শাওয়াল ১৪৪৪   ||   মে ২০২৩

মাওলানা মুমতাজুল করীম বাবা হুযুর রাহ.
একজন সাহসী ও নিঃস্বার্থ মুরব্বীর বিদায়

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ

৫ রমযান ১৪৪৪ হিজরী (৪ রমযান দিবাগত রাত) মোতাবেক ২৮ মার্চ ২০২৩ (সোমবার দিবাগত) রাত ১ টা ২০ মিনিটে হাটহাজারী মাদরাসার অন্যতম প্রবীণ উস্তায মাওলানা মুমতাজুল করীম বাবা হুযুর ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মঙ্গলবার বাদ আসর হাটহাজারী মাদরাসা মাঠে তাঁর জানাযা নামায অনুষ্ঠিত হয়।

বাবা হুযুরকে কাছ থেকে দেখা হয়েছে করাচীতে। এর আগে হাটহাজারীতেও দেখা হয়েছে। আমার ওয়ালেদ ছাহেবের সঙ্গেও তাঁর পরিচয় ছিল। সে হিসেবে আমাদের দুই ভাইয়ের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম স্নেহ ছিল। তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার শুরু করাচীতে। হাটহাজারী মাদরাসার কাজে তিনি রমযানে করাচী যেতেন। আরও বিভিন্ন মাদরাসার শিক্ষকরাও যেতেন। কারও সঙ্গে তুলনা না করেই বলি, সেখানে আমরা তাঁকে অনেক ব্যতিক্রম পেয়েছি। তাঁকে দেখেছি মাদরাসার জন্য নিবেদিতপ্রাণ। মাদরাসার খরচের বেলায় খুবই মিতব্যয়ী। সে যুগেই করাচীতে ভাড়ায় ট্যাক্সি পাওয়া যেত। অটোরিক্সা তো ছিলই। কিন্তু তিনি বাসে চলাফেরা করতেন। বাস থেকে নেমে মাদরাসার কাজ হেঁটে হেঁটেই করতেন; যাতে মাদরাসার কয়টা টাকা বাঁচে।

একদিন ঘটনাক্রমে আমাকে বললেন, তুমি যাবে আমার সঙ্গে?

ভাবলাম, কোথাও তো তেমন যাওয়া হয় না; যাই হুযুরের সঙ্গে ঘুরে আসি।

হুযুরের সঙ্গে গেলাম। তিনি বাস থেকে নেমে হেঁটে এই শপিংমলে যান, ওই শপিংমলে যান। করাচীতে তো তীব্র গরম। সেইসঙ্গে গ্রীষ্মকালের রোযা। একপর্যায়ে যখন আমার অবস্থা কাহিল, তখন বললাম, একটা রিক্সাও নিচ্ছেন না, ট্যাক্সিও নিচ্ছেন না; আমি আর হাঁটতে পারছি না।

হুযুর বললেন, হাঁটো, আরেকটু হাঁটো!

বললাম, আমার তো রোযায় কষ্ট হচ্ছে। পিপাসা পেয়েছে।

হুযুর বললেন, বুঝেছি বুঝেছি, তোমাকে দিয়ে হবে না। এগুলো মাদরাসার টাকা। মাদরাসার খরচ বাড়ানো যাবে না।

তাঁর প্রতি আমার যে এক ধরনের ভক্তি ও বিশ্বাস তৈরি হয়েছে তা বেশভূষা, মুখের বুলি দিয়ে তৈরি হয়নি।

ইখলাস ও লিল্লাহিয়াত বেশভূষা ও বুলির বিষয় নয়, এগুলো অন্তরের বিষয়। বাইরের খোলস দিয়ে এসব বুঝে আসে না। অথচ সমাজের প্রবণতা হল হৈচৈ ও খোলস দেখে মূল্যায়ন করা। আমার তখন থেকেই মনে হয়েছে, এ মানুষটি অসাধারণ।

যাইহোক, এভাবে প্রতি রমযানেই করাচীতে তাঁকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হত। আমরা বাঙালীরা আলাদা রান্না করে খেতাম। এদেশ থেকে যাঁরা মাদরাসার কাজে যেতেন তাঁরা আমাদের সাথেই খেতেন। তাঁরা কিছু খরচও দিয়ে দিতেন।

