শাবান-রমযান ১৪২৮   ||   সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ২০০৭

অর্জনের মৌসুম রমযান
অধিক ফলপ্রসূ করা যায় কী উপায়ে

মাওলানা হেদায়াতুল্লাহ

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন চান তাঁর প্রত্যেক বান্দাই যেন শ্রেষ্ঠ হয়ে যায় এবং অন্য সকলকে ছাড়িয়ে তাঁর নৈকট্য অর্জনে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়, বান্দার প্রতিটি মুহূর্ত উত্তম থেকে উত্তম আমলে এবং আল্লাহর স্মরণে অতিবাহিত হয়।  শরীয়তের বিধি-বিধান ও নির্দেশনাকে আল্লাহ তাআলা এমনভাবে বিন্যস্ত করেছেন যাতে বান্দা তাঁর স্মরণ থেকে কখনো গাফেল হতে না পারে। সকালে ঘুম থেকে উঠার সঙ্গে সঙ্গে নির্ধারিত দুআ ও যিকরের মাধ্যমে আল্লাহকে স্মরণ করার কথা শেখানো হয়েছে। সারাদিনের অত্যাবশ্যকীয় পাঁচ ওয়াক্ত নামায এমনভাবে বিন্যস্ত করা হয়েছে যে, কোনো বান্দা আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল থাকতে চাইলেও বেশি সময় থাকতে পারবে না। ঘুম থেকে উঠার পর, ঘর থেকে বের হওয়ার সময়, কারো সঙ্গে সাক্ষাতের সময়, গোসলের সময়, খাওয়ার আগে ও পরে মোটকথা জাগ্রত হওয়ার পর থেকে পুনরায় নিদ্রায় যাওয়া পর্যন্ত প্রতিটি পদে বিশেষ বিশেষ দুআ-যিকিরের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যাতে সর্বদা আল্লাহর স্মরণ বান্দার অন্তরে তাজা থাকে এবং আল্লাহর সঙ্গে তার বন্ধন সদা অটুট থাকে। কিন্তু বান্দা যে দুর্বল। সে ইচ্ছা করে এগোতে কিন্তু পারে না। বারবার হোচট খায়। নফসের কাছে পরাজিত হয়। শয়তানের ফাঁদে পা দেয়। প্রতিকূল পরিবেশের নানা জঞ্জালে জড়িয়ে পড়ে। ফলে ব্যাহত হয় তার এগিয়ে চলা এবং সে পিছিয়ে পড়ে অনেক পেছনে।

তাই আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাদের অগ্রসর করার জন্য এবং পিছিয়ে পড়াদের উত্তরণের জন্য দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক এবং বার্ষিক বিভিন্ন সুযোগ ও উপলক্ষ সৃষ্টি করে দিয়েছেন, যাতে বান্দা অল্প সময়ে স্বল্প শ্রমে আবার এগিয়ে যেতে পারে, রহমতে এলাহীর হাতছানির দিকে জোড়া লাগাতে পারে তার ছিন্ন বন্ধনকে। আর সেই উপলক্ষগুলোর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হল রমযান মাস। তাই এমাসকে গণীমত মনে করে সার্বিকভাবে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে মনোযোগী হওয়া উচিত এবং এই সুবর্ণ সুযোগকে  কীভাবে অধিক থেকে অধিকতর ফলপ্রসূ করা যায় তার প্রস্তুতি এখন থেকেই গ্রহণ করা উচিত।

রমযানের প্রস্তুতি

রমযানের প্রস্তুতি বলতে আমরা সাধারণত যা করে থাকি তা হল আগে থেকেই একটু ভাল ইফতারী এবং ভালো খাবারের ব্যবস্থা। এ ছাড়া অন্যরকম প্রস্তুতির কথা আমরা কমই ভাবি।

একটু ভালো খাবারের ব্যবস্থা করা অন্যায় কিছু নয়; বরং রমযান মাসে রোজগারের পেছনে অধিক সময় ব্যয় করা যাবে না এবং ইবাদতে অধিক মনোযোগ ও শ্রম দিতে হবে বলে যদি আগে থেকে একটু ভালো খাবার দাবারের আয়োজন করে রাখা হয় তবে তা অবশ্যই প্রশংসনীয়। কিন্তু অনেকে এ বিষয়ে একটু বাড়াবাড়িই করে ফেলেন। তারা এ উপলক্ষে এত শ্রম, সময় ও অর্থ ব্যয় করেন, মনে হয় যেন এটা বিলাস-ভোজনেরই একটা মোক্ষম সময়। এমনটি করা থেকে অবশ্যই বিরত থাকা চাই।

