মুহাররম ১৪৪৫   ||   আগস্ট ২০২৩

মুহাররম আশুরা ও হিজরী নববর্ষ : কিছু দিক কিছু বিষয়

মাওলানা মুহাম্মাদ তাওহীদুল ইসলাম তায়্যিব

মুহাররম হল হিজরী বর্ষের প্রথম মাস। এ মাস থেকেই নতুন হিজরী বছরের গণনা শুরু হয়; শেষ হয় যিলহজে¦

হিজরীবর্ষ হিসাব করা হয় চাঁদকে কেন্দ্র করে। এক চাঁদের উদয়ে মাস শুরু হয় আরেক চাঁদের উদয়ে হয় সমাপ্তি। এভাবে ১২টি চাঁদের উদয়াস্তে বারোটি মাস গণনা করা হয়। বারো মাসে পূর্ণ হয় বছর।

ইসলামপূর্ব যুগেও চাঁদকে কেন্দ্র করে দিন, মাস ও বছর গণনার প্রচলন ছিল। ইসলাম সেই পদ্ধতিকে বহাল রেখেছে। রমযানের রোযা, হজ¦, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা, আইয়ামে তাশরীক, ফযীলতপূর্ণ বিভিন্ন দিবস-রজনীসহ ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিধান চান্দ্রবর্ষের হিসাবে নির্ধারিত হয়।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তারিখ গণনার ক্ষেত্রে চাঁদ অত্যন্ত সহজ ও বড় একটি মাধ্যম। পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের মানুষ শিক্ষিত-অশিক্ষিত, গ্রামবাসী-শহরবাসী এবং পাহাড়-পর্বত, বন-জঙ্গল, নদী-সাগর ও জনমানবহীন দ্বীপে অবস্থানকারী ব্যক্তিও চাঁদের উদয়াস্ত ও বাড়া-কমা দেখে দিন-তারিখ হিসাব করতে পারে। নিঃসন্দেহে এটা আল্লাহ রাব্বুর আলামীনের অনেক বড় অনুগ্রহ এবং ইসলামী জীবন ও শরয়ী বিধি-বিধানের গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশিষ্ট্য।

কুরআন মাজীদেও চাঁদকে দিন-তারিখ ও সময় হিসাবের মাধ্যম হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন

يَسْـَٔلُوْنَكَ عَنِ الْاَهِلَّةِ   قُلْ هِيَ مَوَاقِيْتُ لِلنَّاسِ وَ الْحَجِّ.

তারা আপনাকে নতুন চাঁদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। আপনি বলুন, এটা মানুষের (বিভিন্ন কাজ-কর্মের) এবং হজ্বের সময় নির্ধারক। সূরা বাকারা (২) : ১৮৯

অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে

وَّ قَدَّرَهٗ مَنَازِلَ لِتَعْلَمُوْا عَدَدَ السِّنِيْنَ وَ الْحِسَابَ .

আর (আল্লাহ) তার জন্য নির্ধারণ করেছেন মনযিলসমূহ, যাতে তোমরা বছরের গণনা ও (মাসসমূহের) হিসাব জানতে পার। সূরা ইউনুস (১০) : ৫

সৌরবর্ষ

সময় ও দিন-তারিখ হিসাবের আরেকটি মাধ্যম হল সূর্য। এখানে সূর্যোদয়ের মাধ্যমে দিন শুরু হয়; সূর্যাস্তের মাধ্যমে হয় রাত্রি। এভাবে সময়ের হিসাব করা হয়। তবে এ হিসাব সৌরবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিদ্যায় পারদর্শী হওয়া ছাড়া নিজে নিজে করা সম্ভব নয়। আর সেজন্যই ইসলামী শরীয়ত সৌরবর্ষ রেখে চান্দ্রবর্ষকে বিধি-বিধান পালনের মাধ্যম বানিয়েছে। কারণ ইসলাম সর্বযুগের, সব অঞ্চলের, সকল শ্রেণি, পেশা, গোত্র, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য। তাই সময় ও তারিখ গণনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে সহজ ও সর্বজনীন পদ্ধতিটি নির্বাচন করাই ছিল অধিক সঙ্গত।

তবে চাঁদ যেমন আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি, সূর্যও আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি। এবং আল্লাহ তাআলাই উভয়টিকে সময় নির্ণয়ের মাধ্যম বানিয়েছেন।

সূর্য সময় নির্ণয়ের মাধ্যম হওয়ার প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন

وَ جَعَلْنَا الَّيْلَ وَ النَّهَارَ اٰيَتَيْنِ فَمَحَوْنَاۤ اٰيَةَ الَّيْلِ وَ جَعَلْنَاۤ اٰيَةَ النَّهَارِ مُبْصِرَةً لِّتَبْتَغُوْا فَضْلًا مِّنْ رَّبِّكُمْ وَ لِتَعْلَمُوْا عَدَدَ السِّنِيْنَ وَ الْحِسَابَ .

