রবিউল আউয়াল ১৪৪৫   ||   অক্টোবর ২০২৩

মিথ্যা : ভারসাম্যহীন জীবনের দুয়ার

খালিদ সাইফুল্লাহ

যেসমস্ত গোনাহকে সব গোনাহের মূল বলা যায়- মিথ্যা সেগুলোর অন্যতম। কারণ মিথ্যা এমন  গোনাহ, যা আরো অনেক গোনাহকে অনিবার্য করে তোলে। এবং মিথ্যাবাদীকে নতুন নতুন মিথ্যার সাথে জড়িয়ে দেয়।

একবার মিথ্যা বললে সে মিথ্যা ঢাকার জন্য আরো দশটি মিথ্যা বলতে হয়। আরো দশটি এমন মিথ্যায় সে জড়িয়ে যায়, যেগুলোর ভিত্তি ঐ প্রথম মিথ্যা। এমনকি ঐ একটি মিথ্যা সকল কাজ এলোমেলো করে দেয়; সব কাজের ভারসাম্য নষ্ট করে ফেলে।

মিথ্যার ক্ষতি অনেক ব্যাপক। মিথ্যা বলার কারণে দুনিয়ায় যেসমস্ত ক্ষতি আমরা দেখতে পাই তার মধ্যে অন্যতম হল, মিথ্যা ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করে।

কারণ মিথ্যা তো সেই কাজের নাম, যা করা হয়নি, সেই কথার নাম, যা বলা হয়নি; অথচ দাবি করা হচ্ছে যে, কাজটা হয়েছে, অথবা কথাটা বলা হয়েছে। এভাবে শ্রোতার কাছে মিথ্যা এমন এক বস্তু উপস্থিত করে, যার কোনো বাস্তবতা নেই। অথচ শ্রোতা সেটাকে সত্য বলে মেনে নেয়। তার মাথায় সেই না ঘটা জিনিসটাই, না বলা কথাটাই ঘটেছে, করেছে কিংবা বলা হয়েছে, করা হয়েছে হিসেবে গেঁথে যায়। এভাবেই ভারসাম্যহীনতার সূত্রপাত ঘটে।

উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টা খোলাসা করা যাক। একটা ছেলে বাসা থেকে বের হয়েছে স্কুলে যাবে। বাসা থেকে বাবা-মা তা-ই জানে। কিন্তু সে স্কুলে না গিয়ে এক আত্মীয়ের বাসায় রওয়ানা হল। স্কুলে ফোন করে বলল, স্যার, আজ স্কুলে আসতে পারব না, আমি অসুস্থ। স্যার ধরে নিলেন, অসুস্থতার কারণে সে বাসায় আছে। ওদিকে বাসার মানুষ জানে, সে স্কুলে গেছে। অথচ সে গেল তৃতীয় আরেকটি স্থানে। আত্মীয়দের পক্ষ থেকে জিজ্ঞাসা করা হল, কী খবর? তোমার স্কুল নেই! সে জানাল, না আজকে আমার স্কুল বন্ধ।

লক্ষ করে দেখুন, এখানে কতগুলো ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হচ্ছে। কোনোভাবে যদি স্যার জানতে পারে, সে অসুস্থ নয়, বরং সে স্কুলের নাম করে বাসা থেকে বের হয়ে আত্মীয়ের বাসায় গিয়েছে। অথবা অত্মীয় জানল যে, সে দুইটা জায়গায় মিথ্যা বলে এখানে এসেছে; তার এসময় স্কুলে থাকার কথা ছিল! এই সত্য ব্যাপারটা জানাজানি হলে তখন অবস্থা কী দাঁড়াবে?

আমাদের সমাজে কিন্তু এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে। এভাবেই সমাজ দিনদিন অস্থিতিশীল হচ্ছে। মিথ্যার বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়ছে মানুষ। আমাদের একেকটি মিথ্যা একেকটি অস্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টির জন্য দায়ী। এভাবে মিথ্যা, অভিনয়, শঠতা দিয়ে ভরে যাচ্ছে সমাজ। ঘরে বাইরে সব জায়গায় আমরা বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছি। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছি না।

দুর্নীতি যেমন একটা দেশের অর্থনীতিকে একেবারে নিঃশেষ করে দেয়, তেমনি মিথ্যা। মিথ্যা একটা সমাজকে অন্তঃসারশূন্য করে ফেলে। বাহ্যত মনে হবে, সবই তো ঠিক আছে। কিন্তু বাস্তবতা হল, কিছুই ঠিক নেই; এক ভারসাম্যহীন জীবন ও সমাজ।