এ মাসের প্রস্তুতি হিসাবে যা করা দরকার তা হল প্রয়োজনীয় কাজকর্মগুলো যথাসম্ভব রমযানের আগে-পরে করে নেওয়া। রমযান মাসের জন্য ইবাদত-বন্দেগীর বাইরে একান্তই জরুরি কাজ ছাড়া কোনো কাজ না রাখা। দুনিয়াবী কাজকর্ম এবং খাওয়া-দাওয়ার জন্য যথাসম্ভব কম সময় বরাদ্দ রেখে বাকি সময় ইবাদত-বন্দেগীর জন্য রুটিনবদ্ধ করে ফেলা।

রমযানের প্রথম কাজ

রহমত ও বরকতপূর্ণ রমযান মাস শুরু হলে প্রথমে আল্লাহর দরবারে খাঁটি দিলে তওবা করে নেওয়া চাই। তওবার পরের কাজ হবে যথারীতি রুটিনমাফিক ইবাদত-বন্দেগী শুরু করে দেওয়া। কারণ গোনাহগার বান্দার চেয়ে তওবাকারী বে-গোনাহ বান্দা আল্লাহর নিকট বেশি প্রিয়। সুতরাং তার ইবাদতও আল্লাহর বেশি প্রিয় হবে। তওবার কাজটি এখনই করে ফেলা যায় বা করতে থাকা যায়। একথা মনে করার কোনো প্রয়োজন নেই যে, রমযান আসলেই একেবারে তওবা করে নেব। কারণ তওবা সব সময় করার বিষয়। বিশেষ করে যখন কোনো গোনাহ হয়ে যায় তখন তো সঙ্গে সঙ্গে তওবা করা জরুরি।

গোনাহ থেকে বিরত থাকা

তওবার অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ হল গোনাহ না করার অঙ্গীকার করা। সুতরাং তওবা করার পর এ অঙ্গীকারকেও বাস্তবায়ন করতে হবে এবং সব ধরনের গোনাহ পরিহার করে চলতে হবে। কারণ এ মাসের ফযীলত যেমন বেশি তেমনি গোনাহের পরিণতিও অনেক ভয়ঙ্কর। তাই রমযানের রহমত বরকত পেতে হলে অবশ্যই গোনাহের কাজ বর্জন করে চলতে হবে। অন্যথায় তা হবে ফুটো পাত্রে পানি সংগ্রহের মতো। ফুটো পাত্রে যেমন মহাসমুদ্রের পানি ঢেলে দিলেও এক ফোঁটা পানিও থাকবে না, তেমনি গোনাহে লিপ্ত ব্যক্তির ভাগ্যেও এত ফযীলতের এক ফোঁটাও অবশিষ্ট থাকবে না।

দুএকটি গোনাহ সম্পর্কে বিশেষভাবে সতর্কতা অবলম্বন খুবই জরুরি।

গীবত : গীবতের গোনাহ যত ভয়াবহ, সমাজে তার সয়লাবও তত ব্যাপক। এ ধ্বংসাত্মক মহামারিতে অবচেতনভাবেই সমাজের প্রায় অধিকাংশ মানুষ লিপ্ত। অথচ হাদীসে এসেছে, গীবত ব্যভিচার থেকেও জঘন্য। যেখানে বছরের অন্যান্য সময়েই এ গোনাহ ব্যভিচারের চেয়ে জঘন্য সেখানে রমযানের বরকতপূর্ণ সময়ে তার পরিণতি যে কত ভয়াবহ হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। এক হাদীসে এসেছে, গীবত রোযাকে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেয়।

