রজব ১৪২৮   ||   আগস্ট ২০০৭

নিরাপত্তা
সব সুমনের জন্যই সফল অভিযান দরকার

আবু তাশরীফ

টানা ১৪ দিন অভিযানের পর অপহৃত হোসেন শহীদ সুমনকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। ২৫ জুন বান্দরবনের দুর্গম খেবুরি পাড়ার এক সভা থেকে উপজাতীয় অপহরণকারীদের একটি দল তাকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। তার সঙ্গে তার ড্রাইভারকেও নিয়ে যায়। চারদিন পর ড্রাইভারকে উদ্ধার করা সম্ভব হলেও সুমনকে তখন উদ্ধার করা যায়নি। পুলিশ, বিডিআর, আর্মির যৌথ অভিযান চলতে থাকে। দুর্গম পাহাড়ী অঞ্চলের এক স্থান থেকে অন্যস্থানে হানা দিতে দিতে শেষ পর্যন্ত ৮ জুলাই লোশন পাড়ার ঝিরির কাছ থেকে অপহৃত সুমনকে একা উদ্ধার করে যৌথবাহিনী। এ অভিযানে পায়ে হেটে, গাড়ি নিয়ে এবং হেলিকপ্টার যোগেও অনুসন্ধান তৎপরতা চালানো হয়েছে। অপহরণের পর দিন থেকেই সহস্রাধিক যৌথবাহিনী সদস্যের এ অভিযানের প্রতিদিনকার অসাফল্যের খবর মিডিয়াতে প্রচারিত হতে হতে শেষমেশ সাফল্যের খবর এ অভিযানের সমাপ্তিটিকে অর্থবহ ও তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলে।

এ দেশের কোনো অপহরণঘটনার পর তাৎক্ষণিক, বড়মাপের ও উদ্ধারে মরিয়া কোনো প্রয়াস এবং শেষমেশ তার সাফল্যের ঘটনা বড় দাগে সম্ভবত এটিই প্রথম। নিঃসন্দেহে এ সাফল্য শান্তিদায়ক ও স্মরণযোগ্য। অপহরণের পর উদ্ধার হওয়া সুমনের পরিবারের সঙ্গে সঙ্গে গোটা দেশবাসীই এতে স্বস্তি পেয়েছেন এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের প্রতি অভিনন্দন জানিয়েছেন। ইতিপূর্বে চট্টগ্রাম শহর থেকে ব্যবসায়ী জামালউদ্দিন অপহৃত হওয়ার পর নিষ্ফল চেষ্টা, সরকারী আশ্বাস, দীর্ঘ অনিশ্চয়তা এবং শেষ পর্যন্ত তার কংকাল উদ্ধারের মধ্য দিয়ে অপহরণের একটি বেদনাদায়ক ও হতাশাজনক ঘটনা জাতি দেখেছে। অপহৃত কোনো নাগরিককে অপহরণকারী দুবৃত্তদের হাত থেকে উদ্ধারের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র বা সরকারের উদ্যোগের অপর্যাপ্ততা ও ব্যর্থতা দেখে স্তম্ভিত হয়েছেন মানুষ। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ অপহরণ প্রবণঅঞ্চলগুলোতে এরপর বহু পরিবার বাধ্য হয়ে ভীতিকাতর দিনরাত পার করেছেন। অপহরণ ও জিম্মি করার পেশায় নিয়োজিত পেশাদার দুর্বৃত্ত, খুনী ও অর্থপাগল শ্রেণী হয়েছে উৎসাহিত। ধরেই নেওয়া হয়েছিল, কেউ অপহৃত হওয়ার অর্থ হলো অপহরণকারীদের অমানবিক দাবি-দাওয়া মেনে তাকে উদ্ধারের চেষ্টা করা কিংবা অনাঘাতে মৃত্যুর পর কাফন-দাফন বিহীন কোনো পাহাড়ী গুহায় নিখোঁজ কংকালে পরিণত হওয়া। সুমন-উদ্ধারের ঘটনায় অপহরণ নিয়ে প্রান্তিক এই হতাশা থেকে নাগরিক সাধারণের উত্তরণের একটি আশাব্যঞ্জক উপলক্ষ্য সৃষ্টি হয়েছে। নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্র ও সরকারের দায়-দায়িত্বের এই ইতিবাচক প্রকাশের ক্ষেত্রটি ভবিষ্যতে আরো ব্যাপক ও বিস্তৃত হওয়া দরকার।

