শাওয়াল ১৪৪৪   ||   মে ২০২৩

দাঈদের জন্য অনুষ্ঠিত কর্মশালা
সংক্ষিপ্ত রোয়েদাদ

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দ্বীনী দাওয়াতী কাজে জড়িত কয়েকজন আলেমের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে ফরমায়েশ আসছিল, যেন তাদের তত্ত্বাবধানে কাজ করা দাঈ উলামায়ে কেরামকে মারকাযুদ দাওয়াহ্য় একত্র করে একটি নির্দেশনামূলক কর্মশালার আয়োজন করা হয়। সে লক্ষ্যে গত ৪ শাবান ১৪৪৪/২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ শনিবার মারকাযুদ দাওয়াহর জামে মসজিদে দাঈদের জন্য দিনব্যাপী কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রায় আড়াইশ দাঈ উলামায়ে কেরাম এবং তাদের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনায় নিয়োজিত মুরব্বী আলেমগণ অংশগ্রহণ করেন। উক্ত মজলিসের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ছিল মারকাযুদ দাওয়াহর আমীনুত তালীম মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ছাহেবের পেশ করা দাঈর কিছু গুণ এবং দাওয়াত সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শীর্ষক গুরুত্বপূর্ণ একটি নিবন্ধ। উক্ত মজলিসের সংক্ষিপ্ত রোয়েদাদ আলকাউসারের পাঠকদের উদ্দেশে পেশ করা হল।

প্রস্তুত করেছেন মাওলানা মুহাম্মাদুল্লাহ মাসুম। সম্পাদক

 

কুরআন কারীম তিলাওয়াতের মাধ্যমে মজলিসের সূচনা হয়। এরপর মাওলানা নাজমুদ্দীন সাহেব দাওয়াতুল ইসলামের দাওয়াতী কারগুযারী পেশ করেন। তারপর মাওলানা যুবায়ের আহমদ সাহেব ইসলামী দাওয়াহ ইনস্টিটিউট-এর দাওয়াতী কারগুযারী শোনান। হযরত মাওলানা আব্দুর রাযযাক নদভী দামাত বারাকাতুহুম দাওয়াতুল ইসলামের কার্যক্রমের শুরুর ইতিহাস তুলে ধরেন। এরপর অন্যান্য মুরব্বিগণ উপস্থিত দাঈদের উদ্দেশে গুরুত্বপূর্ণ হেদায়েত পেশ করেন।

মজলিসের শুরুতেই হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ছাহেব দা. বা. বলেন

তাবাদুলে আরা ও তাবাদুলে খেয়াল তথা পরস্পর মতবিনিময় এবং পরস্পর মুযাকারা-আলোচনা সালাফে সালেহীনের সুন্নত। সাহাবা যুগ থেকেই এই সিলসিলা চলছে। পরস্পর মুযাকারার সিলসিলা ইমামগণের মাঝে, উলামা-মাশায়েখের মাঝে ছিল। আগের উম্মতের মধ্যেও ছিল। এখন যে বিষয়টি মাফকূদ বা একেবারে হারিয়ে গেছে, তা নয়। এখনো কমবেশি আছে।

আলোচনার একপর্যায়ে তিনি বলেন আল্লাহ তাআলা মুমিনকে দুটি হাইসিয়ত দান করেছেন :

এক. নিজেকে গড়া। নিজের মধ্যে ঈমানী যিন্দেগী ও ঈমানী গুণাবলি নিয়ে আসা। একজন মুমিন, মুসলিম, মুহসিন ও মুত্তাকী হিসেবে নিজেকে এবং নিজের পরিবারকে গড়ে তোলা।

দুই. এ গুণগুলোর হেফাজতের জন্য এবং নিজের ইসলাহের ইতমাম ও পূর্ণতার জন্য অন্যদেরকে নিয়ে ভাবা। সেই হিসেবে সবাই খাদেমে দ্বীন।

তিনি আরো বলেন আমাদের প্রত্যেকেই খাদেমে দ্বীন। দ্বীনের খাদেমগণের মাঝে পরস্পর মুযাকারা জরুরি। যাতে একে-অপর থেকে আমরা উপকৃত হতে পারি।

আমার ভাইয়ের সাথে যখন মুযাকারা হবে, আমার কোনো খামি ও কমতি থাকলে সেটা স্পষ্ট হবে। আমি সহজে নিজের ইসলাহ করতে পারব। আমার মধ্যে কোনো কিছু তাঁর নযরে আসতে পারে, যেটাকে হয়তো তিনি অনুসরণীয় ভাবতে পারেন। সেই হিসেবে তাবাদুলে খেয়াল ও মতবিনিময় হওয়া ভালো।

হুযুর মজলিসের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেন দ্বীনের খেদমতের তো অনেক প্রকার। বিশেষত এক নাউ বা প্রকারের খাদেমীন যারা, তাদের মাঝে এই ধরনের তাবাদুলে খেয়াল ও মুযাকারা আরো বেশি উপকারী।

বিশেষত, দ্বীনী খেদমতগুলোতে নযম ও নসক দরকার। প্রয়োজনে সেটা আমাদের নিজেদের উদ্যোগেই করতে হবে, ব্যবস্থা নিতে হবে।

মজলিসে মারকাযুদ দাওয়াহর রঈস ও মাসিক আলকাউসারের মুহতারাম সম্পাদক মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ ছাহেব দা. বা. খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু হেদায়েত পেশ করেন। তিনি বলেন

দাঈ, দাওয়াহ বিভাগ বা দাওয়াতি সংগঠন এগুলো আমাদের এই অঞ্চলে অনেক পুরনো পরিভাষা নয়। তার মানে এই নয় যে, দাওয়াতী কাজ পুরো বন্ধ ছিল। না, ব্যাপারটা এমন নয়। বরং আগেও দাওয়াতের কাজ ছিল এবং সেটা আলেমদের স্বভাবের মধ্যেই তখন ছিল।

