শাওয়াল ১৪৪৪   ||   মে ২০২৩

চিরন্তন কুরআনী ঘোষণা
অবশ্যই সে সফল হয়েছে, যে নফসকে পরিশুদ্ধ করেছে

মাওলানা মুহাম্মাদ তাওহীদুল ইসলাম তায়্যিব

قَدْ اَفْلَحَ مَنْ زَكّٰىهَا وَ قَدْ خَابَ مَنْ دَسّٰىهَا.

অবশ্যই সে সফল হয়েছে, যে নফসকে পরিশুদ্ধ করেছে। আর সে ব্যর্থ হয়েছে, যে তা বিনষ্ট করেছে। সূরা শামস (৯১) : ৯-১০

প্রতিটি মানুষের জীবন ও ব্যক্তিত্বের প্রাথমিক প্রকাশ ঘটে থাকে তার নৈমত্তিক কাজকর্মে। একান্ত আলাপচারিতা, ব্যক্তিগত পর্যায়ে দেওয়া উপদেশ ও পরামর্শ, জনসম্মুখে দেওয়া ভাষণ ও বিবৃতি এবং নিজস্ব জীবনাচার ও বিভিন্ন পর্যায়ে কৃত লেনদেনে একজন মানুষের সাধারণ পরিচয় ফুটে ওঠে। স্পষ্ট হয় তার চিন্তা, রুচি, দৃষ্টিভঙ্গি ও মন মানসিকতা। তবে এর মূলে যে প্রভাব ও ভূমিকা থাকে তার কেন্দ্রবিন্দু হল মানুষের নফস ও কলব, তথা হৃদয় ও অন্তর। সেখানেই মানুষের ভাব ও ভাবনা লালিতপালিত হয়। বোধ ও বিশ্বাসের চর্চা-পরিচর্যা হয়। এককথায় মানুষের বাহ্যিক জীবনের মৌলিক বিষয়গুলো তার একান্ত ভেতর থেকেই পরিচালিত হয়। তাই কুরআন ও হাদীসে মানুষের বাহ্যিক জীবনকে যেমন সুন্দর ও নিয়মসিদ্ধ করার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, অভ্যন্তরীণ অবস্থাকেও পরিশুদ্ধ ও পবিত্র করার প্রতি জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু দেখা যায়, নানা স্তর ও পর্যায়ে মানুষ বাহ্যিক জীবনকে সুন্দর করার চেষ্টা করলেও অভ্যন্তর সুন্দর করার ক্ষেত্রে অনেক অবহেলা করে। এমনকি কথিত সচেতন সমাজের বড় একটি অংশজুড়ে কেবল বাহ্যিক আচরণ-উচ্চারণের সৌন্দর্যকেই প্রধান বিবেচ্য বলে মনে হয়। অথচ সকলের কাছেই স্বীকৃত এবং অনস্বীকার্য বাস্তবতা হল, বাহ্যিক জীবনাচারের সৌন্দর্য কোনোভাবেই প্রকৃত জীবনসৌন্দর্য হতে পারে না। অভ্যন্তরীণ শুদ্ধি ও পরিশুদ্ধি থেকে উৎসারিত আচরণিক সৌন্দর্যই প্রকৃত সৌন্দর্য। কুরআন মাজীদে উল্লেখিত এ বিষয়ক আয়াতগুলো যেমন মুগ্ধ হবার মতো, তেমনি ভাবনা ও ফিকির উদ্রেককারী।

নফসের পরিশুদ্ধি জীবন-সফলতার মানদণ্ড

একজন মানুষের দুনিয়াবী জীবনের কীর্তি ও সৌন্দর্য এবং পরকালীন জীবনের স্থায়ী সফলতা অর্জনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা থাকে তার নফসের। নফসের শুদ্ধতা ও অশুদ্ধতা, নির্মলতা ও কলুষতা এবং পবিত্রতা ও অপবিত্রতা প্রতিনিয়তই প্রকাশ পেতে থাকে তার প্রতিটি পদক্ষেপে। জীবনের এ পদক্ষেপগুলোই মানুষকে দাঁড় করিয়ে দেয় হয়ত সফলতার উচ্চ শিখরে কিংবা ব্যর্থতার গভীর গিরিখাদে। তাই কুরআন মাজীদ খুব পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে এ নিগূঢ় রহস্য। ইরশাদ করেছে

قَدْ اَفْلَحَ مَنْ زَكّٰىهَا وَ قَدْ خَابَ مَنْ دَسّٰىهَا.