আমি রাত ও দিনকে দুটি নিদর্শন বানিয়েছি। অতঃপর রাতের নিদর্শনকে অপসারিত করেছি আর দিনের নিদর্শনকে করেছি আলোকিত, যাতে তোমরা নিজ প্রতিপালকের অনুগ্রহ সন্ধান করতে পার এবং জানতে পার বছরের গণনা ও (মাসের) হিসাব । সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ১২

নিঃসন্দেহে চাঁদ-সূর্য উভয়টিই মানুষের বহু কল্যাণে নিয়োজিত, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দুটি মহাদান। এগুলোর জন্য স্বতন্ত্রভাবে আল্লাহ তাআলার শোকর আদায় করা উচিত। কুরআন মাজীদে সেদিকেও ইশারা করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে

وَ هُوَ الَّذِيْ جَعَلَ الَّيْلَ وَ النَّهَارَ خِلْفَةً لِّمَنْ اَرَادَ اَنْ يَّذَّكَّرَ اَوْ اَرَادَ شُكُوْرًا  .

এবং তিনিই সেই সত্তা, যিনি রাত ও দিনকে পরস্পরের অনুগামী করে সৃষ্টি করেছেন সেই ব্যক্তির জন্য, যে উপদেশ গ্রহণের ইচ্ছা রাখে কিংবা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে চায়। সূরা ফুরকান (২৫) : ৬২

اَللّهُمَّ لَكَ الْحَمْدُ كُلُّهُ وَلَكَ الشُّكْرُ كُلُّهُ.

সূর্যকেন্দ্রিক সময় গণনার দুটি হিসাব ও তারিখ আমাদের সমাজে ব্যাপকভাবে প্রচলিত। একটি হল, ঈসায়ীবর্ষ। আরেকটি, বাংলাবর্ষ। এই দুই হিসাব থেকেও আমরা আমাদের দিনযাপনের বহু ক্ষেত্রে উপকৃত হয়ে থাকি।

বছরে ১২টি মাস এবং সম্মানিত মাস চারটি

হিজরী বর্ষ, ঈসায়ী বর্ষ, বাংলাবর্ষ প্রত্যেকটিতেই মাসের সংখ্যা ১২টি। কুরআন মাজীদেও এসেছে বারো মাসের কথা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন

اِنَّ عِدَّةَ الشُّهُوْرِ عِنْدَ اللهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِيْ كِتٰبِ اللهِ يَوْمَ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضَ مِنْهَاۤ اَرْبَعَةٌ حُرُمٌ  ذٰلِكَ الدِّيْنُ الْقَيِّمُ  فَلَا تَظْلِمُوْا فِيْهِنَّ اَنْفُسَكُمْ.

নিশ্চয় আল্লাহর নিকট আল্লাহর বিধানে মাসের সংখ্যা বারো সেই দিন থেকে, যেদিন তিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। এর মধ্যে চারটি মাস (বিশেষ) মর্যাদাপূর্ণ। এ-ই সরল দ্বীন। সুতরাং তোমরা এ মাসগুলোতে নিজেদের প্রতি জুলুম করো না। সূরা তাওবা (৯) : ৩৬

উক্ত আয়াতে চারটি মাসকে বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। সেই চার মাস কোন্গুলো তার বিবরণ এসেছে হাদীস শরীফে। হযরত আবু বাকরা রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন

السَّنَةُ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا، مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ، ثَلَاثٌ مُتَوَالِيَاتٌ: ذُو الْقَعْدَةِ وَذُو الْحِجَّةِ وَالْمُحَرَّمُ، وَرَجَبُ مُضَرَ الَّذِي بَيْنَ جُمَادَى وَشَعْبَانَ.

বারো মাসে এক বছর। এর মধ্য থেকে চারটি মাস সম্মানিত। তিনটি ধারাবাহিক যিলকদ, যিলহজ¦, মুহাররম। আরেকটি হল রজব, যা জুমাদাল আখিরাহ ও শাবানের মাঝের মাস। সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৬৬২; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৬৭৯

এই সম্মানিত চার মাসের ব্যাপারে কুরআনী নির্দেশনা হল 

তোমরা এ মাসগুলোতে নিজেদের প্রতি জুলুম করো না।

অর্থাৎ এ মাসসমূহে বিশেষভাবে গোনাহ থেকে বেঁচে থাক। কারণ আল্লাহ তাআলার নাফরমানী করা এবং পাপাচারে লিপ্ত হওয়াই নিজের প্রতি কৃত বান্দার সবচে বড় জুলুম।

আল্লাহর নাফরমানী ও পাপাচার সবসময়ই গর্হিত এবং পরিহারযোগ্য। তার পরও এই দিনগুলোতে গোনাহ থেকে বাঁচতে বিশেষভাবে নির্দেশ করা হয়েছে এজন্য যে, ইবাদত ও নেক আমলের এবং কল্যাণ ও বরকতের এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে যে আল্লাহর নাফরমানী করবে, সে হবে অনেক বড় হতভাগা!

হাদীসে সম্মানিত এই মাসগুলোতে গোনাহ পরিত্যাগের ব্যাপারে যেমন উৎসাহিত করা হয়েছে, তেমনি উৎসাহিত করা হয়েছে বেশি পরিমাণে তাওবা-ইসতিগফার ও বিশেষ কিছু নেক আমলের প্রতি।

এ নিবন্ধে আমরা শুধু মুহাররম মাসের কিছু বিশেষ আমলের কথা উল্লেখ করছি।

মুহাররম মাসের আমল

সাহাবী আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন

أَفْضَلُ الصِّيَامِ، بَعْدَ رَمَضَانَ، شَهْرُ اللهِ الْمُحَرَّمُ. وَأَفْضَلُ الصَّلَاةِ، بَعْدَ الْفَرِيضَةِ، صَلَاةُ اللَّيْلِ.