তারপর তিনি শুনিয়েছেন তাঁর প্রিয় প্রতিষ্ঠান, শৈশবের শিক্ষালয় খেড়িহর মাদরাসার প্রতিষ্ঠাকালে চারপাশের প্রতিকূল পরিবেশ এবং মহল্লার মানুষদের বিরূপ হালচাল। শুনিয়েছেন দাওয়াতের কোন্ পথ ও পন্থা প্রয়োগের মাধ্যমে মাদরাসার মুরব্বী ও কর্তাব্যক্তিগণ উতরে ওঠেছেন এই সংকট থেকে, সেই গল্প। শুধু তাই নয়, এর ফলে মাদরাসার যহেরী-বাতেনী কী কী কল্যাণ সাধিত হয়েছে, সম্ভাব্য কী কী আশঙ্কা থেকে পরবর্তীতে মাদরাসা নিরাপদ থেকেছে, সেই বিষয়টিও উঠে এসেছে তাঁর আলোচনার মধ্য দিয়ে। তিনি বলেন

আমি ও মাওলানা আবদুল মালেক সাহেব যে মাদরাসায় পড়েছি, খেড়িহর মাদরাসা। শুরুর সময়ে চারদিকের লোকজন মাদরাসার বিরোধী ছিল। ছোট্ট একটা টিনের ঘরে মাত্র মাদরাসা চালু হল। যোগ্য যোগ্য উসতাযগণ আছেন। কিন্তু মাদরাসা থেকে বের হলেই দেখতাম, আমাদের বাঁকা চোখে দেখা হয়। ওহাবী বলা হয়। মাদরাসার চিন্তার পক্ষে লোক ছিল না বললেই চলে।

কিন্তু আমরা লক্ষ্য করলাম, এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে হুযুররা কী বড় কাজই না করেছেন! গ্রামের এবং আশপাশের লোকদের বিরোধিতাকে তাঁরা কোনো পরওয়া করেননি; বরং বেশ কয়েকজন উসতায তালীমের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের দাওয়াতী মেহনত চালিয়ে গেছেন। ওপরের জামাতের তালিবে ইলমদেরও বিভিন্ন মহল্লায় জায়গির দিয়েছেন। অথচ বোর্ডিংয়ে খাবারের ব্যবস্থা সবার জন্যই ছিল। অনেক জায়গায় সাবাহী মকতবের ব্যবস্থা করেছেন। হুযুররা মানুষের সাথে আখলাকে হাসানার চর্চা করেছেন। কারো রোগ-শোক হলে খবর নিতে যেতেন। একটু ফু দিয়ে আসতেন। পানিপড়া দিয়ে আসতেন। কারো বাড়িতে বিবাহ-শাদি হলে বিবাহ পড়িয়ে দিয়ে আসতেন। এককথায় দরদ ও আন্তরিকতার সাথে তাদের সঙ্গে মিশতেন এবং তাদের যাবতীয় কাজ করতেন। সুখে-দুঃখে তাদের সাথে থাকতেন। সে আমার বিরোধী, এই পরোয়া করতেন না। ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। ওই এলাকায় এবং এর আশপাশের গ্রামগুলোতে এখন বহু আলেম তৈরি হয়েছে। এখন মাদরাসার বিরোধী নেই বললেই চলে।

আমি বলতে চাচ্ছি, তালীম ও তাদরীসের সাথে তাঁরা যে কাজগুলো করেছেন, এ কেবল নির্দিষ্ট অঞ্চল বা খেড়িহরের কথা নয়। এটা ছিল দেশব্যাপী। আমাদের উপমহাদেশের মুরব্বীগণ তালীম, ইমামত, খেতাবতের সাথে সাথে ফিতরীভাবেই দাওয়াতের কাজগুলো করেছেন। এর বদৌলতেই ইসলাম আছে এবং চারদিকে মুসলমান আছে। এটা তাদেরই কারণে।

তিনি আরো বলেন

প্রত্যেক বিভাগেই যখন দেখা যায়, সাধারণ পদ্ধতিতে কাজ হচ্ছে না, তখন আলাদা ব্যবস্থা নিতে হয়। সেটা কার্যকরও হয়। তো দাওয়াতের জন্য এখন যে আয়োজন আমাদের ভাইয়েরা করছেন, করে যাচ্ছেন, এটা সময়ের একটা দাবি। এটা যত সুন্দর ও সুশৃঙ্খল হবে, ততই পুরো দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণকর হবে।

দাওয়াতের পদ্ধতি কেমন হবে এ বিষয়ে তিনি বলেন

একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, আপনার দাওয়াত যে আঙ্গিকেই হোক, অর্থাৎ সরাসরি ঈমান ও আমলে সালেহের দাওয়াত কিংবা বাতিল মতবাদের খণ্ডনের মাধ্যমে দাওয়াত, সবই ইসবাতি ও ইতিবাচকভাবে করতে হবে। মাওলানা আবুল বাশার ছাহেব ইশারা দিয়ে গেছেন। কারো কোনো মতবাদের রদ করতে হলে সেটাও আন্তরিকতার সাথে এবং সুন্দর আখলাকের সাথে করা। যাতে তার কল্যাণকামিতা প্রকাশ পায়।

দাঈদের পরস্পর সহযোগিতা এবং আওয়ামের সাথে চলার ক্ষেত্রে সতর্ক পদক্ষেপ বিষয়ে তিনি বলেন

বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখেছি, বিভিন্ন মুরব্বীর পক্ষ থেকে বিভিন্ন দাঈ কাজ করেন। একেকজন হয়তো একেক কাজ করছেন। সবার মাঝে পরস্পরের সম্পর্ক অবশ্যই যাতে সহযোগিতাপূর্ণ থাকে। একজন আরেকজনের পরিপূরক ও সম্পূরক থাকবে। পেছন থেকে একজন আরেকজনের দোষচর্চা করা বা ইঙ্গিতপূর্ণ কথার চর্চা বা এজাতীয় কিছু একেবারেই কাম্য নয়। এমন নয় যে, আপনাদের মধ্যে এগুলো আছে; বরং এমনিতেই বলে রাখছি।

