শাওয়াল-যিলকদ ১৪২৮   ||   নভেম্বর ২০০৭

কিছু সময় বেহেশতের বাগানে

আবদুল্লাহ মুযাককির

সুস্থতা ও অসুস্থতা মাবন জীবনের স্বাভাবিক অনুষঙ্গ। মানুষ কখনো সুস্থ থাকে, আবার কখনো অসুস্থ হয়। অসুস্থ অবস্থায় মানুষ যে কষ্ট ভোগ করে, কষ্টের সে মুহূর্তগুলোতে তার করণীয় এবং কীভাবে এই কষ্ট-ভোগ তার জন্য ফলদায়ক হতে পারে তার সুন্দর নির্দেশ কুরআন ও হাদীসে রয়েছে। যিনি রোগে ভুগে কষ্ট পাচ্ছেন তার জন্য যেমন রয়েছে সওয়াবের প্রতিশ্রুতি, তদ্রƒপ অসুস্থ মানুষটির চারপাশের লোকজনের জন্যও পুণ্য অর্জনের বহু সুযোগ। ইসলামে একদিকে অসুস্থ ব্যক্তিকে সবর ও ধৈর্য্য ধারণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে অন্যদিকে তার স্বজন ও প্রতিবেশীদের বলা হয়েছে তার প্রতি সহানুভূতিশীল হতে।

সহানুভূতি একটি উন্নত মানবীয় গুণ এ গুণের কারণে মানুষ আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জনে সমর্থ হয়। সহীহ মুসলিমের একটি হাদীসে এ বিষয়টি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভাষায় উল্লেখিত হয়েছে। হাদীসটি এই, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাঁর বান্দাকে বলবেন, হে আদম সন্তান! আমি অসুস্থ হয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে দেখতে আসনি। বান্দা বলবে, ইয়া রব! আপনি হলেন সারা জাহানের পালনকর্তা। আমি কীভাবে আপনাকে দেখতে যেতে পারি? আল্লাহ বলবেন, তুমি কি জানতে না যে, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ ছিল? তুমি যদি তাকে দেখতে যেতে তাহলে তার প্রতিদান আজ আমার কাছে পেতে। আল্লাহ তাআলা পুনরায় বলবেন, হে আদম সন্তান! আমি তোমার কাছে খাবার চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে খাবার দাওনি। বান্দা বলবে, ইয়া রব! আমি আপনাকে কীভাবে খাবার দিতে পারি। আপনি হলেন সারা জাহানের পালনকর্তা? আল্লাহ বলবেন, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে খাবার চেয়েছিল, কিন্তু তুমি তাকে খাবার দাওনি। যদি তুমি তাকে খাবার দিতে তবে আজ আমার কাছে পেতে। আল্লাহ বলবেন, আমি তোমার কাছে পানি চেয়েছিলাম, তুমি আমাকে পানি দাওনি। বান্দা পূর্বের মতোই উত্তর দিবে। আল্লাহ বলবেন, তোমার কি স্মরণ আছে, আমার এক বান্দা তোমার কাছে পানি চেয়েছিল, কিন্তু তুমি তাকে পানি দাওনি? তুমি কি জান, তুমি যদি সেদিন তাকে পানি দিতে তাহলে তার প্রতিদান আজ আমার কাছে পেতে।-রিয়াযুস সালেহীন

অসুস্থকে দেখতে যাওয়া, ক্ষুধার্তকে খাবার দেওয়া, পিপাসার্তকে পানি দেওয়া এগুলো হল মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশের বিভিন্ন মাধ্যম। কুরআন-সুন্নাহয় এ কাজগুলোর অনেক ফযীলত উল্লিখিত হয়েছে। অসুস্থকে দেখতে যাওয়া প্রসঙ্গে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এক মুসলিম যখন অন্য কোনো মুসলিমকে দেখতে যায় তখন সে খুরফতুল জান্নাহ তে বিচরণ করতে থাকে। সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুরফাতুল জান্নাহ কী? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, জান্নাতের ফলফলাদি।-সহীহ মুসলিম; রিয়াযুস সালেহীন, পৃ. ২৪৫-২৪৬

অন্য হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কোনো মুসলিম যদি অন্য কোনো মুসলিমকে দেখতে যায় তাহলে সকালে গেলে সন্ধ্যা পর্যন্ত সত্তর হাজার ফেরেশতা তার জন্য রহমতের দুআ করতে থাকেন আর সন্ধ্যায় গেলে সকাল পর্যন্ত সত্তর হাজার ফেরেশতা তার জন্য রহমতের দুআ করতে থাকেন। আর তার জন্য জান্নাতে থাকবে ফলফলাদির পুরস্কার।-জামে তিরমিযী; রিয়াযুস সালেহীন, পৃ. ২৪৬