রমযানের পর সবচে উত্তম রোযা হল আল্লাহর মাস মুহাররমের রোযা। আর ফরয নামাযের পর সবচে উত্তম নামায হল রাতের নামায (অর্থাৎ তাহাজ্জুদের নামায)। সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৬৩

এই হাদীসে দুটি বিষয় লক্ষণীয় :

এক. মুহাররমকে বলা হয়েছে শাহরুল্লাহ বা আল্লাহর মাস।

নিঃসন্দেহে সকল মাসই আল্লাহর মাস। তারপরও একে বিশেষভাবে আল্লাহর মাস বলে এর গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য এবং বৈশিষ্ট্য ও বিশেষ মর্যাদার প্রতি ইশারা করা হয়েছে। যেমন, দুনিয়ার সকল মসজিদই আল্লাহর ঘর। এরপরও কাবা ঘরকে বাইতুল্লাহ বা আল্লাহর ঘর বলে তার বিশেষ সম্মান ও মর্যাদার দিকে ইশারা করা হয়।

দুই. রমযানের মতো মহান ও মহিমান্বিত মাসের পর এ মাসের রোযাই সবচেয়ে উত্তম।

অতএব এ মাসের সম্মান রক্ষা করা এবং তা থেকে বিশেষভাবে উপকৃত হওয়ার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য একটি মাধ্যম হল, এই দিনগুলোতে অধিক পরিমাণে রোযা রাখা।

বিশেষ আমল তাওবা ও ইসতিগফার

এ মাসের গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল হল, তাওবা ও ইসতিগফার।

কোনো সন্দেহ নেই তাওবা-ইসতিগফার মুমিনের সব সময়ের আমল। তবে এ মাসে তওবা-ইসতিগফারের বিশেষ গুরুত্ব ও তাৎপর্য রয়েছে। কারণ হাদীস শরীফে এসেছে, আল্লাহ তাআলা এ মাসে অনেক মানুষের তাওবা কবুল করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অনেক মানুষের তাওবা কবুল করবেন।

মুসনাদে আহমাদ ও জামে তিরমিযীসহ হাদীসের অনেক কিতাবে বর্ণিত হয়েছে, এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি আমাকে রমযানের পর আর কোন্ মাসে রোযা রাখার নির্দেশ দেন?

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন

إِنْ كُنْتَ صَائِمًا بَعْدَ شَهْرِ رَمَضَانَ فَصُمُ المُحَرَّمَ، فَإِنَّهُ شَهْرُ اللهِ، فِيهِ يَوْمٌ تَابَ فِيهِ عَلَى قَوْمٍ، وَيَتُوبُ فِيهِ عَلَى قَوْمٍ آخَرِينَ.

قال الترمذي : هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ غَرِيبٌ

তুমি যদি রমযানের পর আরও কোনো মাসে রোযা রাখতে চাও তাহলে মুহাররমে রোযা রাখ। কেননা সেটি আল্লাহর মাস। তাতে এমন একটি দিন আছে, যেদিন আল্লাহ তাআলা অনেক মানুষের তাওবা কবুল করেছেন। ভবিষ্যতেও সেদিন আরও মানুষের তাওবা কবুল করবেন। জামে তিরমিযী, হাদীস ৭৫১; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৩২২

হাদীস ব্যাখ্যাতাদের মতে, এখানে যেই দিনের দিকে ইশারা করা হয়েছে সেটি খুব সম্ভব মুহাররমের দশ তারিখ বা আশুরার দিন। ) দ্রষ্টব্য : লাতাইফুল মাআরিফ, পৃ. ১৩৯১৪০

তবে এ মাসের প্রতিটি দিনেই তাওবা ও ইসতিগফারের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

মুহাররমের দশ তারিখ বা আশুরার দিন

মুহাররমের দশ তারিখকে বলা হয় ইয়াওমু আশুরা বা আশুরার দিন। হাদীস শরীফে এ দিনের অনেক গুরুত্ব, তাৎপর্য ও ফযীলতের কথা বর্ণিত হয়েছে।

উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন

كَانَ يَوْمُ عَاشُورَاءَ تَصُومُهُ قُرَيْشٌ فِي الْجَاهِلِيَّةِ، وَكَانَ رَسُولُ اللهِ صَلّى الله عَلَيْه وَسَلَّم يَصُومُهُ، فَلَمَّا قَدِمَ الْمَدِينَةَ صَامَهُ وَأَمَرَ بِصِيَامِهِ، فَلَمَّا فُرِضَ رَمَضَانُ تَرَكَ يَوْمَ عَاشُورَاءَ، فَمَنْ شَاءَ صَامَهُ وَمَنْ شَاءَ تَرَكَهُ.

