রজব ১৪৪৫   ||   জানুয়ারি ২০২৪

ঢাকার হুজুর রাহ. ॥
আমার জীবন-আকাশের আরো একটি নক্ষত্র ডুবে গেল

মুফতী মাহমুদুল হাসান

২৩ জুমাদাল উলা ১৪৪৫ হিজরী (৭ ডিসেম্বর ২০২৩ ঈসায়ী) বৃহস্পতিবার সুবহে সাদিকের সময় আমার জীবন আকাশের আরো একটি নক্ষত্র ডুবে গেল! আমার উস্তায শাইখুল হাদীস হযরত মাওলানা মুফতী আবদুর রউফ (ঢাকার হুজুর) রাহ. আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেলেন!

إنا لله وإنا إليه راجعون. اللهم أجرنا في مصيبتنا واخلف لنا خيرا منها.

সেই শৈশব থেকে এই বার্ধক্যপ্রায় জীবনে হুজুরের কত যে স্নেহ পেয়েছি, পেয়েছি কত ভালবাসার পরশ, কত মধুর স্মৃতি। কত সৌভাগ্যের আলাপন হুজুরের সাথে। হুজুরের বিদায়ের পর সেই স্নেহ ও ভালবাসামাখা মধুর স্মৃতিগুলো থেকে থেকে হৃদয়ে এসে জড়ো হচ্ছে। অন্যরকম এক ভালোলাগা কাজ করে, আবার আনমনা হয়ে যাই।

হুজুরকে আমি পেয়েছি গওহরডাঙ্গা মাদরাসায় গিয়ে। ১৯৭৪ সনে। এর আগে সম্ভবত হুজুরকে কখনো দেখিওনি। হুজুরের জন্ম ১৯৩৬ ঈসাব্দ সনের ৩রা মার্চ। বর্তমান মুন্সিগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান থানার ঈসাপুরী ইউনিয়নের বাহিরকুচি গ্রামে হুজুরের বাড়ি। মুন্সিগঞ্জ জেলাটি একসময় বৃহত্তর ঢাকার অন্তর্ভুক্ত ছিল। তখন থেকেই হুজুরের পরিচিতি ঢাকার হুজুরনামে।

হুজুরের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সূচনা হয় বাড়ির কাছে মোস্তফাগঞ্জ মাদরাসায়। সেখানে চাঁদপুরের বিখ্যাত হাফেজ মুহসিন সাহেবের কাছে হুজুর হিফজ পড়েন। মিযান পর্যন্ত হুজুর সেখানেই পড়েন। এরপর চলে যান লালবাগ মাদরাসায়। সেখানে ১৯৬৩ সনে দাওরায়ে হাদীস সম্পন্ন করেন। এরপর এক বছর (১৯৬৪ সনে) তাঁর মাদারে ইলমী-জামিআ ইসলামিয়া মোস্তফাগঞ্জ মাদরাসায় তাদরীসের খেদমত করেন। পরবর্তী বছর ১৯৬৫ সনে পাড়ি জমান বিন্নূরী রাহ.-এর কাছে; করাচীর জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়ায়। হুজুরের বিন্নূরী টাউনে ভর্তির গল্পটি সুন্দর। সে গল্প দিয়েই আমি আমার স্মৃতিচারণা শুরু করছি।

বিন্নূরী টাউনে ভর্তি

বিন্নূরী টাউনে হুজুরের ভর্তির গল্প আমি সরাসরি হুজুরের মুখেই শুনেছি। বিন্নূরী রাহ. একবার ঢাকায় আসেন। ছদর ছাহেব রাহ.-এর সঙ্গেও সাক্ষাৎ হয়। তখন ছদর ছাহেব রাহ. ঢাকার হুজুরের কথা বিন্নূরী রাহ.-কে বলেন যে, আমার এই ছাত্রকে আপনার কাছে হাদীস পড়ার জন্য পাঠাব। আপনি তাকে সহযোগিতা করবেন।

বিন্নূরী রাহ. তখন ভর্তির ব্যাপারে আশ্বাস দেন। পরবর্তীতে যখন ঢাকার হুজুর করাচীতে যান, তখন ছদর ছাহেব রাহ. বিন্নূরী রাহ.-এর উদ্দেশে ঢাকার হুজুরের কাছে একটি চিঠি লিখে দেন।

ঢাকার হুজুর ওখানে গিয়ে যথারীতি ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। হুজুরের পরীক্ষা যার কাছে ছিল, তার ব্যাপারে প্রসিদ্ধ ছিল যে, তাঁর কাছে পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হতে পারা কঠিন ব্যাপার। সেই পরীক্ষক উস্তাযের নামও ঢাকার হুজুর আমাকে বলেছিলেন, ভুলে গেছি। কুতুবখানায় ইমতিহান নিচ্ছিলেন। পরীক্ষক বিভিন্ন প্রশ্ন করছেন। কুতুবখানা থেকে কিতাব নিয়ে আসতে বলছেন। হুজুর নিয়ে আসলে সেখান থেকে প্রশ্ন করছেন। হুজুর প্রতিটি প্রশ্নেরই সুন্দর জওয়াব দিচ্ছিলেন। সবশেষে পরীক্ষক আরবীতে একটি মাকালা লিখতে বললেন। হুজুর একটি মাকালা লিখে পরীক্ষককে দিলেন।