আমাদের এখানে কিসমুদ দাওয়াহর সাথীভাইদের আমি বলে থাকি, আপনারা যখন দাওয়াতের কাজে যাবেন তখন আপনাদের আর মাদরাসার ভেতরে যারা থাকেন, তাদের মাঝে মৌলিক পার্থক্য আছে। সেটা হল, আমি আপনি আমরা যখন আমাদের মাদরাসার পরিবেশে থাকি, তখন আমরা নিজেরা নিজেরা। আমাদের দোষত্রুটিগুলো আমাদের মধ্যেই সীমিত থাকে। সেটা কেবল আমরাই দেখি। কিন্তু যখন আমরা বাইরে যাই, তখন আমি চাই আর না চাই, প্রস্তুত থাকি আর না থাকি, আমার দিকে কিন্তু দৃষ্টি রাখা হয়। আমাকে কিন্তু অনেকে দেখে। আমার ওঠা-বসা, চলা-ফেরা, চাল-চলন, মুআমালা-মুআশারা সবই প্রত্যক্ষ করা হয়। যা আমি বলি, তার ওপর আমার কতটুকু আমল আছে, সেটাও তারা দেখে। ফলে আমার ভেতরের বিষয়, আখলাক-তবিয়ত, স্বভাব-চরিত্রগুলো না চাইলেও মানুষের সামনে চলে আসে। কেমন যেন আমরা সিসি ক্যামেরার আওতায় থাকি। চব্বিশ ঘণ্টাই নজরদারিতে। আসলে যার যত ফযীলত, কষ্টও তার তত বেশি। সতর্কতাও বেশি। দাঈর ফযীলতও বেশি, অন্যদের তুলনায় তার কষ্ট ও সতর্কতাও বেশি। আমরা যারা মাদরাসায় থাকি, মাদরাসায় কাজ করি, দাঈকে তার ময়দানে এর চেয়ে বেশি সতর্ক ও সচেতন থাকতে হয়।

দাওয়াতী কাজের প্রচার-প্রচারণার ক্ষেত্রে কী মূলনীতি হওয়া চাই এদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন

সব কাজের সংবাদ প্রচার করতে হয় না। কিছু কাজে সতর্কতারও দরকার হয়। সেখানে চুপচাপ থাকা ভালো। আর যেখানে একটু প্রচার-প্রচারণা একটু জানাজানি করে দিলে উপকার হবে, সেখানে জানিয়ে দেওয়া যায়। আমাদের বর্তমান দেশীয় প্রেক্ষাপট, বিশ্বপ্রেক্ষাপট, দুশমনানে ইসলামের হালত, সবকিছু মাথায় রাখতে হয়। মুরব্বীদের থেকে মশওয়ারা নেওয়া যে, কোন্ সংবাদ প্রচার করা ভালো আর কোন্ সংবাদ প্রচার না করা ভালো। সবগুলোর জন্য এক হুকুম প্রযোজ্য নয়।

দাঈর খাস পড়াশোনা ও প্রস্তুতি বিষয়ে তিনি বলেন

একজনকেই সব ফিরকার রদ করতে হবে এটা জরুরি নয়। একজনকে সব ফিরকা সম্পর্কে পড়তে হবে তাও নয়। এটা অনেক কঠিনও। যে যে বিভাগে কাজ করছেন, তিনি মৌলিকভাবে ওই বিভাগের বিষয়গুলো ভালো করে পড়বেন আর দ্বীনের মৌলিক ও সাধারণ জ্ঞান তো সকলেরই থাকা আবশ্যক।

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন

এক হল আইন আরেক হল দেশীয় বাস্তবতা। দেশের সংবিধান অনুযায়ী সবাই তার ধর্মের প্রচার করতে পারে। আমরাও পারি, অন্যরাও পারে। কিন্তু বাস্তবতা অনেক সময় ভিন্ন হয়। তাই আপনি যখন আইনের দোহাই দিয়ে সরাসরি আপনার ধর্মের প্রচার করবেন, তারা হয়তো অন্যভাবে আপনাকে ঝামেলা করে বসবে। এজন্য হিকমার দরকার হয়। মুরব্বীদের সঙ্গে পরামর্শ করে তাঁদের নির্দেশনামতো কাজ করতে হবে।

তবে হাঁ, হিকমতের দোহাই দিয়ে যেন আমরা আদর্শবিচ্যুত না হই এদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন

হিকমাহ মানে নিজের আদর্শ থেকে সরা নয়। নিজের আকীদা-বিশ্বাস, চিন্তা-চেতনা থেকে বিচ্যুতি নয়।

নওমুসলিমের সাথে ভারসমাম্যপূর্ণ আচরণ বিষয়ে তিনি  বলেন

নতুন করে কেউ আপনার দাওয়াতে ইসলাম কবুল করলে তাকে একসাথে দ্বীনের সব দিয়ে দিতে হবে এমন নয়। বরং তার ধারণ ক্ষমতা  ও অবস্থা অনুযায়ী বলা। হালাল-হারামের সবগুলো একসাথে বললে তার জন্য কঠিন হয়ে যেতে পারে। বরং ধীরে ধীরে কিছু কিছু করে বলব। যাতে তার জন্য সহজ হয়।

মজলিসে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা রাখেন হযরত মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম ছাহেব দা. বা.। তিনি কয়েকটি মৌলিক বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি বলেন

ইলম ও তাকওয়ার ভিত্তিতে যারা আল্লাহর পথে দাওয়াতের কাজ করেন তাঁরা তো সত্যিই আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের প্রতিনিধিত্ব করেন। আমাদের এই কাজ আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের প্রতিনিধিত্ব। যেই সেই কাজ নয় এটা।

এটা যদি বুঝি তাহলে দ্বিতীয় পর্যায়ে আরেকটা জিনিস বুঝতে হয়। তা হল, এই প্রতিনিধিত্ব করার কতটুকু ক্ষমতা আমার আছে? আমার সামর্থ্য কতটুকু? আমি কতটুকু পারি? নিজ সামর্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা খুবই জরুরি। এটা কেবল এই দাওয়াতের ময়দানেই নয়, সকল ক্ষেত্রেই জরুরি। সামর্থ্য সম্পর্কে সচেতন না থাকার কারণে অনেক বে-জাহ দাবি-দাওয়া আমরা করে বসি এবং এটা নানা ফিতনার কারণও হয়ে যায়। বিভিন্ন মাদরাসা, প্রতিষ্ঠান বা কোনো সংগঠনে গেলে অনেক সময় আমি নিজ সামর্থ্যের চেয়ে বেশি দাবি করি। আমি হয়তো আমার সামর্থ্য সম্পর্কে সচেতন নই, কিন্তু অন্যরা সচেতন। আর সচেতন বলেই আমার বেজাহ দাবিকে তারা গুরুত্ব দেয় না। তখন আমি মন খারাপ করি। একসময় মন খারাপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং তার প্রকাশও ঘটতে থাকে। এজন্য খুব বেশি জরুরি, নিজের সামর্থ্য সম্পর্কে সচেতন থাকা। যতটুকু আমার সামর্থ্যে আছে, আমি যাতে তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকি। সামর্থ্যের বাইরে পা না বাড়াই। দ্বীনের যে ধরনের খেদমতই হোক, আমি যতটুকু পারব ততটুকুই করব। যেটা আমি পারি না, সেই বিষয়ে প্রস্তুতি নেব। কিন্তু এখন করব ততটুকুই, যতটুকু পারি।