জাহেলী যুগে কুরাইশরা আশুরার দিন রোযা রাখত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও এ দিনে রোযা রাখতেন। (কারণ কুরাইশদের এই অভ্যাস মূলত শরীয়তসম্মত ছিল) পরবর্তীতে যখন তিনি মদীনায় এলেন (তখনও) নিজে রোযা রাখতেন, অন্যদেরকেও রোযা রাখার নির্দেশ দিতেন। এরপর যখন রমযানের রোযা ফরয হল তখন আশুরা (র রোযার ব্যাপারে আগের মতো গুরুত্ব দেওয়া) ছেড়ে দিলেন। তখন যার ইচ্ছা এ দিনে রোযা রাখত, যার ইচ্ছা রাখত না। সহীহ বুখারী, হাদীস ২০০২

এখান থেকে জানা গেল জাহেলী যুগেও আশুরার দিনের গুরুত্ব ছিল। এ দিনে মানুষ রোযা রাখত। এক বর্ণনায় আছে, এ দিনে তারা কাবা শরীফের গায়ে গিলাফ জড়াতো। সহীহ বুখারী, হাদীস ১৫৯২)

জানা গেল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মক্কায় ছিলেন তখনও এই দিন রোযা রাখতেন। এরপর যখন মদীনায় হিজরত করলেন তখন নিজেও রোযা রাখতেন, অন্যদেরকেও রোযা রাখার নির্দেশ দিতেন।

তবে রমযানের রোযা ফরয হওয়ার পর আশুরার রোযা নফল হিসেবে নির্ধারিত হয়। (দ্রষ্টব্য : শরহু মুসলিম, ইমাম নববী ৮/৪)

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় হিজরত করার আগে সেখানের লোকেরাও এই দিনে রোযা রাখত।

সাহাবী ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় এসে দেখলেন, ইহুদীরা আশুরার দিন রোযা রাখে। নবীজী তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা এ দিন রোযা রাখ কেন?

তারা বলল

هَذَا يَوْمٌ عَظِيمٌ. أَنْجَى اللهُ فِيهِ مُوسَى وَقَوْمَهُ. وَغَرَّقَ فِرْعَوْنَ وَقَوْمَهُ. فَصَامَهُ مُوسَى شُكْرًا. فَنَحْنُ نَصُومُهُ.

এটি একটি মহান দিন। এই দিনে আল্লাহ তাআলা মূসা আ. ও তাঁর সম্প্রদায়কে  (ফেরাউনের কবল থেকে) মুক্তি দিয়েছেন। আর ফেরাউনকে তার দলবলসহ (দরিয়ায়) ডুবিয়ে দিয়েছেন। তাই মূসা আ. এইদিন শুকরিয়াস্বরপ রোযা রাখতেন। সেজন্য আমরাও রোযা রাখি।

একথা শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন

فَنَحْنُ أَحَقُّ وَأَوْلَى بِمُوسَى مِنْكُمْ.

মূসা আ.-এর ক্ষেত্রে তো আমরা তোমাদের চেয়ে অধিক হকদার এবং আমরা তাঁর বেশি  নৈকট্যবর্তী।

এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও রোযা রাখলেন, অন্যদেরকেও রোযা রাখতে বললেন। [নবীজী তো আগে থেকেই রোযা রাখতেন। মদীনায় এসে সাহাবীদেরকেও রোযা রাখতে বলেছেন। (দ্র. লাতাইফুল মাআরিফ, পৃ. ১২৩)] সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৩০; সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৩৯৭, ৩৯৪৩

উপরিউক্ত বর্ণনাগুলো থেকে জানা যায়

ক. প্রাচীন যুগ থেকেই এ দিনের অনেক গুরুত্ব ছিল এবং ইসলামও সেই গুরুত্ব বজায় রেখেছে।

খ. এই দিনকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শাহরুল্লাহ বা আল্লাহর মাস বলে আখ্যায়িত করেছেন।

গ. এই দিনে আল্লাহ তাআলা অনেক মানুষকে ক্ষমা করেছেন এবং তাদের তাওবা কবুল করেছেন। ভবিষ্যতেও অনেক মানুষের তাওবা কবুল করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

ঘ. এই দিনে ভয়ংকর জালিমের কবল থেকে আল্লাহ তাআলা হযরত মূসা আ. ও তাঁর উম্মতকে মুক্তি দিয়েছেন এবং সেই জালিমকে তার দলবলসহ ডুবিয়ে শাস্তি দিয়েছেন।

ঙ. নবী হযরত মূসা আ. এই দিনকে কৃতজ্ঞতা আদায়ের দিন হিসাবে গ্রহণ করেছেন এবং রোযা পালনের মাধ্যমে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।

চ. আমাদের নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও মাক্কী জীবনে এই দিন রোযা রেখেছন এবং মাদানী জীবনে নিজে যেমন রোযা রেখেছেন, অন্যদেরকেও রোযা রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন।

তাছাড়া রমযানের রোযা ফরয হওয়ার আগে ইসলামে এই দিনের রোযা ফরয ছিল। রমযানের রোযা ফরয হওয়ার পর এই দিনের রোযা নফল ও মুস্তাহাব হিসেবে নির্ধারিত হয়েছে। আততামহীদ, ইবনে আবদুল বার ৭/২০৪-২০৭; আলমিনহাজ, ইমাম নববী ৮/৪

হাদীস শরীফে এ দিনের রোযার নির্দিষ্ট কিছু ফযীলতের কথাও বর্ণিত হয়েছে। নিম্নে তা পেশ করা হল।

আশুরার রোযার ফযীলত

সাহাবী আবু কাতাদা রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন

صِيَامُ يَوْمِ عَاشُورَاءَ، أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُّكَفَّرَ السَّنَةَ الَّتِيْ قَبْلَه.