এদিকে ছাত্ররা- বিশেষ করে বাঙালী ছাত্ররা; যারা ঢাকার হুজুরকে চিনত তারা অধীর হয়ে হুজুরের জন্য অপেক্ষা করছে। না জানি তাঁর কী ফায়সালা হয়! অবশেষে তিনি বের হয়ে আসলেন। সবার কৌতূহলী দৃষ্টি ভর্তি ফরমের মন্তব্যের ঘরে। কী লিখে দিয়েছেন পরীক্ষক সেখানে! দেখা গেল, ভর্তির উপযুক্ততা বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত সর্বোচ্চ শব্দ তিনি হুজুরের জন্য লিখেছেন।

বিন্নূরী টাউনে হুজুর তাখাসসুস ফী উলূমিল হাদীস অধ্যয়ন করেন। বিন্নূরী রাহ.-এর জামাতা শহীদ মাওলানা হাবীবুল্লাহ মুখতার রাহ. সেখানে হুজুরের হামসবক-সহপাঠী ছিলেন। অনেক পরে আমরাও দেখেছি, তিনি ঢাকার হুজুরকে খুব মূল্যায়ন করতেন। বিন্নূরী টাউনে তাখাসসুস সমাপনান্তে হুজুর যে মাকালা বা অভিসন্দর্ভ লিখেছিলেন, তার শিরনাম ছিল-

السنة النبوية والإمام الأعظم أبو حنيفة

বিন্নূরী টাউন থেকে আসার পর হুজুর ছদর ছাহেব রাহ.-এর নির্দেশে গওহরডাঙ্গা মাদরাসায় খেদমতে যুক্ত হন ১৯৬৭/৬৮ ঈসাব্দ সনে। সেই থেকে ২০২৩; দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের বেশি কাল হুজুর গওহরডাঙ্গা মাদরাসায় নিজের জীবনকে তিলে তিলে ক্ষয় করে অক্ষয় হয়ে আছেন আমাদের মাঝে, আমাদের আকাশে, ভুবনে।

হুজুরের দরসে

গওহরডাঙ্গা মাদরাসায় হুজুরের কাছে আমার একাধিক কিতাব পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে। আমি গওহরডাঙ্গা মাদরাসায় গিয়েছি আমার নাহবেমীরের বছর। ১৯৭৩/৭৪ সনে। হুজুরের দরস পেয়েছি কাফিয়ার বছর। কাফিয়ার বছর হুজুরের কাছে নাফহাতুল ইয়ামানপড়েছি। এরপর শরহে বেকায়ার বছর পড়েছি নূরুল আনওয়ার (কিতাবুল্লাহ অংশ)। জালালাইন জামাতে পড়েছি তাফসীরে জালালাইন (২য় খণ্ড)। সব শেষে দাওরায়ে হাদীসের বছর পড়েছি সহীহ বুখারী (২য় খণ্ড)।

হুজুরের দরস সব সময়, সারা বছর এক ধাঁচে হত। হুজুর সব সময় এক মাপের আলোচনা করতেন। আলোচনা খুব দীর্ঘও হত না, আবার খুব সংক্ষিপ্তও হত না; বরং দুয়ের মাঝামাঝি হত। এভাবে সারা বছর আলোচনা করে করেই কিতাব শেষ করতেন। কোনো বেগ পেতে হত না। বুখারীর দরসের চিত্রও এমনই ছিল। একদম শেষ দিকে কয়েকদিন চলোকরে পড়েছেন।

সুদৃষ্টির প্রথম ঝলক

আলহামদু লিল্লাহ, হুজুরের সাথে পরিচয়ের শুরু থেকেই হুজুরের স্নেহ-ভালবাসায় সিক্ত হয়েছি। কাফিয়ার বছর নাফহাতুল ইয়ামান’-এর পরীক্ষায় হুজুর একটি আরবী মাকালা লিখতে দিয়েছিলেন। কোনো বিষয় নির্ধারিত ছিল না। আমি লিখেছিলাম, ‘গওহরডাঙ্গা মাদরাসা এবং আমার স্বপ্ননিয়ে। আমার মাকালাটা হুজুরের খুব ভালো লেগেছিল। গওহরডাঙ্গা মাদরাসায় তখন আমার মেঝ ভাইজানও পড়তেন। তিনি পড়তেন দাওরায়ে হাদীসে। হুজুর ভাইজানের কাছে আমার মাকালার প্রশংসা করেছিলেন। এখানেও অবশ্য ছোট্ট একটি গল্প আছে

গওহরডাঙ্গা মাদরাসায় তখন দেয়ালিকাবের হত। সেই দেয়ালিকার কাজের সাথে আমিও জড়িত ছিলাম। কলাখালি হুজুরের ছেলে মাওলানা বশীর ভাইও সে কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন। ঢাকার হুজুর এগুলো ছাত্রদের জন্য খুব একটা পছন্দ করতেন না। হুজুরের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, এগুলোর কারণে ছাত্রদের পড়াশোনায় ক্ষতি হয়। হুজুর একদিন আমার ভাইজানকে বললেন, মাহমুদ তো মাশাআল্লাহ, লেখাপড়ায় ভালো। আমি পরীক্ষায় একটি আরবী মাকালা লিখতে দিয়েছিলাম, ও খুব চমৎকার লিখেছে। কিন্তু ও যেভাবে আল-গওহর দেয়ালিকার সাথে জড়িয়েছে, এতে তো আস্তে আস্তে ওর প্রতিভাটা নষ্ট হয়ে যাবে।

ভাইজান তখন গওহরডাঙ্গা মাদরাসায় দাওরায়ে হাদীস পড়তেন। ভাইজান আমাকে হুজুরের মনোভাবের কথা জানালেন যে, হুজুর আমার দেয়ালিকার সম্পৃক্ততা পছন্দ করছেন না। যেহেতু হুজুর আমার জন্য পছন্দ করছেন না, তাই আমি ধীরে ধীরে আমার সম্পৃক্ততা কমিয়ে আনলাম।