এখন তো কঠিন কঠিন বিষয় সামনে এসে গেছে। কাদিয়ানী, খ্রিস্টান মিশনারী, নাস্তিক্যবাদ, আন্তঃধর্মীয় মতবাদ, আহলে কুরআন-এর মতো ফিতনাগুলো, এগুলো বুদ্ধিবৃত্তিক। এগুলো এমন নয় যে, কেবল একটা কথা বলে ফেলল; বরং তারা এগুলোকে দালীলিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছে এবং এর জন্য কুরআন কারীমের বিভিন্ন আয়াত ও হাদীস থেকে বিকৃতি করে দলীল দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু আমার যদি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দক্ষতা না থাকে, আমি তো প্রথমেই কুপোকাত হয়ে যাব। একটা আয়াত সামনে নিয়ে এল, অথচ আমার ওই আয়াতের ব্যাখ্যা কিছুই জানা নেই। আমি কী করে তার জবাব দেব? এজন্য আমি কতটুকু পারি, সেই বিষয়ে খুব সচেতন হওয়া চাই।

আমি পারি কেবল নামাযের দাওয়াত দিতে, আমি নামাযেরই দাওয়াত দেব। আমি পারি মানুষকে বিভিন্ন সুন্নত সম্পর্কে সচেতন করতে, ব্যস, আমি এতটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকব।

আমি জানি না ডারউইনের বিবর্তনবাদ কী জিনিস, এখন আমি যদি এই বিষয়ে কথা বলতে যাই, সেখানে কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে বসে, হুজুর! বিবর্তনবাদ কী, তখন তো আমি জবাব দিতে পারব না। বরং তখন আমি হাসির খোরাক হয়ে যাব। এজন্য আমার কোনটা জানা আছে, কোনটা জানা নেই, আমি কতটুকু পারি, কতটুকু পারি না, সেই বিষয়ে খুব সচেতন থাকা দরকার।

তবে যেহেতু আমি দাঈ, মাঠে নেমেছি, তাই যেটা পারি না, সেটা পারারও চেষ্টা থাকতে হবে। আমি বসে থাকব না, বরং প্রস্তুতি এবং পড়াশোনা চালিয়ে যাব। কারণ সেখানেও তো কারো না কারো কাজ করার দরকার আছে। আমি যদি প্রস্তুতি না নিই, তাহলে ওই ময়দান কি এমনিতেই ছেড়ে দেওয়া হবে? এভাবে কেউই যদি প্রস্তুতি না নেয়, তাহলে তো খোলা মুক্ত ময়দান বাতিলের জন্য ছেড়ে দেওয়া হবে। সেটাও তো হতে পারে না। এজন্য যতটুকু আমার সামর্থ্যে আছে, সেই বিষয়ে কাজ করে যাব আর যেটা আমি পারি না, সেই বিষয়ে প্রস্তুতি নিতে থাকব।

দাওয়াতের ক্ষেত্রে আমাদের আলোচনা ও বক্তব্য হতে হবে বস্তুনিষ্ঠ এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন

আমি যে বিষয়ে পারি, সেখানেও অনেক কিছু লক্ষ্য করার আছে। শুধু জবানদারাযী নয় যে, কেবল কথার খই ফুটাতে থাকলাম, কিন্তু সারবস্তু একেবারে কম। দেখুন, বর্তমানের মানুষ বড় হুঁশিয়ার। কে কী বলেছে, মানুষ তার বিচার করে। অনেক সময় আমরা ইলযামি জবাব দিয়ে সেরে দিতে চাই। এতে মানুষ কিন্তু খুশি হয় না। সে এটা বোঝে যে, আমাকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। তার জানাশোনা কিছু নেই, এখন ইলযামি জবাব দিয়ে গা বাঁচাচ্ছে! এজন্য যে বিষয়ে কিছু সামর্থ্য আছে, সেখানেও কথা হওয়া দরকার বস্তুনিষ্ঠ।

দাওয়াতের ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের সম্মান বজায় রেখে দাওয়াত দেওয়া। এ মূলনীতি তুলে ধরে তিনি বলেন

বস্তুনিষ্ঠ কথাও হওয়া উচিত প্রতিপক্ষের ইহতিরাম ও সম্মান বজায় রেখে। বাস্তবিক অর্থে আমার প্রতিপক্ষই বা কে? সবই আমার পক্ষের। ও তো অসুস্থ। বোঝে না। পথ হারিয়ে ফেলেছে। তাই তার হাত ধরে তাকে পথে নিয়ে আসা আমার কাজ। সেজন্যই আমি মাঠে নেমেছি। কাজেই আমার কোনো প্রতিপক্ষ নেই। আমি যখন দাঈ, সবাই আমার মাদঊ। সবাই যখন আমার মাদঊ, কেউ আমার শত্রু নয়, তাই তাদের প্রতি দিলে দরদ থাকতে হবে। দরদের সঙ্গে কথা বলতে হবে এবং তার আজমত রক্ষা করতে হবে। আমরা কথাবার্তায় অনেক বেপরোয়া। মানুষের আজমত রক্ষা করি না। অথচ সব মানুষেরই মানবিক মর্যাদা আছে। তাছাড়া দলগত বা ঘরানাগত তার একটা অবস্থানও আছে। সেই হিসেবে সে নিজেকে একটা মর্যাদার অধিকারী মনে করে। তাই আমার কথাবার্তায় যাতে তার মর্যাদায় আঘাত না লাগে।

