।

আমাদের প্রিয় প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান রাহ.-এর সাথে এই অধমের সম্পর্ক ছিল বলে হযরতের নিকট ও পরিচিতজনেরা জানতেন। কিন্তু কোনো ধরনের অতিশয়োক্তি ছাড়া যদি সত্য বলি, তাহলে বলব, আমার দ্বারা হযরতের সোহবতের ক্ষেত্রে চরম গাফলতি ও অবহেলা হয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আর হযরতকে চেনার ও বোঝার মতো যোগ্যতাই বা আমার কতটুকু? তবে হযরতকে দেখা ও তাঁর থেকে শোনা আমার কিছু অনুভূতি বর্ণনা করব, আশা করি তা শিক্ষণীয় ও উপকারী হবে।

আমাদের হযরত ছিলেন একজন আল্লাহওয়ালা। তিনি ছিলেন অনন্য আখলাকের অধিকারী। উন্নত চরিত্রের সব শাখাতেই তিনি ছিলেন বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। তাঁর চারিত্রিক মাধুর্য সকলকে আন্দোলিত করত। কখনো তাঁর আচরণ আমাদের কল্পনাকেও হার মানাত। সুন্নতের অনুসরণ-অনুকরণে তাঁর মাঝে সাহাবায়ে কেরামের চরিত্রের বাস্তব প্রতিফলন ঘটত। তাঁর সান্নিধ্যে আমরা মিষ্টতা ও শান্তি অনুভব করতাম। মাঝে মাঝে আমরা চমকে যেতাম। আজকের এ লেখায় হযরতের অনেক বিষয় থেকে তিনটি বিষয়ে আমি কিঞ্চিত আলোচনা করব। কোনো বান্দা যদি উপকৃত হন, সেটা আমার জন্য বড়ই সৌভাগ্যের বিষয় হবে।

এক. উলামায়ে কেরামের সম্মান ও মর্যাদা।

দুই. দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা ও বিশুদ্ধতা।

তিন. নিজেকে আড়াল করে রাখা।

আলেমগণের সম্মান ও মর্যাদা

বড় মাপের বা সাধারণ যেকোনো আলেমের সাথেই হযরত মর্যাদা ও শ্রদ্ধার আচরণ করতেন। আলেম মাত্রই তাঁর কাছে ছিল পরম সম্মানের পাত্র। তিনি বলতেন, আমি উলামায়ে কেরামের গোলাম, আমি তাদের জুতা।

যখন তিনি বয়ান করতেন, সাধারণত তাঁর শ্রোতাদের বেশির ভাগই থাকত জেনারেল শিক্ষিত, তাই তাদের সামনে উলামায়ে কেরামের মর্যাদা তুলে ধরতেন।

লোকেরা তো বড় মাপের ও বিখ্যাত আলেমদেরকে শ্রদ্ধা করে ও  সম্মানের পাত্র মনে করে। কিন্তু হিফযখানা-মক্তবের শিক্ষকের মর্যাদা বোঝাতে তিনি হযরত থানভী রাহ.-এর একটি উক্তি শোনাতেন- যারা মাদরাসা-মক্তবে আলিফ-বা-তা-ছা পড়ায়, তাদেরকে নিরেট নিষ্কর্মা ও বেকার আখ্যা দেওয়া হয়। তবে যারা ওয়াজ-নসীহত করে বেড়ায় তাদেরকে কিছুটা কাজের লোক মনে করা হয়। বড়ই পরিতাপের বিষয়, যে কাজটি সর্বাধিক জরুরি, তাকেই অনর্থক মনে করা হয়।

তিনি বলেন, আমি বলি, এরাই দ্বীন নামক ঘড়ির হেয়ার স্প্রিং। এদের ওসীলাতেই ইসলাম টিকে আছে।

হযরত থানভী রাহ.-এর এ বাণী আমাদের হযরত প্রায়ই উদ্ধৃত করতেন।

আলেমদের যেন মর্যাদাহানী না হয়এব্যাপারে হযরতের তীক্ষè নজর থাকত। এ ব্যাপারে হযরতের সাথে আমার কয়েকটি ঘটনা বলছি।