হুজুরের কামরাতেই আমার থাকা

গওহরডাঙ্গার ছাত্র-জীবনে আমি ঢাকার হুজুরের কামরায় থাকতাম। মালিবাগ মাদরাসার বড় হাফেজ সাহেব হাফেজ মাওলানা মোশাররফ ভাইও হুজুরের কামরায় থাকতেন। পড়াশোনা-খাওয়া-থাকা-ঘুম সব হুজুরের কামরায় ছিল। যতদিন লজিংয়ে ছিলাম ততদিন লজিংয়ের সময়টুকু লজিংয়ে থাকতাম। বাকি সময় মাদরাসায় হুজুরের কামরায় থাকতাম। শরহে বেকায়া জামাতের শেষ থেকে দাওরায়ে হাদীসের শেষ পর্যন্ত পুরো সময়ই হুজুরের কামরায় থেকে আমি পড়াশোনা করেছি। হুজুর তখন গওহরডাঙ্গা মাদরাসার মুফতী ছিলেন। হুজুর নিয়মতান্ত্রিক কোনো ফতোয়া বিভাগে পড়েননি; কিন্তু তখন গওহরডাঙ্গা মাদরাসায় ফতোয়ার কাজ হুজুরই করতেন। লিখিত ফতোয়াগুলোও হুজুরই লিখতেন। বিভিন্ন সময় হুজুর আমাকে প্রয়োজনীয় কিতাব আনতে বলতেন। আমি নিয়ে আসতাম। হুজুর আমাকে দিয়ে ফতোয়া লেখাতেন। অর্থাৎ হুজুর বলতেন, আমি সেটা লিখতাম। পরবর্তীতে মেশকাত-দাওরার বছরগুলোতে বিভিন্ন সময় হুজুর আমাকে বিভিন্ন হাওয়ালাও দেখতে বলতেন। কখনো কোনো মাসআলার তাহকীক করে হুজুরকে দেখাতে বলতেন। আমি কিতাবাদি ঘেঁটে দলীল-আদিল্লাহ বের করে হুজুরকে দেখাতাম। একথা বললে ভুল হবে না, ছাত্র-জীবনে ঢাকার হুজুরের এই নির্দেশ পালনের ফলে ফিকহ-ফতোয়ার কিতাব এবং ফতোয়া লেখা বিষয়ে আমার কিছুটা হলেও তাআররুফ ও উনস (পরিচয় ও অন্তরঙ্গতা) হয়েছিল। যেটা আমার পরবর্তী জীবনের জন্য সঞ্চয় হয়ে থেকেছে। পরবর্তী শিক্ষক জীবনে তো হুজুরের তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন ইস্তেফতার পূর্ণ জওয়াবই লেখা হয়েছে। ওয়ালিল্লাহিল হামদ।

এভাবে ছাত্র জীবনে হুজুরের স্নেহ-পরশ পেয়েছি। এরপর শিক্ষক-জীবনের দীর্ঘ সময় গওহরডাঙ্গা মাদরাসায় হুজুরের সান্নিধ্যে থেকেছি। ঢাকায় আসার পরও আলহামদু লিল্লাহ হুজুরের স্নেহ-শাফকতের ছায়া আমার জীবনকে বেষ্টন করে ছিল। এছাড়া দেশে ও দেশের বাইরে বিভিন্ন সফরেও হুজুরের সঙ্গে থেকেছি। হুজুরকে কাছ থেকে দেখেছি। আমার ক্ষুদ্র দৃষ্টির দীর্ঘ অবলোকনে হুজুরের জীবনের যে দিকগুলো আমার কাছে উজ্জ্বল তার কয়েকটি এখানে তুলে ধরছি।

হুজুরের জীবনের কিছু উজ্জ্বল দিক ও দৃষ্টান্ত

এক. হুজুর ছিলেন মাদরাসার জন্য নিবেদিতপ্রাণ, মাদরাসার প্রতি খায়েরখাহ

মাদরাসার প্রতি খায়েরখাহীর একটি দৃষ্টান্ত, হুজুর সব সময় মাদরাসার দরস ও অন্যান্য যিম্মাদারির প্রতি খুব যত্নবান ছিলেন। দরস কখনো নাগাহ দিতেন না। মাদরাসার কাজে কত দূর-দূরান্তের সফরে যেতেন। দৌড়-ঝাঁপ করতেন। আবার পূর্ণ যত্নের সাথে সবকে উপস্থিত হতেন।

এছাড়া একসময় মাদরাসার সিংহভাগ আর্থিক সহায়তা হুজুরের মাধ্যমে আসত। গওহরডাঙ্গা মাদরাসার মসজিদটা একসময় অনেক ছোট আয়তনে ছিল। পরবর্তীতে সেটি প্রশস্ত করা হয়েছে। এই বড়-প্রশস্ত মসজিদের কাজ; প্ল্যান থেকে শুরু করে নির্মাণ সম্পন্ন করে নামাযের উপযুক্ত করা পর্যন্ত বলা যায় পুরোটা হুজুরের প্রচেষ্টায় হয়েছে। বিভিন্ন সময় বিশেষ করে ঢালাইয়ের সময় হুজুরের তত্ত্বাবধানে ও উৎসাহ-উদ্দীপনায় আমরাও মসজিদের কাজে শরীক হয়েছি। গ্রামবাসীরা সৌভাগ্য মনে করে স্বশরীরে কাজে অংশগ্রহণ করেছে।