আশুরার দিনের রোযা সম্পর্কে আমি আল্লাহ তাআলার কাছে আশা রাখি, (এর মাধ্যমে) তিনি বিগত এক বছরের গোনাহ ক্ষমা করে দেবেন। সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৬২

তবে আশুরার রোযার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হল, আশুরার দিনের সাথে তার আগের দিন বা পরের দিন অর্থাৎ ৯ বা ১১ মুহাররমও রোযা রাখা উচিত। কারণ আশুরার দিনকে আহলে কিতাবও সম্মান করে। তারাও এ দিনে রোযা রাখে। তাই তাদের সঙ্গে মুসলমানদের আমলের পার্থক্য স্পষ্ট করা জরুরি একটি বিষয়।

সেজন্য সাহাবী হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলতেন

صُومُوا التَّاسِعَ وَالعَاشِرَ وَخَالِفُوا اليَهُودَ.

তোমরা ৯ ও ১০ তারিখ রোযা রাখ এবং ইহুদীদের ব্যতিক্রম কর। জামে তিরমিযী, হাদীস ৭৫৫; শুআবুল ঈমান বাইহাকী, হাদীস ৩৭৮৮

এখানে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. যে নির্দেশনা দিয়েছেন তা একটি মারফূ হাদীস দ্বারাও প্রমাণিত। (দ্রষ্টব্য : সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৩৪; শরহু মুসলিম, ইমাম নববী ৮১২-৮১৩; ফাতহুল বারী ৪/২৮৮-২৮৯)

৯ তারিখে রোযা না রাখা হলে মূল বিষয় অর্থাৎ ইহুদী-নাসারাদের সাথে মুসলমানদের আমলের পার্থক্য স্পষ্ট করার জন্য ১১ তারিখেও রোযা রাখা যায়।

যেমন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন

صُومُوا يَوْمَ عَاشُورَاءَ، وَخَالِفُوا الْيَهُودَ؛ صُومُوا قَبْلَهُ يَوْمًا، أَوْ بَعْدَهُ يَوْمًا.

তোমরা আশুরার রোযা রাখ এবং ইহুদীদের ব্যতিক্রম কর। তার (আশুরার) আগে এক দিন কিংবা পরে এক দিন রোযা রাখ। [অর্থাৎ আশুরার দিনের সাথে আরেকদিন।] সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস ২০৯৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২১৫৪ 

(وفي سنده شيء من الضعف)

এসকল বিষয়ে আরও বিস্তারিত ও সারগর্ভ আলোচনার জন্য দেখা যেতে পারে ইমাম ইবনে রজব হাম্বলী রাহ.-এর কিতাব লাতাইফুল মাআরিফ ফীমা লিমাওয়াসিমিল আমি মিনাল ওয়াযাইফ, পৃষ্ঠা : ১২২-১৪৯, দারু ইবনে খুযাইমা, রিয়াদ

একটি বছরের শুরু, একটি বছরের সমাপ্তি

নিঃসন্দেহে মুহাররম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তাৎপর্যপূণ ও ফযীলতপূর্ণ একটি মাস। এর পাশাপাশি মুহাররম একটি নতুন বছরের শুরু এবং একটি দীর্ঘ বছরের সমাপ্তি। শুরু ও সমাপ্তির আবেদন মানবজীবনে অনেক গভীর। একটি জীবনের শুরু ও সমাপ্তি যেমন গভীর তাৎপর্য বহন করে, তেমনি একটি বছর, একটি মাস, একটি সপ্তাহ, একটি দিন এবং মুমিনের প্রতিটি কাজের শুরু ও সমাপ্তির মাঝে থাকে গভীর অর্থ ও তাৎপর্য। সবাই চায় এবং সবার চাওয়া উচিত পুরো জীবন কিংবা অন্তত সকল শুরু ও সমাপ্তি যেন হয় সুন্দর, নির্মল ও পবিত্র।

শুরু ও সমাপ্তির ক্ষেত্রে ইসলামী চেতনার কিছুটা আন্দায পাওয়া যায় হাদীসে বর্ণিত সকাল-সন্ধ্যার বিভিন্ন দুআর প্রতি খেয়াল করলে। তাছাড়া সকল কাজ আল্লাহর নাম নিয়ে শুরু করা এবং কাজ শেষে আল্লাহর শোকর ও ইসতিগফার করার অর্থ সম্বলিত বিভিন্ন দুআর বাক্যগুলো দেখলে বিষয়টি আরও গভীরভাবে উপলব্ধি হয়। সে বিষয়ে আজ এখানে দীর্ঘ আলোচনার অবকাশ নেই। তবে নতুন মাসের চাঁদ দেখে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেসকল দুআ পড়েছেন তন্মধ্য থেকে একটি দুআ এখানে উল্লেখ করছি।

সাহাবী তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নতুন চাঁদ দেখে এই দুআ পড়তেন

اللّهُمَّ أَهِلَّهُ عَلَيْنَا بِاليُمْنِ وَالإِيمَانِ وَالسَّلَامَةِ وَالإِسْلَامِ، رَبِّي وَرَبُّكَ اللهُ.

হে আল্লাহ! এই চাঁদকে আপনি আমাদের জন্য বরকত ও ঈমান এবং শান্তি ও ইসলামের সাথে উদিত করুন। (হে চাঁদ!) আমার ও তোমার রব আল্লাহ। জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৪৫১; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৩৯৭

এ দুআটি যদি মুহাররমের চাঁদ দেখে পড়া হয় তাহলে নতুন মাসের সাথে নতুন বছরের জন্যও দুআ করা হবে। তবে নতুন বছরের শুরুতে আরেকটি দুআ পড়ার কথা সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে। সেই দুআ সম্পর্কে সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে হিশাম রা. বলেন

كان أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم يتعلمون هذا الدعاء كما يتعلمون القرآن إذا دخل الشهر أو السنة.