প্রথম ঘটনা : ২০০৩ অথবা ২০০৪ সালের দিকে পুরান ঢাকার সদরঘাট এলাকার ভিক্টোরিয়া পার্ক মসজিদ কমিটির লোকজন আমার টঙ্গীর মসজিদে এলেন। তাঁরা আমাকে তাঁদের মসজিদের ইমাম বানাতে চান। তাঁদের কেউ কেউ আমার পেছনে ঢাকার ইস্কাটনে তারাবীর নামায পড়েছিলেন। তাঁদের এ প্রস্তাব আমার আগ্রহ সৃষ্টি করল। আমি হযরতের সাথে পরামর্শ করতে উত্তরা গেলাম।

তিনি সব শুনে বললেন, তুমি এখন যে মসজিদে নামায পড়াও সেখানকার মুসল্লিরা তুমি চলে গেলে বলবে, হুজুর বেশি টাকা পেয়ে আমাদের মসজিদের ইমামতি ছেড়ে দিলেন। এটা আলেমের শানের খেলাফ। তুমি যেয়ো না।

দ্বিতীয় ঘটনা : একই মসজিদে আমার তারাবী পড়ানোর নবম বছর চলছিল। ২০০৭ সালের রমযানে তারাবীর জন্য কমিটির লোকজন আমাকে না জানিয়ে একজন তারাবীর হাফেজ নিয়োগ দিলেন। শবে বরাতের পরবর্তী ফজর নামাযে আমি যখন নামায পড়াতে দাঁড়াব তখন মসজিদ কমিটির একজন সদস্য বললেন, ‘হুজুর! হাফেয সাহেবকে নামায পড়াতে দিন।

আমি তাকে নামায পড়াতে দিলাম না। নামাযান্তে তাদের সাথে আমার তুমুল তর্ক-বিতর্ক হল। আমি বিষয়টি হযরতকে জানালাম। হযরত সব শুনে বললেন, তুমি মসজিদের মুতাওয়াল্লীকে জানিয়ে দাও, তুমি এখানে ইমামতি করবে না।

আমি তাই করলাম। মুতাওয়াল্লী সাহেব বললেন, আপনি আমাকে একথা বলেছেনআর কাউকে বলবেন না। তেমন আর কী হয়েছে? আপনি এখানেই থাকবেন।

এবার হযরত আমাকে মুফতী আব্দুর রহমান ছাহেবের কাছে নিয়ে গেলেন। হযরত মুফতী ছাহেব রাহ. আলেমদের শান ও আত্মমর্যাদাবোধ নিয়ে কথা বললেন। হযরত মুফতী সাহেবের কাছ থেকে এসে বললেন, তুমি লিখিতভাবে পদত্যাগপত্র দিয়ে দাও।

আমি তাই করলাম। মুতওয়াল্লী সাহেব সেটি হাতে নিয়ে খুব কান্নাকাটি করলেন। আমি হযরতকে বিষয়টি জানালাম। হযরত বললেন, ‘মাওলানা! কান্না করা সহজ, মাফ চাওয়া কঠিন। তারা তোমার কাছে মাফ না চাইলে তুমি সেখানে থাকবে না। মসজিদে জুমার নামাযে ব্যক্তিগত অপারগতা জানিয়ে মুসল্লিদের থেকে বিদায় নেবে। ঘুুণাক্ষরেও ঝগড়ার কথা বলবে না।

তৃতীয় ঘটনা : ২০০৭ থেকে ২০০৯ সাল দুবছর আমি কোথাও ইমামতি করিনি। ২০০৯ সালে আমার বর্তমান মসজিদে ইমামতির কথা হচ্ছিল। মসজিদ কমিটি তাদের পছন্দের কথা জানালে হযরতের সাথে পরামর্শের জন্য গেলাম। হযরত শুনে খুব একটা আগ্রহ দেখালেন না। পরে বললেন, মাওলানা! তুমি ইমামতি কোথায় করবে? সাধারণ অবস্থা তো হল, কমিটির ভাবখানা এমন যে, তারা গোলাম বানিয়ে রাখতে চায়। সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে ইমামতি করতে পারলে যাও।