দুই. মুরব্বি মান্যতা

ঢাকার হুজুরের মুরব্বি-রাহনুমা ছিলেন মুজাহিদে আজম মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী (ছদর ছাহেব) রাহ.। তাঁর প্রতি হুজুরের ভক্তি-শ্রদ্ধা ও মান্যতা ছিল এককথায় বে-নযীর। এখানে একটি ঘটনা উল্লেখ করছি। ঘটনাটি আমি শুনেছি, প্রধানত দুই ব্যক্তির কাছে; একজন হল, আমার নানী শাশুড়ি ছদর ছাহেবের আহলিয়া রাহ.। আরেকজন হল, আমার শফীক উস্তায হযরত মাওলানা শফীউল্লাহ (চৌমুহনী হুজুর) রাহ.। সংশ্লিষ্ট কিছু অংশ শুনেছি গওহরডাঙ্গা মাদরাসার বড় হাফেজ সাহেব; হাফেজ আবদুল হক রাহ.-এর কাছে।

তখন পাকিস্তান আমল। কিছুদিন হল ঢাকার হুজুর বিন্নূরী রাহ.-এর সান্নিধ্য থেকে ফিরেছেন। তিনি গওহরডাঙ্গা মাদরাসার নওজোয়ান উস্তায। দাওরায়ে হাদীসে খুব সম্ভব সুনানে আবু দাউদ পড়ান। একদিন ছদর ছাহেব তাঁকে বললেন, ‘তুমি সারা বছর হাদীস পড়া ও পড়ানোর যেসকল সমস্যা ও জটিলতার সম্মুখীন হবে, যেগুলোর সমাধান তুমি খোঁজ-তালাশ করে পাবে না, সেগুলো নোট করে রাখবে। রমযানের ছুটিতে বিন্নূরী রাহ.-এর কাছে চলে যাবে। তাঁর সান্নিধ্যে সময় কাটাবে এবং তাঁর কাছ থেকে বিষয়গুলো হল করে আসবে। এজন্য তুমি আগ থেকেই টাকা জমাতে থাকবে। যেন একসাথে বড় অঙ্কের টাকার চাপ তোমাকে নিতে না হয়।মুরব্বির নির্দেশমতোই ফয়সালা। হুজুর টাকা জমাতে শুরু করলেন। রমযানের আগে যাওয়ারও পাক্কা নিয়ত। কিন্তু পারিবারিক জটিলতার কারণে হুজুর যেতে পারলেন না।

রমযানে হুজুর একদিন মাদরাসায় আসলেন। ছদর ছাহেব তাঁকে দেখে বললেন, তুমি এখানে! তোমার না বিন্নূরী ছাহেবের কাছে যাওয়ার কথা!

ঢাকার হুজুর বললেন, ‘হুজুর! আমার যাওয়ার পাক্কা ইরাদা ছিল। কিন্তু বাড়িতে যাওয়ার পর আব্বা বললেন, আমার তো কিছু টাকার প্রয়োজন। তোমার কাছে কি আছে? থাকলে আমাকে দাও। আব্বা এ কথা বললে, আমি টাকাগুলো আব্বাকে দিয়ে দিয়েছি।

ছদর ছাহেব বললেন, ‘তুমি কি তোমার আব্বাকে আমার কথা বলেছিলে যে, আমি তোমাকে এই টাকাগুলো এই জন্য রাখতে বলেছি?’

হুজুর বললেন, জী না!

ছদর ছাহেব বললেন, ‘কেন বলনি? এই কথা বলার পরেও যদি তোমার আব্বা বলতেন, টাকাগুলো আমার দরকার, তাহলে তখন তুমি দিতে। কিন্তু তুমি তো সেটা বলইনি!

ঢাকার হুজুর তখন মেঝেতে বসা ছিলেন আর ছদর ছাহেব ছিলেন চেয়ারে বা খাটে। ছদর ছাহেব হুজুরের হাতে একটি লাঠি ছিল। সেই লাঠি দিয়ে তিনি ঢাকার হুজুরকে পেটানো শুরু করলেন। পেটাচ্ছেন আর বলছেন, ‘তুমি আমার কথা শোনোনি। বের হয়ে যাও আমার এখান থেকে। বের হয়ে যাও। আর আসবে না এখানে।

তখন ঢাকার হুজুর ছদর ছাহেবের পা জড়িয়ে ধরে বারবার মাফ চাচ্ছেন আর বলছেন, হুজুর আমাকে মাফ করে দেন। আমি যেভাবেই হোক, এখন যাব।

অনেক সময় পর ছদর ছাহেব বললেন, ‘হাঁ, তোমাকে মাফ করতে পারি এক শর্তে; বিন্নূরী ছাহেব যদি তোমাকে গওহরডাঙ্গা মাদরাসায় রাখার ব্যাপারে আমার কাছে সুপারিশ করেন তাহলে তোমাকে রাখব, না হলে তুমি আমার কাছে থাকতে পারবে না। গওহরডাঙ্গা মাদরাসায় থাকতে পারবে না।

ঢাকার হুজুর ছদর ছাহেবের কাছ থেকে উঠে এসে টাকা-পয়সার ব্যবস্থা করে বিন্নূরী রাহ.-এর কাছে চলে গেলেন। বিন্নূরী রাহ.-এর সাহচর্যে সময় অতিবাহিত করতে থাকলেন। এক সুযোগে বিন্নূরী রাহ.-কে ছদর ছাহেবের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা বললেন। বিন্নূরী রাহ. তখন ছদর ছাহেবের উদ্দেশে একটি চিঠি লিখলেন। চিঠিতে ঢাকার হুজুরের ইলমী ইস্তেদাদ, তাদরীসের সালাহিয়্যাত সম্পর্কে নিজের অভিব্যক্তি ব্যক্ত করে তার জন্য সুপারিশ করলেন। চিঠিটি ঢাকার হুজুর আসার সময় সঙ্গে করে নিয়ে আসেন।