এক হাদীসে একে ইসলামী ভ্রাতৃত্বের দাবি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এক মুসলিমের উপর অন্য মুসলিমের হক পাঁচটি। সালামের জওয়াব দেওয়া, অসুস্থ হলে দেখতে যাওয়া, মারা গেলে জানাযার সঙ্গে থাকা, আহ্বান করলে সাড়া দেওয়া এবং হাঁচি দিয়ে আলহামদুলিল্লাহ বললে জওয়াবে ইয়ারহামুকাল্লাহ বলা।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন এ আদর্শের বাস্তব নমুনা। তাঁর সাহাবীদের মধ্যে কেউ অসুস্থ হলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে দেখতে যেতেন। তার কাছে বসতেন, সান্ত¡না দিতেন এবং তার রোগমুক্তির জন্য দুআ করতেন। উপযুক্ত ক্ষেত্রে সংক্ষিপ্ত ও প্রয়োজনীয় উপদেশও প্রদান করতেন। অসুস্থকে দেখতে যাওয়ার বিষয়টি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু মুসলিমদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি। তার সঙ্গে কোনোভাবে সংশ্লিষ্ট অমুসলিমকেও তিনি দেখতে গেছেন। দৃষ্টান্ত হিসেবে একনজ ইহুদী কিশোরের কথা বলা যায়। সে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাজকর্ম করে দিত। ছেলেটি একদিন অসুস্থ হয়ে পড়লে নবীজী তাকে দেখতে গেলেন এবং তার শয্যাপাশে বসে তাকে বললেন, আসলিম অর্থাৎ তুমি ঈমান নিয়ে আস। ছেলেটি পিতার দিকে তাকাল। ইহুদী পিতা বলল, তুমি তাঁর আনুগত্য কর। পিতার অনুমতি পেয়ে ছেলেটি মুমিন হয়ে গেল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত আনন্দিত হলেন এবং বললেন, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি ছেলেটিকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করেছেন। এখান থেকে বোঝা যায় যে, অসুস্থ অমুসলিমকে দেখতে যাওয়া এবং তাকে ঈমানের দাওয়াত দেওয়া নবীর সুন্নত। হাদীস শরীফে এসেছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোনো রোগীর কাছে যেতেন তখন তাকে সান্ত¡না দিয়ে বলতেন-

لا بأس طهور إن شاء الله

অর্থাৎ চিন্তার কিছু নেই, এ রোগভোগ ইনশাআল্লাহ তোমাকে পবিত্র করে দিবে। বলাবাহুল্য, তাঁর এ ছোট্ট বাক্যটি অসুস্থ মানুষের মানসিক বল অনেকখানি বৃদ্ধি করে দিত। এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় এই যে, এ বাক্যে রোগীর জন্য সান্ত¡না লাভের সকল উপকরণ বিদ্যমান রয়েছে, কিন্তু কোনো অলীক বা অবাস্তব কথা তাতে নেই। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কথায় তা থাকতেও পারে না। নবুওয়তের একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, কোনো অবস্থাতেই নবীদের মুখ থেকে অবাস্তব কথা বের হয় না। এই বাক্যটিতে প্রত্যক্ষভাবে রোগীর জন্য সান্ত¡না রয়েছে আর পরোক্ষভাবে তাকে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে সবর ও রিযার প্রতি। কেননা বিপদ-আপদে সবর করার মাধ্যমে এবং আল্লাহর ফয়সালায় সন্তুষ্ট থাকার মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর রহমতপ্রাপ্ত হয় এবং তার গুনাহসমূহ ক্ষমা করা হয়। রোগীকে সান্ত¡না দানের একটি সুন্দর পদ্ধতি এই হাদীস থেকে জানা গেল।

 রোগীকে দেখতে গিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার জন্য দুআ করতেন। হাদীস শরীফে এ বিষয়ক বিভিন্ন দুআ বর্ণিত হয়েছে। সাহাবী সাদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রা. অসুস্থ ছিলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে দেখতে গেলেন এবং দুআ করলেন-

اللهم اشف سعدا

ইয়া আল্লাহ! আপনি সাদকে সুস্থ করে দিন। এ কথাটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন বার বললেন।-সহীহ মুসলিম; রিয়াযুস সালেহীন, পৃ. ২৪৭

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একজন স্ত্রী অসুস্থ হলেন। নবীজী ডান হাত তার শরীরে বুলালেন এবং এই দুআ করলেন-

اللهم رب الناس، اذهب البأس، واشف، أنت الشافي، لا شفاء إلا شفاءك، شفاء لا يغادر سقما.

অর্থ : ইয়া আল্লাহ! মানবকুলের পরওয়ারদেগার, তার কষ্ট দূর করে দিন এবং আপনি (তাকে) পূর্ণ সুস্থতা দান করুন। কেননা একমাত্র আপনিই হলেন সুস্থতা দানকারী।

এই হাদীস থেকে বোঝা যায় যে, পরিবার-পরিজনের কেউ অসুস্থ হলে তাকে সান্ত¡না দেওয়া এবং তার জন্য রোগমুক্তির দুআ করা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নত।

অন্য এক হাদীসে সহজ একটি দুআর অনেক বড় উপকারিতা বর্ণিত হয়েছে। দুআটি এই-

أسأل الله العظيم، رب العرش العظيم، أن يشفيك.

আমি আরশে আযীমের অধিপতি মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি, তিনি যেন তোমাকে সুস্থ করে দেন।

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন যে, কেউ যদি কোনো অসুস্থকে দেখতে যায় এবং তার কাছে এই দুআটি সাতবার বলে তাহলে তার মৃত্যু সমুপস্থিত না হলে আল্লাহ তাকে ওই রোগ থেকে সুস্থ করে দিবেন।-আবু দাউদ; জামে তিরমিযী; রিয়াযুস সালেহীন, পৃ. ২৪৭

মোটকথা, এভাবে হাদীসে বর্ণিত পদ্ধতিতে রোগীর ইয়াদত করা হল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সুন্নত। এ সুন্নতের উপকারিতা সুদূরপ্রসারী। আখিরাতের প্রভূত কল্যাণ ছাড়াও পারস্পরিক সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি সৃষ্টি হওয়ার পিছনে এর গভীর প্রভাব রয়েছে। বলাবাহুল্য, নবী আদর্শের এরূপ সহজ শিক্ষাগুলোর মধ্যেই মুসলিম সমাজের সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি, কল্যাণ ও অগ্রগতির বীজমন্ত্রটি নিহিত রয়েছে। আল্লাহ আমাদেরকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শের মূল্য বোঝার এবং তাঁর অনুসরণ করার তাওফীক দান করুন। আমীন।

 

 

advertisement