বদ নজর : এটিও বড় গোনাহগুলোর অন্যতম। ইসলামী সমাজব্যবস্থার যদি বাস্তবায়ন থাকত তবে এ গোনাহের ক্ষেত্র খুব কমই আসত, বরং তেমন কোনো ক্ষেত্রই আসত না। কিন্তু আফসোস হল, বর্তমানে এ গোনাহ শুধু বেপর্দা পর্যন্ত এসে থামেনি। এটা এ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকলেও কিছু রক্ষা হত। উলঙ্গপনা আর বেহায়াপনার পাগলা ঘোড়া যেভাবে ছুটেছে তার পরিণতি ও বিষক্রিয়া যে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সমাজকে তা ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়। এ লাগামহীনতার কারণে বদ নজরির গোনাহও মহামারির রূপ ধারণ করেছে। রমযান মাসে এ বিষয়ে আমাদেরকে বিশেষভাবে সতর্ক হতে হবে। এ ক্ষেত্রে নারীদের ভূমিকাই প্রধান। তারা যদি নিজেদেরকে পর্দার আড়ালে নিয়ে আসতে পারে তবে পুরুষও নিজেকে বাঁচাতে পারে এবং অসংখ্য মানুষ রক্ষা পেতে পারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অভিশাপ থেকে।

মিথ্যা ও অশ্লীলতা

হাদীসে এসেছে, যে মিথ্যা পরিহার করতে পারল না তার পানাহার বর্জন করার (রমযানে)  আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই। -সুনানে আবু দাউদ ২/৩০৭, হাদীস নং ২৩৬২

অপর হাদীসে এসেছে, তোমাদের কেউ যখন রোযা থাকে তখন যেন সে অশ্লীলতা পরিহার করে এবং মূর্খতা না করে। কেউ যদি তার সঙ্গে লড়তে আসে বা তাকে গালি দেয় তখন যেন সে তাকে বলে দেয়- আমি রোযাদার, আমি রোযাদার। -সুনানে আবু দাউদ ২/৩০৭, হাদীস নং ২৩৬৩

মোটকথা, রমযান এবং রমযান মাসের আমলের অনেক অনেক ফযীলত থাকলেও গোনাহ করতে থাকলে তার ফযীলতের কোনো প্রতিফলন হয় না। তাই রমযান এলে আমাদেরকে এ বিষয়ে খুবই সতর্ক থাকতে হবে যাতে জিবরাঈল আ.-এর বদ দুআর শিকার আমাদের না হতে হয়। যেমন তিনি বলেছেন, ওই ব্যক্তি ধ্বংস হোক যে রমযান মাস পেয়েও তার গোনাহ মাফ করাতে পারল না এবং এ ধ্বংসের দুআ কবুল করার জন্য স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমীন বলেছেন। আর ওই রোযাদারের মতোও যেন আমাদেরকে না হতে হয় যার সম্পর্কে হাদীসে এসেছে, অনেক রোযাদার এমন রয়েছে যাদের কপালে ক্ষুধার্ত থাকা ছাড়া আর কিছুই জুটে না এবং অনেক নামাযী এমন আছে যাদের কপালে বিনিদ্র থাকা ছাড়া আর কিছুই জুটে না। আল্লাহ আমাদেরকে হেফাযত করুন।

রোযা রাখা

এ মাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল রোযা রাখা। রোযার অনেক সওয়াব ও ফযীলতের কথা হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে। এক হাদীসে এসেছে, মানুষের প্রত্যেক নেক আমলের সওয়াব দশ থেকে সাতশত গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। আল্লাহ বলেন, তবে রোযার বিষয়টি ভিন্ন। কেননা রোযা একমাত্র আমার জন্য। তার প্রতিদান আমি নিজেই প্রদান করব।

এ ছাড়া রোযাদারকে বে-হিসাব সওয়াব দেওয়া, কেয়ামতের দিন রোযাদারের পক্ষে রোযার সুপারিশ ব্যক্ত করা, একমাত্র রোযাদারকে জান্নাতের রাইয়ান নামক শাহী গেট দিয়ে প্রবেশের অধিকার দেওয়া, রোযাদারের দুআ কবুল হওয়া ও রোযাদারের সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়াসহ আরো অনেক ফযীলতের কথা হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে। সুতরাং একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে এ মাসে রোযা রাখার বিকল্প কোনো আমল নেই।