এরও পূর্বের ঘটনা হল, ঢাকার হুজুর বিন্নূরী রাহ.-এর কাছে পৌঁছার পর ছদর ছাহেবের কাছে দুআ চেয়ে একটি চিঠি লিখেছিলেন। ঢাকার হুজুরের পাঠানো এই চিঠি যখন ছদর ছাহেব পড়েন, তখন গওহরডাঙ্গা মাদরাসার বড় হাফেজ সাহেব সামনে ছিলেন। ছদর ছাহেব চিঠিটি পড়ে অত্যন্ত খুশি হন। বড় হাফেজ সাহেবকে বারবার বলতে থাকেন, ‘হাফেজ সাহেব, বলেন বলেন, আবদুর রউফের জন্য কী দুআ করা যায়! তাকে আমি যেভাবে রাগ করেছি, যেভাবে মেরেছি, আমি তো ভেবেছিলাম ও আমার কাছে আর আসবে না। হাফেজ সাহেব, দেখেন, ও আমাকে চিঠি লিখেছে। বলেন, ওর জন্য কী দুআ করব!

ছদর ছাহেব রাহ.-এর ঐ এক দুআই তো একটি জীবন আলোকিত হয়ে যাওয়ার জন্য অনেক!

ঢাকার হুজুরের মুরব্বি মান্যতার আরেকটি দৃষ্টান্ত হল, গওহরডাঙ্গা মাদরাসায় পুরোটা জীবন কাটিয়ে দেওয়া। হুজুরের তো আরো আরামে-আয়েশে থেকে দ্বীনী খেদমতের ব্যবস্থা ছিল। তাঁর ছাত্র-শাগরিদদের পক্ষ থেকে জোর আবদারও ছিল। কিন্তু সব কিছু পেছনে ফেলে হুজুরের কথা ছিল, আমি যদি গওহরডাঙ্গা ছেড়ে যাই, আর কিয়ামতের দিন ছদর ছাহেব যদি আমাকে বলেন, আমি তোমাকে গওহরডাঙ্গা মাদরাসায় রেখে এসেছিলাম আর তুমি সেটা ছেড়ে অমুক জায়গায় চলে গেলে? আমি তখন হযরতকে কী জবাব দেব! তাই আমি গওহরডাঙ্গা ছেড়ে কোথাও যাব না।

তিন. নামাযের প্রতি ভালবাসা

ক. তখনকার সময়ে গ্রামের সফর ছিল কষ্ট-ক্লান্তির সীমা ছাড়িয়ে। হুজুর সেই দুঃসময়েপায়ে হেঁটে, নৌকায় চড়ে দূর-দূরান্ত চষে বেড়িয়েছেন। কোনো কোনো সফরে আমিও হুজুরের সঙ্গ-সৌভাগ্য লাভ করেছি। সেই কঠিন সফরেও দেখেছি, হুজুর জামাতের ব্যাপারে অত্যন্ত যত্নবান। এমনকি সফরে তাহাজ্জুদও কখনো ছুটত না। এত ক্লান্তির পরও হুজুর কী এক শক্তি-তৃপ্তি খুঁজে পেতেন নামাযে!

খ. আমি তখন করাচী বিন্নূরী টাউনের ছাত্র। হুজুর গওহরডাঙ্গা মাদরাসার কাজে করাচী গেলেন। হুজুর করাচী গেলে বিন্নূরী টাউনেই থাকতেন। সময়টা ছিল ১৪০৫ হিজরীর রমযান মাস। একে তো রোযা। আবার গরমও প্রচণ্ড। ঠাণ্ডা পানিতেও যেন তৃষ্ণা মেটে না, তাই ইফতারিতে এবং তারাবীর সময় মসজিদে কাতারে কাতারে বরফ পানির ব্যবস্থা থাকত। হুজুর সেই প্রচণ্ড রোদে সারাদিন রোযা রেখে মাদরাসার কাজে ব্যস্ত থাকতেন। দৌড়-ঝাঁপ করতেন। মাদরাসায় এসে একসঙ্গে ইফতারি করতেন। এরপর রাতে নিজেই খতম তারাবি পড়াতেন। আমাদের সময় বিন্নূরী টাউনে তারাবির নামাযের একাধিক জামাত হত। দুটো জামাত হত বড়; মসজিদের মূল জামাত এবং দাওরায়ে হাদীসের রুমে এক জামাত। এছাড়া মসজিদের বিশাল বারান্দায় ছোট ছোট অনেক জামাত হত। তো ঢাকার হুজুরও স্বতন্ত্র জামাত করতেন। হুজুরই নামায পড়াতেন। আমরা হুজুরের জামাতে শরীক হতাম। দু-একদিন হুজুরের নির্দেশে আমিও পড়িয়েছি।

এরপর শেষ রাতের তাহাজ্জুদ তো সাধারণ সময়েই ছুটত না। সুতরাং রমযানে তো ছোটার প্রশ্নই আসে না। হুজুর যত দিন ওখানে ছিলেন, কোনো দিন এমন হয়নি যে, সাহরির সময় হুজুর আমাদের পরে উঠেছেন। সব সময় আমরা উঠে দেখেছি, হুজুর তাহাজ্জুদের মুসল্লায়।