অর্থাৎ নতুন মাস বা বছর শুরু হলে সাহাবায়ে কেরাম এ দুআটি এমনভাবে (গুরুত্ব দিয়ে) শিখতেন, যেভাবে কুরআনুল কারীম শেখেন।

দুআটি এই

اللّهُمَّ أَدْخِلْهُ عَلَيْنَا بِالأَمْنِ وَالإِيمَانِ وَالسَّلَامَةِ وَالإِسْلَامِ، وَجِوَارٍ مِّنَ الشَّيْطَانِ، وَرِضْوَانٍ مِّنَ الرَّحْمنِ.

হে আল্লাহ! আপনি আমাদের মাঝে এ মাস/বছরের আগমন ঘটান নিরাপত্তা ও ঈমান, শান্তি ও ইসলামের সাথে; এবং শয়তান থেকে সুরক্ষা ও দয়াময় আল্লাহর সন্তুষ্টির সাথে। মুজামুস সাহাবাহ ৩/৫৪৩; আলমুজামুল আওসাত তাবারানী, বর্ণনা ৬২৪১আলইসাবাহ ৪/২৫৬

মাস ও বছরের শুরুতে কৃত এ সকল দুআ আবেগ ও অনুভূতির সাথে পড়া উচিত। শুধু মুখের পড়া নয়, বরং দুআর অর্থ ও মর্ম উপলব্ধি করে বিষয়গুলো আল্লাহ তাআলার কাছে চাওয়া উচিত।

একটু ভেবে দেখি তো!

আজ শুরু হচ্ছে ১৪৪৫ হিজরীর মুহাররম মাস। দশ বছর আগে ঠিক একইভাবে শুরু হয়েছিল ১৪৩৫ হিজরীর মুহাররম। তখন আজকের এই দিনকে মনে হয়েছিল অনেক দূর, যেমন আজ দূর মনে হচ্ছে আগামী দশ বছর পরের মুহাররমকে। একটু ভেবে দেখি তো, বিশ বছর পর ১৪৫৫ হিজরী! অনেক দূর মনে হয় না কি? অথচ বিশ বছর আগের ১৪২৫ হিজরীকে মনে হয় যেন এই সেদিনের কথা! বাস্তবতা এমনই। কৈশোরের স্মৃতিকে মনে হয় মাত্র পার হল, বার্ধক্যকে মনে হয় সুদূর ভবিষ্যত। এই যে মনে হওয়া, এটা অনেক সময়ই গাফলত সৃষ্টি করে। আর জীবন ও জীবনের পরিণতি সম্পর্কে যে-ই গাফলতের শিকার হয় তার দুর্ভোগ হয় বড় বেদনাবহ।

কবি সাহিত্যিকগণ বছর শুরুর এ সময়গুলোকে জীবনযাত্রার একেকটি স্টেশন হিসেবে উল্লেখ করেন। জন্মের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যেন একটি পথ। প্রতিটি মানুষ এ পথের মুসাফির। প্রত্যেকের জন্মের দিন এবং প্রতিটি বছরের শেষ দিন যেন মানুষ একেকটি স্টেশনে এসে দাঁড়ায়। এখান থেকে আবার নতুন স্টেশনের দিকে যাত্রা শুরু করে। এরমধ্যে জীবনের একটু হিসাব করে কতটুকু পথ পার হলাম, কতটুকু পথ বাকি! কতটুকু কী করা হল, আর কতটুকু কী করা দরকার ছিল! আখেরাতের প্রস্তুতি কতটুকু হল এবং জীবন কতটুকু গোছানো হল!

এ বিষয়ে বরেণ্য আরবী সাহিত্যিক শায়খ আলী তানতাবীর একটি লেখা থেকে কিছু অংশ তুলে ধরছি। তিনি লেখেন

মুসাফির পথের একটি মানযিল অতিক্রম করে একটু থামে। পেছন ফিরে দেখে, কতটুকু পথ সে অতিক্রম করেছে আর কতটুকু বাকি।

ব্যবসায়ী বছর শেষে তার সম্পদের হিসাব করে। দেখে, এক বছরে কী পরিমাণ লাভ হয়েছে কিংবা কোনো লোকসান হয়েছে কি না!

নতুন বছর একটি নতুন স্টেশন। জীবনের পথ চলতে গিয়ে আমরা এখানে একটু থামি। বুঝতে পারি, জীবন থেকে আরও একটি বছর চলে গেছে! এখানে এসে আমরাও কি একটু হিসাব মেলাব না! একটু কি ভাবব না?...

আমাদের অবস্থা তো হল, স্টীমার কিংবা বিমানে আরোহী মুসাফিরের মতো। যার টার্গেট থাকে সুন্দর একটি কেবিন অথবা আরামদায়ক একটি আসন। কেউ প্রথম শ্রেণির যাত্রী হয়, উৎকৃষ্ট মানের খাবার খায়, এরপর পত্রিকা-ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাতে থাকে এবং চারপাশের সুন্দর মনোরম দৃশ্য উপভোগ করে। অথচ এটা মাত্র কয়েক ঘণ্টার কিংবা মাত্র কয়েকদিনের সফর! অতএব তার জন্য কি এটা উত্তম ছিল না যে শহরে সে যাচ্ছে সেখানের উন্নত বাড়ি ও উৎকৃষ্ট খাবারের বিষয়ে ভাববে! তার জন্য কি এটা বেশি উপকারী নয় যে, সে সফরের অল্প কদিন একটু কষ্ট করবে। মিতব্যয়ী হয়ে অর্থ বাঁচাবে। এরপর গন্তব্যের দীর্ঘ অবস্থানে গিয়ে আরাম করবে?