কারো মর্যাদায় আঘাত করা দাওয়াত কবুল হওয়ার পথে একটা বাধা। বরং উন্নাসিকতা ও অহমিকা যেসব লোকের মধ্যে আছে তারা তো ঈমান থেকেও বঞ্চিত থেকে যায় কেবল অহমিকার কারণে। সে মনে করে, এই দাওয়াত কবুল করলে আমি এখন যে পজিশনে আছি সেটা থাকবে না। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই পদ হারিয়ে ফেলল, এজন্য সে বিদ্বেষ ও হঠকারিতার শিকার হয়ে গেল। আত্মমর্যাদাবোধ ও আত্মাভিমান একটা সাংঘাতিক জিনিস, যা সকলেরই আছে। কারো আত্মাভিমানে আঘাত করা উচিত নয়। আঘাত করলেই তাকে জিদ পেয়ে বসে। এতক্ষণ হয়তো তাকে পথে আনা কিছুটা হলেও সহজ ছিল, যেই না জিদ পেয়ে গেল, এখন আর সহজ হবে না। এজন্য মঞ্চে কথা বলার সময়ও আমাদের এই বিষয়টা মাথায় রাখতে হবে।

হাকীমুল উম্মত হযরত থানভী রাহ.-এর সামনে কেউ একজন বলেছিল আহমদ রেজা খান। তারপর তার সম্পর্কে কোনো কথা বলছিল।

তখন হযরত থানভী রাহ. বললেন তুমি মাওলানা বললে না কেন? তিনি কি মাওলানা নন?

এর মধ্যে আমাদের জন্য শিক্ষা রয়েছে।

যাইহোক, অন্যের ইহতিরাম বজায় রাখা আমাদের ইসলামের শিক্ষা। দাওয়াতের ক্ষেত্রে এটা আরো বেশি জরুরি। এমন কোনো কথা বলব না, যেটা তার আত্মমর্যাদা ও আত্মাভিমানে লেগে যায়। বরং তাকে আকৃষ্ট করার জন্য যেসব পন্থা দরকার, সেসব অবলম্বন করব। দরদ ও বিনয়ের সঙ্গে কথা বলব।

আমাকে একবার একজন এক সফরে প্রশ্ন করেছিল, তাদেরকে দাওয়াত কীভাবে দেব? দাওয়াত দিতে গেলে তো তারা মারমুখী হয়ে ওঠে?

আমি বললাম, মারমুখী হয়ে ওঠে, এরকম অবস্থায় তুমি দাওয়াত দিতে যাও কেন? তুমি কথা বললেই সে মারমুখী হয়ে উঠবে এমন অবস্থায় তুমি তার কাছে দাওয়াত নিয়ে যাবে না! বরং আগে তার সঙ্গে মেলামেশা কর। চা খাও, কথাবার্তা বল! বিভিন্ন কৌশলে তার মন জয় করার চেষ্টা কর। বিভিন্নভাবে যখন ক্ষেত্র তৈরি হবে, এরপর তুমি দাওয়াত দাও! তখন আর মারমুখী হবে না। বরং এমনও হতে পারে, তখন আর তাকে দাওয়াতও দিতে হবে না। এমনিতেই সে তোমার সাথে চলে আসবে। 

যাইহোক, পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে দাওয়াত দেওয়া। তাকে কতটুকু কথা বলা যাবে, সেটা ভালো করে ভাবা। একেবারে শেষ কথাটা কি এখনই বলব, না আরেকটু অপেক্ষা করব! শেষ কথাটা শুরুতে বলে দিলে অনেক সময় হিতে বিপরীতও হয়ে যেতে পারে। তাই দাওয়াতের ক্ষেত্রে পর্যায়ক্রম রক্ষা করা। বলা হয়েছে

اُدْعُ اِلٰی سَبِیْلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ.

এখানে হিকমাহর অর্থ উলামায়ে কেরাম ভালো জানেন। এমনিতে হিকমত অর্থ যদি প্রজ্ঞা হয়ে থাকে, তাহলে প্রজ্ঞা অর্থ আমরা জানি জ্ঞানের যথোচিত ব্যবহার। হিকমত যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে আয়াতের অর্থ হল, দাওয়াত যাতে যথোচিত হয়। স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনা করে দাওয়াত দেওয়া হয়। আমি কোন্ জায়গাতে, কোন্ পরিবেশে দাওয়াত দিচ্ছি? কোন সময়ে দাওয়াত দিচ্ছি? সময়টাও লক্ষ্য করা। ব্যক্তি ও সামষ্টিক, সকল দিক থেকে সময়টা বিবেচনা করা। যাকে দাওয়াত দেব, তাকেও পড়া। সে কোন্ স্তরের লোক, সেটা নির্ণয় ও পরিমাপ করা। এমনও তো হতে পারে, যাকে আমি দাওয়াত দিতে গেলাম, সে এমন এক ব্যক্তি যে, আমার কাজ নয় তাকে দাওয়াত দেওয়া। হতে পারে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আমার জানাশোনা আছে, কিন্তু এই লোক বড় অন্যরকম। তাকে দাওয়াত দেওয়ার জন্য আরো পরিপক্ব লোক দরকার।

তিনি আরো বলেন, (আমি খেয়াল রাখব) আমার দ্বারা যাতে হক ও হক্কানিয়াতের কোনো বদনাম না হয়

দাওয়াতের ময়দানে আমি যেন যথাযথভাবে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিনিধিত্ব করতে পারি। এমন যেন না হয় যে, আমার দ্বারা ঘরানার বদনাম হচ্ছে। হক ও হক্কানিয়াতের বদনাম বা ক্ষতি হচ্ছে। আমাদের আচার-আচরণ অনেক সময় এরকম হয়। এজন্য কথাবার্তা, আচার-আচরণ অবশ্যই সংযত হওয়া দরকার। যাতে আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের বরকতপূর্ণ, পবিত্র ও বিশুদ্ধ এই কাজের প্রতিনিধিত্ব আমাদের দ্বারা হতে পারে।

 এরপর গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা রাখেন হযরত মাওলানা আবদুল গাফফার ছাহেব দা. বা.। তিনি সূরা রাদ-এর ১৭ নং আয়াত তিলাওয়াত করেন

اَنْزَلَ مِنَ السَّمَآءِ مَآءً فَسَالَتْ اَوْدِیَةٌ بِقَدَرِهَا فَاحْتَمَلَ السَّیْلُ زَبَدًا رَّابِیًا وَ مِمَّا یُوْقِدُوْنَ عَلَیْهِ فِی النَّارِ ابْتِغَآءَ حِلْیَةٍ اَوْ مَتَاعٍ زَبَدٌ مِّثْلُهٗ   كَذٰلِكَ یَضْرِبُ اللهُ الْحَقَّ وَ الْبَاطِلَ   فَاَمَّا الزَّبَدُ فَیَذْهَبُ جُفَآءً وَ اَمَّا مَا یَنْفَعُ النَّاسَ فَیَمْكُثُ فِی الْاَرْضِ   كَذٰلِكَ یَضْرِبُ اللهُ الْاَمْثَالَ.