চার. কুরআন মাজীদ ছিল স্বচ্ছ আয়নার মতো

হুজুরের কুরআন মাজীদের হিফজ ছিল খুব মজবুত। কুরআনের মযমূন ও বিষয়বস্তুও ছিল হুজুরের হৃদয়ে সদা জাগ্রত। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে হুজুর উপস্থিত একের পর এক কুরআনের আয়াত বলে যেতেন। বিভিন্ন সময় এটা দেখেছি। বিশেষভাবে লক্ষ করেছি তাফসীরে জালালাইনের দরসে।

পাঁচ. সহজ-সরল জীবনের অধিকারী

হুজুরের জীবন-যাপন ছিল একদম সাদামাটা। সাদামাটা পোশাক, সাদামাটা খাবার। হুজুর যখন মাদরাসায় খেতেন তখন মাঝে মাঝে টুকটাক রান্না করতেন। চুপচাপ নিজে নিজেই করতেন। কাউকে বলতেন না। কখনো আমরা বুঝতে পেরে হুজুরকে রান্না করে দেওয়ার কথা বললে হুজুর বলতেন, না তোমরা যাও; পড়াশোনা করো। হুজুর নিজেও রান্না-বান্না ভালো বুঝতেন না। কয়েকটা তরকারি মিলিয়ে একসাথে চড়িয়ে দিতেন। কিছু সময় নেড়ে-চেড়ে নামিয়ে খেয়ে নিতেন। দেখা যেত, কোনোটা সেদ্ধও পরিপূর্ণ হয়নি। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে হুজুরের কোনো অভিযোগ ছিল না। যেকোনো সাধারণ খাবারও খুব মজা করে আগ্রহ নিয়ে খেতেন।

হুজুরের সাথে সফরে কখনো এমন হয়েছে , সকালে বের হয়েছি। পায়ে হেঁটে, নৌকায় চড়ে পথ চলছি। সকালে খাওয়া হয়নি। দুপুরেও খাইনি। আমার ক্ষুধা পেয়েছে। কিন্তু হুজুরের কোনো ফিকিরই নেই। দেখেও বোঝা যায় না যে, হুজুরের খাবারের কোনো প্রয়োজন আছে।

ছয়. লৌকিকতা মুক্ত পবিত্র হৃদয়

এ বিষয়ে আমি আমার স্মৃতি থেকে এক টুকরো এখানে পেশ করছি। হুজুর ঢাকায় আসলে মাঝে মাঝে আমার মসজিদে অথবা বাসায় আসতেন। কখনো আসার আগে ফোন করে বলতেন, আজকে আপনার মসজিদে জুমার নামাজ পড়ব। কখনো হঠাৎ করেও চলে আসতেন। আবার অনেক সময় ফোনেই বলতেন, জুমার নামায তোমার ওখানে পড়ব; কিন্তু খাওয়া দাওয়া অন্য কোথাও করব। হুজুর এগুলোর ব্যাপারে একদম বে-তাকাল্লুফ ছিলেন।

জুমার দিন আসলে আমি হুজুরকে বয়ানের অনুরোধ করতাম। হুজুর অনেকবার আমার মসজিদে জুমার আগে আলোচনা করেছেন। মুসল্লিরাও খুব খুশি হত। বয়ানের আগে আমি সংক্ষেপে মুসল্লিদের কাছে হুজুরের পরিচয় তুলে ধরতে চেষ্টা করতাম। তিনি আমার বরেণ্য উস্তায, সেটা বলতাম।

আরো কিছু স্মৃতি

ছোটদের হিম্মত আফযায়ী

হুজুর আমাকে খুব স্নেহ করতেন। এবং আলহামদু লিল্লাহ, আমার প্রতি হুজুরের একটা সুদৃষ্টি ছিল। আমার তাদরীসী যিন্দেগীর দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় বছর; ১৯৮৬/৮৭ সনের ঘটনা। তখন পর্যন্তও আমার সর্বোচ্চ দরস ছিল জালালাইন জামাতে। জালালাইন জামাতে তাফসীরে জালালাইন এবং হেদায়া ছানীর দরস ছিল আমার যিম্মায়। মেশকাত-দাওরায় আমার কোনো দরস ছিল না। থাকার কথাও না।

ঢাকার হুজুর তখন মেশকাত জামাতে  মেশকাত শরীফ (১ম খণ্ড) পড়াতেন। একই দরসে তখন মেশকাতের মুকাদ্দিমাও পড়ানো হত। আমি গওহরডাঙ্গা মাদরাসার কথা বলছি। ঢাকার হুজুর আমাকে বললেন, মেশকাতের মুকাদ্দিমার অংশটা তুমি পড়াও। এভাবে হুযুরের নির্দেশে গওহরডাঙ্গা মাদরাসায় আমার তাদরীসী যিন্দেগীর একদম শুরুর দিকে মেশকাতের দরসে বসা হয়েছিল। গওহরডাঙ্গা মাদরাসার বর্তমান মুহাদ্দিস মাওলানা আবদুস সালাম (বাঁশবাড়িয়ার হুজুর) ও আমার ৫ম ভাই মাওলানা মানসূর তখন মেশকাত পড়ত।