এ তিনটি ঘটনা থেকে সুস্পষ্ট বোঝা যায়, তিনি আলেমদের জন্য কী চাইতেন এবং আলেমগণের কাছ থেকে কী আশা করতেন। আলেমদের ছোট হওয়া তাঁর মোটেও বরদাশত হত না।

দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা ও দৃঢ়তা

হযরতের সৌভাগ্য হয়েছিল ছোটবেলা থেকে আলেমদের সান্নিধ্যে থাকার। জীবনের বিভিন্ন সময়ে বড় বড় আলেমের সাহচর্য লাভের তাওফীক হয়েছিল। হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর দীর্ঘ সময়ের ঘনিষ্ঠ সোহবত ও খিলাফত লাভ করে অনেক উঁচু মাকাম অর্জন করেছে। তারপর হারদূঈ হযরত মাওলানা আবরারুল হক রাহ.-এর  সোহবত ও খেলাফত লাভ করেছেন। তাঁর দ্বীন, শরীয়ত, সুন্নাহ, মাদরাসা, দাওয়াত, সিয়াসাত সম্পর্কে সঠিক ও সুস্পষ্ট ধারণা ছিল। বৈষয়িক বিষয় তো তিনি ভালো বুঝতেনই। ফলে দ্বীন ও পার্থিব কোনো কিছুতেই তাঁর মাঝে বৈপরীত্য পরিলক্ষিত হত না। জটিল হয়ে উঠত না কোনো কিছু। আমাদের কাছে অনেক বিষয় জটিল মনে হলেও তিনি খুব সহজেই এর সমাধান দিয়ে দিতেন। প্রত্যেকটির আলাদা আলাদা ক্ষেত্র দেখিয়ে দিতেন। কোন্ কাজটি আমার জন্য করণীয় এবং কোন্টি আমার কাজ নয় তার পার্থক্য বুঝিয়ে দিতেন।

একদিন আমি তাকে ইসলামী-রাজনীতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, তোমার তা করার প্রয়োজন নেই। তবে তুমি তাদের জন্য এ দুআ করবে

اللّهُمَّ انْصُرْ مَنْ نَصَرَ دِيْنَ مُحَمَّدٍ صَلّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّم.

হে আল্লাহ! যারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দ্বীনকে সাহায্য করে, তাদেরকে তুমি সাহায্য করো।

হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ. ১৯৮২ সালের  প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করার সময়, আমাদের হযরত তাঁর অর্থসচিব (আমীনুল মাল) ছিলেন। হাফেজ্জী হুযুরের সাথে তিনি সারা দেশ ঘুরেছেন। নির্বাচন-পূর্ববতী ও পরবর্তী রাজনীতি কাছ থেকে দেখেছেন। সুতরাং এব্যাপারে তাঁর সম্যক ধারণা ছিল।

মুনকার-এর ইসলাহ সম্পর্কে তিনি বলতেন, ইসলাহের কাজ আগ থেকে করো। তুমি আগ থেকে লোকদের বুঝিয়ে তাদের মানসিকতা তৈরি কর, তাহলে তারা সহজে মেনে নিতে পারবে।

বয়ানে তিনি কঠোরতা পছন্দ করতেন না। সহজ ও নরম উপস্থাপনায় সাদামাটা কথা বলা তাঁর অভ্যাস ছিল। অন্যদের বেলায়ও তাই চাইতেন। বয়ানের ব্যাপারে বলতেন, দিলে যা আসে তাই বলো। বানিয়ে সাজিয়ে কথা বলার প্রয়োজন নেই।

