রজব ১৪২৮   ||   আগস্ট ২০০৭

উম্মাহ
রক্তে লাল লাল মসজিদ

খসরূ খান

অবশেষে রক্তে লাল হয়েই লাল মসজিদের অপারেশন সমাপ্ত হলো। পাকিস্তানের ইসলামাবাদে অবস্থিত লাল মসজিদ ও সংলগ্ন মাদরাসা গুলি চালিয়েই দখল করলো পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী। লাল মসজিদের দ্বিতীয় খতীব মাওলানা আব্দুর রশীদ গাজী, তার মাসহ বহু নারী-পুরুষের প্রাণ এ অভিযানে ঝরে পড়লো। উভয় পক্ষ হার্ড লাইনে থাকার ফলে এ ঘটনার রক্তাক্ত সমাপ্তি হলো এবং সরকারী বাহিনী বিজয়অর্জন করলো।

ইসলামাবাদের লাল মসজিদ কমপ্লেক্স ও সংলগ্ন মাদরাসার প্রধান ছিলেন আফগান জিহাদের একজন বলিষ্ঠ সমর্থক। নব্বুই দশকের মাঝামাঝি সময়ে আততায়ীরা তাকে হত্যা করলে তার দু আলেম ছেলে এ কমপ্লেক্স পরিচালনা করে এসেছেন।

গত প্রায় তিন মাস আগে এ মাদরাসার কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী অশ্লীলতা ও দেহ ব্যবসায় অভিযুক্ত পার্শবর্তী বিউটি পারলারে হামলা চালায়, অশ্লীল সিডি ও পর্ণোগ্রাফি ব্যবসার দোকানপাটে চড়াও হয়। এভাবে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। লাল মসজিদের ঘটনার খবর তখন দেশ-বিদেশের দৃষ্টি কাড়ে। লাল মসজিদের নেতৃবৃন্দ ওই সময় ইসলামী রাষ্ট্র গঠনেরও দাবি জানান। পাকিস্তানের সামরিক শাসক পারভেজ মোশাররফ ঘরে-বাইরে কঠিন পরিস্থিতির শিকার থাকায় লাল মসজিদের প্রসঙ্গটি তার জন্য একই সঙ্গে বিব্রতকর ও দৃষ্টি ঘুরানো একটি সাবজেক্টে পরিণত হয়। এ ইস্যুটি থেমে থেমে চলতে থাকে।

পাকিস্তানের বহু তাত্ত্বিক আলেম ওই ঘটনার সময় পত্রপত্রিকায় তাদের অভিমত ছাপিয়ে এ ধরনের যুদ্ধ যুদ্ধ মহড়া দেওয়ার পদ্ধতিতে ইসলামী রাষ্ট্রের দাবি জানানোর বিষয়টির সমালোচনা করেন। এ কাজকে কেউ কেউ হঠকারী ও অপরিনামদর্শী পদক্ষেপ হিসেবেও আখ্যায়িত করেন। কেউ কেউ আবার প্রধান বিচারপতি বরখাস্ত সংকট ও পশ্চিমাদের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে অসহযোগিতার পশ্চিমা অভিযোগের মধ্যে লাল মসজিদের ঘটনাকে সরকারী গোয়েন্দা সংস্থার একটা ট্র্যাপও মনে করেছেন। বিচারপতি বরখাস্ত কেন্দ্রিক আন্দোলনের তাপ থেকে দেশ-বিদেশের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়া এবং কঠোর হাতে লাল মসজিদ ওয়ালাদের দমনের মাধ্যমে সন্ত্রাসবিরোধী ইমেজকে কাজে লাগানোর সুযোগ সরকারের হাতে চলে আসে। জুলাই মাসের শুরুতে আবার শুরু হয় লাল মসজিদ ইস্যু। লাল মসজিদ মাদরাসার ছাত্রদের কর্তৃক দুটি সরকারী প্রতিষ্ঠানে হামলা, পুলিশের উপর গুলি বর্ষণ, প্রকাশ্যে ভারী অস্ত্র বহন এবং সরকারকে হুমকি দেওয়ার মধ্য দিয়ে এ ঘটনার পুনঃসূত্রপাত ঘটে। তিন চার দিন অতিবাহিত হয় লাল মসজিদ ঘেরাও করে রাখা সামরিক-আধাসামরিক বাহিনী আর লাল মসজিদে অবস্থান গ্রহণকারী ছাত্র-শিক্ষকদের হামলা পাল্টা হামলার মধ্য দিয়ে। সমঝোতা উদ্যোগও ব্যর্থ হয়। উভয় দিকে হতাহতের ঘটনা ঘটতে থাকে। এক পর্যায়ে গত ১০ জুলাই মঙ্গলবার সরকারী বাহিনীর ব্যাপক আক্রমণে লাল মসজিদের উপপ্রধান খতীব মাওলানা আব্দুর রশীদ গাজীসহ তার প্রধান সহযোদ্ধারা নিহত হন। লাল মসজিদ ক্যাম্পাস সরকারী বাহিনী দখল করে নেয়।