অত্যন্ত যাহীন ও ধীমান ব্যক্তিত্ব

হুজুরের যেহেন মাশাআল্লাহ, খুব তেজ ছিল। কোনো বিষয় হুজুর সহজে ভুলতেন না। একবারের ঘটনা মনে আছে। একটি হাদীসের বিষয়ে গওহরডাঙ্গা মাদরাসার প্রবীণ উস্তায মাওলানা আবদুল মুকতাদির ছাহেব (বরিশালী হুজুর) এবং ঢাকার হুজুরের মাঝে একটু মতভিন্নতা হল। ঢাকার হুজুর বলেছেন, হাদীসটি কুতুবে সিত্তাহয় নেই। বরিশালী হুজুর বলছেন, আছে। বরিশালী হুজুর গওহরডাঙ্গা মাদরাসায় সকলের কাছে গ্রন্থকীটহিসাবে প্রসিদ্ধ ছিলেন। হুজুর কোনো এবারত-হাদীস বিষয়ে কিছু বললে সবার কাছে সেটার মূল্য থাকত। কিন্তু এ ঘটনায় তো বরিশালী হুজুরের বিপরীত বলছেন ঢাকার হুজুর। মীমাংসা বড় জটিল। বরিশালী হুজুর কুতুবে সিত্তাহ মুতালাআ শুরু করলেন। নিজে মুতালাআ করছেন। ছাত্ররা মুতালাআ করছে। কিন্তু কুতুবে সিত্তাহয় কেউ ঐ হাদীস খুঁজে পাচ্ছেন না। তখন ঢাকার হুজুর বললেন, ‘এ হাদীসটি যে, ‘কুতুবে সিত্তাহর ভেতর নেইসে কথা আমি আল্লামা ইউসুফ বিন্নূরী ছাহেবের কাছে শুনেছি। তাঁর কাছে শুনেছি বলেই এত আস্থার সঙ্গে বলেছি।

আওজানে শারইয়্যাহ; মুদ রিতল সাদিরহাম মিছকাল ইত্যাদি আমি কতবার পড়ে পড়ে মুখস্থ রাখতে চেয়েছি; কিন্তু পারি না। হুজুরের এগুলো সব সময় ইস্তেহযার ছিল। প্রয়োজনের মুহূর্তে বলতেন এবং বুঝিয়ে দিতেন।

সেই ইহসান ভোলার নয়

খুব সম্ভব ১৯৮৭ সনের কথা। আমি তখন গওহরডাঙ্গা মাদরাসার শিক্ষক। একবার আমার আহলিয়া একটি মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয়। তার চিকিৎসার জন্য যে পরিমাণ টাকার প্রয়োজন, সেটা আমার কাছে ছিল না। মাদরাসার ওযিফা ছিল এক হাজার টাকা, সেটা তো স্বাভাবিকভাবেই খরচ হয়ে যেত। আমি তখন ঢাকার হুজুরকে বিষয়টি বললাম। হুজুর আমার জন্য তৎকালীন ৪/৫ হাজার টাকা ঋণের ব্যবস্থা করে দিলেন। সে সময় আমার জন্য সেটা বিরাট ইহসান ছিল।

হজ্বের সফরে দুটি মুলাকাত

এক.

একবার হজ্বের সফরে মক্কা মুকাররমায় হুজুরের সঙ্গে দেখা। শামিয়ায়। গাজ্জার কাছে। বিভিন্ন কথা-বার্তার পর আমি হুজুরকে জিজ্ঞেস করলাম। হুজুর, কোথায় যাবেন?

বললেন, মদীনায়। বললাম, সামানপত্র কোথায়?

নিজের হাতের দিকে ইশারা করে বললেন, এই যে!

তাকিয়ে দেখি, হাতে একটি পলিথিনের ব্যাগ। পুরো হজ্বের সফরে এটিই হুজুরের সামানা!! জিজ্ঞাসা করলাম, খাওয়া-দাওয়া কোথায় করবেন?

খুব স্বাভাবিকভাবে বললেন, পথে করে নেব।

আমি অনুমতি চাইলাম, হুজুর, কিছু খাবার কিনে দিই?

বললেন, দাও।

আমি পাশের দোকান থেকে কিছু শুকনো খাবার কিনে হুজুরের হাতের ঐ ব্যাগে দিয়ে দিলাম।

দুই.

এটি আরেক হজ্বের সফরের ঘটনা। সেবার হুজুরের সাথে দেখা হল মক্কা মুকাররমায়; মিসফালায় যেতে যে রোড ঐ রোডের একদম শুরুতে; হারাম শরীফের কাছে। ফজরের নামাযের পর। কথা প্রসঙ্গে হুজুর আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোথায় আছ? বললাম, মিসফালায়। আমিও জিজ্ঞেস করলাম, হুজুর, আপনি কোথায়? বললেন, চলো, তোমাকে আমার বাসায় নিয়ে যাই। আজকে তুমি আমার সাথে নাস্তা করবে। আমি হুজুরের পেছনে পেছনে রওয়ানা হলাম। বর্তমানে যেখানে সুরম্য ক্লক টাওয়ার নির্মিত হয়েছে, সেখানটাতে তখন ছিল মক্কার প্রাচীন পাহাড়। হুজুর পাহাড়ের নিচে এক দোকান থেকে রুটি-ডাল কিনলেন। এরপর আমাকে নিয়ে পাহাড়ে চড়তে শুরু করলেন। উঠতে উঠতে পাহাড়ের অনেক উপরে উঠে গেছেন। আমি আর পারলাম না, জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় হুজুর আপনার বাসা? বললেন, আসো আমার সাথে। আমরা একদম পাহাড়ের চূড়ায় উঠে গেলাম। চূড়ায় কয়েকটি ঘর দেখতে পেলাম। হুজুর একটা ঘরে প্রবেশ করলেন। বললেন, এই যে আমার বাসা। আমি এখানে থাকি। বললাম, হুজুর আপনার কষ্ট হয় না? বললেন, এখানে তো তেমন আসা হয় না। দিনে একবার হয়তো আসা হয়। কোনো কোনো দিন একবারও আসা হয় না।