আর যদি সফরের উপভোগ তাকে উদ্দেশ্যের কথা ভুলিয়ে দেয়, পথের সুন্দর দৃশ্যাবলি যদি গন্তব্য থেকে উদাসীন করে দেয় সেটা কত বেদনাদায়ক?

এই লেখার পরবর্তী অংশে তিনি তার দুটি অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। ভাবনা উদ্রেককারী সেই দুটি অনুভূতি এই

ইবনুল জাওযী রাহ.-কৃত সায়দুল খাতির কিতাবটির কাজ করতে গিয়ে হঠাৎ একটি বাক্য নজরে পড়ল। তিনি বলেছেন

إِنَّ لَذَائِذَ الدُّنْيَا تُعْرَضُ وَلَا تُقْبَضُ.

দুনিয়ার ভোগ-উপভোগ এমন, যা পরিবেশন করা হয়; তবে গ্রহণ করা যায় না।

অর্থাৎ দুনিয়ার উপভোগ যেন পরিবেশন ও বিজ্ঞাপনের বিলবোর্ডে থাকা কিছু জিনিস, যা খরিদ করা যায় না, কোনোভাবে সংগ্রহও করা যায় না। আপনি কেবল তা দেখে দেখে চোখ জুড়াতে পারবেন, তার মালিকানা অর্জন করতে পারবেন না।

দুনিয়ার সবচে বড় ভোগ ও আনন্দের কথাই ধরুন। দেখবেন, বাস্তবে তা এক মিনিট কিংবা দুই মিনিটের আনন্দমাত্র। সেই আনন্দ এমন, যেন পেতে পেতেই হারিয়ে যায়।

বাস্তবে এইসব আনন্দ ও উপভোগ কেবল আখেরাতের আনন্দ ও উপভোগের ক্ষুদ্রতর নমুনা। এখানে যা মুহূর্তের, আখেরাতে সেটাই দীর্ঘস্থায়ী।

দোকানী যেমন ছোট্ট চামচে করে সামান্য একটু খাবার খেতে দেয় চেখে দেখার জন্য। পছন্দ হলে ক্রেতা সেটি কিনবে এবং তৃপ্তির সাথে খাবে। দুনিয়ার বিষয়ও অনেকটা তেমনি। দুনিয়াতে কেবল একটু চেখে দেখবে। তৃপ্তি ও পরিতৃপ্তি হবে আখেরাতে। এজন্য পাপাচারীকে দেখবেন, অনেক হারাম ভোগ করেও সে অতৃপ্ত। নতুন করে ভোগ্যবস্তু দেখলে সে আবার অস্থির হয়ে পড়ে। যেন কোনোদিন সে তা ভোগ করেনি। এভাবে সে নিতান্ত দুর্বল হয়ে গেলেও লিপ্সা কমে না। সে যেন সমুদ্রের নোনা পানি পানকারী পিপাসার্ত ব্যক্তির ন্যায়। যত পান করে পিপাসা ততই বেড়ে চলে।

সম্পদ লিপ্সাও এমন। যে গরিব মাটির কুঁড়ে ঘরে বাস করে, যবের রুটি খায়, জীর্ণ পোশাকে চলে, খালি পায়ে হাঁটে কিংবা গাধার গাড়িতে চড়ে, সে ভাবে- যদি একদিন শুধু ধনীদের বিছানায় ঘুমানো যেত! সম্পদশালীদের দস্তরখানে যদি শুধু একবার খাওয়া যেত! কোটিপতির গাড়িতে যদি কিছুক্ষণের জন্য একটু চড়া যেত! তাহলেই সব সুখ-আনন্দ তার লাভ হয়ে যেত! কিন্তু যে ধনী এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছে সে তাতে কোনো স্বাদই পায় না।...

দুনিয়ার ভোগ ও আনন্দ হল মরীচিকার মতো। মরীচিকা চেনেন? দূর থেকে মনে হবে বিরাট পুকুর। কাছে গিয়ে দেখবেন ধু ধু মরুভূমি। সেখানে অনেক পানি! তবে সেটা কেবলই দূর থেকে!...

এখানে দুনিয়া ও দুনিয়ার ভোগ-উপভোগের জীবন্ত একটি বিবরণ উঠে এসেছে।

তিনি তার দ্বিতীয় অনুভূতির প্রসঙ্গটি তুলে ধরেছেন এভাবে

একবারের কথা। আমি আমার ছোট ভাইকে নিয়ে বৈরুত থেকে জেদ্দার উদ্দেশে সফরে বের হলাম। বিমানবন্দরের হোটেলে বসে নাস্তা করছি আর অপেক্ষা করছি। হোটেল ভর্তি মানুষ। প্রত্যেকেই খাওয়া দাওয়া আর কথাবার্তায় মগ্ন। দেখলে আপনার মনে হবে, তারা একে-অপরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মনে হবে, তারা কখনো একে-অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না। তাদের এ ঐক্য যেন কখনো ভাঙ্গবার নয়।