লাল মসজিদের ঘটনায় গোটা পাকিস্তান জুড়েই এখন বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। মোশাররফ সরকারকে আমেরিকার দোসর ঘোষণা করে তাকে উৎখাত করার দাবি উঠেছে। কিন্তু লাল মসজিদের ঘটনা চলাকালে সাধারণ আলেম উলামা কিংবা রাজনৈতিক শক্তি এ বিষয়ে তেমন উচ্চাবাচ্য করেছেন বলে দেখা যায়নি। আসলে দুচারশ গজের নিজস্ব একটি কমপ্লেক্সে কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা করে একটি প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ করে  ইসলামী রাষ্ট্রের ডাক দিলেই যে, হুড় হুড় করে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষের লোকেরা ছুটে আসেন না, এমনকি এ ধরনের কাজকে সমর্থনও দেন না বা দিতে পারেন না, এ ঘটনাটি তার একটি নজির হয়ে আছে। হঠাৎ করে কিছু অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেই যে, রাষ্ট্রের রূপরেখা বদলের কল্পনাও করা যায় না, এটা এখন সব দেশের সবাই বুঝে। বুঝলেন না লাল মসজিদের নেতৃবৃন্দ, বুঝলেন না আমাদের এখানকার জেএমবির সদস্যরা। রক্ত ঝরলো, জীবন গেলো আর দেশে-বিদেশে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিটি একটি আতংজনক দাবি বা শ্লোগানে পরিণত হলো। বর্তমান সময়ে জনমত গঠন এবং গণরায় বা গণ আন্দোলন ছাড়া কোনো মসনদ কিংবা পদ্ধতি বদলানোর কোনো সুযোগ নেই। এ সত্যটি বুঝতে দেরি করলে যে কোনো সময় ভয়ংকর সর্বনাশের কারণ ঘটে যেতে পারে। তবে, এর সঙ্গে এটাও সত্য যে, পাকিস্তানের তাবেদার সরকার এ ঘটনায় এত তাৎক্ষণিক একশনমুখি না হয়ে সময় নিয়েও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারতেন। সংলাপ, সমঝোতা অথবা সময় ক্ষেপন করে এ সংকটের রক্ষপাতহীন সমাধান অসম্ভব ছিল না। বিশেদি শক্তি নির্ভর স্বৈরশাসক যে, নিজের দেশের মানুষের প্রতি কত ভয়ংকর পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করতে পারে লাল মসজিদ তারও নজির হয়ে গেল।

লাল মসজিদ কতৃর্পক্ষকে অনমনীয় রেখে তাদেরকে কঠোর হাতে দমন করে পাকিস্তানী সরকার সন্ত্রাসবিরোধীআরেকটি ক্রিম তার মুখে ঘষে মুখটা পশ্চিমাদের সামনে উজ্জ্বল দেখানোর সুযোগ এ ঘটনায় হাতে পেল। মাঝখান থেকে বহু তাজা জীবন ঝরে গেল। বদনাম হলো মসজিদ, মাদরাসা ও ইসলামী শরীয়া আইনের আওয়াজ উত্তলনকারীদের। এটা বেদনাদায়ক, এটা দুঃখজনক।

দুর্ঘটনা, ভুল কিংবা আবেগ যে কারণেই লাল মসজিদদের চত্বর লাল হয়ে থাকুক, এটি যে ব্যক্তি বা দুনিয়াবী স্বার্থে ঘটেনি এটাতো সত্য। সেজন্যই ওই ঘটনায় নিহত প্রত্যেকের রূহের মাগফিরাতের জন্য আমরা দুআ করি এবং হঠাৎ রক্ত পাতের পথ বাদ দিয়ে দীর্ঘ দাওয়াতী ও জাগরণী উপায়ে দেশে দেশে ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখি।

 

 

advertisement