তারাবীহ

এ মাসের রাত্রের বিশেষ একটি আমল হল তারাবীহ। তারাবীর অনেক সওয়াব ও ফযীলত রয়েছে এবং রমযানের রহমত বরকত লাভের অন্যতম মাধ্যম এ তারাবীহ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তোমাদের উপর রমযানের রোযা ফরয করেছেন এবং আমি (আল্লাহর হুকুমে) কিয়ামে রমযান (রাতের নামায বিশেষত তারাবীহ)-এর বিধান চালু করেছি। সুতরাং যে পূর্ণ বিশ্বাস নিয়ে এবং সওয়াবের উদ্দেশ্যে রমযানের রোযা রাখবে এবং রাতের নামায (বিশেষত তারাবীহ) পড়বে সে যাবতীয় গোনাহ থেকে এমন পরিচ্ছন্ন হয়ে যাবে যেমন গোনাহমুক্ত থাকে একটি শিশু তার জন্মের দিনে।

এ ছাড়া তারাবীর আরো অনেক ফযীলতের কথা বিভিন্ন হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে। তাই আল্লাহর নৈকট্য লাভের এ আমলটিও রমযান মাসে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে আদায় করতে হবে।

তিলাওয়াত

এ মাসে কুরআন তিলাওয়াতের পরিমাণ অনেক অনেক গুণ বাড়িয়ে দেওয়া দরকার এবং শুধু তিলাওয়াতই নয়, প্রত্যেকে নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী কুরআন বোঝারও চেষ্টা করা দরকার। কারণ এ মাসের সঙ্গে কুরআনের সম্পর্ক বছরের অন্য সব সময় থেকে ভিন্ন ও গভীর। এ মাসেই কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও এ মাসে অনেক বেশি তিলাওয়াত করতেন। হাদীসে এসেছে, হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম রমযানের প্রতি রাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসতেন এবং তিনি তাঁকে কুরআন তিলাওয়াত করে শোনাতেন। সালাফে সালেহীনের জীবনীতেও তাই দেখা যায় তাঁরা অনেকেই রমযান মাসে বহুবার কুরআন মজীদ খতম করতেন।

দান সদকা

দান সদকার বিষয়েও এ মাসে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া চাই এবং অন্যান্য সময় থেকে এ সময়ে বেশি বেশি দান করা চাই। হাদীস শরীফে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দানশীল। রমযান মাসে তাঁর এ দানের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পেত।

দান সদকা বিশেষ করে রমযান মাসের দান সদকার ব্যাপারে আমাদের দেশে যে ব্যাপক উন্নাসিকতার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে আছে অবিলম্বে এ বিষয়ে সমাজের সর্বস্তরের দাতা-গ্রহীতা সকলের সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে প্রয়োজনীয় কিছু বিষয়ে দৃষ্টি আকষর্ণ করা যায়-

ক. দেখা যায় বিত্তশালীদের অনেকে নফল দান-সদকা তো দূরের কথা ফরয, ওয়াজিব সদকা-যাকাত পর্যন্ত ঠিকমতো আদায় করে না। তাদের খুব ভাবা উচিত সেই দিনের কথা, যেদিন এই সম্পদ সাপ হয়ে গলায় ঝুলবে। সেদিন তারা এ সম্পদের ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নিবে। সিদ্ধান্ত এখনই নেওয়া উচিত। এই রমযানের মোবারক মাসকে গণীমত মনে করে পেছনের কৃতকর্মের উপর খালেসভাবে তওবা করে পেছনের বছরগুলোর যাকাতসহ এবারের যাকাত এই মুহূর্তে আদায় করে দেওয়া দরকার। সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতিপূরণের জন্য নফল সদকাও করা দরকার। আর মনে রাখা দরকার, এই সম্পদের মালিক যিনি তিনি আমাকে তা বণ্টনের দায়িত্ব দিয়েছেন, তিনি যেকোনো মুহূর্তেই তার সম্পদ ছিনিয়ে নিতে পারেন বা অন্য কারো হাতে এর কর্তৃত্ব তুলে দিতে পারেন।

খ. অনেকে দান-সদকা করার জন্য এমন পরিবেশ সৃষ্টি করেন যা দেখে বোঝা কঠিন যে, তিনি দান করছেন নাকি দান প্রচার করছেন। এসব বিষয়  আমাদেরকে রমযানের রহমত বরকত থেকে বঞ্চিত করে দিতে পারে।