[তিনিই আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেছেন, ফলে নদীনালা আপন-আপন সামর্থ্য অনুযায়ী প্লাবিত হয়েছে, তারপর পানির ধারা স্ফীত ফেনাসমূহ উপরিভাগে তুলে এনেছে। এরকমের ফেনা সেই সময়ও ওঠে, যখন লোকে অলংকার বা পাত্র তৈরির উদ্দেশ্যে আগুনে ধাতু উত্তপ্ত করে। আল্লাহ এভাবেই সত্য ও মিথ্যার দৃষ্টান্ত বর্ণনা করছেন যে, (উভয় প্রকারে) যা ফেনা, তা তো বাইরে পড়ে নিঃশেষ হয়ে যায় আর যা মানুষের উপকারে আসে তা জমিতে থেকে যায়। এ রকমেরই দৃষ্টান্ত আল্লাহ বর্ণনা করে থাকেন। সূরা রাদ (১৩) : ১৭]

উপরোক্ত আয়াতের আলোকে তিনি পৃথিবীতে টিকে থাকার মূলনীতি তুলে ধরেন। বলেন

এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা হক ও বাতিলের উপমা দিয়েছেন। হক হল যা মানুষের কল্যাণে আসে। তাই তা পৃথিবীতে টিকে থাকে। বাতিল হল ফেনার মতো। সমুদ্রের ফেনা, বৃষ্টির ফেনা কিছুক্ষণ পর শেষ হয়ে যায়। তদ্রƒপ লোহা বা স্বর্ণের আংটির ওপর যে জং পড়ে, আগুনে দেওয়ার পর সেটা চলে যায়। তো আল্লাহ বলেন

فَاَمَّا الزَّبَدُ فَیَذْهَبُ جُفَآءً   وَ اَمَّا مَا یَنْفَعُ النَّاسَ فَیَمْكُثُ فِی الْاَرْضِ .

এ এক মূলনীতি। মানুষকে যা উপকৃত করে সেটা টিকে থাকে আর অনুপোকারী ও অকার্যকর জিনিস ভেসে যায় এবং তার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। হক মানুষের পার্থিব জীবনের জন্যও উপকারী, পরকালের জন্যও উপকারী। বাতিল দুনিয়ার জন্য কখনো বাহ্যত ক্ষতিকর নাও মনে হতে পারে, কিন্তু আখেরাতের জন্য অবশ্যই ক্ষতিকর।

এই আয়াত থেকে আমরা মূলনীতি পেয়ে যাই। মানুষকে যা উপকার করে, তা পৃথিবীতে টিকে থাকে। সায়্যেদ আবুল হাসান আলী মিঁয়া নদভী রাহ. এখান থেকে বলেছেন, টিকে থাকার শর্ত ও মাপকাঠি আসলাহিয়্যাত বা অধিক উপযোগিতা নয়; টিকে থাকার শর্ত ও মাপকাঠি আনফাইয়্যাত ও অধিক উপকারিতা। যোগ্য হলেই টিকে থাকবে, জরুরি নয়। আমরা অনেক যোগ্যকে দেখেছি, অনেক যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে দেখেছি, তারা পৃথিবীতে টিকে থাকেনি বা কোনো কাজ করতে পারেনি। যারা মানুষকে উপকার করেছে, যার দ্বারা মানুষের উপকার হয়েছে, তারা টিকে ছিল। এজন্য দাঈ হিসেবে নিজেকে কওমের নিকট নাফে ও উপকারী প্রমাণিত করতে হবে। যাকে দাওয়াত দিচ্ছি, তার কাছে নিজেকে তার উপকারী ও কল্যাণকামী প্রমাণ করতে হবে। আমি তার বিরোধী নই, বরং শুভাকাঙ্খী বিষয়টা যখন তার কাছে স্পষ্ট হবে, তখনই আমার কথা ও কাজ তার মধ্যে প্রভাব বিস্তার করবে।

হাঁ, হযরাতুল উস্তায আবুল বাশার ছাহেব হুজুর যেটা বললেন, যোগ্যতাও দরকার। যোগ্যতা না থাকলে সেই বিষয়ে কথা বলব কীভাবে? কিন্তু যোগ্যতার সঙ্গে সঙ্গে তার চেয়ে বেশি দরকার হল নিজেকে নাফে ও তার শুভানুধ্যায়ী প্রমাণ করা।

এরপর তিনি ইনাবাত ইলাল্লাহ ও তাওয়াক্কুল আলাল্লাহর প্রতি বিশেষভাব গুরুত্বারোপ করেন। বলেন

দাওয়াত ইলাল্লাহ যেহেতু নবুওতের মূল অংশ, কাজেই নববী খাসলত আমাদের মধ্যে ধারণ করা উচিত।

অতএব

یٰۤاَیُّهَا الْمُدَّثِّرُ، قُمْ فَاَنْذِرْ.

(হে বস্ত্রাবৃত! ওঠ এবং মানুষকে সতর্ক কর।)

এর সাথে

یٰۤاَیُّهَا الْمُزَّمِّلُ، قُمِ الَّیْلَ.