করাচী থেকে ফেরার পর আমি বেশ কয়েক বছর বিভিন্ন মাদরাসায় পড়িয়েছি। ১৯৯৬ সালে বেশ ছোট্ট পরিসরে ভাড়া বাসায় মারকাযুদ দাওয়াহ শুরু হয়। আমাদের শুরুটা তো ছিল খুবই অনাড়ম্বর। সবাইকে দাওয়াতও দেওয়া হয়নি। দুয়েকজন মুরব্বী এসেছিলেন। বাবা হুযুরকেও বলা হয়নি।

তিনি একদিন এসে উপস্থিত হলেন। খোঁজ-খবর নিলেন। জানতে পারলেন, এদের তো কোনো আয়োজন নেই। অল্প কিছু কিতাব আর দুয়েকজন লোক একত্রিত হয়ে শুরু করে দিয়েছে। এদের না খাবারের কোনো তহবিল আছে, না এরা কোনো চান্দা করে, না চান্দা করতে জানে। কোনো ব্যবস্থাই এদের নেই।

তিনি খুব উৎসাহ দিলেন। সাহস যোগালেন। এ কাজের প্রয়োজনীয়তাও বললেন। সামান্য কিছু অর্থও দিলেন চাল-ডাল কেনার জন্য। পরিমাণটা এখন মনে নেই।

সেই থেকে শুরু। এরপর ঢাকা এলেই তিনি মারকাযে আসতেন। তখন তাঁর বাসাও ঢাকায় ছিল। সেই সুবাদে ঢাকায় ঘন ঘনই আসা হত। এরপর নিজস্ব ভবন না থাকায় মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা বিভিন্ন স্থানে স্থানান্তর হয়েছে বারবার। কিন্তু যেখানেই মারকায যেত তিনি সেখানেই উপস্থিত হয়ে যেতেন। যখনই আসতেন কিছু না কিছু অর্থ দিয়েই যেতেন। পরের মাসে আসা হয় কি হয় না তাই বিভিন্ন জনের নামে পরচা লিখে দিতেন দুই হাজার টাকা দেবেন, তিন হাজার টাকা দেবেন। কাগজে বড় করে এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত দস্তখত করতেন। সাধারণত এমন হত যে, তাদের কাছে তিনি টাকা পেতেন।

কাগজ দিয়ে বলতেন, আগামী মাসের এত তারিখে ওখানে পাঠিয়ে দেবেন। তারিখ মতো লোক পাঠালে টাকা দিয়ে দিত।

বলে বোঝানো যাবে না এই দুই, তিন, পাঁচ হাজার টাকা সে সময় কত  গুরুত্বপূর্ণ ও উপকারী ছিল। তখন অনেক সময়ই চাল-ডাল কেনার মতো সামর্থ্যও থাকত না। সেই তিন হাজার টাকাই আমাদের অনেক কাজে দিত। এরচেয়ে বড় যে বিষয় তা হল, নিরঙ্কুশ সমর্থন, সহযোগিতা ও সাহস দেওয়া। অল্প যে কজন মুরব্বী মারকাযুদ দাওয়াহর শুরু থেকে উৎসাহ দিয়ে গেছেন ফারিদাবাদ মাদরাসার শাইখুল হাদীস মুহাদ্দিস মাওলানা আব্দুল হাফীয রাহ., মাওলানা হারুন ইসলামাবাদী রাহ. (মৃত্যু : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০০৩ ঈ.), শাইখুল হাদীস মাওলানা আজীজুল হক রাহ. (মৃত্যু : ৮ আগস্ট ২০১২ ঈ.) প্রমুখ এবং তাদের অন্যতম ব্যক্তিত্ব ছিলেন বাবা হুযুর রাহ.। তবে তিনি কিছু কিছু আর্থিক সহযোগিতাও করে যাচ্ছিলেন।

তিনি মারকাযে আসার অর্থই ছিল ছেলেরা সেদিন ভালো ফল খাবে। যখন যে ফলের মৌসুম থাকত সে ফল কিনে এনে খাওয়াতেন। ছাত্রদের নিয়ে বসতেন। এটা সেটা লেখাতেন। মজা করতেন। তিনি এলে একটা আনন্দের আবহ তৈরি হতো। এমন চলেছে দীর্ঘ দিন।