অবশ্যই সে সফল হয়েছে, যে নফসকে পরিশুদ্ধ করেছে। আর সে ব্যর্থ হয়েছে, যে তা বিনষ্ট করেছে। সূরা শামস (৯১) : ৯-১০

নফসকে পরিশুদ্ধ করার অর্থ হল, সব ধরনের পাপাচার ও কলুষতা থেকে মুক্ত করা। পাপচিন্তা, পাপ-ইচ্ছা ও পাপাচারী মানসিকতা থেকে রক্ষা করা। প্রবৃত্তি ও রিপুশক্তির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। মনের সকল চাহিদা ও ইচ্ছাকে আকল ও বিবেকের অনুগামী করা। এরপর আকল ও বিবেককে আল্লাহ তাআলার হুকুম ও বিধানের অনুগত করা।

নফসকে বিনষ্ট করার অর্থ হল, বিভিন্ন প্রকারের গোনাহ ও মন্দকাজে লিপ্ত হয়ে নিজের চিন্তা, কর্ম ও মন-মানসিকতাকে পাপাচ্ছন্ন করে ফেলা। মনের সকল ইচ্ছা ও চাহিদাকে অনুসরণ করে করে প্রবৃত্তি-রিপুকে শক্তিশালী করা এবং আকল ও বিবেককে রিপুর অনুগামী করা। এভাবে আল্লাহর হুকুম ও বিধান থেকে সরে গিয়ে নিজের কামনা ও বাসনার অনুগত হওয়া। (দ্র. তাফসীরে ইবনে কাসীর ৪/৮১৬; রূহুল মাআনী ১৫/১৬৫; তাফসীরে উসমানী, পৃষ্ঠা ৭৯৩

অন্তরের রোগ ও তার একটি প্রকাশ

বিভিন্ন কারণে আমাদের দেহে যেমন রোগ-জীবাণু বাসা বাঁধে, তেমনি আমাদের অন্তরেও নানা প্রকারের রোগ ও ব্যাধি তৈরি হয়। সেজন্য আমাদের অন্তরকে পরিশুদ্ধ ও পবিত্র করার ক্ষেত্রে প্রথম কাজ হল, সব ধরনের রোগ-ব্যাধি থেকে তাকে মুক্ত করা।

কুরআন মাজীদে অন্তরের রোগ ও তার ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে উল্লেখিত একটি আয়াত সব সময় স্মরণ রাখার মতো। সেখানে নবীপত্মীদেরকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ তাআলা বলেছেন

اِنِ اتَّقَيْتُنَّ فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَيَطْمَعَ الَّذِيْ فِيْ قَلْبِهٖ مَرَضٌ...

যদি তোমরা তাকওয়া অবলম্বনকারী হয়ে থাক, তবে (পর-পুরুষের সাথে) কোমল কণ্ঠে কথা বলো না। অন্যথায় যার অন্তরে রোগ আছে সে লালসায় পড়বে। সূরা আহযাব (৩৩) : ৩২

এখানে নারী কণ্ঠের কোমলতায় লালসার শিকার হওয়া থেকে সতর্ক করতে গিয়ে বলা হয়েছে, তাতে এমন ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যার অন্তরে রোগ আছে।

এখানে রুগ্ন অন্তরের কেবল একটি প্রকাশ তুলে ধরা হয়েছে। বাস্তবে এমন অন্তরের মানুষ নানাক্ষেত্রে নানান রকম গোনাহ ও পেরেশানীর শিকার হয়ে থাকে। জীবনের নানা ক্ষেত্রে তাদের কষ্ট ও দুর্ভোগ মনোজগতের অস্থিরতা কেবল বৃদ্ধিই করতে থাকে। ফলে জীবন ও জগৎ দুর্বিসহ হয়ে ওঠে। পঙ্কিলতায় ছেয়ে যায় সকল ভাব ও ভাবনা।

অন্তরের রোগ বৃদ্ধি পায় কীভাবে?

অন্তরের এজাতীয় রোগ ও ব্যাধি কীভাবে বৃদ্ধি পায় সে বিষয়ে পরিষ্কারভাবে আলোচনা করা হয়েছে একটি হাদীসে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন

বান্দা যখন কোনো গোনাহ করে তার অন্তরে একটি কালো দাগ পড়ে। এরপর যখন সে গোনাহ থেকে নিবৃত্ত হয়, ক্ষমা চায় এবং তাওবা করে তখন তার অন্তর পরিষ্কার করে দেওয়া হয়। নতুবা পুনরায় গোনাহ করতে থাকলে সেই কালো দাগ আরও বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে পুরো  অন্তর (কালো দাগে) ছেয়ে যায়। সেটাকেই আল্লাহ তাআলা মরিচা বলে উল্লেখ করেছেন

كَلَّا بَلْ رَانَ عَلٰي قُلُوْبِهِمْ مَّا كَانُوْا يَكْسِبُوْنَ .