কিন্তু সেই বিমানবন্দরে প্রতি চার ঘণ্টা অন্তর অন্তর একটি করে বিমান নামে, একটি ওড়ে। হঠাৎ স্পিকারে ঘোষণা হল বিমান ইঙঅঈ অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই লন্ডন অভিমুখে রওয়ানা হচ্ছে। ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে একদল মানুষ খাওয়া দাওয়া রেখে ছুটে গেল।

এরপর ঘোষণা হল জাকার্তাগামী বিমান কখগ অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই রওয়ানা হচ্ছে। অমনি একদল মানুষ খাওয়া দাওয়া ছেড়ে উঠে গেল।

আরেকটি বিমান রওয়ানা হচ্ছে আমেরিকা অভিমুখে। আরেকটি কঙ্গো অভিমুখে। আরেকটি ইরান অভিমুখে। আরেকটি মস্কো অভিমুখে।

মানুষের এই অবস্থা দেখে আমি আমার ভাইকে বললাম, এই হল আমাদের জীবন। আমরা খাওয়া-দাওয়া ও নানা ভোগ-উপভোগে মগ্ন। এরইমধ্যে হঠাৎ ঘোষকের ডাক আসছে। এরপর কেউ চলে যাচ্ছে আফ্রিকার বনে। কেউ সাইবেরিয়ার বরফে। কেউ প্যারিসের পার্কে। কেউ নিউইয়র্কের পর্যটনকেন্দ্রে।

যে ব্যক্তি সফরের পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়েছে। প্রয়োজনীয় কাজগুলো সম্পন্ন করেছে। জিনিস-পত্র গুছিয়ে নিয়েছে এবং তার বোঝা হালকা, সে নিশ্চিন্তে রওয়ানা হয়ে যাচ্ছে। আর যার ডাক এসে গেছে কিন্তু সে এখনো অপ্রস্তুত। প্রয়োজনীয় কাজ যে এখনো সম্পন্ন করেনি, সেও রওয়ানা হয়ে যাচ্ছে; প্রস্তুতি ছাড়া।

আমরা একটু খেয়াল করে দেখি তো, জীবনের সবচে বড় সফরের প্রস্তুতি কি আমরা সম্পন্ন করেছি? প্রয়োজনীয় পাথেয় কি আমাদের সঙ্গে আছে? নাকি আমরা নিশ্চিত মৃত্যুকে ভোলার ভান করে আছি? নাকি অতি নিকটের মৃত্যুকেও মনে করছি অনেক দূরে?

এই যে আমরা জানাযার নামায পড়ছি, লাশ দাফন করছি, কতজনকে চিরবিদায় জানাচ্ছি। এরপরও দুনিয়া নিয়ে এত ভাবছি, মনে হয় যেন আমরা এখানে চিরদিন থাকব! যেন শুধু আমি ছাড়া বাকি সবার জন্যই মৃত্যুর বিধান! সুয়ারুন ওয়া খাওয়াতির, পৃ. ৫-১২

শেষকথা

আজকের এই নতুন বছরের শুরুতে চলুন আমরা নিজেকে নিয়ে একটু ভাবি এবং দৃঢ় সংকল্প করি। নতুন করে জীবনকে সুন্দর করার প্রত্যয়াবদ্ধ হই। ঈমান, আমল ও আখলাক সুন্দর করি। আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভের সর্বোচ্চ চেষ্টা করি। কায়মনোবাক্যে দুনিয়া ও আখেরাতের কামিয়াবী প্রার্থনা করি। স্মরণ করি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই বাণী

كُنْ فِي الدُّنْيَا كَأَنَّكَ غَرِيبٌ أَوْ عَابِرُ سَبِيلٍ، وَعُدَّ نَفْسَكَ فِي أَهْلِ القُبُورِ.

দুনিয়াতে তুমি পরদেশী কিংবা পথিকের মতো থাক এবং নিজেকে কবরবাসীদের মধ্যে গণ্য কর। (অর্থাৎ তোমাকে যে নিশ্চিত কবরে যেতে হবে, সেটা মনে রাখ।) জামে তিরমিযী, হাদীস ২৩৩৩

আরও স্মরণ করি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা.-এর হেকমতপূর্ণ এই নসীহত

إِذَا أَمْسَيْتَ فَلَا تَنْتَظِرِ الصَّبَاحَ، وَإِذَا أَصْبَحْتَ فَلَا تَنْتَظِرِ الْمَسَاءَ، وَخُذْ مِنْ صِحَّتِكَ لِمَرَضِكَ، وَمِنْ حَيَاتِكَ لِمَوْتِكَ،[ فَإِنَّكَ لَا تَدْرِي يَا عَبْدَ اللهِ مَا اسْمُكَ غَدًا.

তুমি যখন সন্ধ্যায় উপনীত হও তখন সকালের অপেক্ষা করো না। যখন সকালে উপনীত হও, সন্ধ্যার অপেক্ষা করো না। সুস্থতার সময়ই অসুস্থতাকালের প্রস্তুতি নাও এবং জীবন থাকতেই নাও মৃত্যুর প্রস্তুতি। হে আল্লাহর বান্দা! তুমি তো জানো না আগামীকাল তোমার কী উপাধি হবে (জীবিত না মৃত)! সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪১৬; জামে তিরমিযী, হাদীস ২৩৩৩

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সব ধরনের গাফলত ও উদাসীনতা দূর করে আখেরাতমুখী সুন্দর জীবন যাপন করার তাওফীক দান করুন আমীন। 

 

 

advertisement