জুমাদাল আখিরাহ ১৪২৮   ||   জুলাই ২০০৭

একে মন্দ ব্যবহার বলে

হামীদুল্লাহ

কয়েকদিন আগের ঘটনা। সকালে নাস্তা করার উদ্দেশ্যে মোটামুটি অভিজাত একটি হোটেলে ঢুকেছিলাম। পরিবেশ পরিচ্ছন্ন ছিল, খাবার-দাবারও রুচিসম্মত ছিল, কিন্তু তারপরও ঠিকমতো খাওয়া গেল না। কারণ ইতোমধ্যেই একটি অরুচিকর বিষয় আমার সামনে ঘটে গেছে। যিনি ঘটিয়েছেন তিনি একজন সুবেশী ভদ্রলোক। তিনি হোটেলে ঢুকলেন এবং চেয়ারে বসেই চেঁচিয়ে উঠলেন, এ্যাই! এ টেবিলে কে? হোটেলবয়দের একজন এসে বিনীত কণ্ঠে বলল, জ্বী স্যার আমি।

কে আসছে কে যাচ্ছে খবর রাখতে হয় না? শুধু শুধু মালিকের বেতন খাও, কাজের নামে কিছুই না? এ রকম আরো কিছু কথা ঝাঁঝালো কণ্ঠে তিনি বললেন। বয়টি তার চেহারার দিকে তাকিয়ে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে রইল। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আরেক ধমক। কী আনব বলেন! বিনয়ের সাথে বলল ছেলেটি। উল্টিয়ে রাখা পরিষ্কার একটি গদ্বাসের দিকে ইঙ্গিত করে লোকটি বলল, যা, সাবান দিয়ে ভালো করে ধুয়ে নিয়ে আয়। গ্লাসটি পরিষ্কার করে জ্বী স্যার বলে টেবিলে রাখল ছেলেটি। তিনি গ্লাসটি নাকে লাগিয়ে খুব ভালোভাবে পরখ করে বললেন, গাধা, কী ধুলি? সাবানের গন্ধ লাগে কেন? সাথে সাথে গদ্বাসটি পুনরায় ধুয়ে আনা হল। এবার তিনি বললেন, টেবিল মুছতে হবে না? কাজ পাওনা? সব কিছুই কি বলে দিতে হবে? নির্ধারিত তোয়ালে দ্বারা টেবিল মুছে দেওয়া হল। ভদ্রলোক এবার কিছুটা সুস্থির হলেন এবং বাম হাতে এক গদ্বাস পানি ঢক ঢক করে পান করে বললেন, এ্যাই নাস্তা কী কী আছে? কয়েকটি আইটেমের নাম বলা হল। আর কিছু নেই? না স্যার। কী হোটেলে ঢুকলাম! যা ভালো করে এক কাপ চা নিয়ে আয়।

ছেলেটি যাচ্ছে। এ্যাই ছেলে! না বুঝেই দৌঁড় দিলি কেন? আগে ভালো করে বুঝার চেষ্টা কর, পরে যা। শোন, চা কড়া গরম হবে, দুধ-চিনি বেশি হবে, তাড়াতাড়ি আনতে হবে। বুঝতি তো? এবার যা। লোকটি যখন এ দফাগুলো শুনাচ্ছিল ছেলেটির চোখে তখন অশ্রু ছলছল করছিল। আর মনে মনে হয়তো ভাবছিল, আজ এ কোন দাজ্জালের পাল্লায় পড়লাম। চা উপস্থিত হতেই সেই গর্জন, এত দেরি কেন? সময়ের কি মূল্য নেই? ইত্যাদি। অবলা ছেলেটি নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে কাঁদো কাঁদো অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইল। তার মনে কিছু কষ্ট লেগেছিল? মা-বাবার কিংবা বড় ভাইয়ের কথা কি মনে পড়েছিল? হয়তো পড়েছিল, কিংবা পড়েনি। কিন্তু ওই ভদ্রলোকটির মনে যে তার সন্তানের কথা, ছোট ভাইবোনের কথা মনে পড়েনি তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ছেলেটি মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকাচ্ছিল। হয়তো তার এ দৃষ্টির কোনো অর্থই ছিল না। কিন্তু আমার মনে হল অন্তত বিবেকের দায় এড়ানোর জন্য হলেও লোকটিকে কিছু বলা দরকার। লোকটির এতক্ষণের আচরণদৃষ্টে আরও অনেকের মতো আমার মনেও কিছু ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। তারপরও নিজেকে সংযত রেখে শান্ত কণ্ঠে বললাম, ভাই! এরা গরীবের সন্তান। লেখাপড়ার সুযোগ পায়নি। বয়স কম। বুদ্ধি আরও কম। কিছু ভুল তো হতেই পারে। এদের প্রতি বোধহয় একটু সদয় হওয়া উচিত। আমার কথা কেড়ে নিয়ে তিনি বললেন, এদেরকে শেখাতে হবে না? এ উত্তর শুনে কিছুটা কৌতুকবোধ করলাম। তবে বললাম, শেখানোর পদ্ধতি তো এটা নয়। একটু সুস্থিরভাবে বুঝিয়ে বললে সেও বিষয়টা বুঝতে পারবে, আপনার মহৎ উদ্দেশ্যটাও পূর্ণ হবে। ধমকের চোটে সে যদি দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে যায় তাহলে তো আপনার উদ্দেশ্যটাই ... আমার কথা এখনো শেষ হয়নি। তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন, ‘‘ঠিক আছে, আপনি দয়া করেন ..’’। বিড় বিড় করে বোধহয় আমাকেও কিছু শেখানোর জন্য অনেক কিছু বলতে বলতে হোটেল ত্যাগ করলেন। আমি নাস্তা শেষ করলাম। এরপর ছেলেটিকে কিছু সান্ত¡না দিলাম এবং হোটেলে আগত ব্যক্তিদের সঙ্গে ভালো ব্যবহারের কথা বলে কিছু বখশিশ দিয়ে চলে এলাম। ঘটনাটি কিন্তু আমার স্মৃতির পর্দায় ভাসতে লাগল। মনে পড়তে লাগল এ জাতীয় আরো অনেক ঘটনার কথা। তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই এ প্রশ্নটি আমার মনে জাগ্রত হচ্ছিল যে, এই ভদ্রবেশী লোকগুলো কি সত্যিই মানুষ নয়? তবে কেন মনুষ্যত্বের পরিচয় পাওয়া যায় না এদের আচরণে? যে অসহায় মানুষগুলোকে দেখলেও মানব-হৃদয়ে দয়ার উদ্রেক হওয়ার কথা তাদের প্রতিও এতটুকু মানবতাবোধ জাগে না কেন এদের হৃদয়ে? দুঃখী মানুষের জন্য অনেক কিছু করা সম্ভব না হোক অন্তত দুটো সুন্দর কথা কিংবা একটুখানি সহানুভূতির আচরণ দ্বারাও তো তাদের বঞ্চিত জীবনে আমরা সামান্য শান্তির পরশ বোলাতে পারি। সত্যি কথা এই যে, আল্লাহ যদি তাওফীক না দেন তাহলে সহজ কাজগুলোও আর সহজ থাকে না। তাই আল্লাহর কাছেই কামনা করি, হে আল্লাহ! আপনি আমাদের ভালো হওয়ার তাওফীক দিন।

 

 

advertisement