বরং তাদের কৃতকর্ম তাদের অন্তরে মরিচা ধরিয়ে দিয়েছে। [সূরা মুতাফফিফীন (৮৩) : ১৪] জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৩৩৪

মরিচার আস্তর জমে লৌহধাতু যেমন তার স্বাভাবিকতা, স্বচ্ছতা, সৌন্দর্য ও কার্যক্ষমতা হারাতে থাকে, মানব হৃদয়ও তেমনি হারাতে থাকে তার স্বভাব শক্তি। ফলে জীবনের বিশুদ্ধতা বিনষ্ট হতে থাকে, স্বাভাবিক-শুদ্ধ পথে চলা মন্থর হতে থাকে, হ্রাস পেতে থাকে পাপ প্রতিরোধের কুদরতী ক্ষমতা। আর তখনই মানুষ তার মানবমর্যাদা থেকে নিচে নামতে শুরু করে। সম্ভাবনার সকল দুয়ার থেকে দূরে সরতে থাকে। জীবন পর্যবসিত হয় গ্লানিমাখা ব্যর্থতায়।

এ করুণ বাস্তবতা মানব সমাজে কম তো নয়।

অন্তরের সুস্থতা-অসুস্থতা দেহেও প্রভাব ফেলে

বাস্তবেই, অন্তরজগতের অসুস্থতা শারীরিক অসুস্থতা থেকে মোটেও কম কিছু নয়। বরং অন্তরের অসুস্থতা অনেকক্ষেত্রে দেহের অসুস্থতা থেকেও বেশি ক্ষতিকর। কারণ, তাতে আখেরাতের ক্ষতি তো আছেই, দুনিয়াতেও আছে ঘৃণা, লাঞ্ছনা, বঞ্চনাসহ বহুবিধ ক্ষতি ও পেরেশানী। উপরন্তু অন্তরের অসুস্থতা মানবদেহকেও নানাভাবে অসুস্থ করে তোলে। দেহের সুস্থতার ক্ষেত্রে অন্তরের সুস্থতাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সেকথাও উল্লেখিত হয়েছে একটি হাদীসে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন

أَلاَ وَإِنَّ فِي الجَسَدِ مُضْغَةً: إِذَا صَلَحَتْ صَلَحَ الجَسَدُ كُلُّهُ، وَإِذَا فَسَدَتْ فَسَدَ الجَسَدُ كُلُّهُ، أَلاَ وَهِيَ القَلْبُ.

জেনে রাখ, নিশ্চয় দেহে একটি পিণ্ড আছে। সেটি যখন ঠিক হয়ে যায়, পুরো দেহ ঠিক হয়ে যায়। আর যখন সেটি নষ্ট হয়ে যায়, পুরো দেহই নষ্ট হয়ে যায়। জেনে রাখ, সেই পিণ্ডটি হল কলব। সহীহ বুখারী, হাদীস ৫২; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৫৯৯

রুগ্ন অন্তরের অবস্থা

রুগ্ন দেহের মতো রুগ্ন অন্তরও এক সময় তার স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তাতে পঁচন ধরে। দুর্গন্ধ ছড়ায়। পাশের মানুষজন সেই গন্ধ অনুভব করে। কষ্ট পায়।

দেহের বড় একটি রোগ যেমন ক্যান্সার, অন্তরেরও ক্যান্সারতুল্য রোগ হল অহংকার ও হিংসা।

ক্যান্সারাক্রান্ত রোগীর যন্ত্রণা বর্ণনাতীত। দেহের ক্যান্সার দৃশ্যমান বলে তা মেশিনে ধরা পড়ে। অন্তরের ক্যান্সার অদৃশ্য বলে কোনো যন্ত্রে ধরা পড়ে না। তবে যন্ত্রণা অনভূত হয় দুটোরই এবং সকল কাজ-কর্মেই সে রোগের ছাপ থাকে।

এমনিভাবে অন্তরের অন্যান্য ব্যাধিগুলোর মধ্যে আছে লোভ, ক্ষোভ, কার্পণ্য, রিয়া বা লোকদেখানো মনোভাব, আত্মমুগ্ধতা, কুধারণা ও পরনিন্দা ইত্যাদি। এগুলো ছাড়াও ছোট-বড় আরো অনেক রোগ রয়েছে।

আমাদের উচিত অন্তরের রোগ-ব্যাধি সম্পর্কে সচেতন হওয়া। এর চিকিৎসা করা। হৃদয় ও অন্তরকে পবিত্র করা এবং সুস্থ, স্বাভাবিক ও প্রশান্তির জীবন যাপন করা।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে তাওফীক দান করুন আমীন। 

 

 

advertisement