রবিউল আখির ১৪২৮   ||   মে ২০০৭

মাওলানা আবদুল আযীয রহ.
জীবন ও জীবনদর্শন

মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম ইসলামাবাদী

বাংলাদেশে দ্বীনী ইলমের বিস্তার, আধ্যাত্মিক সাধনা এবং আল্লাহর বান্দাদের কাছে দ্বীন ইসলামের দাওয়াত ও পয়গাম পৌঁছে দিয়ে তাদেরকে আমলী মুসলমান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য যে কয়জন আলেমে দ্বীন অনন্য সাধারণ অবদান রেখেছেন, মুফতী আবদুল আযীয ছাহেব রহ. ছিলেন তাঁদের অন্যতম। ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত তিনি দ্বীনের জন্য নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। আরাম-আয়েশ সুখ এবং নিজের অনেক ব্যক্তিগত প্রয়োজনকে বিসর্জন দিয়ে তিনি দ্বীনী কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। সময়মতো মাদরাসায় চলে যেতেন মাদরাসা খোলার দিন। মাদরাসার দায়িত্বকে একটি বড় আমানতদারী বলে মনে করতেন। আর এ আমানতের খিয়ানত করাকে তিনি সহ্য করতে পারতেন না। মাদরাসার দায়িত্বের ফাঁকে ফাঁকে যখনই সুযোগ পেতেন দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে বের হয়ে পড়তেন। মুফতী আবদুল আযীয রহ. কুমিল্লা সদর দক্ষিণ-এর ভাটিসতলা গ্রামের মিয়াজী বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম মুন্সী মিন্নত আলী রহ.। স্থানীয় মক্তবে পবিত্র কুরআন শরীফ শিক্ষা লাভ করেন। এরপর প্রেমনল (যার বর্তমান নাম হযরত মাওলানা আবদুল আযীয রহ.-এর নামে আযীযনগর) প্রাইমারি স্কুলে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। অতঃপর ভর্তি হন সদর কুমিল্লাস্থ যুক্তিখোলা সিনিয়র ফাজিল মাদরাসায়। সেখানে জমাতে নাহুম (মিযান) পর্যন্ত শিক্ষা লাভ করে নাঙ্গলকোট থানার অন্তর্গত মৌকারা ফাজিল মাদরাসায় ভর্তি হন এবং হাপ্তম (হেদায়াতুন নাহু) পর্যন্ত শিক্ষা লাভ করেন। মৌকারা মাদরাসার প্রিন্সিপাল ছিলেন হযরত মাওলানা ওয়ালী উল্লাহ রহ., যিনি মৌকারার পীর সাহেব নামে পরিচিত ছিলেন। (অতি সম্প্রতি তিনিও ইন্তেকাল করেছেন) পীর সাহেব হলেন হযরত মুফতী সাহেবের বড় ভগ্নিপতি।

ছাত্র জীবনের প্রথম থেকেই তিনি খুবই মেধাবী ও দ্বীনদার ছিলেন। ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞানে উচ্চ শিক্ষা লাভে তাঁর খুব আগ্রহ ছিল। তাই একটি বড় প্রতিষ্ঠানে গিয়ে কুরআন, হাদীস, ফেকাহ ও অন্যান্য ইসলামী বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এভাবে বাংলাদেশের সর্বপ্রাচীন ও বৃহত্তম ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র চট্রগ্রাম হাটহাজারী জামেয়া আহলিয়া দারুল উলূম মঈনুল ইসলাম মাদরাসায় গিয়ে ভর্তি হন। সেখানে জামাতে শশম থেকে ফুনুনাতসহ দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত শিক্ষা লাভ করে অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন ১৩৮১ হিজরী, মোতাবেক ১৯৬১ সনে।

দেশের বিশিষ্ট আলেম, মুহাদ্দিস, মুফতী, আদিব ও আধ্যাত্মিক ব্যক্তিবর্গ তখন হাটহাজারী মাদরাসায় শিক্ষা ও দীক্ষা দানে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি তাঁদের কাছ থেকে শিক্ষা ও দীক্ষা লাভ করেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন- ১. হাটহাজারী মাদরাসার তখনকার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও মুফতীয়ে আযম হযরত মুফতী ফয়জুল্লাহ রহ. ২. আবদুল ওয়াহহাব রহ. ৩. শায়খুল হাদীস হযরত আবদুল কাইউম রহ.। তাঁর কাছে মুফতী আবদুল আযীয রহ. বুখারী শরীফ পড়েন ৪. মুফতীয়ে আযম হযরত মুফতী আহমদুল হক সাহেব। ৫. শায়খুল হাদীস মাওলানা শাহ আবদুল আযীয রহ.। তাঁর কাছ থেকেই মুফতী আবদুল আযীয রহ. খেলাফত লাভ করেন। ৬. শায়খুততাফসীর মাওলানা আবুল হাসান রহ., ৭. শাইখুল আদব মাওলানা নযির আহমদ আনোয়ারী রহ., ৮. হযরত মাওলানা নাদেরুজ্জামান সাহেব রহ., ৯. হযরত মাওলানা মোহাম্মদ আলী রহ., ১০. হযরত আল্লামা মোহাম্মদ হামেদ রহ. ছাত্র জীবনে তিনি এ বুযুর্গ মনীষীর বিশিষ্ট খাদেম ছিলেন। ১১. পীরে কামেল হযরত মাওলানা হাফেজুর রহমান (পীরসাহেব হুজুর) রহ., ১২. হযরত মাওলানা শাহ আহমদ শফী সাহেব, ১৩. হযরত মাওলানা আবদুস সাত্তার শাহ সাহেব, মুফতী আবদুল আযীয রহ. তাঁর কাছে তাফসীরে জালালাইন শরীফ প্রভৃতি কিতাব শিক্ষা লাভ করেন।