[হে চাদরাবৃত! রাতে (ইবাদতের জন্য) দাঁড়িয়ে যাও]

-ও থাকা উচিত। আল্লাহর কাছে রোনাযারি, ইনাবাত ইলাল্লাহ, তাওয়াক্কুল আলাল্লাহ, এই বিষয়গুলোও থাকা চাই। কেবল নিজের যোগ্যতা দিয়ে দাওয়াত দিয়ে কাউকে বুঝিয়ে ফেলব, কুপোকাত করে ফেলব, এমন ধারণা ঠিক নয়। কারণ এটা যথেষ্ট নয়। মানুষের হৃদয়কে জয় করার জন্য কেবল আপনার সুন্দর ভাষা আর জোরালো উপস্থাপন যথেষ্ট নয়। হৃদয়কে আকৃষ্ট করার জন্য হৃদয়ের দরকার। সেই আকর্ষণ তো আল্লাহ্ই সৃষ্টি করেন। কাজেই দাওয়াতের ক্ষেত্রে নিজের যোগ্যতার ওপর যতটা না ভরসা করব, তার চেয়ে বেশি ভরসা করতে হবে আল্লাহ তাআলার রহমতের ওপর। এর জন্য আল্লাহর কাছে দুআও করতে হবে। সত্য কথা হল, কেবল দাওয়াত নয়, রোনাযারি ও ইনাবাত ইলাল্লাহ ছাড়া জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই সফলতা লাভ করা সম্ভব নয়।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে ইনাবাত ইলাল্লাহ ও তাওয়াক্কুল আলাল্লাহ্র গুণ অর্জন করার তাওফীক দান করুন। আমরা যেন নাফে হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে পারি, সেই তাওফীক যেন আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দান করেন আমীন।

এরপর মাওলানা নাজমুদ্দীন ছাহেব  কিছু ভাবনা ও প্রস্তাবনা পেশ করেন। তিনি বলেন

আমি মনে করি, দ্বীনদার মুসলিম সমাজের কাছে, বিশেষত আহলে ইলমের কাছে দাঈদের সম্মানজনক অবস্থান ও মর্যাদা থাকা দরকার। যদি আমরা আলেমদের ও দ্বীনদার মুসলিম সমাজের কাছে দাঈদের সম্মানজনক অবস্থান ও মর্যাদা ফুটিয়ে তুলতে না পারি, তাহলে দেখা যাবে...।

যাদের মধ্যে আমরা দাওয়াতের কাজ করতে যাই, তাদের থেকে তো আমরা কিছুই প্রত্যাশা করি না। লা-আসআলুকুম আলাইহি আজরা’— বিনিময়ও আমরা চাই না, প্রশংসাও চাই না। কিন্তু আমাদের নিজেদের ঘরানাতেও যদি দাঈদের সেভাবে সম্মান দেওয়া না হয়, তাহলে অনেক সময় দাঈরা হিম্মত হারিয়ে ফেলতে পারেন। এজন্য আমরা মনে করি, দাঈদের সম্মানজনক অবস্থান ও মর্যাদা আহলে ইলমদের মধ্যে আরো বেশি চর্চা হওয়া দরকার।

তেমনি দাঈদের প্রয়োজন পূরণের সংকটও থাকে। কাজের জন্য পূর্ণ ফারেগ দাঈ যারা, তাদের প্রয়োজন পূরণে এক ধরনের সংকট অনেক সময় থেকে যায়। ফলে দাঈ হয়তো পূর্ণ ফারেগ হতে আগ্রহী, কিন্তু তাকে পূর্ণ ফারেগ করা বা তার জরুরত পূরণ করা সম্ভব না হওয়ার কারণে অনেক ক্ষেত্রে দাঈ নিয়োগ করা বা তাদের প্রয়োজনীয় স্থানে পাঠানো কখনো কখনো সম্ভব হয়ে ওঠে না।

তিনি বলেন আজ যেমন মারকাযুদ দাওয়াহর মুরব্বীগণ আমাদেরকে এখানে আসার সুযোগ করে দিয়েছেন, এরকম আকাবির উলামায়ে কেরামের পক্ষ থেকে যদি মাঝেমধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা যোগানো হয়, কেবল মারকাযুদ দাওয়াহ নয়, বরং আরো অন্যান্য যেসব মুরব্বীয়ানে কেরাম রয়েছেন, তাদের পক্ষ থেকেও যদি আমাদের ছোটদের একটু উৎসাহিত করা হয়, তাহলে আমার মনে হয়, দাঈদের হিম্মত বেড়ে যাবে। তাদের কাজের গতিও অনেক বেড়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। 

এরপর তিনি কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরেন

প্রচলিত বাতিল ফিরকাগুলো সম্পর্কে আরো বেশি সুবিন্যস্ত ও তথ্যভিত্তিক বই-পুস্তক সামনে আসা দরকার।

যারা মাঠ পর্যায়ে দাওয়াতের কাজ করেন, তারা যাতে আকাবির উলামার কাছে তাদের কারগুযারি, সাথে সাথে দাওয়াতের ময়দানে তারা যে সমস্যাগুলো অনুভব করেন, সেগুলোর একটা সমাধান পেতে পারেন। এর জন্য সুনির্দিষ্ট একটা সুযোগ করে দেওয়া।

সবশেষে দাঈর কিছু গুণ এবং দাওয়াত সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শিরোনামে হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ছাহেব দা. বা.-এর নিবন্ধটি পড়ে শোনান মাওলানা মাহমুদ বিন ইমরান।

শুরুতেই প্রবন্ধকার মানসাবে দাওয়াত-এর নাজুকতা শিরোনামে বলেন

সামনে যাওয়ার আগে একথা আমাদের সবার মনে জাগরূক করে নেওয়া সঙ্গত হবে যে, মানসাবে দাওয়াত তথা দাওয়াতের মহান দায়িত্ব অত্যন্ত নাজুক ও স্পর্শকাতর। কারণ, দাওয়াতের মাকাম মূলত ইসলামের তরজুমানী এবং শরীয়তের প্রতিনিধিত্বের মাকাম। দ্বীনে হকের নিসবতে যখন কেউ দাওয়াতের কাজ করে তখন মানুষ তাকে দাঈয়ে ইসলাম এবং দাঈ ইলাল্লাহ মনে করে। এই মানসাবের প্রতি লক্ষ করে এমনটি মনে করা যথেষ্টই যুক্তিযুক্ত। তাই দাঈর জন্য নিজের মানসাবের লাজ রক্ষা করা খুব জরুরি।