অথচ হুজুরের কত ছাত্র-শাগরিদ ওখানে আছে। একজনকে বললেই সে সৌভাগ্য মনে করে হুজুরের থাকা-খাওয়া সবকিছুর সুন্দর ব্যবস্থা করত। কিন্তু হুজুর কাউকে কিচ্ছু না জানিয়ে এভাবেই থেকেছেন। জীবনটা এভাবেই নির্মাণ করেছেন।

আমার শেষ মুলাকাত এবং হুযুরের চিরবিদায়

গওহরডাঙ্গায় গেলে চেষ্টা করতাম, হুজুরের সাথে দেখা করতে। হুজুরের সাথে সর্বশেষ মুলাকাত হয়েছে ইন্তেকালের এক মাসেরও কম সময় আগে। গওহরডাঙ্গা মাদরাসায় হুজুরের কামরায়। হুজুর তখন বেশ অসুস্থ। কাউকে চেনেন আবার কখনো চেনেন না। আমি হুজুরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। স্পষ্ট বুঝতে পারলাম না, হুজুর আমাকে চিনতে পারলেন কি না। কিন্তু হুজুরের কথা থেকে মনে হচ্ছিল, হুজুর আমাকে চিনেছেন।

বললেন, ‘আগে তো আপনার ওখানে অনেক যেতাম, এখন তো আর যাওয়া হয় না।বললেন, ‘আমি দুআর খুব মুহতাজ, আমার জন্য খুব দুআ করবেন।

এরপর গওহরডাঙ্গা মাদরাসার বার্ষিক মাহফিলের সময়ও আমি গওহরডাঙ্গায় ছিলাম; হুজুরের সাথে তখন আর দেখা করা হয়নি। শুনেছি, হুজুর হুইল চেয়ারে করে মাহফিলের ময়দান ঘুরে দেখেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, এত অসুস্থতা নিয়ে আপনি মাহফিলে যাবেন?

হুজুর বলেছেন, হাজার-হাজার, লাখ-লাখ মানুষ মাহফিলে এসেছে, আর আমি ঘরে বসে থাকব!

২ ডিসেম্বর শনিবার গওহরডাঙ্গার মাহফিলের দুআ হয়েছে। আর ৭ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার হুজুর আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।

হুজুরের ইন্তেকালের দিনও আমি গওহরডাঙ্গাতেই ছিলাম। সেদিন সকাল প্রায় সাড়ে এগারটা পর্যন্ত আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল। হুজুরের জানাযার নির্ধারিত সময় ছিল দুপুর দুইটা ত্রিশ মিনিট। জানাযায় অংশগ্রহণকারীর উপস্থিতি ছিল অনেক বেশি। আমার মনে হয় গওহরডাঙ্গার বার্ষিক মাহফিলের চেয়ে বেশি লোকের উপস্থিতি ছিল হুজুরের জানাযায়। জানাযার আগ থেকে আকাশ বারি বর্ষণ শুরু করে। মাশাআল্লাহ, বৃষ্টির মধ্যেই সকলে জানাযার নামায আদায় করেন। আমিও ছিলাম সেই বৃষ্টিস্নাত সৌভাগ্যবানদের মধ্যে এক নগণ্যজন।

জানাযার আগে হুজুরের মেজো জামাতা মাওলানা জাফর আহমাদ সাহেব বললেন, ‘ঢাকার হুজুর অনেক বার আমাকে বলেছেন, আমি মারা গেলে তুমি আমার জানাযা পড়াবা। পরিবারের পক্ষ থেকেও সেরকম মাশওয়ারা। কিন্তু আমি বলি, হুজুর ছিলেন ছদর ছাহেব রাহ.-এর আশেক। তাঁর মহব্বতে তিনি আজীবন গওহরডাঙ্গায় থেকেছেন। ইন্তেকালের আগে তো ঢাকায় যেতেই চাইতেন না। এই আশঙ্কায় যে, ‘যদি আমার মৃত্যু ঢাকায় হয়ে যায় আর ঢাকাতেই আমার কবর হয়, তাহলে তো গওহরডাঙ্গায় আমার থাকা হল না!হুজুরের এই মহব্বতের ভিত্তিতে আমি বলি যে, ছদর ছাহেবের ছাহেবযাদা এখানে উপস্থিত। তিনি গওহরডাঙ্গা মাদরাসারও মুহতামিম। আমি হযরতকে অনুরোধ করব, তিনিই হুজুরের জানাযা পড়াবেন।

সেভাবেই হয়। মুফতী রুহুল আমীন ছাহেব জানাযার ইমামতি করেন। এরপর মাকবারায়ে শামছিয়ায় হুজুরের দাফন হয়। আল্লাহ তাআলার কী সুন্দর আয়োজন! জীবদ্দশায় যে মানুষ ছিল তাঁর নয়ন-তারা, যে ছিল তাঁর হৃদয়-রাজ্যের রাজপুত্তুর, সেই ছদর ছাহেবের পাশেই রচিত হল তাঁর শেষ ঠিকানা। এভাবেই আল্লাহ হুজুরের শেষ আরজিটিও কবুল করলেন।

হে আল্লাহ, তুমি হুজুরের কবরকে জান্নাতের টুকরা বানিয়ে দাও। আমাদেরকে বানাও তাঁর উত্তম ওয়ারিশদের অন্তর্ভুক্ত। 

 

 

advertisement