১৮ জানুয়ারি ২০০৭, ২৭ যিলহজ্ব ১৪২৮ হিজরী রোজ বৃহস্পতিবার রাত ৮.৩০ মিনিটে মুফতী আবদুল আযীয রহ. তাঁর গ্রামের বাড়িতে ইন্তেকাল করেন। (ইন্নালিল্লাহি...রাজিউন) তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর। তিনি স্ত্রী, ৫ ছেলে ও ৪ মেয়ে রেখে গেছেন। ছেলেদের কেউ এখনো পড়াশোনয় মগ্ন আছে এবং কেউ দ্বীনী খিদমতে নিয়োজিত রয়েছেন। মুফতী আবদুল আযীয রহ. এর ৫ ভাই ও ৫ বোন ছিল। বর্তমানে ৩ ভাই ও ১ বোন জীবিত আছেন। ১৯ জানুয়ারি শুক্রবার দুপুর ১১ টায় তাঁর বিশাল নামাযে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। মরহুমের দ্বিতীয় পুত্র মাওলানা আবদুল আখির নামাযে জানাযার ইমামতী করেন। জানাযার নামাযে ঢাকা, নোয়াখালী, কুমিল্লা ও চাঁদপুরসহ বিভিন্ন এলাকার হাজার হাজার মানুষ অংশগ্রহণ করেন। অতঃপর তাঁকে মাকবারায়ে আযীযীতে দাফন করা হয়। তাঁর নামেই এ নতুন কবরস্থানের নামকরণ করা হয়েছে। এলাকাটির নতুন নাম করা হয়েছে আযীযনগর।

মুফতী আবদুল আযীয রহ. হাটহাজারী মাদরাসা থেকে শিক্ষা সমাপ্ত করে ফেনীর প্রাচীন ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্র শর্শদি দারুল উলূম মাদরাসায় ১৯৬১ সনে শিক্ষকতা শুরু করেন। ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত এ ঐতিহ্যবাহী দ্বীনী প্রতিষ্ঠানের মুহাদ্দিস ও মুফতী হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি এ প্রতিষ্ঠানের শায়খুল হাদীস ও প্রধান মুফতী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ইন্তেকালের আগে যখন শর্শদি মাদরাসায় দ্বিতীয়বারের মতো দাওরায়ে হাদীস খোলা হয় তখন সকলের আশা ছিল তিনি শায়খুল হাদীসের দায়িত্ব পুনরায় গ্রহণ করবেন। দাওরায়ে হাদীসের উদ্বোধনী জলসায় তিনি শরিক ছিলেন। কিন্তু এর পরপরই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং কিছুদিন পরই তিনি ইন্তেকাল করেন।