মারকাযুদ দাওয়াহর মজলিসে শূরা গঠনকালে তাঁর নাম প্রস্তাব করা হলে তিনি সানন্দে সম্মতি জানান। তিনি মজলিসে শূরার বৈঠকগুলোতে নিয়মিত অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি বারবার বলতেন, আপনারা মান ধরে রাখবেন। সাধারণদের মতো হয়ে যাবেন না। বেশি লোক নেবেন না। অল্প লোক নিয়েই থাকবেন। যোগ্য লোক ছাড়া নেবেন না। মান গেলে আপনাদের সব যাবে। এসব কথা তিনি খুব জোরালোভাবে বলতেন। অন্যরাও তাঁকে সমর্থন করেছেন।

মুমতাজুল করীম ছাহেবের সঙ্গে আমাদের একটা সম্পর্ক ছিলই। সেইসঙ্গে মারকাযের সাথে তাঁর নিঃস্বার্থ ব্যতিক্রম মহব্বতের কারণে তাঁর চলে যাওয়া আমাদের জন্য বাড়তি বেদনার কারণ। আমরা দূরে চলে আসার পরও তিনি ঢাকার জ্যাম ঠেলে হযরতপুরে আসতেন।

মারকাযুদ দাওয়াহর যখন খুব আর্থিক সংকট, নিজস্ব জায়গা নেই, ছোট ছোট বাসায় ভাড়া থাকতে হত তখন কোনো কোনো বড় ব্যক্তিত্ব যাঁরা আমাদেরকে স্নেহ করতেন, প্রস্তাবও দিয়েছিলেন মারকায কোনো বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাক; এক্ষেত্রে মারকাযকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া হবে। কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করা হবে না।

এই প্রস্তাবের বাধাদানকারীও ছিলেন। তাঁদের কথা ছিল, কষ্ট করে হলেও মারকায পৃথক থেকেই কাজ করুক। বাধাদানকারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন শাইখুল হদীস আজীজুল হক ছাহেব রাহ. ও মুমতাজুল করীম ছাহেব রাহ.।

এই তো তাঁর সঙ্গে মারকায সংশ্লিষ্ট স্মৃতি। যতদিন মারকাযুদ দাওয়াহ থাকবে ইনশাআল্লাহ ততদিন তাঁর কাছে সদকায়ে জারিয়া পৌঁছতে থাকবে। মারকাযের প্রতি তাঁর যে সুদৃষ্টি, স্নেহ ও ঋণ তার বদলা ইনশাআল্লাহ তিনি পেতে থাকবেন।

ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব হিসেবে অন্যরা ভালো মূল্যায়ন করবেন, যাঁরা সব সময় তাঁর কাছে ছিলেন। আমার দৃষ্টিতে তিনি বাহাদুর ব্যক্তিত্ব ছিলেন। হিম্মতওয়ালা মানুষ ছিলেন এবং স্পষ্টভাষী ছিলেন। যেজন্য তাঁকে অপছন্দ করার মতো লোকও থাকবে। সোজা-সাপ্টা কথা বলে ফেলতেন। কিন্তু তাঁর অন্তর স্বচ্ছ ছিল। বিদ্বেষ বা পরশ্রীকাতরতা যে তাঁর মধ্যে ছিল না সেটা আমরা তাঁর সঙ্গ লাভ করেই বুঝতে পেরেছি। এছাড়া অনেক ভালো গুণাবলি তাঁর মধ্যে ছিল।

একবার হক কথা বলার কারণে তিনি জেলবন্দীও হয়েছিলেন। স্বভাবজাত কারণেই তিনি জেলখানায়ও ছিলেন নিঃশঙ্ক ও নির্ভীক। জেলের বন্দী, কর্মচারী, কর্মকর্তাদের সঙ্গে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। সবাইকে কুরআনের তালীম দেন। জেলখানাকে মাদরাসার মতো মাতিয়ে রাখেন। জেলে তাঁর এমন জনপ্রিয়তা ও নিঃশঙ্কতা দেখে কতৃর্পক্ষ অল্প কিছু দিনের মধ্যেই তাঁকে জামিন দিতে বাধ্য হন।

আল্লাহ তাআলা তাঁকে ভরপুর মাগফিরাত নসীব করুন। জান্নাতের উঁচু মাকাম দান করুন। তাঁর সকল খেদমতকে সদকায়ে জারিয়া হিসেবে কবুল করুন। তাঁর সন্তান-পরিবারকে সবরে জামীল এখতেয়ারের তাওফীক দিন আমীন ইয়া রাব্বাল আলামীন। 

 

 

advertisement