হযরতের উত্তরা ৩ নং সেক্টরের ১৮ নং রোডের ৫৪ নং বাসায় যে মাহফিল হত, পরবর্তী সময়ে তা কেন্দ্রের মর্যাদা লাভ করে। এ মাহফিলের কোনো বাহ্যিক জৌলুস ছিল না। কিন্তু রূহানিয়াতের এক মারকায ছিল।

২০১৩ সালে নাস্তিকদের বিরুদ্ধে হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক হযরত আহমাদ শফী সাহেব রাহ.-এর নেতৃত্বে যে মহাগণজাগরণ ও আন্দোলন হয়, তাতে হযরতের জোরালো অংশগ্রহণ ছিল। ঢাকা প্রবেশের বিভিন্ন পথে যে অবরোধ হয় তাতে তিনি স্বশরীরে অংশগ্রহণ করেন। তাঁকে আমি আব্দুল্লাহপুর রাস্তায় অনেকক্ষণ ধরে পায়চারি করতে দেখেছি। পরে তিনি শাপলা চত্ত্বরের সমাবেশে গিয়েছিলেন। বাহ্যত যখন এ আন্দোলন ব্যর্থ হয়ে গেল, এর পরে তাঁর বাসায় জুমাবার সকালের মজলিসে গেলাম, তখন সেই প্রসঙ্গ উঠলে তিনি মন্তব্য করেছিলেন, ‘সংগ্রামের পর এমন সময় এসেছিল যে, আমরা কেউ মাথায় টুপি পরে বের হওয়ার সাহস পেতাম না, কই আল্লাহর দ্বীন তো আল্লাহ টিকিয়ে রেখেছেন।

বাতিলের মুকাবেলায় তিনি মক্তব প্রতিষ্ঠায় জোর দিতেন। সাধারণত জাহেরীভাবে বাতিলের প্রতিবাদ করতে চাইতেন না। হক প্রতিষ্ঠায় সর্বোত্তম হাতিয়ার মনে করতেন মাদরাসা-মক্তবকে। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত তিনি সারা দেশে মক্তব প্রতিষ্ঠা এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত মক্তবগুলো পরিদর্শনে বিরামহীন এক সফর অব্যাহত রেখেছিলেন। দ্বীনী চেতনা তৈরি ও আখেরাতমুখী জীবন গড়তে ঘরোয়া মাহফিলের খুব জোর দিতেন। প্রায় প্রতিদিন এক ও একাধিক ঘরোয়া মাহফিল করতেন। সাথে আলেমদের নিয়ে যেতেন।

পবিত্র কুরআন ছিল তাঁর ধ্যান ও জ্ঞান। দীর্ঘ সময় ধরে তিলাওয়াত করতেন ও শুনতেন। পুরো কুরআন ছিল তাঁর নখদর্পণে, বয়ানের সময় আলোচ্য বিষয় সম্পর্কিত ও প্রাসঙ্গিক একের পর এক আয়াত তিলাওয়াত করতে থাকতেন।

সোহবত ও ইসলাহের ক্ষেত্রে তাঁর ছিল এক বিরল পদ্ধতি। সাধারণত কাউকে তিরস্কার করতেন না বা ধমক দিতেন না। তবে তিনি চাইতেন, তাঁর সাথে যেন তাঁর প্রিয়জনেরা বেশি সময় থাকে। আর এতেই কাজ হয়ে যেত।

নিজেকে আড়াল করে রাখা

আমাদের হযরতের মধ্যে বিনয় ও আত্মোৎসর্গের প্রাবল্য ছিল। নিজেকে যে কীভাবে বিলীন করেছেন তার উপমা তিনি নিজেই। কখনো কোনোভাবে নিজের প্রকাশ চাইতেন না। নিজেকে আলেমদের জুতাবাহক ও গোলাম বলতেন। বোর্ডবাজার এলাকায় ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে প্রথমে প্রফেসর হিসেবে যোগদান করেন। পরে যখন পার্টটাইম বা খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে পড়াতেন তখন ক্লাস করলে টাকা পেতেন, না করলে কোনো সুবিধা পেতেন না। সেসময় নিজেকে দিনমজুর হিসেবে অখ্যায়িত করতেন। বলতেন আমি তো কাজ করলে টাকা পাই, না করলে পাই না। আমার আর দিনমজুরের মধ্যে কী পার্থক্য?