হোসেন শহীদ সুমন কেবল এদেশের একজন নাগরিক ছিলেন না, ডেনমার্ক সরকারের দাতা সংস্থা ডানিডার তিনি ছিলেন প্রকল্প কর্মকর্তা। দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের গা ছাড়া ঐতিহ্যও নাগরিকদের জানমালের সমস্যা নিয়ে সরকারের আন্তরিক উদ্যোগের দীর্ঘসূত্রিতালক্ষ্য করে যারা বাস্তব কারণে হতাশাবাদী তাদের অনেকেই-সুমন উদ্ধারের নিরবচ্ছিন্ন অভিযান ও সাফল্যের পেছনে এই ডেনিশ-কানেকশনকে বড় করে দেখছেন। তারা মনে করেন, উন্নতবিশ্বের একটি দেশের কোনো একটি সংস্থার সঙ্গে যুক্ত না হলে সুমনের জন্য এত বড় ও এত দীর্ঘ অভিযান পরিচালিত হতো কি না সেটা বলা যায় না।

এ ধরনের মনোভাবকে কি একদম উড়িয়ে দেওয়া যায়? আইন-শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে নাগরিক সাধারণের জন্য সরকারের দায়িত্ব চর্চার যে নমুনা অহরহ চোখের সামনে বিদ্যমান তাতে একজন নাগরিকের জন্য এটি একটি বিশেষ নজির। আমরা মনে করতে চাই, সুমন এ দেশের একজন নাগরিক হওয়ার কারণেই প্রশাসনের এত বড় মনোযোগ পেয়েছেন, মিডিয়ার এত দৃষ্টি কেড়েছেন এবং আমরা দেখতে চাই, ভবিষ্যতে এ ধরনের পরিস্থিতি ঘটলে ডানিডা-ফানিডার সঙ্গে যুক্ত না থেকেও এ দেশের যে কোনো হোসেন, যে কোনো শহীদকিংবা যে কোনো সুমনেরজন্য প্রশাসন এভাবেই তৎপর হবে, এভাবেই সফল হবে। মিডিয়াও এভাবে দৃষ্টি কাড়বে, এভাবে ফলোআপ করে যাবে।

সুমনকে উদ্ধারে যৌথবাহিনীর চেষ্টা ও সাফল্যকে যদি সরকারেরই একটি সফল আন্তরিক উদ্যোগ হিসেবে চিহ্নিত করা যায় তাহলে প্রাসঙ্গিক কারণেই বলতে হয়, একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণায় নাগরিক নিরাপত্তার দাবি যেমন এভাবে পূরণ করতে হয়, তেমনি নিরাপত্তার অঙ্গন ও ক্ষেত্রকেও সর্বাত্মক করে দেখতে হয়। কেবল দুর্গম পাহাড়ী অঞ্চলে অপহরণই যেন বজ্র নিরাপত্তা প্রোগ্রামের একমাত্র সাবজেক্টে পরিণত না হয়, দেশের সব গ্রাম ও শহরের বাসিন্দাদের বাসস্থানে, কর্মক্ষেত্রে এবং চলার পথে যেন নিরাপত্তা কোনোভাবে বাধাপ্রাপ্ত না হয়, জীবনের সামনে জীবনবিনাশী কোনো হুমকি ও আতংক এসে না দাঁড়ায়, প্রশাসনের আন্তরিক উদ্যোগ সেসবক্ষেত্রেও বিস্তৃত হওয়া কাম্য। সুমন-উদ্ধার আইন শৃঙ্খলা নিয়ে নাগরিক মনে যে স্বস্তি দেওয়ার উপলক্ষ্য তৈরি করেছে রাস্তার ছিনতাইকারী, মহল্লার মাস্তান অফিসের চাঁদাবাজ এবং গ্রামের ডাকাত যেন সে স্বস্তি কেড়ে নিতে না পারে সেদিকে প্রশাসনের সজাগ দৃষ্টি রাখলে দেশ, সমাজ, নাগরিক ও সরকার- সবারই কল্যাণ হবে।

 

 

advertisement