গ. অনেকে দান করার জন্য গরীবদেরকে নিজের বাড়িতে জড়ো করে সারা দিন বসিয়ে রেখে ৬০/৭০ টাকার একটি লুঙ্গি বা শাড়ি দিয়ে বিদায় করে। একে তো সারা দিনের অপেক্ষা, তার সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি আর দাতাপক্ষের ধমকা ধমকিতে কাহিল দশা হয়। আর এতক্ষণে হয়তো বেচারা গ্রহীতার কয়েক ৭০ টাকা আদায় হয়ে যেত। কিন্তু বেচারা ফকির বলে কথা। শারীরিক প্রতিবন্ধী না হলে কিংবা চেয়ে খাওয়ার মানসিকতা না থাকলে হয়তো সে এতক্ষণে আরো অনেক বেশি কামাই করতে পারত। সাথে সাথে তার আত্মমর্যাদাও রক্ষা পেত।

ঘ. আসলে দান করার ক্ষেত্রে গ্রহীতার হাতে তা পৌঁছে দেওয়াই দাতার দায়িত্ব। কারণ দান গ্রহণ করার দায়িত্ব শরীয়ত কাউকে দেয়নি, কিন্তু দান করার দায়িত্ব সম্পদশালীদের উপর দেওয়া হয়েছে। দাতাদের মানসিকতা এমন হওয়া উচিত যে, গ্রহীতা আমার দান গ্রহণ করে আমাকে ধন্য করল। আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ। আর যারা দান করে নিজেকে দয়াবান হিসেবে জাহির করে এবং গ্রহীতাকে অনুগ্রহ করল বলে মনে করে গ্রহীতাদের জন্য তাদের দান পরিহার করতে পারলেই ভালো হয়। তাদের রিযিক আল্লাহ অবশ্যই উত্তমপথে দান করবেন।

ঙ. সম্মানিত উলামায়ে কেরাম যারা নিজের জন্য কখনই নয়, বরং দ্বীনী প্রতিষ্ঠানের জন্য কিংবা এতিম,-গরিব শিক্ষার্থীদের জন্য বিত্তবানদের দান সংগ্রহ করতে যান তাদের সঙ্গেও এ ধরনের আপত্তিকর আচরণ করা হয়, নিঃসন্দেহে এ আচরণ নিতান্তই গর্হিত এবং ন্যাক্কারজনক। বিশেষ করে রমযান মাসে তো তা আরো দুঃখজনক। আল্লাহ না করুন এমন দান-সদকা সওয়াবের পরিবর্তে আমাদেরকে রমযানের ফয়েজ বরকত থেকেও বঞ্চিত না করে দেয়।

দুআ-ইস্তিগফার

দুআ মুমিনের জীবনের অনেক বড় হাতিয়ার। এর মাধ্যমে সে আল্লাহর নিকট থেকে সব কিছুই করিয়ে নিতে পারে। কখনো যদি বাহ্যত দুআ কবুল হচ্ছে না বলে মনে হয় তাতেও অস্থির হওয়া উচিত নয়। দুআ সবসময় করেই যেতে হবে। কারণ মুমিনের দুআ কখনই বিফলে যায় না। বাহ্যিক ফল কখনো না পাওয়া গেলেও তা অবশ্যই ইবাদত হিসেবে গণ্য হয়। তাই রমযানের রহমত বরকত লাভের জন্য বেশি বেশি দুআ করা চাই। বিশেষ করে দুআ কবুলের বিশেষ সময় যেমন ইফতার-তাহাজ্জুদ ইত্যাদি সময়গুলোর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া চাই। দুআর সঙ্গে সঙ্গে বেশি বেশি ইস্তেগফার করা চাই। যেহেতু এ মাসে গোনাহ মাফ করাতে না পারলে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার বদ দুআ রয়েছে, তাই আল্লাহর দরবারে রোনাযারী করে যে কোনোভাবে নিজের গোনাহ মাফ করিয়েই নিতে হবে।