যতদিন দেহে শক্তি ছিল তার নোয়া গাড়ির সবার পেছনের সিটে বসতেন। রাস্তায় সফর সঙ্গীদের বার বার খাওয়াতেন। যখন কোথাও কিছু কেনার জন্য বা খাওয়ানোর জন্য চাইতেন কাউকে নামতে দিতেন না। নিজে নেমে খাবার নিয়ে আসতেন অথবা ড্রাইভারকে পাঠাতেন। সফরে সাথীদের আরামের প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখতেন। তাঁর ইবাদত চোখে পড়ত কম, লুকিয়ে লুকিয়ে ইবাদত করতেন। কখনো কখনো টয়লেট পরিষ্কার করতেন, কিন্তু বুঝতে দিতেন না।

একবার তাঁর সাথে সিলেটের পথে সফরে যাচ্ছিলাম, নরসিংদীর পর এক জায়গায় ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বললেন। গাড়ি থামার পর পেছনের দিকে কিছু দূর হেঁটে গেলেন। তারপর দেখলাম রাস্তায় কোনো গাড়ির নিচে পিষ্ট হয়ে পড়ে আছে একটি কুকুর। তিনি সেটির পা ধরে রাস্তার এক পাশে সরিয়ে দিলেন।

তিনি বলতেন, ইংরেজি শিক্ষিতদের দ্বীনদারী সব লেবাসের মধ্যে। মাঝে মাঝে তারা তাদের খোলস ছেড়ে বের হয়ে আসে। তখন তাদের আসল চরিত্র প্রকাশ হয়ে যায়। তখন তারা আলেমদের তুচ্ছজ্ঞান করে এবং তাঁদের সাথে দুর্ব্যবহার করে।

তিনি বলেন, আমি আমার ছেলেদের বলেছি, তোমরা আমাকেও বিশ্বাস করবে না।

এধরনের অতি বিনয়ের কথা তাঁর মুখ থেকে আমরা প্রায়ই শুনতাম। এর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ছিল তাঁর ভেতরের বিনয়।

হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ. বলেছেন, বিনয়-নম্রতা তো অভ্যন্তরীণ এক গুণ, যার প্রকাশ কথা ও আচরণে বুঝা যায়।

তাঁর সোমবারের মাহফিলে আলোচকগণ একটা বিষয় জানত যে, মাহফিলে তাঁর কোনো প্রশংসা করা যাবে না। কেউ করলে তিনি তাকে থামিয়ে দিতেন। আমরা খুব সর্তক থাকতাম, যেন তাঁর প্রশংসা মুখ ফুটে বের হয়ে না যায়, তাহলে ভীষণ রাগ করবেন।

আমরা শোকর বা কৃতজ্ঞতাবোধের এমন সব আচরণ দেখতে পেতাম, যা সত্যিই বিরল। যাদের ইহসান তাঁর ওপর ছিল, তাদের এতটাই শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতেন এবং সাধ্যমতো তাদের ইহসানের বদলা দেওয়ার এমন সব চেষ্টা করতেন, যা আর কোথাও দেখিনি। তাঁর এ গুণটি আলোচ্য লেখার বিষয় নয়, তবুও শুধু এজন্য বললাম যে, বিনয়-নম্রতা ছাড়া এমন আচরণ করা আসলে সম্ভব না।

হযরত এখন আমাদের মাঝে নেই, এ এক কঠিন শূন্যতা ও বাস্তবতা। তবে তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শ চির-অম্লান হয়ে থাকবে আমাদের মাঝে। আমরা তাঁকে তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শের মাঝে খুঁেজ ফিরব ইনশাআল্লাহ। মহান রাব্বে কারীম তাঁকে রহমান ও রহীমের শান অনুযায়ী উত্তম বদলা দান করুন। 

 

 

advertisement