দ্বিতীয় কথা, দাওয়াতের অধিক গুরুত্বপূর্ণ একটি মাকসাদ হল, যাকে দাওয়াত দেওয়া হয় সে যেন দাওয়াত কবুল করে হেদায়েতের পথে চলে আসে। আর এটা তখনই হবে, যখন দাঈর ওপর তার আস্থা হবে এবং তার কাছে দাঈর ব্যাপারে যৌক্তিক কোনো আপত্তি না থাকবে। এই দৃষ্টিকোণ থেকেও যদি দেখা হয় তাহলেও দাঈর মাঝে সেই গুণাবলি পাওয়া যাওয়া জরুরি, যার মাধ্যমে তার প্রতি মানুষের আস্থা ও নির্ভরযোগ্যতা তৈরি হয়।

কুরআন-সুন্নাহ ও ইসলামী শরীয়তে দাঈর গুণাবলি এবং দাওয়াতের উসূল ও নীতিমালা সম্পর্কে যে গুরুত্বারোপ ও তাকিদ আমরা দেখতে পাই তার পেছনের আসল রহস্যও উক্ত দুই বিষয়।

এ বিষয়টি নিয়ে যদি গভীরভাবে চিন্তা করা হয় তাহলে মানসাবে দাওয়াতের নাজুকতা ও স্পর্শকাতরতা এবং তার গুরুভার হওয়ার বিষয়টি স্পষ্টভাবে বোঝা যাবে।

প্রবন্ধটিতে যেসব বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আকারে আলোচনা করা হয় এর মৌলিক শিরোনামগুলো পাঠকের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে।

দাঈর কিছু গুণ : 

১. অটল ও অবিচল ঈমান।

২. আহলুস সুন্নাহ ওয়াল-জামাআতের মাসলাকের ওপর ইস্তেকামাত।

৩. ইলম, ফিকহ, বাসীরত, ফাতানাত।

৪. কথা ও কাজের মিল।

৫.  قَوْلاً ليِّناً   (নরম বচন)।

৬.  دَفْعُ السَّيِّئَةِ بِالْحَسَنَةِ

৭. আল্লাহর বান্দাদের প্রতি মায়া ও সহমর্মিতা।

৮. মুসলিমদের হক এবং সংশ্লিষ্ট লোকদের হক আদায় করা।

৯. উত্তম আচরণ ও খেদমতে খালক।

১০. তাওয়াক্কুল এবং যুহ্দ ও ইসতেগনা।

১১.   সবর ও ইস্তেকামাত

 وَ تَوَاصَوۡا بِالۡحَقِّ ، وَ تَوَاصَوۡا بِالصَّبۡرِ.                  

১২. ইখলাস ও ইহতেসাব।

১৩. ইত্তেবায়ে সুন্নাত।

১৪. সিদ্ক ও আমানত।

১৫. তাওয়াযূ ও তাকওয়া।

১৬. লেনদেনে স্বচ্ছতার বিষয়ে গুরুত্বারোপ।

১৭.   ইসলামী আদব এবং সুন্দর আচার-আচরণের ইহতেমাম।

১৮. পাক-পবিত্রতা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, গোছালো ও পরিপাটি থাকা এবং সময়ানুবর্তিতা।

১৯. ধীরতা, স্থিরতা ও স্থৈর্য।

২০. উসূল ও নিয়মনীতির হেফাজত করা এবং উসূলের ওপর অবিচল থাকা।

প্রবন্ধটিতে দাওয়াত সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শিরোনামের অধীনে বলা হয়েছে :

১.   ইলমী প্রস্তুতি।

২.   নিজেকে প্রস্তুত করা।

৩.   নিজের মামুলাতের জন্য সময় বের করা।

৪.   শূন্যতা পূরণের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া।

৫.   (لا يعني) অনর্থক বিষয় থেকে দূরে থাকা।

৬.   ایک گىر محکم گىر   (একটি ধরুন, কিন্তু মজবুত করে ধরুন)।

৭.   ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির দ্বীনী খেদমতের মাঝে খলত না করা।

৮.   ولا تقف ما ليس لك به علم   

৯.   শোকর কাম্য, উজব নিন্দিত।

১০. মেহনত হবে কিন্তু নিরাশা নয়।

১১. স্থানীয় আলেমদের সঙ্গে পরামর্শ করা, তাদের আস্থা অর্জন করা।

১২.     বড়দের সঙ্গে জুড়ে থাকা।

১৩.     যেহনী ইনতেশার এবং ফিকরী ইনতেশার থেকে বেঁচে থাকা।

১৪.     প্রকাশ ও প্রচার থেকে দূরে থাকা।

১৫.     সবার জন্য দাওয়াতের একই শৈলী অবলম্বন করা মুনাসিব নয়।

১৬.     পরস্পর প্রীতি-মহব্বত ও সহযোগিতার মানসিকতা থাকা।

১৭. উলূ ও গুলূ থেকে বেঁচে থাকা।

১৮.     সুওয়াল থেকে বেঁচে থাকা জরুরি।

১৯.     নিজের হেফাজতের জন্য নিয়মিত দুআ ও যিকির পাঠ।

২০. নিজেকে নয়, বরং দ্বীনকে নিজের প্রতি মুহসিন মনে করুন।

২১.     দাওয়াতের ময়দান অনেক প্রশস্ত।

২২.     দাওয়াত, তালীম ও খেদমতে খালক পরস্পর যুক্ত।

সবশেষে দাওয়াতের উসূল ও আদাব সম্পর্কে নমুনাস্বরূপ কিছু কিতাব শিরোনামে দাওয়াতের উসূল ও আদাব সংক্রান্ত কিছু কিতাবের নাম উল্লেখ করে প্রবন্ধটি শেষ করা হয়।

দিনব্যাপী এই মজলিসের মাধ্যমে দাঈগণ অনেক উপকৃত হন বলে মন্তব্য করেছেন অনেকে। বড়দের গুরুত্বপূর্ণ হেদায়েত ও নির্দেশনার  মাধ্যমে তারা কাজকে আরো এগিয়ে নেওয়ার প্রেরণা লাভ করেন। দাঈদের মাঝে পরস্পর সহযোগিতা, যোগাযোগ ও মতবিনিময়ের একটি সুন্দর নমুনা কায়েম হয়।

আল্লাহ তাআলা এই মজলিসকে কবুল করুন। দাঈদের হিম্মত আরো বাড়িয়ে দিন। মুরব্বীদের তত্ত্বাবধানে দাওয়াতের কাজকে আরো সুন্দর, সুকৃঙ্খল আকারে এগিয়ে নেওয়ার তাওফীক দান করুন আমীন। 

 

 

advertisement