ইতেকাফ

রমযানের শেষ দশদিনের বিশেষ আমল হল ইতেকাফ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি রমযানেই দশদিন ইতেকাফ করতেন। ইন্তেকালের আগের বছর করেছেন বিশদিন। ইতেকাফের অনেক ফযীলত রয়েছে। একজন ইতেকাফকারী যদি কোনো আমল না করে, এমনকি ঘুমিয়েও থাকে তবুও সে ইবাদতের সওয়াব পেতে থাকে। অর্থাৎ মসজিদে অবস্থানই তার ইবাদত। তার উপর যদি অন্য কোনো ইবাদতে মশগুল থাকে তাহলে তো সোনায় সোহাগা। ইতেকাফের আরেকটি দিক হল এতে শবে কদর লাভ করার প্রায় নিশ্চিত সম্ভাবনা থাকে। সুতরাং রমযানের বরকত হাসিলের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে ইতেকাফের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই এর প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা চাই। উল্লেখ্য দশ দিনের সুন্নতে মুআক্কাদা ইতেকাফ আদায় করার সুযোগ কারো না থাকলে যতদিন বা যতক্ষণ সুযোগ হয় ততক্ষণই নফল ইতেকাফে বসে ইতেকাফের সওয়াব হাসিল করা যায় এবং পুরুষরা যেমন মসজিদে ইতেকাফ করতে পারেন তেমনি মহিলারাও ঘরের নির্জন কোণে ইতেকাফে বসে অর্জন করতে পারেন রমযানের বিশেষ বরকত ও রহমত।

শবে কদর অন্বেষণ

বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ মাস রমযানের সর্বশ্রেষ্ঠ রাত এই শবে কদর। কুরআনে কারীমে সুস্পষ্ট বলা হয়েছে কদরের রাত হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এ যেন মুমিনের জীবনে চরম সৌভাগ্যের পরম মুহূর্ত। এ যেন বান্দার ভাগ্যের কলম তার হাতে ধরিয়ে দেওয়া। লিখে যাও তুমি জান্নাত নাকি জাহান্নাম চাও। পবিত্র কুরআনও নাযিল হয়েছে এ রাতেই। এই সামান্য জীবনে শুধু প্রাকৃতিক প্রয়োজনগুলো সেরে দুনিয়ার আর সবকিছু বাদ দিয়েও যদি কেউ ইবাদতে লেগে থাকে তবুও কি হাজার মাস ইবাদতে অতিবাহিত করা সবার পক্ষে সম্ভব হবে? তাহলে এ সীমাবদ্ধ স্বল্পায়ু মানুষের জীবন থেকে যদি এত মহান এবং এত সহজ একটি রাতও চলে যায় আর সে গাফেল থাকে তাহলে তার কাছে আর কিইবা আশা করা যেতে পারে! আল্লাহ আমাকে এবং আমাদের সকলকে এমন গাফলতের ব্যাধি থেকে রক্ষা করুন। বিষয়টি আরেকটু হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টা করি। মনে করুন বিশ্বব্যাপী একটা সাধারণ ঘোষণা হল যে, অমুক তারিখ সারারাতে যারা শ্রম দিবে তাদের এক রাতের পরিশ্রমিক দেওয়া হবে হাজার রাতের সমান। ওই রাতে এমন কোনো নির্বোধ খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে কি যে গাফলতের ঘুমে রাতটি পার করে দিবে? কক্ষনো নয়, বরং নিকট জনেরা প্রতিবন্ধী, অসমর্থ, অধসমর্থ লোকদের দিয়েও কিছু না কিছু কাজ করিয়ে নিবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই শবে কদরের এই ফযীলত জানার পর নিজেই ভাবুন আমাদের কী করা উচিত, কী করব আমরা।