জীবনের শেষ সময়টুকু আল্লাহর দরবারে হাজির হওয়ার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত ছিলেন। শেষ কয়টি দিনেও লোকদেরকে আল্লাহর পথে আহবান করেছেন। দাওয়াত ও তাবলীগের খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন। শর্শদি দারুল উলূম মাদরাসা এক ঐতিহ্যবাহী দ্বীনী প্রতিষ্ঠান। হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ.-এর বিশিষ্ট খলিফা ওলিয়ে কামেল হযরত মাওলানা নূর বখস রহ. এ দ্বীনী প্রতিষ্ঠানটির মুহতামিম নিযুক্ত হন। বর্তমান মুহতামিম হযরত মাওলানা নূরুল ইসলাম সাহেব। তিনি উলামা বাজার মাদরাসার মুহতামিম হযরত মাওলানা আবদুল হালীম রহ. খলীফা। দারুল উলূম দেওবন্দ-এর ফাযিল মাওলানা নূরুল ইসলাম সাহেব বলেন, মুফতী আবদুল আযীয রহ. অত্যন্ত দক্ষতা, দায়িত্বশীলতা ও নিয়মানুবর্তিতার সাথে সুদীর্ঘকাল শর্শদি মাদরাসার মুহাদ্দিস ও মুফতী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর মতো সুযোগ্য উস্তাদ পাওয়া খুবই কঠিন। ১৯৬১ সন থেকে ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত তিনি কখনো শর্শদি মাদরাসা ছাড়েননি। এটা তাঁর প্রাণপ্রিয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। কুমিল্লার বরুড়া মাদরাসা ও রাজধানী ঢাকার বড় বড় প্রতিষ্ঠানে শায়খুল হাদীস ও মুফতী হিসেবে যোগদান করার জন্য তাঁকে অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু শর্শদি মাদরাসা ছেড়ে আসতে তিনি রাজি হননি। শর্শদি মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা হযরত মাওলানা নূর বখশ রহ. ও প্রাক্তন মুহতামিম হযরত মাওলানা নজীর আহমদ (শহীদ মরহুম)-এর সাথে তাঁর একটি রূহানী সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। যখনই শর্শদি মাদরাসা ছেড়ে চলে যাবার কথা হত শর্শদি মাদরাসার উল্লেখিত দুই বুযুর্গকে তিনি স্বপ্নে দেখতেন। স্বপ্নে তারা বলতেন, আপনি আমাদের ছেড়ে কোথায় যাবেন? এ স্বপ্ন দেখার পর তিনি অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে যাবার আহবান নাকচ করে দিতেন এবং বলতেন, শর্শদি মাদরাসা ছাড়ার ব্যাপারে জীবিত ব্যক্তিদের চেয়ে মৃত ব্যক্তিরাই প্রধান বাধা। এ ব্যাপারে বড় বড় ব্যক্তির প্রস্তাবও তিনি গ্রহণ করেননি। এক জায়গায় সুদীর্ঘ ৪৫-৪৬ বছর শিক্ষকতা করার দ্বারা বিরাট দ্বীনী খেদমত সম্পাদন করতে তিনি সক্ষম হন। তাঁর বহু সংখ্যক শাগরিদ এখন দেশে বিদেশে বহুবিধ দ্বীনি খেদমতে নিয়োজিত রয়েছেন।

মুফতী আবদুল আযীয রহ. দাওয়াত ও তাবলীগের কাজকে তালীমের খেদমতের পর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতেন। গুরুত্বের একটি ঐতিহাসিক কারণ আছে। তা এই যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বপ্নযোগে তাঁকে উৎসাহিত করেছেন দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ করার জন্য।

স্বপ্ন শরীয়তের কোনো দলীল নয় কিন্তু কুরআন হাদীস দ্বারা যে বিষয়টি শরীয়তসম্মত হওয়া প্রমাণিত তার সম্পর্কে যদি কেউ কোনো স্বপ্ন দেখে এবং সে কাজের প্রতি উদ্বুদ্ধ হয় তাতেও কোনো অসুবিধা নেই। আর স্বপ্নের মাধ্যমে কোনো ভালো কাজের হেদায়াত পাওয়া, যার দ্বারা সে কাজের প্রতি আগ্রহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়-তা যে একটি সৌভাগ্য এ ব্যাপারে এতে কোনো সন্দেহ নেই।

মুফতী আবদুল আযীয রহ. হাদীস, তাফসীর, ফেকাহ, আদব, নাহু, সরফ, উসূল, মানতেক প্রত্যেকটি বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন। সহকর্মী শিক্ষকরা যখন কোনো জটিলতার সম্মুখীন হতেন তখন তার শরণাপন্ন হতেন। তিনি কিতাবের জটিল অংশটি খুব সহজভাবে বুঝিয়ে দিতেন। এটা আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ, আল্লাহ যাকে চান দ্বীনের বুঝ দান করেন।

একটি কারামত : তার নিয়ম ছিল বিভিন্ন মসজিদকে টার্গেট করে সেখানে যেতেন তাবলীগী কাজের উদ্দেশ্যে। গাশত করতেন, বয়ান করতেন এবং বুঝিয়ে সুঝিয়ে মানুষকে আল্লাহর রাস্তায় বের করতেন। তিনি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ঘন ঘন স্বপ্নে দেখতেন। মুফতী আবদুল আযীয রহ.-এর জীবন ছিল ইসলামের জন্য নিবেদিত। তাঁর দর্শন ছিল তিলে তিলে জীবনকে আল্লাহর দ্বীনের জন্য উৎসর্গ করে দেওয়া। একমাত্র লক্ষ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ। সকলকে তিনি পবিত্র কুরআন, সুন্নাহ এবং সাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে সালেহীনের আদর্শ ও চিন্তাধারা অনুসরণ করতে বলতেন। আর আল্লাহর কাছেই সব সময় সাহায্য প্রার্থনা করতেন। কুরআন ও হাদীসের বিধান মতো সব সময় আমল করতেন। আকাবিরে দেওবন্দ ও আকাবিরে হাটহাজারীর বাস্তব প্রতিচ্ছবি ছিলেন মুফতী আবদুল আযীয রহ.। আজকের দিনে আমাদের পথ চলার জন্য তার ন্যায় মহৎ ব্যক্তিত্বের জীবন আলোচনা ও তাঁর অনুসরণ জরুরি।

 

 

advertisement