মিথ্যা বাহ্যত আপনাকে তৎক্ষণাৎ বাঁচিয়ে দেবে; কিন্তু বাস্তবতা হল, এই এক মিথ্যা আপনাকে অনেক বিপদে ফেলবে, আপনাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেবে। প্রবাদ রয়েছে- الكذب يهلكমিথ্যা ধ্বংস করে। আপনি একবার মিথ্যা বলে বাঁচলেন। আরেকবার বাঁচলেন। কিন্তু দিনশেষে আপনি ধরা পড়বেন। আর আখেরাতের পাকড়াও তো আছেই।

মিথ্যা আপনাকে পাপ কাজটি পুনরায় করতে উদ্বুদ্ধ করে। আপনি একটি কাজ করলেন। মিথ্যা বলে পার পেলেন। তখন নফস আপনাকে প্ররোচনা দেবে- কই! কিছুই তো হল না। যাও আবার ঐ কাজে লিপ্ত হও। পার পেয়ে যাবে। এভাবে এক মিথ্যা আপনাকে বহু পাপের দিকে নিয়ে যাবে এবং অবশেষে জাহান্নামে নিয়ে ফেলবে। হাদীস শরীফে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে সতর্ক করে সেকথাই বলেছেন। ইরশাদ হয়েছে-

إِيَّاكُمْ وَالْكَذِبَ، فَإِنَّ الْكَذِبَ يَهْدِي إِلَى الْفُجُورِ، وَإِنَّ الْفُجُورَ يَهْدِي إِلَى النَّارِ، وَإِنَّ الرَّجُلَ لَيَكْذِبُ وَيَتَحَرَّى الْكَذِبَ حَتَّى يُكْتَبَ عِنْدَ اللهِ كَذَّابًا.

তোমরা মিথ্যা থেকে দূরে থাক। কেননা মিথ্যা পাপাচারের পথে পরিচালিত করে। আর পাপাচার জাহান্নামে নিয়ে ফেলে। ব্যক্তি মিথ্যা বলে ও মিথ্যার অন্বেষায় থাকে, এভাবে একসময় আল্লাহর কাছে সে চরম মিথ্যুক হিসেবে লিখিত হয়ে যায়। -সুনানে আবু দাউদহাদীস ৪৯৮৯

মিথ্যা আপনাকে মিছে তৃপ্তি ও প্রাপ্তির ঢেকুর তুলতে সাহায্য করবে। মনে হবে আপনি পেয়েছেন; কিন্তু বাস্তবে আপনি খুইয়েছেন, আপনি হারিয়েছেন।

মিথ্যা যেমন অনেক গোনাহের মূল, গোনাহের পথে নিয়ে যায়; এমনকি জাহান্নামে নিয়ে ফেলে। ঠিক এর উল্টো হল সত্য। তা কল্যাণের পথ দেখায়, কল্যাণের পথে পরিচালিত করে এবং জান্নাতে পৌঁছে দেয়। উপরোক্ত হাদীসেই নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

وَعَلَيْكُمْ بِالصِّدْقِ، فَإِنَّ الصِّدْقَ يَهْدِي إِلَى الْبِرِّ، وَإِنَّ الْبِرَّ يَهْدِي إِلَى الْجَنَّةِ، وَإِنَّ الرَّجُلَ لَيَصْدُقُ وَيَتَحَرَّى الصِّدْقَ حَتَّى يُكْتَبَ عِنْدَ اللهِ صِدِّيقًا.

তোমরা সত্যকে অবলম্বন কর। কারণ সত্যবাদিতা ভালো কাজে উপনীত করে। আর ভালো কাজ উপনীত করে জান্নাতে। মানুষ সত্য বলে ও সত্যবাদিতার অন্বেষায় থাকে, একপর্যায়ে সে আল্লাহর কাছে সত্যবাদী হিসেবে লিখিত হয়ে যায়। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৯৮৯

আসুন সর্বদা সত্য বলি। সত্যের কারণে আলাদা এক সাহস, ভিন্ন রকম এক মনোবল লাভ করব। যা প্রতিটি কাজে আমাকে প্রফুল্লতা দান করেবে। ভারসাম্যপূর্ণ এক সুন্দর জীবন দান করবে। আমাকে পরিচালিত করবে জান্নাতের পথে। 

 

 

advertisement