জানা দরকার- কদরের রাতটি কোন রাত

আল্লাহ পাক বিভিন্ন হেকমতে এবিষয়টি সম্পূর্ণ সুনির্দিষ্ট করে দেননি। যেমন একটি হেকমত হল, এ রাতের সন্ধানে সম্ভাব্য প্রতি রাতেই বান্দা ইবাদত করবে। এ উসিলায় বান্দার আমলনামায় অনেক আমল জমা হবে। এ রাতটি যে রমযান মাসের বাইরে নয়, বরং রমযানেরই একটি রাত একথা কুরআন ও হাদীসে সুস্পষ্ট রয়েছে। এরপর যারা দুর্বল রমযানের পুরো মাস জুড়ে কদর সন্ধানের সামর্থ্য যাদের নেই তাদের জন্য এর পরিধি সীমিত করে হাদীস শরীফে বলা হয়েছে, রমযানের শেষ দশকে তোমরা শবে কদর অন্বেষণ কর। আরেক হাদীসে বলা হয়েছে, দশ দিন না পারলে শেষ সাত দিনে খোঁজ। অন্য হাদীসে বলা হয়েছে, এ শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে শবে কদর তালাশ কর। অপর এক হাদীসে সাতাশে রমযানের রাতের প্রতিও বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, এ রাতগুলোতে শবে কদর অন্বেষণের অর্থ হল সম্ভাব্য প্রতিটি রাতই ইবাদত বন্দেগীতে অতিক্রম করা, যাতে শবে কদর যে রাতেই হোক সে রাতের ইবাদত যেন আমার ছুটে না যায়। তাহলে আমি এক রাতের ইবাদত দ্বারাই হাজার মাসেরও বেশি ইবাদতের সওয়াব পাব।

একথা সবাই জানেন যে, হাজার মাসের ইবাদতের সওয়াবের জন্য শুধু ত্রিশ রাত কেন রমযানের মতো কয়েক মাসও যদি বিনিদ্র থাকতে হয় তবুও তা প্রাপ্তির মোকাবেলায় অতিসামান্যই মাত্র।

রোযাদারকে ইফতার করানো

রোযাদারকে ইফতার করানো অতিসহজে অর্জন করার মতো অনেক বড় একটি সওয়াবের সুযোগ। এ বড় আশ্চর্য যে, একজন মুমিন সারাদিন উপবাস যাপন করে রোযা রেখে যে পরিমাণ সওয়াব পায় তাকে শুধু এক গদ্বাস পানি খাইয়ে ইফতার করালেই আল্লাহ তাকে রোযাদারের সমপরিমাণ সওয়াব দিয়ে দেন। হাদীসে বলা হয়েছে, যাকে ইফতার করানো হয় তার রোযার সমপরিমাণ সওয়াব ইফতার করানেওয়ালা পেলেও সেই রোযাদারের সওয়াব সামান্যও কমবে না।

শুনেছি, আরবের সামর্থ্যবান লোকেরা নাকি রাস্তার মোড়ে মোড়ে ইফতারী নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন রোযাদারদের অপেক্ষায়। ফলে পথিকদের কখনো ইফতারের সন্ধান করতে হয় না। ইফতারীই তাদের সন্ধান করে। এক্ষেত্রে আমাদের দেশের চিত্রটা যে কি রকম তা সকলেরই জানা। আল্লাহ আমাদেরকে ভালো বিষয়ে ভালোদের অনুসরণ করার তাওফীক দিন।

নফল ইবাদত

শেষ কথা হল এই বরকতময় সুবর্ণ সুযোগ জীবনে আর কখনো আসবে কি না জানা নেই। তাই যথাসম্ভব এ সময়কে অধিক থেকে অধিকতর ফলপ্রসূ করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ব্যয় করা উচিত। অত্যাবশ্যকীয় আদেশ-নিষেধগুলো পালনের সঙ্গে সঙ্গে নফল ইবাদতের প্রতিও বিশেষ মনোনিবেশ করা উচিত। এ মাসে বিভিন্ন সময়ের বিশেষ যিকির-আযকার ও নফল নামাযগুলোর অভ্যাসও রপ্ত করে ফেলা উচিত। যেমন সকাল-বিকালের তাসবীহ, তাহাজ্জুদ, চাশত, ইশরাক, আউয়াবীন ইত্যাদি। হাদীসে এসেছে, এ মাসে শয়তানগুলোকে বেঁধে রাখা হয়। অপর হাদীসে এসেছে, এ মাসের একটি নফলের সওয়াব অন্য সময়ের একটি ফরযের সমান। আর একটি ফরযের সওয়াব অন্য সময়ের সত্তরটি ফরযের সমান। তাই এ মাসে যত সহজে এবং যত দ্রুত অগ্রসর হওয়া সম্ভব তা আর কখনো সম্ভব নয়।

 

 

advertisement